আমরা বড় কদর্য্য সময়ের ভিতর দিয়ে যাচ্ছি। বাংলাদেশ সব সময় এরকম দৃশ্যের ভিতর দিয়ে পরিচালিত হয়েছে। এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে আমাদের রাজনৈতিক প্রজ্ঞাহীনতা। ফলে একাত্তরের পর থেকে বহু ঘটনা রেখাপাত করেছে বাংলা শিল্প-সাহিত্যে। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে মূলত সূচনা হয় বাংলাদেশের দূর্ভাগ্য।
তারপর আরেক কলঙ্কিত অধ্যায়ের সূচনা হয় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান কে হত্যার মাধ্যমে। একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই এ হত্যাকান্ডগুলো হয়। মূলত একাত্তরের পর থেকে বাংলাদেশ কবি শামসুর রাহমানের উদ্ভট উটের পিঠে চড়েই চলছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশে এতো সংকট কাল কেনো? এর কিছু উত্তর আমরা পরিপাশ্ব থেকে তুলে আনতে পারি। প্রথমত স্বাধীনতা বিরোধীরা বাংলাদেশে সমতালে রাজনীতি করে আসছে, দ্বিতীয়ত, যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা দেশের উন্নয়নের তুলনায় নিজের ভাগ্য উন্নয়নে কাজ করেছে।
আর বুদ্ধিজীবিরা সব সময় কোন না কোন দলের লেজুরবৃত্তি করেছে। যদিও বুদ্ধিজীবির সংজ্ঞায় তারা কেউই বুদ্ধিজীবি নয়। কারণ যারা নিজেকে বুদ্ধিজীবি দাবি করে তারা কেউই প্রান্তিক মানুষের কথা বলে না। বাংলাদেশে যারা জীবিত আছেন তাদের মধ্যে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ছাড়া খুব কম চিন্তাশীল মানুষ আছেন যিনি নিজেকে বুদ্ধিজীবি হিসেবে দাবি করতে পারেন। আহমদ শরীফ, সরদার ফজলুর করিম কিংবা হুমায়ূন আজাদের মত দার্শনিক বুদ্ধিজীবি আমাদের দেশে খুব পাওয়া যাবে না।
ফরহাদ মাজহারের মত বণিক শ্রেনী আমাদের দেশে অগুন্তি। ফরহাম মাজহার এক সময় আমাদের আলোচনার মধ্যমণি ছিলেন। কিন্তু নব্বইয়ের শেষ সময় থেকে আমরা দেখতে থাকি তার ভিন্ন চেহারা। তিনি নিজের অবস্থানের বাইরে কিছু কথাবার্তা এবং কর্মকান্ড করতে শুরু করেন। প্রসঙ্গক্রমে একটি ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে।
একবার মানবজমিনে একটি স্বাক্ষাৎকার ছাপা হলো হুমায়ূন আজাদের। সেখানে তিনি নির্মোহভাবে আক্রমণ করলেন ফরহাদ মাজহার এবং আহমদ ছফা কে। মানবজমিনের সাহিত্য সম্পাদক তখন রাজু আলাউদ্দিন। তিনি একদিন সন্ধ্যায় আমাকে ফোন করে ফরহাদ মাজহারের বাসায় যেতে বললেন। আমরা দু’জন প্রায় রাত এগারোটার দিকে বাংলামোটর থেকে যাত্রা করি ফরহাদ মাজহারের আধাবরের বাসায়।
বাসায় গিয়ে দেখি তিনি নেই। আমরা অপেক্ষা করি। তিনি প্রায় রাত বারটার দিকে বাসায় ফিরলেন। আলোচনার এক ফাকে হুমায়ূন আজাদের স্বাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে কথা বলতেই তিনি এবং তার শ্যালক মামুন ক্ষেপে যান। স্বাক্ষাৎকারটি ছাপার জন্য মানবজমিন এবং হুমায়ূন আজাদের বিরুদ্ধে মামালা করারও হুমকি দেন।
পরদিন আমি কি একটা কাজে হুমায়ূন আজাদের বাসায় গিয়েছিলাম। তখন কথা প্রসঙ্গে হুমায়ূন আজাদকে ফরহাদ মাজহারের কথা বলতেই তিনি বলেন, ’দ্যাখো, ফরহাদ হচ্ছে একজন বণিক। তার একটি এনজিও আছে সেটা চালাতে হলে তাকে অনেক পক্ষপাতিত্ব করতে হয়। তাকে তোমরা চিন্তাশীল মানুষ না বলাই ভালো’। শাহবাগের আজিজ সুপার মার্কেটে সন্ধ্যায় আমাদের আড্ডা ছিলো নিয়মিত।
সেখানে দু’তলায় মাঝে মধ্যে যেতাম আহমদ ছফা’র অফিসে। সন্ধ্যায় বেশ ভালো আড্ডা জমাতেন তিনি। সেখানে একদিন সন্ধ্যায় ছফা ভাইয়ের সাথে প্রসঙ্গটি তুলতেই তিনি বলেন, ’শুন হুমায়ূন আজাদ হচ্ছে একটি সজারু, যেদিকে যায় সেদিকে কাঁটা ফুটায়। এ নিয়ে পরে মানবজমিনে আরো অনেক লেখালেখি হয়েছে। আহমদ ছফাকে নিয়ে সেখানে তেমন কোন কটু মন্তব্য হয়নি।
হয়েছে আহমদ মাজহার ও হুমায়ূন আজাদকে নিয়ে। আহমদ মাজহারকে নিয়ে যা মন্তব্য হয়েছে তার সবই ছিলো তার বণিকপনা নিয়ে এবং তার মত পরিবর্তনের আদর্শ নিয়ে। আর হুমায়ূন আজাদ সম্পর্কে যা বলা হয়েছে তার সবই ওনার দাম্ভিকতা নিয়ে। কারণ মানুষটি দাম্ভিক ছিলেন। কেননা তিনি দাম্ভিকতা দেখানোর মত পড়াশুনা জানতেন।
তিনি রাজনীতিকদের সমালোচনা করার সময় রেখে ঢেকে বলতেন না। তাঁর মত কড়া সমালোচক আমি খুব একটা দেখি নি। হুমায়ূন আজাদকে আমি খুব কাছে থেকে দেখেছি। তিনি একজন সত্যবাদি কড়া সমালোচক ছিলেন। তাঁর এ বিশ্বাসটি আমাকে বারবার তার কাছে টেনে নিয়েছে।
তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের একজন সত্যিকারের বন্ধু সমালোচক ছিলেন। তিনি দেশের সমুদয় অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলতেন। তিনি শেখ হাসিনা এবং খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে অজস্রবার সমালোচনা করেছেন। তিনি তাদের তৃতীয় শ্রেনীর মানুষ বলে চিহ্নিত করেছেন। কারণ তিনি প্রধান দু’দলের নেতার মানষিক উৎকর্ষ চেয়েছিলেন।
যা কিনা বাংলাদেশের জন্য হতে পারতো মঙ্গলের। এরকম সমালোচক এখন বাংলাদেশে নেই। কারণ সবাই চায় নিজের ভাগ্য পরিবর্তন। কেউ দেশের ভাগ্য পরিবর্তন চায় না। এটা মনে হয় ভারত উপমাহাদেশের একটি দূর্ভাগ্য।
সাতচল্লিশে দেশ ভাগ হলো জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন ও মতামতের প্রাধান্য দেয়ার জন্য। তারপর একাত্তরে স্বাধীনতা যুদ্ধ হলো তাও একই কারণে। দেখা গেলো বার বার শুধু রাষ্ট্রের উত্থান হয়েছে, কিন্তু জনগণের ভাগ্যের কোন পরিবর্তন হয়নি। তাহলে কি জনগণের মুক্তি নেই। অবশ্যই আছে।
এতো ভাঙচূড়, দু:সময়ের মধ্যেও ভালো সময়ও আছে আমাদের। আর এ সময়ের নির্মাতা সাধারণ মানুষ। বাংলাদেশে সরকার মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন খুব কমই করেছে। যা করেছে মানুষ তার নিজের চেষ্টায় করেছে। এতে এখন বিশেষ করে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত শ্রেনী অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।
তারা নিজেই নিজের ভাগ্য পরিবর্তন করছে।
বাংলা টাইমস এর বর্ষপূর্তি। কি লিখতে পারি ভাবতে বসে মনে হলো বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম একমাত্র পারে আমাদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিতে। আমি এ লেখায় বুদ্ধিজীবিদের চরিত্র সম্পর্কে বলার চেষ্টা করেছি। কারণ আমি আশা করি বাংলা টাইমস ওইসব বুদ্ধিজীবিদের কথা উপস্থাপন করবে যারা প্রান্তিক মানুষের পক্ষে কথা বলে।
তাহলে কেবল শুধু রাষ্ট্রের উত্থান নয় জনগনের ভাগ্যেরও পরিবর্তন হবে।
মিলটন রহমান, কবি, বার্তা সম্পাদক, বাংলা টিভি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।