ডাকে পাখি, খোলো আঁখি। দেখো সোনালী আকাশ, বহে ভোরেরো বাতাস।
পূর্ববর্তী পর্ব: বিদায় ইতালি, বিদায় বিশ্বকাপ ২০১০ (প্রথম পর্ব)
ফ্রান্স ’৯৮ বিশ্বকাপ পর্যন্ত আমার পছন্দসই কোন দল ছিলো না। কেন জানি তখনো পর্যন্ত আমার কোন দলের খেলাই ভালো লাগতো না। এরপর যথাসম্ভব ’৯৯ তে এসে আমি প্রথমবারের মতো ইতালির সেই বিখ্যাত কাতানেসিও পদ্ধতিতে খেলার ব্যাপারে জানতে পারি।
ধীরে ধীরে এই ফুটবল কৌশলটির ব্যাপারে জ্ঞাত হই কি করে নিজেদের রক্ষণদূর্গকে আগলে রেখে ক্রমাগত প্রতিপক্ষের আক্রমন প্রতিহত করে যেতে হয়, কি করে সন্তর্পনে সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হয় যে কখন প্রতিপক্ষের গোলমুখের দুয়ার আলগা হয়ে যায় এবং সেই সাথে কি করে মোক্ষম সময়ে প্রাপ্ত সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হয়। এই কৌশলী ছকের ব্যাপরে প্রথম জানাতেই আমার তা ভীষনভাবে ভালো লেগে যায়। আর তখন থেকেই আমি হয়ে গেলাম ইতালিয়ান ফুটবলের এক একনিষ্ঠ ভক্ত।
অনেকের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে যে ফুটবল ছকে লাতিনের ছন্দ নেই, জাদুকরী আর মোহনীয় ওয়ান-টু-ওয়ান পাস নির্ভর খেলা নেই, গোল করে যাওয়ার জন্য আক্রমনের বন্যা নেই, দর্শককুলের জন্য নেই কোন আনন্দদায়ক প্রয়াস, সেই ধীরগতির আর স্থিমিত ফুটবল কৌশল ভালো লাগার কি কারণ থাকতে পারে? আছে, কোন না কোন কারণ তো অবশ্যই আছে। এই প্রসঙ্গে বলা যেতে পারে ফুটবল নিয়ে নির্মিত একটি বিখ্যাত চলচ্চিত্র শাওলিন সকার এর কথা।
আলোচ্য চলচ্চিত্রে একজন ফুটবল কোচ তার শিষ্যকে ফুটবল খেলার কৌশল সম্পর্কে বলেন: ফুটবল খেলা হচ্ছে এক ধরনের যুদ্ধ। আসলেও যেন ঠিক তাই। এই খেলায় ১১ জন খেলোয়াড় একই সঙ্গে প্রতিপক্ষ ১১ জন খেলোয়াড়ের করা আক্রমন প্রতিহত করে, তাদের বিরুদ্ধে আক্রমন রচনা করে এবং প্রতিপক্ষের সব চেয়ে সুরক্ষিত দূর্গে(গোলমুখ) আঘাত হানার প্রচেষ্টায় সর্বদা লিপ্ত থাকে। আর ফুটবল যদি কোন যুদ্ধ হয় তাহলে ইতালিয়ন কৌশল যেন সেই যুদ্ধে একজন স্নাইপারের পদকেই অলংকৃত করে। সেটা কিভাবে?
আমরা জানি যে কোন যুদ্ধে একজন স্নাইপার বন্দুক হাতে সন্তর্পনে নিরাপদ কোন স্থানে লুকিয়ে থাকে এবং শত্রুপক্ষের কাছে নিজের অবস্থানকে সনাক্তহীন রেখে মোক্ষম সময়ে সঠিক নিশানায় শত্রুপক্ষের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি বা স্থাপনায় নিখুঁতভাবে গুলি করে।
সরাসরি শত্রুপক্ষের মুখোমুখি না হয়ে নিজেকে আড়ালে রেখে যুদ্ধের সময় স্নাইপারের এইভাবে শত্রুর উপর আক্রমন করার কৌশলটা হয়তো অনেকের কাছেই অবস্থাদৃষ্টে কাপুরষোচিত বলে মনে হতে পারে। তবে যুদ্ধের ক্ষেত্রে জয়/পরাজয় ভিত্তিক ফলাফলটাই হয়ে দাঁড়ায় মুখ্য, কে কতোটা বীরত্ব দেখালো সেটা কিন্তু মুখ্য হিসেবে বিবেচ্য হয় না। এ জন্যই হয়তো বলা হয়ে থাকে যে যুদ্ধ এবং ভালোবাসায় অন্যায় বলে কিছু নেই। কাজেই, ফুটবল নামক এই যুদ্ধে ইতালিয়ান কাতানেসিও পদ্ধতি অনুযায়ী আক্রমনকে আড়াল করে ক্রমাগত রক্ষণ করে যাওয়া, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুযোগের অপেক্ষায় থাকা এবং সুযোগ পাওয়া মাত্রই সঠিক নিশানায় লক্ষ্যভেদ করার কৌশলটা কি একজন স্নাইপারের মূলনীতিকেই মূর্ত করে তুলে না?
অনেকেরই বলে থাকেন যে ইতালিয়ান কৌশল অত্যন্ত বিরক্তিজনক এই কারণে যে তাদের খেলাতে দৃষ্টি নন্দন কোন গতি থাকে না। তবে একজন দর্শকের প্রেক্ষিতে না দেখে ফুটবলীয় কলা-কৌশলের দৃষ্টি কোণ থেকে দেখলে শ্রম সঞ্চয়ী এই কৌশল কি কাঙ্ক্ষিত জয়ের লক্ষ্যে আসলেই বুদ্ধিদীপ্ত নয়? আমরা সবাই জানি যে সারা বিশ্বের ফুটবলকে বাঁচিয়ে রাখার তীর্থভূমি এবং সেই সাথে বিশ্বসেরা ফুটবলারদের লালনক্ষেত্র হলো ইউরোপ।
শুধু তাই নয়, ইউরোপই হলো ফুটবলীয় কলা-কৌশল চর্চা ও বিশ্লেষণের এক আদর্শ গবেষণাগার। এই গবেষণাগার থেকেই যুগে যুগে নতুন নতুন সব ফুটবল-তত্ত্ব আর কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, সারা বিশ্বকে উপহার দেয়া নেদারল্যান্ডের সাবেক কোচ রাইনাস মিশেলসের বিখ্যাত টোটাল ফুটবল তত্ত্ব। আর ইউরোপের সবচেয়ে পুরনো ফুটবল তীর্থ হলো ইতালি। আজ হয়তো সেখানে স্পেন কিংবা ইংল্যান্ডের ঘরোয়া লীগের মতো আকর্ষনীয় জৌলুস নেই, কিন্তু তারপরেও এক সময় বিশ্বের সবচেয়ে জমজমাট ফুটবল লীগ ছিলো ইতালিয়ান সিরি-এ।
কাজেই, ফুটবলীয় কৌশল নিয়ে ইতালিয়ানদের গবেষণা, চর্চা আর বিশ্লেষণ থেকে জাত তাদের নিজস্ব ধারার এই ফুটবল কৌশলটি নিশ্চয়ই ঠুনকো কিংবা ফেলনা হবার যোগ্য নয়। আর ঠিক সেই নিরিখেই পদ্ধতিগত দক্ষতা এবং সর্বোপরি শ্রম সাশ্রয়ী এই ইতালীয় ফুটবল দর্শনের প্রতি আমার এতোটা ভালো লাগা।
( চলবে.... )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।