খুব ক্লান্ত ছিলাম বলে প্রতি ভোরের জাগতিক ব্যাস্ততা, সাড়াশব্দ জাগিয়ে দেয়নি আজ । অসাড় হয়ে মিশেছিলাম বালিশ আঁকড়ে বিছানায়। প্রতিদিন কয়েকশো কিলোমিটার যাতায়াত, তার উপর নাকানি-চুবানী খাওয়া সব সময়ের হিসাব রাখা ঠিকঠাক মতন । সময়ের হেরফেরে বিচ্যুত হয়ে যায় নানান কাজ, নানান মন। আমার ছুটতে ইচ্ছা করে না এমন ঘোড়দৌড়ের সওয়ার হয়ে, আমি ভেসে যেতে চাই অলস মেঘের মতন আপন মনে ।
কে তার হিসাব রাখে, ভেবে দেখে আমি কী চাই ?
ঘুম থেকে জেগে উঠলাম দূরালাপনীর শব্দে। ঘুম জড়ানো কন্ঠ শুনে ওপাশের মানুষটি থতমত খেলো, দু:খিত জাগিয়ে দিলাম। থাক তবে পরে কথা হবে।
-জেগে গেছি বলে ফেলো।
-বাবা দিবসের লেখা চাই।
গভীর ঘুম, স্বপ্নের আচ্ছন্নতা কেটে গেলো নিমেষে! কী দেখছিলাম স্বপ্নে তা আর মনে করার ইচ্ছা জাগল না। জীবনকালের সবচেয়ে প্রিয় মানুষের মুখ ভেসে যেতে থাকল চোখের পাতায়। হৃদয়ের তন্ত্রীতে উতল টান, ধমনীর স্রোতে বয় সারাটা জীবন যেন চোখের সামনে। আঁকুপাঁকু করে উঠল ব্যাথায় মন, শ্বাস নিতে কষ্ট। সবচেয়ে ভালোবাসার মানুষটি আর নাই এই পৃথিবীতে যে সারাক্ষণ গভীর উদ্বিগ্ন থেকেছে এতটুকু ফুলের টোকাও যেন লাগেনা গায়ে আমার তার জন্য ।
পরবাসের এই জীবন-যাপনের শুরুতে যে আমার সাথে কথা বলত না অনেক দিন, কান্না চেপে রাখতে পারবে না বলে। আর যখন কথা হতো সারাটা সময় গভীর মমতায় অস্থিরতায় শুধু জানতে চাইত, বাবা, তোমার অনেক কষ্ট একা একা তাইনা?
আমিও দু:খ না দেওয়ার ছলে সব যন্ত্রণা-কষ্ট গোপনে জমিয়ে হেসে গেছি সুখের চন্দ্রিমা ছড়িয়ে, না না কোন কষ্ট তো নেই। ভালো আছি খুব ভালো আছি।
জীবনের প্রতিটি সময়ের কথা তোমার সাথে, সব অনেক মূল্যবান। শিশুকালে সেই আঙ্গুল ধরে হাঁটার বয়স থেকে প্রতিটি মূহুর্তে ভালোবাসায়, যত্নে, আদরে নিঃস্বার্থ জড়িয়ে রাখায় তোমার মতন মহানুভব দ্বিতীয় কাউকে পাইনি।
তোমার সাথে বন্ধুর মতন গল্পে আড্ডায়, ভালোবাসায় ধাপে ধাপে সময়ের পলে জীবন বদলে গেছে আমার। প্রতিটি ধাপে মমতায়, আদরে প্রতিটি বিষয়ে জ্ঞান দান করেছো তুমি। স্বযত্নে এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছো পৃথিবীর পথে, কখনো দেখিনি রাগ কখনো দেখিনি অসন্তোষ কোন ব্যাপারে। কখনো আরোপ করনি নিজেস্ব মতামত জোর করে কারো উপর। উদার্য আর মহানুভবতার এক আশ্চর্য মানুষ তুমি।
কোন বিষয়ে মন খারাপ করলে সব সময়ই নতুন করে আশার কথা শুনিয়েছো।
আমাদের বাড়িটা ছিল একটা জাম্পেস আড্ডাখানা খেলাধূলা, সংস্কৃতিক জগতের। ক্যারাম, লুডু, তাস, দাবা ভাই বোন, মা বাবা, পড়শি, বন্ধু মিলে সময় সুযোগ মতন যখন যা ভালোলাগে মেতে উঠেছি। আমরা যখন গান বা কবিতার র্চচা করছি তুমি ঠিক সামিল হয়ে গেছো আমাদের মাঝে। প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য নিজে তৈরি করে দিয়েছো।
একজন ডাক্তার মানুষের এত কবিতা মুখস্ত কেন ছিল?
না, তোমর মতন কঠিন বড়সর কবিতাগুলো মুখস্ত করে উঠতে পারিনি কখনো। ভূগোল, ইতিহাস, ইংরেজি, বিজ্ঞান, জ্যোতিষবিদ্যা, সাঁতার, সেলাই সব তো তোমার কাছেই শিখা। বইএর পাতায় পড়ার চেয়ে গল্পের ছলে বলা তোমার শিক্ষা এখনো মস্তিষ্ক ধরে রেখেছে ।
নতুন আনা গল্পের বই হারিয়ে গেলে পাওয়া যেত তোমার হাতে। তুমি ঠিক জমে গেছো আগে গল্পের মায়াজালে।
ভাগ-বাটোয়ারা করে পড়তাম তুমি যখন কাজে সে সময় আমার। বন্ধুরা যখন আফসোসে বাঁচেনা কেমন করে নতুন সিনেমাটি দেখবে বলে তখন তুমি নিজে বলতে, আজ সন্ধ্যায় আমরা সবাই নতুন আসা সিনেমা দেখতে যাবো। ” দল বেঁধে পুরো পরিবার নিয়ে সিনেমায় চলে যেতে। ফুপাতো, চাচাতো ভাই-বোনরাও তোমার জন্য তাদের বাড়ির সম্মতি পেয়ে যেতো, সঙ্গী হতো আমাদের। কোন কিছুতে বাঁধা নেই, শীতকালের মেলা, র্সাকাস, যাত্রা সব কিছুই আমরা একসাথে তোমার সাথে উপভোগ করতাম।
বর্ষাকালে নৌকাভ্রমণ বাঁধা ছিল প্রতিবছর। সেই ছোট বেলাতেই বাংলাদেশের এ প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত ঘুরে বেড়িয়েছি তোমার সাথে প্রতিবছর। ষাটগম্বুজ মসজিদ, কক্সবাজার, টমটম ঘোড়ার গাড়িতে ঢাকা শহর, যাদুঘর, চিড়িয়াখান, রমনা র্পাক। চিলাহাটি থেকে তামাবিল। ভ্রমণের বীজটা বড় প্রবল হয়ে গেঁথে, গেছে আমার মনে।
এছাড়া মাঝে মাঝে নিয়ে আসতে লোকজ কোন সঙ্গীত শিল্পীকে। যার প্রচার হয়তো নেই কিন্তু গায় ভালো। আসর বসে যেত তাতক্ষণিক। মা ও তার টেপ রের্কডারে স্থায়ী করে রাখত গানগুলি। শুধু বাচ্চারা তোমার চোখের সমুখে না থাকলে তোমার বুক শুকিয়ে উঠত, কষ্টে করুণ হতো তোমার মুখ।
মেয়েরা ঘুরবে ফিরবে হাসবে প্রজাপতির মতন তোমার চোখের সম্মুখে। উচ্চশিক্ষার জন্য ঢাকায় চলে এলে উন্মূখ হয়ে প্রতীক্ষা করতে ছুটির দিনের জন্য। বাড়ি ফিরে আসার দিনটিতে পথপানে চেয়ে অপেক্ষায় থাকতে বারান্দায় বসে। সবার আগে দেখা হতো পথ পানে চেয়ে অপেক্ষা করা তোমার সাথে। সে আবেগ সে অনুভূতি এখন শুধুই অনুভব করি, তোমার সে অধীর মুখ উচ্ছাসিত মুখ সন্তানের বাড়ি ফিরে যাওয়ার আনন্দে আবার ফিরে আসার দিনের করুণ ছবি।
রাজসিকভাবেই চলাফেরা করতাম হলে থাকায় খাওয়ায়। কোনভাবেই যেন অসুবিধা না হয়, তাই প্রয়োজনের অতিরিক্ত টাকা-পয়সা দিয়ে রাখতে সব সময়। ঢাকায় আসা কোন যুবকের সাথে নিঃসংকোচে আমরা চলে আসতাম ঢাকায়। তুমিই খুঁজে বের করতে শহর থেকে কে যাচ্ছে ঢাকায়। ধনী, গরিব, হিন্দু, মুসলিম কোন ভেদাভেদ ছিল না।
তাদের করণীয় তেমন কিছু ছিল না, আমরা গল্পে কথায় দীর্ঘ সময় ও রাস্তা পার করতাম শুধু রাত হয়ে গেলে যেন ঝামেলামুক্ত ভাবে আস্তানায় পৌঁছে যাই, সে সময় সাথে কেউ থাকে তার ব্যবস্থা করে তোমার নিশ্চিন্ত হওয়া। ঢাকাতো আর আমাদের নিরিবিলি শহরনা যেখানে সবাই তোমাকে চিনে তোমার কল্যাণে আমাদেরও যথেষ্ট সম্মান করে ।
বন্ধুর মতন সহজ ছিলে তুমি, আর্দ্র ছিলে আদরে ভালোবাসায় র্নিদ্বিধায় যাকে সব কিছু বলতে পারতাম। তাইতো ভালোবাসার কথাটি স্বাচ্ছন্দে তোমার কাছেই বলতে পেরেছিলাম সবার আগে। শান্ত স্থির থেকে ঠিক তুমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে অনুভূতির সম্মান জানিয়ে।
বাড়ি না থাকলেও ঠিক আমার ভাগ আলাদা করে রাখতে তুমি সব কিছুতে। সুযোগ পেলেই পাঠিয়ে দিতে ঢাকায়। কখনো বা কাউকে পাঠিয়ে দিতে শুধুই জিনিস দেয়ার জন্য। বাড়ি থেকে আসার আগে কত কিছুই যে বাঁধতে তুমি আপন হাতে । মধুমাধব পোলাউর চাল, কালিজিরা পোলাউয়ের চাল, আরো কত রকম কত কিছু।
কমলা থেকে সাতকড়া, শুটকি, বড় রুই, মৃগেল, চিতল, পাংগাশ, কই, পাবদা মাছ এমন কি বাড়িতে জবাই করা, খাসি, গরুর মাংস পর্যন্ত আলাদা করে তোলা থাকত ফ্রিজে যা নিয়ে আসতে হবে ঢাকায় আসার সময়। এতদিন থাকলাম খেলাম সে কথায় কিছু যায় আসে না। সব নিয়ে আসতে হবে। সব কিছু আমাদের জন্য নিজের জন্য কিছু লাগেনা তোমার এক চশমা, ঘড়ি, কলম দিয়ে কাটিয়ে দিলে জীবন। একটা সার্ট পর্যন্ত কিনলে তোমার জন্য অনেক বেশী হয়ে যাচ্ছে তাই জানাতে।
ভালোবাসা আর দেয়ার মাঝে ছিল তোমার আনন্দ। কখনো দেখিনি কোন কিছুর জন্য চাহিদা বা অনুযোগ ছিল তোমার।
আমাদের সেই ছোট্ট শহরে কবেকার সেই সময়ে তুমি ছিলে প্রথম এমবিবিএস ডাক্তার, ঢাকা মেডিকেল কলেজের প্রথম ব্যাচ তুমি। যখন মুসলিম পরিবারে পড়ালেখার বিকাশ তেমন হয়নি সে সময় এইচএসসি পরীক্ষায় স্ট্যান্ড করলে তুমি নিঃশ্চিন্তে ভর্তি হলে ঢাকা মেডিকেল কলেজে। তোমার থার্ড ইয়ারের একটা গল্প তুমি প্রায় আমাদের বলতে, রেজাল্ট হবে, সব ছাত্র ভয়ে আছে তার উপর টিচার ঘোষণা করলেন, ওনলি টু স্টুডেন্ট পাসড, ভয়ে সবার আত্মারাম খাঁচা ছাড়া।
পাস করা দুজন ছাত্রের নাম বলা হলো অন্য একজন আর তোমার নাম। সে বছর পাস না করলে হয়তো তোমার অনেক অসুবিধা হতো কারণ বাবার অকাল মৃত্যুতে তোমার চিকিৎসা শাস্ত্রে পড়ালেখার খরচ চালানো অসম্ভব এক অবস্থায় পড়েছিল। নিশ্চিন্ত মনে শুধু পড়ালেখা করা হয়ে উঠছিল না পাশাপাশি খরচ চালানোর চিন্তা পড়ালেখা বিঘ্নিত করছিল।
ঢাকা থেকে পাশ করে তোমার বন্ধুরা যখন বিদেশে চলে গেলো আরো উচ্চ শিক্ষার জন্য পড়ালেখা করতে, অনেকেই আর ফিরেও এলো না দেশে। তুমি তখন স্কলারশিপ নিয়ে বিদেশ যাওয়া নিজের ভবিষ্যত সাজানো গোছানোর কথা না ভেবে ফিরে গেছো নিজের শহরে।
গ্রামের মানুষদের চিকিৎসা দিতে। ছোটবেলায় অনেক সময় লিলু ফার্মেসিতে বসে থাকতাম আমি তোমার পাশে রোগী দেখার সময় তখন দেখেছি। তুমি যখন রোগীর হাতে প্রেসক্রিপশন ধরিয়ে দিতে তখন তারা ঐ কাগজ তোমার হাতে ফিরিয়ে দিয়ে বলত, এই রাখো তোমার কাগজ, তোমার পাঁচ টাকা ফীও দিতে পারব না ঔষুধও কিনতে পারব না তো এই কাগজ নিয়ে কী করব? তুমি তখন প্রেসক্রিপশনসহ টাকা দিয়ে দিতে ঔষুধ কেনার জন্য। আমার মাও জানতো না কত টাকা তুমি মানুষদের সাহায্য করতে। কিন্তু তোমার একটা বদঅভ্যাস ছিল প্রতিদিনের হিসাব লিখে রাখার।
তাই তোমার চলে যাওয়ার পরে প্রয়োজনীয় কাগজ-পত্র সব দেখতে গিয়ে মা পেয়ে যায় তোমার মানুষকে দান করার হিসাবের খাতা । তোমার চলে যাওয়ার পর গ্রামে গ্রামে মানুষরা তোমার নামে প্রার্থনা করছিল আপন উদ্দোগে তোমার প্রতি তাদের ভালোবাসায় যা আমরা শুনেছিলাম পরে। তুমি ছিলে অনেকের কাছে ফেরেস্তার মতন। বাড়িতে তোমার রোগী দেখার কোন সময় বাঁধাছিল না। কত গভীর রাতে জেগে উঠেছি মানুষের হাঁক-ডাকে, ডাক্তার নিতে এসেছে মূমুর্ষ রোগীর জন্য, তুমি চলে গেছো রোগীর চিকিৎসা দিতে, মা সারারাত পথপানে চেয়ে জেগে থেকেছে তোমার ফিরার।
অসংখ্যবার উচ্চারিত হয়েছে, ডাক্তারসাব বাসাতনি? সারাদিন রাত ব্যাপী। আমাদের ময়না পাখিটাও তাই প্রায়ই বলে উঠত, ডাক্তারসাব বাসাতনি।
দুপুরের খাওয়ার সময় গড়িয়ে যেত বিকালে। খাচ্ছো তখন রোগী এলে খাওয়ার মাঝেই উঠে যেতে রোগী দেখতে। রোগীরা তোমাকে দেখেই অনেক ভালো হয়ে উঠত।
স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ইন্ডিয়াতে চলে যাওয়া অনেকেই ফিরে এসে বলেছে শুনেছি, তোমার লিখে দেওয়া প্রেসক্রিপশন যত্ন করে সাথে রেখেছিল প্রয়োজনে সে অনুযায়ী ঔষুধ খেয়ে কাটিয়েছে যুদ্ধের দিনগুলোতে তারা।
কত স্মৃতি, মুহূর্ত, দিনক্ষণের একটা বই হয়ে যাবে সব লিখলে । ভালোবাসা প্রতিদিন প্রতিক্ষণ তোমার জন্য হৃদয়ে করো বাস তোমার জীবন র্দশনে গভীর মানবিকবোধে আমাকে জড়িয়ে রাখো।
আমাকে ঘিরে থাকো তুমি সারাক্ষণ, উজ্জীবিত করো জীবনের চলার পথে। নিয়ন্ত্রণ করো, স্বান্তনা দাও অশান্ত সময়ে।
তোমার থেকে পাওয়া শিক্ষাদীক্ষায় মার্জিত চলার রুচি, বোধবুদ্ধি ছড়িয়ে আছে, ঘিরে আছে আমাকে ছায়ার মতন অনুক্ষণ ভালোবাসায়
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।