চট্টগ্রামকে একটি আধুনিক নগরে রূপ দেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নিয়েছিলেন্রআওয়ামী লীগের নেতা এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী। ১৭ বছরে নগরবাসী তাঁকে তিনবার নগরপিতার আসনে বসালেও তিনি প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেননি। তিনি হয়ে উঠেছিলেন অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী। স্বেচ্ছাচারিতা, দম্ভ আর দুর্ব্যবহারের অভিযোগও ওঠে তাঁর বিরুদ্ধে। অবশেষে ১৭ জুনের নির্বাচনে চট্টগ্রামের মানুষ নীরব ভোট-বিপ্লব ঘটাল।
চট্টগ্রামের বিভিন্ন পর্যায়ের্রলোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বেশ কয়েকটি কারণে মেয়র পদে বিএনপি-সমর্থিত চট্টগ্রাম উন্নয়ন আন্দোলনের প্রার্থী মোহাম্মদ মন্জুর আলমের কাছে ৯৫ হাজার ৫২৮ ভোটে হেরেছেন মহিউদ্দিন চৌধুরী। দলকে উপেক্ষা, মধ্যবিত্ত ও তরুণ ভোটারদের আকর্ষণে ব্যর্থতা, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে অবহেলা, জনবিচ্ছিন্নতা, নাগরিক সমস্যাকে এড়িয়ে চলা তাঁর পরাজয়ের কারণ।
দলকে উপেক্ষার খেসারত: একক কতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে মহিউদ্দিন চৌধুরী অনেককে দূরে ঠেলে দিয়েছেন। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করেছেন। দলীয় অন্তর্দ্বন্দ্বের দায় ঘাড়ে নিয়েই তিনি নির্বাচন করেছেন।
দলীয় কোন্দল মেটাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফকে চট্টগ্রামে পাঠিয়েছিলেন। তিনি কোন্দল মেটাতে মহিউদ্দিনবিরোধীদের নিয়ে বৈঠকও করেন। নগর আওয়ামী লীগের একজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, হানিফের ওই উদ্যোগের পরও মহিউদ্দিন চৌধুরী তাঁর বিরোধী হিসেবে পরিচিত সাংসদ নুরুল ইসলাম বিএসসিসহ অন্যদের সঙ্গে সামান্য সৌজন্য বিনিময়ের কথাও ভাবেননি। বরং তাঁদের সম্পর্কে কটু মন্তব্য করেছেন। এ ছাড়া কাউন্সিলর পদে প্রতিটি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগ থেকে তিন-চারজন প্রতিনিধি থাকলেও নাগরিক কমিটি একজনকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে।
ফলে অন্য প্রার্থীরা মন্জুরের পক্ষে কাজ করেছেন বলে আওয়ামী লীগের বিক্ষুব্ধ এক নেতা এ প্রতিবেদককে জানান। তিনি জানান, সিটি করপোরেশনে বিদ্রোহী মহিলা কাউন্সিলরদের সঙ্গে দুর্ব্যবহার করার বিষয়টিও নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
বিনয়ের কাছে পদানত দম্ভ: সিটি করপোরেশন রাজনীতিতে মহিউদ্দিনের হাত ধরেই আবির্ভাব মন্জুরের। নির্বাচনী প্রচারে সব সময় নগরবাসীর সেবার সুযোগ পেতে বিনয়ের সঙ্গে ভোট প্রার্থনা করেছেন মন্জুর। কখনো কাউকে কটু কথা বলেননি।
বিএনপির নেতা-কর্মীরা যখন একই মঞ্চ থেকে মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করেছেন, তখন মৃদুভাষী মন্জুর শুধু তাঁকে চট্টগ্রামবাসীর সেবার জন্য অন্তত একবার মেয়র পদে নির্বাচিত করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তাঁর বিনয়ী আচরণ যেকোনো বয়সের ভোটারকে মুগ্ধ করেছে। অন্যদিকে পরপর তিনবার দায়িত্ব পালনের্র পর অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসী মহিউদ্দিন চৌধুরী সব সময় দম্ভ প্রকাশ করেছেন।
তরুণ ও মধ্যবিত্তদের কাছে টানার ব্যর্থতা: এবারের নিরুত্তাপ নির্বাচনে প্রায় ১৭ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় পাঁচ লাখই তরুণ ভোটার। তরুণ ভোটারদের অনেকে জানান, দুই প্রার্থীর কেউই আধুনিক চট্টগ্রাম গড়ার মতো প্রত্যয়ী নন।
তবু একজনকেই বেছে নিতে হবে। সে ক্ষেত্রে মেয়র পদে নতুন কাউকে বসানোর পক্ষে বলেছেন কেউ কেউ। অন্যদিকে ভোটারদের উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ভোটার ছিলেন মধ্যবিত্ত। তাঁদের অনেকেই মেয়র পদে পরিবর্তন চাইছিলেন।
কাজে লাগেনি প্রথাগত ভোটব্যাংক: সংখ্যালঘু ও শ্রমজীবী—এই দুই শ্রেণীর মানুষকে সব সময় বিবেচনা করা হয়েছে মহিউদ্দিনের ভোটব্যাংক হিসেবে।
ধারণা ছিল, মহিউদ্দিন চৌধুরী সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর ভোট অনায়াসে পাবেন। তিনি তাঁদের সমর্থনের ব্যাপারে চিন্তামুক্তই ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক কিছু ঘটনায় তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সংখ্যালঘু ভোটারের অনেকেই। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু কর্মকাণ্ডের কারণে মহিউদ্দিনের সঙ্গে তাদের দূরত্ব বাড়তে থাকে। বিশেষ করে গোলপাহাড়ের মোড়ে পশুশালায় উন্নয়ন কর্মকাণ্ড শুরুর নামে ‘অযাচিত হস্তক্ষেপ’ সংখ্যালঘুরা ভালোভাবে নেয়নি।
নির্বাচনের দুই দিন আগে স্যাটেলাইট টিভির সরাসরি সম্প্রচারে তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কী। তিনি বলেছিলেন, নির্বাচিত হলে তিনি সেখানে মন্দির ও হাসপাতাল তৈরি করবেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের এক নেতা জানান, কেন্দ্রীয় নেতারা আসার পর সংখ্যালঘুদের সঙ্গে দূরত্ব প্রায় দূর হয়েছিল। কিন্তু টিভির ওই সম্প্রচারের পর সেই দূরত্ব আরও বেড়েছে। যার রেশ পড়েছে ভোটকেন্দ্রে।
সংখ্যালঘুদের উল্লেখযোগ্য অংশ ভোটকেন্দ্রে যায়নি। যাঁরা গেছেন, তাঁদেরও উল্লেখযোগ্য অংশ শুধু কাউন্সিলরদের ভোট দিয়েছেন—এমন মত প্রকাশ করেছেন বেশ কিছু ভোটার।
খেটে খাওয়া মানুষ তাঁকে ভোট দেবেন—মহিউদ্দিন চৌধুরী সব সময় এ ভরসা করতেন। নিজে শ্রমিক রাজনীতি করেছেন, সংগত কারণে তাঁদের প্রতি আলাদা এক ধরনের নাড়ির টান সব সময় তাঁর ছিল। ফলে সংকটে-সমস্যায়, দিনে-রাতে তাঁরা তাঁকে কাছে পেয়েছেন।
কিন্তু গত তিন দফা মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পালনের সময় যতই সময় গড়িয়েছে, মহিউদ্দিনের সঙ্গে তাঁদের দূরত্ব বেড়েছে। খেটে খাওয়া বিভিন্ন শ্রেণী, বিশেষ করে পোশাক কারখানার কর্মীদের অভিযোগ, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাঁদের সংকটের মুহূর্তে তাঁরা পাশে পাননি মেয়রকে।
এবার নির্বাচন উপলক্ষে এক দিনের সাধারণ ছুটি ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্র ও শনিবার সরকারি ছুটি হওয়ায় টানা তিন দিনের ছুটিতে চট্টগ্রামের বাইরের লোকজন শহর ছেড়ে গেছেন। এদের একটা উল্লেখযোগ্য অংশ শ্রমজীবী মানুষ।
যাঁদের ভোটব্যাংক মনে করতেন মহিউদ্দিন, এবার ভোটের সময় তাঁদের একটি বড় অংশ অনুপস্থিত ছিলেন।
নীরব ভোট বিপ্লব: সাধারণত ভোটের মাঝপথে কিংবা দিনশেষে ফলাফলের একটা আভাস মেলে। এবার এটা দেখা যায়নি। ভোটের পাল্লা কার দিকে ঝুঁকছে, তা ঠিক বোঝা যাচ্ছিল না। অনেকটা নিরুত্তাপ ও নজিরবিহীন শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট অনুষ্ঠানের পাশাপাশি ভোটারের কম উপস্থিতি সমীকরণটা কেমন হতে যাচ্ছে, তার সঠিক আভাস দিচ্ছিল না।
কিন্তু ভোটাররা পরিবর্তনের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন আগেভাগেই। তাই নীরব ভোটেই তাঁরা বদলে দিলেন নগরপিতাকে।
জনবিচ্ছিন্নতা: কয়েকটি সংসদ নির্বাচনে পরাজয়ের পরও শ্রমিকনেতা থেকে ধীরে ধীরে নিজেকে রাজনৈতিক নেতা বানিয়েছিলেন মহিউদ্দিন। ১৯৯৪ সালে প্রথম সিটি করপোরেশন নির্বাচনে নিজে আওয়ামী লীগ প্রার্থী না হয়ে নাগরিক কমিটির প্রার্থী হয়েছিলেন। মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিষ্ঠানকে আক্ষরিক অর্থেই জনকল্যাণের কাজে লাগাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্যকে অগ্রাধিকার দিয়ে শহরের পরিচ্ছন্নতা নিশ্চিত, সড়ক উন্নয়নসহ বেশ কিছু উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করেন।
তিনি যে সিটি করপোরেশনকে সত্যিকার অর্থেই জনগণের কাজে লাগাতে চান, এমন আভাসই পেয়েছিল নগরবাসী। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনকে আর্থিকভাবে লাভবান করতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ বেশ কিছু প্রকল্প হাতে নেন। কিন্তু পরে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানের আর্থিক লাভের পরিবর্তে ব্যক্তিগত সুবিধার ব্যাপারেই মনোযোগী হয়ে ওঠেন মহিউদ্দিন। তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির। বছরের পর বছর এসব অভিযোগ বাড়তেই থাকে।
কিন্তু এসব অভিযোগকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েছেন। ব্যস্ত থেকেছেন নিজেকে নিয়ে, এড়িয়ে গেছেন তাঁর মূল শক্তি জনগণকে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের এক নেতা বলেন, অপর্ণাচরণ ও কৃষ্ণকুমারী স্কুল ভেঙে তিনি বহুতল ভবন বানিয়ে স্কুল প্রতিস্থাপন করতে চেয়েছিলেন। পরে আন্দোলনের মুখে তাঁকে সেই পরিকল্পনা বাদ দিতে হয়। একইভাবে বাদ দিতে হয় চর চাকতাই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ দখল করে প্লট বরাদ্দের পরিকল্পনা।
এসব বিষয় থেকে বোঝা যায়, তিনি কতটা দূরে সরে যান জনগণ থেকে।
জলাবদ্ধতা: নির্বাচনী প্রচারের শেষ পর্যায়ে এসে টানা বৃষ্টি শুরু হয় চট্টগ্রামে। গত রোববার হঠাৎ বৃষ্টি শুরু হলে শহরের বেশ কিছু এলাকা ডুবে যায়। জলাবদ্ধতায় নাকাল হয় নগরবাসী। আলোচিত হয়ে ওঠে নগরের অন্যতম প্রধান সমস্যাটি।
আর এটিকে শেষ মুহূর্তের প্রচারের মূল বিষয় হিসেবে কাজে লাগান মহিউদ্দিনের প্রতিদ্বন্দ্বী মন্জুর আলম। এমনকি ১৩ জুন গভীর রাতে মন্জুর মুষলধারে বৃষ্টির সময় প্রচারে নামেন বাকলিয়া এলাকায়। পরে এটি মানুষের মুখে-মুখে চলে আসে। মন্জুর প্রচারণায় বলেন, নগরের প্রধান সমস্যাটি দূর করতে কোনো ব্যবস্থা নেননি মহিউদ্দিন। তবে মহিউদ্দিন চৌধুরী জলাবদ্ধতাকে জোয়ার-ভাটাকেন্দ্রিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে সমস্যা সমাধানের দায় এড়িয়েছেন, যা ভোটারদের চোখ এড়ায়নি।
এসব কারণে মহিউদ্দিন চৌধুরীর পরাজয় নিশ্চিত হয়ে উঠেছিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।