আগামীর স্বপ্নে বিভোর...
কক্সবাজার ও বান্দরবানের বিভিন্ন স্থানে গতকাল মঙ্গলবার ভোরে পাহাড়ধসের ঘটনায় ৫০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে শতাধিক ব্যক্তি। দুই দিনের প্রবল বর্ষণে উঁচু পাহাড়ধসে বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়ে এই হতাহতের ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় সেনাবাহিনীর পাঁচ সদস্যের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। আরও একজন নিখোঁজ রয়েছেন বলে জানা গেছে।
এসব প্রাণহানির ঘটনায় রাষ্ট্রপতি মো. জিল্লুর রহমান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তাঁরা নিহত ব্যক্তিদের আত্মার শান্তি কামনা করেন এবং আহত ব্যক্তিদের দ্রুত চিকিৎসাসেবা ও ক্ষতিগ্রস্তদের সর্বাত্মক সহযোগিতা দিতে স্থানীয় প্রশাসনের প্রতি নির্দেশ দেন।
কক্সবাজারের পুলিশ সুপার নিবাসচন্দ্র মাঝি জানান, গতকাল বেলা তিনটা পর্যন্ত টেকনাফে ৩৩ জন, উখিয়ায় ছয়, কক্সবাজার শহরে দুই ও হিমছড়ি সেনাক্যাম্পে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এ ছাড়া বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়িতে একই পরিবারের চারজন মারা গেছে।
গতকাল ভোর চারটার দিকে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের পশ্চিমে টুইন্যা পাহাড়ধসে বসতবাড়ি চাপা পড়ে আবদুল জলিল (৪০), তাঁর স্ত্রী ছালেহা আকতার (৩০), তাঁদের তিন সন্তান আবদুর রাজ্জাক (১১), শিউলী আকতার (৭) ও শারমিন আকতার (২) মারা যায়।
স্থানীয় লোকজন মাটি সরিয়ে তাদের লাশ উদ্ধার করে।
আবদুল জলিলের বড় ভাই আবদুল মজিদ জানান, উঁচু পাহাড় থেকে একখণ্ড মাটি জলিলের ঘরের ওপর পড়ে। এ সময় জলিলের পরিবারের সবাই ঘুমে ছিল। স্থানীয় লোকজন ঘটনাস্থলে পৌঁছার আগেই তারা সবাই মারা যায়।
২০০৮ সালের ৬ জুলাই একই স্থানে পাহাড়ধসে এক পরিবারের চারজনের মৃত্যু হয়েছিল।
প্রত্যক্ষদর্শী গিয়াসউদ্দিন জানান, সকাল সাড়ে সাতটায় দিকে টুইন্যার পাহাড় এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আতঙ্কে মানুষ পাহাড় থেকে নেমে আসছে। ঠিক এ সময়েই পাশের একটি পাহাড় হুড়মুড় করে ভেঙে নুরুল ইসলামের বসতবাড়ির ওপর পড়ে। আগেই নেমে আসায় নুরুল ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বেঁচে যায়।
টেকনাফের বিভিন্ন স্থানের পাহাড়ে বড় বড় ফাটল দেখা গেছে। যেকোনো সময় এগুলো ভেঙে পড়ে হতাহতের ঘটনা ঘটতে পারে।
সকাল সাতটায় ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা যায়, প্রবল বৃষ্টি উপেক্ষা করে শত শত মানুষ পাহাড় থেকে সমতলে নেমে আসছে। অন্য যারা পাহাড়ে ছিল, তাদের নামিয়ে আনতে সকাল ১০টা থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) নেতৃত্বে পুলিশ ও বন বিভাগ মাইকিং শুরু করে।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ভোর ছয়টার দিকে টেকনাফ উপজেলা পরিষদের পশ্চিমে ফকিরামুরা পাহাড়ধসে মারা যায় শিশুকন্যা নূর হাবা (২)। স্থানীয় লোকজন নূর হাবার মা জহুরা খাতুনকে (২৫) গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে। তাঁকে টেকনাফ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
প্রায় তিন বছর ধরে জহুরা পাহাড়ের ঢালে ঝুপড়িঘর বানিয়ে বসবাস করছেন।
ভোর পাঁচটার দিকে উপজেলা শহরের টুইন্যা পাহাড়ধসে মো. হাশিমের বসতবাড়ি বিধ্বস্ত হয়। এতে হাশিমের মেয়ে কুলসুমা খাতুন (৭) ও ছেলে নূর করিম (৩) ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায়। স্থানীয় লোকজন গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাশিম (৫০), তাঁর স্ত্রী তৈয়ুবা খাতুন (৩৫) ও অপর মেয়ে হালিমা বেগমকে (৯)। তাদেরও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে।
ভোর পাঁচটার দিকে টেকনাফ ৪২ রাইফেল ব্যাটালিয়নের পাশে বৈদ্যঘোনা পাহাড়ধসে মারা যায় স্থানীয় দিল মোহাম্মদের ছেলে ফয়সাল (৩)।
ভোর ছয়টার দিকে উপজেলার নিলা ইউনিয়নের উলুচামারি পাহাড়ধসে প্রাণ হারায় এক পরিবারের চারজন। ঘটনাস্থল থেকে টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মিজানুর রহমান প্রথম আলোকে জানান, পাহাড়ধসে একটি ঘর ভেঙে ঘটনাস্থলে মারা যান দিনমজুর নূর মোহাম্মদ (৩৫), তাঁর স্ত্রী লায়লা বেগম (২৮), মেয়ে নাসিমা বেগম (৮) ও ছেলে সরোয়ার আলম (২)। দুপুর দুইটায় পুলিশ মাটি সরিয়ে লাশগুলো উদ্ধার করে।
গতকাল ভোরে উপজেলার হোয়াইক্যং ইউনিয়নের বাজারপাড়ায় পাহাড়ধসে মারা যান হোয়াইক্যং ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য কবির আহমদের স্ত্রী নাজমা বেগম (৪০), ছেলে সাইফুল ইসলাম (১৪) ও বাবু (৩)।
টেকনাফের ইউএনও আ ন ম নাজিম উদ্দিন গতকাল বিকেলে জানান, টেকনাফে পাহাড়ধসের ঘটনায় মোট ৩৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছে অন্তত ৪০। পাহাড়ে বসবাসকারী লোকজনকে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে।
উখিয়ায় নিহত ৬: উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের দক্ষিণ রহমতেরবিল গ্রামে ভোর চারটায় পাহাড়ধসে বসতবাড়ির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যায় একই পরিবারের চারজন।
পালংখালীর ইউপি চেয়ারম্যান মাজহারুল ইসলাম জানান, পাহাড় থেকে মাটি ধসে স্থানীয় কবির আহমদের ছেলে জয়নাল আবেদীনের বসতঘরের ওপর পড়লে ঘরটি ভেঙে পড়ে।
ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে মারা যান গৃহকর্তা জয়নাল আবেদীন (৪০), তাঁর স্ত্রী ইয়াসমিন (২৯), ছেলে আরমান (৮), মো. সোহান (৩) ও মেয়ে উম্মে হাবিবা (৫)।
একই সময় ইউনিয়নের ধামনখালী গ্রামের জাফর আলমের বসতবাড়ি ধসে তাঁর ছেলে আবদুল (১২) প্রাণ হারায়। আহত হন জাফর আলমসহ পরিবারের চার সদস্য।
উখিয়ার কুতুপালং এলাকার সড়ক ও মরিচ্যা লাল ব্রিজ ভেসে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক যোগাযোগ গতকাল ভোর থেকে বিচ্ছিন্ন রয়েছে। ফলে আমদানি পণ্যবাহী শতাধিক ট্রাক ও যাত্রীবাহী বাস আটকা পড়েছে।
হিমছড়িতে পাঁচ সেনাসদস্যের লাশ উদ্ধার: হিমছড়িতে গতকাল ভোর ছয়টার দিকে পাহাড়ধসে চাপা পড়ে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়ক নির্মাণকাজে নিয়োজিত সেনাবাহিনীর (১৭ ইসিবি) একটি ক্যাম্প। এতে ছয় সেনাসদস্য মাটির নিচে চাপা পড়েন। সকাল আটটা থেকে উদ্ধার তৎপরতা শুরু হয়। সেনাবাহিনী, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির সদস্যরা বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত মাটি সরিয়ে পাঁচ সেনাসদস্যের লাশ উদ্ধার করেন।
আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদপ্তরের (আইএসপিআর) সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নিহতরা হলেন নেত্রকোনার খালীয়াজুড়ী উপজেলার জগন্নাথপুর গ্রামের বাসিন্দা সার্জেন্ট (সার্ভেয়ার) মো. আফসার আলী, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার আক্তগানা গ্রামের বাসিন্দা করপোরাল (ডিএসডি) মো. হাবিবুর রহমান, জামালপুর সদর উপজেলার নাসিরপুর গ্রামের সৈনিক (ডিএমটি) মো. হুমায়ুন কবীর, কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার বালুখালী গ্রামের নিবাসী সৈনিক (ডিএমটি) মো. ইসমাইল হোসেন ও চুয়াডাঙ্গার জীবননগর উপজেলার দেহাটি গ্রামের সৈনিক (ডিএমটি) মো. আবদুল মালেক।
অপর একজনকে উদ্ধারে তৎপরতা চলছে।
কক্সবাজার-৩ (সদর-রামু) আসনের সাংসদ লুৎফুর রহমান, জেলা প্রশাসক গিয়াসউদ্দিন আহমদ, পুলিশ সুপার নিবাসচন্দ্র মাঝি, রামুর ইউএনও শহীদ মো. ছাইদুল হকসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে উদ্ধার তৎপরতা তদারক করেন।
কক্সবাজার শহরে দুজনের মৃত্যু: ভোরে কক্সবাজার শহরের মোহাজের পাড়ায় পাহাড়ধসে রুবি আক্তার নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি প্রয়াত দানু মিয়ার স্ত্রী। আহত হয়েছেন তাঁর ছেলে মো. রাসেল (২২)।
সকাল সাতটায় পুলিশ লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কক্সবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে পাঠায়। একই সময় শহরের ঘোনাপাড়ায় পাহাড়ধসে রহিম উল্লাহ নামের এক শিশু মারা গেছে।
বান্দরবানে একই পরিবারের চারজনের মৃত্যু: নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুনধুম ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দীপক বড়ুয়া জানান, এই ইউনিয়নের দুর্গম বাজাবনিয়া উত্তর পাড়ায় প্রবল বর্ষণে ভোরে আকস্মিকভাবে পাহাড় ধসে পড়ে। এতে পাহাড়ের পাদদেশের খায়রুল বশরের বাড়ি চাপা পড়ে এবং ঘুমন্ত অবস্থায় চারজনের মৃত্যু হয়। নিহত ব্যক্তিরা হলেন খায়রুল বশর (৩০), তাঁর স্ত্রী খাদিজা বেগম (২৫) এবং তাঁদের দুই ছেলেমেয়ে সাকিব (৫) ও শাকেরা (২)।
দীপক বড়ুয়া আরও জানান, পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে আরও বেশ কিছু ঘরবাড়ি ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। প্রবল বর্ষণে রাস্তাঘাট ডুবে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় প্রকৃত তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না।
নাইক্ষ্যংছড়ি থানার ওসি জহিরুল ইসলাম বাজাবনিয়া উত্তর পাড়ায় পাহাড়ধসে একই পরিবারের চারজনের মৃত্যুর কথা নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, সোমবার রাত থেকে নাইক্ষ্যংছড়িতে প্রবল বৃষ্টি হচ্ছে। বাকখালী নদী ও ছোট ছোট খালের পানি বেড়ে যাওয়ায় নাইক্ষ্যংছড়ি-রামু সড়কের এক কিলোমিটার ডুবে রয়েছে।
তাই নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ঘুনধুমের বাজাবনিয়া যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। সেখানকার পুলিশ ক্যাম্পকে লাশ উদ্ধারের জন্য বলা হয়েছে।
খবরটা এখান থেকে নেয়া...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।