আমার স্বপ্ন, আমার ভালবাসা... আমার নিঃস্বাস, আমার বিশ্বাস... আমার ঠিকানা..
ইতিহাসঃ
যাতায়াত ব্যবস্হার উন্নতি না হবার ফলে, বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে টেকনাফ পরিচিত ছিল অতি ভয়ংকর ও দূর্গম এলাকা হিসেবে।
সে সময় টেকনাফ ছিল একটি ছোট বানিজ্যিক এলাকা। ব্যবসায়ীরা বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে চাল, কাঠ, তামাক, তাজা এবং শুকনো মাছ এখানে জড়ো করতো। বার্মা থেকেও বাঁধাহীনভাবে অবৈধ পথে এখানে চাল আসত। এখানকার গোত্রের ভিতর, রাখাইন সম্রাদায়ের লোকজনই বেশী ছিল।
জল দুস্যুতা মাত্রারিক্ত বৃদ্ধির কারনে এবং ব্যবাসায়ীদের নিরাপত্তার জন্য তৎকালীন সরকার টেকনাফে একটি পুলিশ ফাঁড়ী স্হাপন করে, যার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হিসেবে ধীরাজকে কলকাতা থেকে টেকনাফে বদলী করা হয়।
কলকাতা থেকে দুর্গম টেকনাফে আসা তার জন্য রীতিমত অসম্ভব ছিল। শিলাইদহ থেকে গোয়ালন্দ প্রথমে ট্রেনে, তারপর গোয়ালন্দ থেকে চাঁদপুর হয়ে চট্রগ্রাম পর্যন্ত ষ্টিমারে। সেখান থেকে স্টীম ইঞ্জিন ট্রেনে চেপে চট্রগ্রামের বা’টালি ষ্টেশন।
সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফ থানা-অদূরে সমুদ্রের নীল জলরাশি।
থানায় তার তেমন কোন কাজ কর্ম ছিলনা। অনেকটা এখানে সেখানে ঘুরে ফিরে কাটাতেন। থাকতেন থানার আধাপাকা ঘরের একটি কক্ষে।
তখন শীতকাল, সাগর শান্ত ছিল। ঐ বছ্র সাগরে মাছ প্রচুর পরিমানে ধরা পরায় জেলেরাও অতিরিক্ত সময় কাজ করে।
কলকাতা ছেড়ে এই প্রথম ধীরাজ দূরে আছে। সহসাই বাড়ির কথা তার খুব মনে পরে। ঘরে তার বৃদ্ধ বাবা-মা।
সেই সময় টেকনাফে সুপেয় পানির খুব অভাব ছিল। একদিন ভোরে একাধিক নারী কন্ঠের অস্পষ্ট মৃদু গুঞ্জনে ধীরাজের ঘুম ভেঙ্গে যায়।
থানার ছোট বারান্দায় এসে দেখেন রং-বেরঙ্গের ফতুয়া (থামি-ব্লাউস) পরিহিতা ৫০/৬০ জন মগী তরুনী পাত কুয়ার চারিদিকে জড়ো হয়ে হাসি গল্পে মশগুল। তাদের সুউচ্চ কলহাস্যে থানা প্রাংগন মুখরিত। এটিই ছিল সমগ্র টেকনাফে একটি মাত্র কূয়া। প্রতিদিন তরুনীরা পাতকূয়ায় জল নিতে আসতেন। কেউ কেউ থানার ছোট বাগানের শিউলী ফুল তুলতো।
ধীরাজ প্রতিদিন গরম চা হাতে থানার বারান্দার চেয়ারে বসে তরুনীদের জল তোলার দৃশ্য দেখতেন।
একদিন ধীরাজের নজরে পড়ে সম্পূর্ন নতুন সাজে সজ্জিত আরেক তরুনীকে, সুন্দর এই তরুনীর নাক-চোখ, মুখ বাংগালী মেয়েদের মত। নাম তার মাথিন। টেকনাফের জমিদার ওয়ানথিনের একমাত্র মেয়ে। প্রথম দর্শনেই মেয়েটিকে তার ভাল লেগে যায়।
প্রতিদিন ভোর হওয়ার আগেই ধীরাজ ভট্টাচার্য্য থানার চেয়ারে গিয়ে বসতেন এবং মাথিনের আগমনের প্রতিক্ষা করতেন। মাথিন যখন কলসি কাঁখে তার সুউচ্চ গ্রীবা দুলিয়ে থানা প্রাংগন দিয়ে হেঁটে আসতেন ধীরাজ তন্ময় হয়ে সে দৃশ্য উপভোগ করতেন। অন্যান্য তরুনীরা আসার আগেই মাথিন পাতকূয়ায় আসতেন এবং জল নিয়ে ফিরতেন। ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় নীরব নিস্তদ্ধ পরিবেশে তারা একে অপরের সাথে গভীর প্রেমে ও মোহবেশে আছন্ন থাকতেন। পরস্পর পরস্পরের দিকে চেয়ে সম্ভব অসম্ভব নানা কল্পনার রঙ্গিন জাল বুনতেন।
দেখা-দেখি, হাসা-হাসি এভাবে তাদের প্রেম ঘনীভুত হয়। দিন গড়াতে থাকে। একদিন, দুইদিন এইভাবে। ইতোমধ্যে দু’জনের প্রেমের কথা সবাই জেনে যায়। নানা বাধা সত্তেও দুজনের মধ্যে বিয়ের কথা পাকা পাকি হয়।
এর মধ্যে কলকাতা থেকে চিঠি আসে ধীরাজের কাছে। তার বাবা অসুস্হ, ধীরাজকে কলকাতা যেতে হবে একমাসের ছুটি নিয়ে। ছুটি না মিললে চাকুরীতে ইস্তফা দিয়ে হলেও যেতে হবে। ধীরাজের আরও একটি ইচ্ছা ছিল বিয়ের আগে তার ভবিষৎ নিয়ে তার বাবা-মা কে জানানো। ধীরাজ সিদ্ধান্ত নেন কলকাতা যাবেন।
সিদ্ধান্তের কথা মাথিনকে জানানো হল। মাথিন রাজি হলেন না। মাথিন নিশ্চিৎ ছিলনা যে, “পরদেশী বাবু” তাকে বিয়ে করার জন্য কলকাতা থেকে ফিরে আসবে কিনা। তাই অনেকটা বাধ্য হয়ে ধীরাজ এক সন্ধায় টেকনাফ থেকে ছেড়ে পালিয়ে গেলেন।
মাথিনের মনে হলো, বাবার অসুখের কারনে হয়ত ধীরাজ কলকাতা চলে গেছে।
কিন্তু বাস্তবিক পক্ষে ধীরাজ মাথিনকে বিয়ে করতে চাননি বলেই রাতে অন্ধকারে কাপুরুষের মত টেকনাফ থেকে পালিয়ে গেলেন।
ধীরাজের এভাবে চলে যাওয়াকে প্রেমিকা মাথিন সহজভাবে মেনে নিতে পারেননি। প্রাণ-পুরুষ ধীরাজকে হারিয়ে মাথিন অন্ন জল ত্যাগ করে হন শয্যাশায়ী। জমিদার বাবা ওয়াথিনসহ পরিবারের সদস্যরা শত চেষ্টা করেও অন্ন জল ছোঁয়াতে পারেন নি। তার এককথা - ধীরাজকে চাই।
প্রেমের এই বিচ্ছেদ এবং অতি কষ্টে একদিন মাথিন মারা যান।
এ কারনে প্রেমের সাক্ষী “মাথিনের কূপ” দেখে এখনো হাজারো প্রেমিক প্রেমিকা তাদের ঐতিহাসিক প্রেমের কথা স্মরণ করে আবেগে আপ্লুত হয়।
পরের কথাঃ
কলকাতা যাবার পর ধীরাজ পুলিশের চাকুরী থেকে ইস্তফা দেন। নতুন পেশা হিসাবে তিনি ছবিতে অভিনয়কে বেছে নেন। তার অভিনিত ছবিগুলোর মধ্যে আরশা হিন্দু হোটেল, হানা বাড়ি এবং বিপ্লবী খুদিরাম অন্যতম।
পরে তিনি নিজের জীবনি অবল্বনে দুইটি বই লিখেন যার একটির নাম “যখন পুলিশ ছিলাম” অন্যটি “যখন নায়ক ছিলাম”। এর পর ধীরাজ আর তার পরিবারের বিষয়ে খুব একটা জানা যায়নি।
পুলিশ প্রশাসন এই জায়গাটি সংরক্ষন করে এটিকে “মাথিনের কূপ” হিসেবে নাম করন করেন। ২০০৬ সালে ধীরাজ-মাথিনের ইতিহাসের প্রায় ৮০ বছর পর, টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জনাব খালেদ হোসেন, সাংবাদিক আব্দুল কুদ্দুস রানা কে সাথে নিয়ে এই কূপটির সংস্কার করেন এবং এটিকে একটি দর্শনীয় স্হান হিসেবে পরিচিতি দেন।
যাওয়ার উপায়
টেকনাফ শহরের প্রান কেন্দ্রে নাফ নদীর পাশে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্তরে এই মাথিনের কূপ।
কক্সবাজার থেকে অনেক গুলো বাস সার্ভিস আছে, ভাড়ায় পাওয়া যাবে রেন্ট-এ-কার এর গাড়ি। ১ ঘন্টা ৩০ মিনিট থেকে ২ ঘণ্টার ভিতরে আপনি চলে আসবেন সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফে।
কক্সবাজার থেকে টেকনাফের দুরতঃ ৮৪ কিঃমিঃ
মাথিনের কূপের কো-অর্ডিনেটঃ 20°51'52.20"N 92°18'01.47"E
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।