আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পদ্মমধু : চির যৌবনের ঢেউ (৫০+)

তারা বলে সম্ভব না, আমি বলি সম্ভাবনা

"ভাইয়েরা, আমার কোম্পানীর পদ্মমধু জীবনে একবার পরিমাণ মতো পান করতে পারলে, তার যৌবনে কখনও ভাটা পড়বে না। মানুষ বুড়িয়ে যেতে পারে, চামড়া কুঁচকিয়ে যেতে পারে, চোখের পাতা ঢিলে হয়ে চোখের উপর পড়ে যাবে। তারপরও যৌবন তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। যে ব্যক্তি জীবনে একবার এ মধু পান করেছে; তার প্রথম স্ত্রী তাকে দ্বিতীয় বিয়ে করার অনুমতি দিয়েছে। এই পদ্মমধু ছানি পড়া চোখের উপর, এক সপ্তাহ লাগালে চোখের অন্ধত্ব দূর হবে।

চির বধির ব্যক্তির কানে দু’ফোটা ঢাললে, বধির পরিষ্কার শুনতে পাবে, চিরতরে কানপাঁকা দূর হবে। শরীরের নরম স্থুল মাংস লৌহ দন্ডের ন্যায় শক্ত হবে। শরীরের ব্যাথায় এই মধু লাগান, ব্যথা চিরতরে পালাবে। বসন্তের রোগীর ফোষ্কার উপর ভাল করে লাগালে, ফোষ্কা দাগসহ শুকিয়ে যাবে। কবুতরের রক্তের সাথে এই মধু মিশিয়ে, টাক মাথায় ৩ মাস লাগালে; টাক মাথায় আবার নতুন চুল গজাবে।

হারানো যৌবন ফিরে পেতে চাইলে; ৩ মাস পাখির মাংসের সাথে ৬ ফোটা মধু খান। ৩ মাসেই তাগড়া যুবক হয়ে উঠবেন, চ্যালেঞ্জ দিলাম কাজ না হলে পয়সা ফেরত। দাঁতে সান্নি-বাতিক হয়েছে তো নরম তুলায় একটু খানি মধু লাগান দাঁত ২০ বছরের বালকের ন্যায় কড়কড়ে হয়ে উঠবে। সাবধান! দাঁতের জন্য বেশী মধু তুলায় লাগাবেন না, বেশী মধু পেটে গেলে পর দেহ-মন এমন উত্তেজিত হবে; ঠান্ডা করার যন্ত্রপাতি সাথে না থাকলে, মাঘ মাসের ঠান্ডা পানিতে তিন ঘন্টা বসে থাকলেও শরীর ঠান্ডা হবেনা। এই পদ্মমধু প্রথমে ব্যবহার করেন গ্রীক বীর আলেক্সান্ডার।

মোগল সম্রাট হুমায়ুন, আকবর, শাহজাহান এমনকি বাংলার নবাব সিরাউদৌলা পর্যন্ত এই পদ্মমধু পান করে, চির যৌবন প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এটা সেই মধু যা শুধু রাজা-বাদশাহরা খেতে পারতেন। বিশাল পদ্মদিঘি জাল দিয়ে ঘিরে মৌমাচিকে আবদ্ধ করে, এই মধু আহরন করতে হয়। যার ফলে এই মধু খুবই দামী ও দুষ্পাপ্য। আমি বিলাত থেকে এই বিদ্যা শিখেছি, বর্তমানে সিলেটে, আমার নিজের কোম্পানীতে এই পদ্মমধু তৈরী করছি।

এই মধু তৈরীর জন্য আমার কাছে ব্রিটিশ সরকারের সনদ আছে, এই দেখুন সেই সনদ। শুধু কোম্পানীর পরিচিতি বৃদ্ধির জন্য এতদূর এসেছি। আমার কাছে মাত্র ৪০ শিশি পদ্মমধু আছে। এগুলো শেষ হয়ে গেলে, আমাকে খুন করলেও কেউ মধু পাবেন না। সুতরাং হেলায় সূবর্ন সুযোগ হারাবেন না।

আমার চেম্বারে গেলে প্রতি শিশি মধুর দাম একশত টাকা। আমার ব্যবসায়ের প্রচার ও প্রসারের জন্য এবং আপনাদের সম্মানার্থে প্রতি শিশি থেকে ৬০ টাকা বাদ দিয়ে, দাম ধরেছি মাত্র ৪০ টাকা, ৪০ টাকা, ৪০ টাকা। আমি জানি, আপনাদের মনে সন্দেহ হবে, এত টাকা দামের মধু! সত্যিই কাজ করবে কিনা? সেটার প্রমান আমার হাতে আছে। নবীজি (সাঃ) বলেছেন, “যে ব্যাক্তি নিয়মিত মধু খাবে, তার কাছে মরন ব্যতীত কোন রোগ আসবে না”। নবীজি নিয়মিত মধু খেতেন, তিনিও উপকার পেয়েছেন, তাই আমাদেরও মধু খেতে বলেছেন।

বন্ধুগন, বাজারের সাধারণ মধুর চেয়ে, পদ্মমধু অনেক গুন বেশী শক্তিশালী ও কার্যকর। অন্য মধু এক চামচ মুখে দিয়ে চাটতে পারবেন কোন সমস্যা হবেনা; তবে এই পদ্মমধু অনেক গরম তাই এর ৪ ফোটা জিহবায় নিলে ভিজা জিহবা গরম হয়ে যায়। বিশ্বাস হয়না? আপনাদের মধ্য থেকে দু’জন বয়স্ক ব্যক্তি আমার কাছে আসুন। আসুন ভাই.... আসুন..., এখানে দাঁড়ান, আপনারা হাঁ করুন, জিহবা বের করুন, এই দিলাম দু’ফোটা পদ্মমধু। সাবধান! খাবেন না, একটু করে বাতাস ছাড়ুন, দেখুন কেমন লাগে।

দর্শক ভাইয়েরা আপনারাই প্রশ্ন করুন কেমন লাগছে তাদের। কি ভাই, কেমন লাগছে? জ্বি ভাই মধুটি গরম ধরনের লাগছে। বন্ধুগন শুনলেন তাদের কথা? পকেট সাবধান! আমার ইচ্ছা থাকলেও, আজ সকলকে মধু খাওয়াতে পারবনা। তারপরও আরো দু’জন ভাইকে খাওয়াব। আসেন ভাই আপনারা দু’জন।

আপনারাও দেখেন কেমন গরম মধু? আল্লাহর কছম! এটা আমার কোন কেরামতি নয়, এটা আল্লাহর একটা সৃষ্টির নমুনা। এই অসাধারন পদ্মমধু এমন গরম, যার একটি ফোঁটা গুলির পিছনে লাগলে, গুলি ফেঠে যাবে। বারুদের উপর পড়লে, বারুদে আগুন ধরে বিরাট বিষ্ফোরণ ঘটবে। আপনাদের কাছে আমার কথা বিশ্বাস হয় না? সমস্বরে উত্তর; বিশ্বাস করি, তবে প্রমান পেলে দেখতে ক্ষতি কি? আসুন সে প্রমানও আপনাদের দিচ্ছি। তবে সাবধান! এক জনও এখান থেকে যাবেন না।

এই দেখুন এটা একটা পরিষ্কার সাদা কাগজ, এই কাগজে কালো বারুদ রাখলাম, আপনাদের সামনেই এক ফোঁটা মধু বারুদে দিলাম......, দেখলেন? দেখলেন! কিভাবে বারুদে আগুন ধরে গেল। এসব পদ্মমধূর পক্ষেই সম্ভব। আমার কথা শেষ; কে কে মধু নেবেন দয়া করে হাত তুলুন, মাত্র ৪০ টি শিশি আছে। এক্ষুনি শেষ হয়ে যাবে। পরে বাড়ীতে গিয়ে পস্তালে মধু পাবেন না।

" সুপ্রিয় পাঠক, এতক্ষন যে বক্তব্য শুনলেন এটা আমার কোন বক্তব্য নয়, এটা কবিরাজ ‘আলী মিয়া’ চৌধুরীর বক্তব্য। তার কথা শুনে আপনাদের যেমন এক শিশি মধু পান করতে ইচ্ছে করছে, আমারও সে ইচ্ছে হয়েছিল। অনেক কষ্টে বাবার পকেট থেকে, ব্যবসায়ের টাকা মেরে এক শিশি পদ্মমধু কিনতে পেরেছিলাম। উপস্থিত অনেক গন্যমান্য ব্যক্তির দেখা দেখি, স্থানীয় যুবক জহুর আলীও চার চারটি শিশি পদ্মমধু কিনেছিলেন। জহুর আলীর বিয়ের নিশাণ তথা এনগেজমেন্ট হয়ে গিয়েছিল, আর মাত্র ৬ মাস পরেই বিয়ে হবে।

এভাবে কিছুক্ষণের মধ্যেই কবিরাজের সবকটি শিশি বিক্রি হয়ে যায়। সময়টি ৭৭-৭৮ সাল, সে সময়ে ৪০ টাকা গ্রামীন মানুষদের জন্য মানুষের জন্য মোটামুটি বড় অংক। দৈনিক কামলার বেতন ছিল ২৫/৩০ টাকা। ঈদের বাজারে সেমাই-চিনি ১১ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল। তখন প্রতি কেজি চিনি ৬ টাকা, ১ পেকেট বিড়ি ও ১ টি দিয়াশলাই ১ টাকায় পাওয়া যেত, এমনকি ৫ পয়সা দিয়ে একটি আইসক্রিম পাওয়া যেত।

আমি হাইস্কুলের ছাত্র, কবিরাজের অনেক কথার উত্তর না বুঝলেও, পদ্মমধু নিয়ে আমার তেমন কোন আগ্রহ ছিলনা। যখন দেখলাম কবিরাজ সাদা কাগজে বারুদ রাখলেন, সে বারুদে মধুর ফোঁটা দিলেন অতপরঃ কাগজটি মুচড়িয়ে বায়ুশুন্য করলেন, অমনি তাতে শুন্য থেকেই আগুন ধরে গেল। এটা আমার কাছে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ন মনে হল। ভাবলাম বারুদ’তো দিয়াশলাই থেকে পাওয়া যাবে; এখন দরকার মধু, আর মধু কিনতে দরকার টাকা, টাকা থাকে বাবার পকেটে। জীবনে সাহস করে এই প্রথম খুবই আপনজনের টাকা আত্মসাৎ করলাম।

ন্যায়-অন্যায় আমার মাথায় নেই; শুধু ঘুরপাক খাচ্ছে, বারুদে মধু ঢালা মাত্রই আগুন। পেশী এবং ধমনীতে কেমন টান টান উত্তেজনা বোধ করলাম, বাড়ীতে পৌঁছা মাত্রই এক্সপেরিমেন্ট হবে। ১ টাকা দিয়ে ৪ টি দিয়াশলাই কিনলাম, বাড়ীতে পৌঁছেই দিয়াশলাইয়ের সমুদয় বারুদ আলাদা করলাম। তারপর কবিরাজের দেখানো পদ্ধতিতে মধু মিশালাম। প্রথম বার ব্যর্থ হলাম, দ্বিতীয় বারও ব্যর্থ, তৃতীয়, চতুর্থ........বারংবার ব্যর্থ হলাম।

বুক ফেটে কান্না আসতে চাইল, বাবার মায়াবী মূখ খানা মনে পড়ল। কি অন্যায় না করেছি! না জানি কি শাস্তি পেতে হয়, অজানা আতঙ্কে শরীরের সমূদয় লোমকূপ খাড়া হয়ে গেল। ছাত্রজীবনে এর পরেও যত ধরনের মধু পেয়েছি, পরীক্ষা করেছি। মধূ ও মৌমাছির পিছনে পড়েই ছিলাম, প্রত্যয় ছিল কবিরাজের চালাকি উদ্ধার করবই। নিজেদের ফুল-ফলের বাগান ছিল, কিভাবে মৌমাছিকে আয়ত্বে এনে পদ্মমধু বানানো যায় ভেবেছি।

মৌমাছির সাথে মিতালী পাকিয়েছি; খালি হাতে, খালি গায়ে লক্ষ মৌমাছির বাসায় হাত ঢুকানোর কসরত করেছি। এসব দেখে পাহাড়িরা, দেবতা প্রদত্ত জ্ঞান মনে করে প্রনাম করতে দেখেছি। লন্ডন থেকে মৌমাছি সর্ম্পকিত বই যোগাড় করেছি, বাংলায় কোন বই তখনও বাজারে ছিলনা। বইয়ের প্রতিটি পাতা পড়েছি, কোথাও পদ্মমধুর বর্ননা পাইনি। যাক, অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষার পরেও মধু দিয়ে, বারুদে আগুন ধরাতে সক্ষম হলাম না।

আমার সকল এক্সপেরিমেন্ট ব্যর্থ হলেও কখন জানি নিজের অজান্তে, একজন সৌখিন মধুচাষী বনে যাই। ছাত্রজীবন এবং দেশের চাকুরী জীবনের সকল অধ্যায়ে যেখানে আমি থাকতাম; সাথে একখানা মৌমাছির বাসা সখের বশতঃ সাথে রাখতাম। হারানো যৌবন খাড়া করার নিমিত্তে জহুর আলী, পদ্মমধুর যে ৪ টি শিশি খরিদ করেছিলেন। কবিরাজের কথামত সে রিতীমত পান করে যাচ্ছিলেন। যথাসম্ভব পাখির গোশতও খাচ্ছিলেন।

প্রথম কয়েকদিন চড়ুই, ঘুঘু, শালিক, বক, ডাহুক দিয়ে কাজ সমাধা করলেন। কয়েকদিনে জহুর আলীর মতি-গতি সব পাখিরা বুঝে ফেলে। এতে পাখিগুলো নিজেদের রক্ষার্থে হুঁশিয়ার হয়ে গেল। তখনকার গ্রামীণ জীবনে পাখি প্রচুর পরিমানে থাকলেও, তাদের ধরাটা খুবই দূরহ ছিল। ওদিকে যৌবন গঠনে জহুর আলীকে পাখির গোশত খেতেই হবে।

অবশেষে জহুর আলী উপায়হীন হয়ে, তার অনুকূলে যে পাখি পাচ্ছিল, তাকেই বধ করা শুরু করল। চন্দনা, দোয়েল, শ্যামা, টিয়া সহ নাম না জানা সব পাখি তার খাদ্যে বস্তুতে পরিনত হল। সাধারনত এসব পাখীর মাংশ তিক্ত ও কটু স্বভাবের বলে, গ্রামীন জনজীবনে এই পাখিগুলো কেউ খায়না। এলাকার মুরুব্বীরা নিষেধ করল, একাজ করনা, বদদোয়া পড়বে। দীর্ঘস্থায়ী যৌবনের আকাঙ্খায় আপ্লুত জহুর আলীর বদদোয়ার ভয় পেলে কি চলে? জহুর আলীর কাজ জহুর আলী করে।

কিছুদিন পর হঠাৎ জহুর আলীর শরীরে কিছু অস্বাভাবিক পরিবর্তন দেখা দিল। স্বল্প চুলের অধিকারী জহুর আলীর মাথার অবশিষ্ট চুলও কোথায় যেন উধাও হয়ে গেল। দুঃচিন্তাগ্রস্থ টাক পড়া জহুর আলীর আরো দুঃখ বাকী ছিল। এক সপ্তাহের মধ্যে আস্তে আস্তে দু’চোখের ভ্রু’গুলো সমূলে উৎপাটিত হল। মোঁচ-দাড়ি সম্পূর্ন্ন মূলোৎপাটিত হলনা বটে, তবে কোথাও কিছু অবশিষ্ট থাকল, কোথাও সম্পূর্ন্ন পড়ল।

ফ্যাসফেসে চেহারার জহুর আলীকে কিম্ভূতকিমাকার দেখাল। হঠাৎ দেখলে মনে হয় মাথার খুলির উপর গাম দিয়ে, চামড়া লেপটে দেয়া হয়েছে। মনের দুঃখে, ক্ষোভে, অপমানে জহুর আলী গ্রাম ছেড়ে তাদের খামার বাড়ী পাহাড়ে চলে গেলেন। ওদিকে হবু শশুড় মেয়ের এনগেজমেন্ট ভেঙ্গে দিল, সে আর জহুর আলীকে মেয়ে বিয়ে দিবেনা। বেচারা জহুর আলীর পিতা-মাতা বহু যায়গায় ধর্না দিয়েও তার জন্য আরেকটি মেয়ে জোগাড় করতে পারেনি।

গ্রামের একমাত্র বোবা মেয়েটির দিকে মুরুব্বীরা ইঙ্গিত দিল, জহুর আলী আমতা-আমতা করে অবশেষে রাজি হল। দু’পক্ষেই বিয়ের প্রস্তুতি শুরু হল, বোবা মেয়ে বুঝতে পারেনি তাকে নিয়ে ঘরে কি হতে যাচ্ছে। দিন কয়েক পর বোবা বুঝল তাকে বিয়ে দিতে যাচ্ছে, জহুর আলীর কাছে। বোবা এটা বুঝতে পেরে তার পিতা-মাতার উপর ভয়ানক ক্ষেপে গেল। জহুর আলীর পিতা-মাতাও বোবাকে বুঝাতে চাইল, উল্টো বোবা দা নিয়ে কোপাতে গেল, সর্বোপরি জহুর আলীর এ বিয়েও ভেস্তে গেল।

বাকী জীবনে জহুর আলী আর বিয়ে করতে পারেনি। জানিনা জহুর আলীর মত আর কতজন এভাবে বিয়ে না করে চির যৌবন ধরে রাখতে পেরেছিল। বৃদ্ধ বয়সেও গায়ে-গতরে জহুর আলীকে সুস্থ-সামর্থ্যবানের মত দেখাত। কবিরাজ আলী মিয়া’র পদ্মমধুর রহস্য উদ্ধারঃ উদ্ভিদ বিদ্যা, প্রাণী বিদ্যা, রসায়ন বিদ্যা বরাবর আমার প্রিয় বিষয় ছিল। কলেজ জীবনে পড়ার সময়, একই সাথে ইউনানী কলেজে ইউনানী বিষয়েও পড়াশুনা শুরু করলাম।

উদ্দেশ্য, বোটানী তথা উদ্ভিদ বিদ্যা ও ইউনানী বিদ্যা, এই দু’টি বিষয় কিভাবে মানুষের কাছে ধারনা দেয়, তা জানা। একটু জেনে রাখা ভাল, আয়ূর্বেদ পাশ করে কবিরাজ হয়, ইউনানী পাশ করে হাকিম হয়। আর্য়ূবেদের জন্ম ভারতে, এই চিকিৎসা শাস্ত্রের সমূদয় তৈজসপত্র ভারতীয় উপমহাদেশের সর্বত্র পাওয়া যায়। ইউনানীর জন্ম গ্রীসে, আরবীতে গ্রীসকে ইউনান বলে। মুসলমানদের সোনালী যুগে মুসলিম চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের হাতে এই চিকিৎসা ব্যবস্থা যথেষ্ট বুৎপত্তি অর্জন করে।

এই চিকিৎসা পদ্ধতি মুসলিম দেশে দেশে সমাদৃত হয়। ফলে ইউনানী চিকিৎসার তৈজস পত্র কোন একক দেশে সীমাবদ্ধ রইলনা। এই চিকিৎসার ধরন প্রায় এলোপ্যাথী চিকিৎসা পদ্ধতির মতো। আয়ুর্বেদীয় ঔষধ তৈরীর পদ্ধতিতে, পঁচন পক্রিয়ার মাধ্যমে তরলে এলকোহল সৃষ্টি করে; ছাঁকন পক্রিয়ার মাধ্যমে সেখান থেকে ঔষধী তরল আলাদা করা হয়। এখানে সেটাই মূল ঔষধ।

ইউনানী এক্ষেত্রে যন্ত্রপাতির সাহয্যে বাষ্পীকরনের সাহায্য নেয়, যে প্রণালী এলোপ্যাথী চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে থাকে। যাক, এই দুটি শাস্ত্রই বর্তমান দুনিয়াতে প্রভূত উন্নতি শুরু করেছে। আমি রসায়নের ছাত্র বলে ইউনানীর পরীক্ষা-নিরীক্ষা গুলো, রসায়নের আধুনিক পদ্ধতিতে করতাম। নিজের ছোট্ট ল্যাবরেটরীও ছিল, সেখানে পরীক্ষার একপর্যায়ে দেখলাম পটাশিয়াম পারম্যঙ্গানেট ও গ্লিসারিনের মধ্যে রসায়নিক বিক্রিয়া ঘটছে। মনে পড়ে গেল বহুদিনের পুরানো ঘটনা।

সাথে সাথেই কাগজ নিলাম, পটাশিয়াম পারম্যঙ্গানেট রাখলাম কাগজে। গ্লিসারিন ফোঁটা ঢাললাম, ঠিক সেভাবে যেভাবে কবিরাজ আলী মিয়া করেছিল। নিজের চোখ দু’টুকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, সাথে সাথেই কাগজের পুটলীতে আগুন ধরে গেল। অবশেষে রহস্যের একটি কিনারা হল। এখানে রহস্যময় ব্যাপার ছিল, আলী মিয়া যেটাকে বারুদ বলেছিল, সেটা ছিল এই পটাশিয়াম পারমাঙ্গানেট।

দুটোর রং কাল, দূর থেকে দেখতে একই ধরনের দেখায়। যেটাকে আলী মিয়া পদ্মমধু বলেছিল, সেটা ছিল গ্লিসারিন, রাত্রে হ্যাজাক লাইটের আলোতে তার রং বুঝা যায়নি। তাছাড়া পদ্মমধুর রং-বর্ণ উপস্থিত সবার কাছেই অপরিচিত ছিল। গ্লিসারিনের ধর্ম হল, মুখে নিয়ে বাতাস ছাড়লে জিহবায় গরম লাগে। এই দুটো জিনিষ ফার্মেসীতে খুবই সস্তায় পাওয়া যায়।

গ্লিসারিনকে একটু তরল করতে মিশানো হয়েছিল, নিরপেক্ষ স্বভাবের সস্তা প্যারাফিন তৈল। জালীয়তির উদ্দেশ্যে যা সাধারনত মিশানো হয় আঁতরের পরিমান বৃদ্ধিতে। সম্ভবত এই প্যারাফিনও মিশ্রন করা হয়েছিল কবিরাজ আলী মিয়ার পদ্মমধুতে। বহু বছর পরে মহাপ্রতারক পদ্মমধু বিক্রেতা কবিরাজ অপর এক আলী মিয়াকে আবিষ্কার করলাম। কবিরাজ নামধারী প্রতারক নিজে দামী জিপ নিয়ে এসেছিলেন, গায়ে ছিল দামী কোট, মাথায় আমেরীকান কাউবয়ের টুপি, দামী হ্যাজাক লাইটের আলোতে মধু বিক্রির পসরা সাজিয়েছিলেন।

কথার উচ্চারন ও বাচন ভঙ্গি খুবই সুন্দর। সে ছিল শিক্ষিত, তবে তার শিক্ষায় হৃদয় ছিলনা, অন্তরে অনুভূতি ছিলনা, ছিলনা আত্মার পরিশুদ্ধি। ফলে আলী মিয়া কবিরাজ না হয়েও, গ্রামের সোজা, অশিক্ষিত ব্যক্তিদের সাথে চরম প্রতারণা করতে তার বিবেক রুদ্ধ হয়নি। বর্তমানে আমাদের দেশে সর্বত্র প্রতারণার সয়লাব হয়েছে। বরং শিক্ষিত প্রতারকেরা আরো মারাত্মক, নতুন ও অভিনব কৌশল গ্রহন করে।

আলী মিয়ারা শিক্ষাকে যেভাবে প্রতারণার কাজে ব্যবহার করেছেন বর্তমানে কি তার হেরফের হয়েছে? ফরমালীনের মত মারাত্মক বিষ খাবারের সাথে মিশানো হচ্ছে। কাপড়ের রং খাদ্য রাঙ্গাতে ব্যবহার চলছে। খাদ্য রুচিকর করতে টেষ্টিং সল্ট তথা এজিনো মটো খাওয়ানো হচ্ছে। এর সবই প্রতারণা! বর্তমান শিক্ষায় মানুষের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যবোধ সৃষ্টি হচ্ছেনা, সৃষ্টির প্রতি মায়া জন্মাচ্ছেনা, আত্মা প্রাণশুন্য হয়ে যাচ্ছে। আর এসব গুণ একমাত্র ধর্মীয় শিক্ষা থেকে জাগ্রহ হয়।

সকল ধর্মই ভাল শিক্ষা দেয়। ধর্ম শিক্ষা বিবেকবোধ জাগ্রত করে, অন্তর পবিত্র করে, আত্মা কূলষমুক্ত করে সর্বোপরি সৃষ্টির সবকিছুকে মায়া করতে শিক্ষা দেয়। আলী মিয়া কাবিরাজের শঠতায় আমি না হয়, মৌচাষী হয়েছি। তবে জহুর আলী চিরতরেই যৌবন হারিয়েছে। জহুর আলীকে যুবক অবস্থায় দেখেছি, পৌঢ় আবস্থায় দেখেছি, বৃদ্ধ অবস্থায়ও দেখেছি, শেষ জীবনে নিঃসঙ্গ অবস্থায় কাটাতে দেখেছি।

চির যৌবনের ঢেউ গায়ে লাগানোর যে আখাঙ্কা-উদ্দীপনা তার অন্তরে ছিল। প্রতারণার পদ্মমধু তাকে চির নিঃস, অসহায় আর একাকী করেছিল। এ পৃথিবী অনেক বড়, পৃথিবীতে এখনো অনেক মেয়ে আছে কিন্তু পৃথিবী জহুর আলীর জন্য অনেক ছোট্ট হয়ে গিয়েছিল, ঠাট্টার ছলেও তার দিকে কোন মেয়ে ভালবাসার হাত প্রসারিত করেনি, এমনকি একজন অসহায় বোবাও নয়। (ই-মেইল থেকে পাওয়া। লেখক: জনৈক নজরুল ইসলাম টিপু )


সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.