আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পাঁচ পরহেজগার ব্যক্তির গল্প (শেষ অংশ)

যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে, ঘড়ির ভিতর লুকাইছে

ইহুদীর গৃহে আশ্রয়ের প্রশ্নে ঈমানী জোশ আর তাকতের কারণে উত্তেজিত মুসাফিরগণ ক্লান্তি ভুলিয়া যথেষ্ট পরিমাণ তর্কে লিপ্ত হইলেও, আশ্রয় লইবার ফয়সালায় উপনীত হইবার পরই প্রথম তাহারা অনুধাবন করিতে সক্ষম হইলো যে কিরূপ ভয়াবহমাত্রার ক্লান্তিতে তাহারা আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে। বস্তুতঃ মরূর বুকে আহার এবং পানীয়বিহীন অবস্থায় অনবরত তিন রাত্রি আর চারদিবস ধরিয়া পথচলার ফলে তাহাদের কেহ যদি মৃত্যুর কোলেও ঢলিয়া পড়িত তাহাতেও আশ্চর্য হইবার কিছু থাকিতোনা। মুসাফিরগণের এহেন নিদারূণ শারীরিক অবস্থা দেখিয়া গৃহস্বামী আঁচ করিতে পারিলেন যে উহাদিগকে শীঘ্রই খাদ্য আর পানীয়ের সরবরাহ করিতে হইবে। একই সঙ্গে আরব দেশের রীতির লংঘন ঘটাইয়া মুসাফিরগনের আমীর কাজী আল মকসুদ মুখ ভাঙিয়া বলিয়াও ফেলিলেন, "জনাব, তিনরাত্রি আর চার দিবস ধরিয়া উপবাস করিতেছি। গৃহে খাদ্য যাহাই থাকে, সত্ত্বর উহা দিয়াই আমাদের চলিয়া যাইবে।

" অন্য কোনসময় হইলে মুসাফিরগণের এহেন বায়নার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনমতো যথাযথ খাদ্যের যোগান দিতে ইহুদী গৃহস্বামীটির কোন অসুবিধা হইতোনা। কিন্তু ঐদিনটি ছিলো আর দশখানা দিন হইতে আলাদা। যাহার জন্য নতুন করিয়া আরেকখানা সমস্যা দেখা দিয়া বসিলো। কোন ধরনের সমস্যা তাহা ব্যাখ্যা করিবার পূর্বে ইহুদীর জীবিকানির্বাহের উপায় সম্পর্কে খানিকটা পরিচয় করিয়া দেওয়া যাক। ইহুদী পশুপালন করিয়া জীবিকা নির্বাহ করিত।

ছোট্ট মরূদ্যানে ফসল ফলাইয়া পোষায়না, নানা রকমের পশু পালন করিয়া, দূরের লোকালয়ে নিয়া উহাদের বিক্রয় করিয়া খাদ্যশস্য ক্রয় করিয়াই তাহাকে জীবিকা নির্বাহ করিতে হইতো। দূর্ভাগ্যবশতঃ তাহার অতিশয় ক্ষুদ্রাকৃতি মরূদ্যানে যেই পরিমাণ উদ্ভিজ্জ জাতীয় খাদ্যশস্য জন্মাইতো তাহা দিয়া খোঁয়াড়ের পশুদিগের যথেষ্ট পরিমাণ আহার্যের সংস্থান হইতোনা। ফলতঃ ইহুদীর দুইপুত্র কিছুদিন পরপর খোঁয়াড়ের উট আর দুম্বাদিগকে লইয়া কয়েকক্রোশ দূরের আরেকখানা বড় মরূদ্যানে চলিয়া যাইতো, ঐখানে কয়েকখানি দিবস ধরিয়া যথেষ্ট পরিমাণ আহার করাইয়া তবেই আবার পশুর পাল লইয়া ফিরিয়া আসিত। বস্তুতঃ মুসাফিরেরা যেইদিন অপরাহ্নে আসিয়াছিলেন, সেইদিন প্রভাতেই ইহুদীর পুত্রদ্বয় পশুর পাল লইয়া দূরের বৃহদাকার মরূদ্যানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইয়া পড়িয়াছিলো। যেহেতু পুত্রদ্বয় রুটি খুব পছন্দ করিত, সেইহেতু তাহাদিগের মাতা ঘরের যবের রুটিগুলিকে পোটলায় বাঁধিয়া তাহাদের সহিত দিয়া দেয়।

ঐদিকে উট আর দুম্বারাজি লইয়া যাইবার ফলে ইহুদীর খোঁয়াড়ে সেইদিন শুয়োর ছাড়া আর কোন প্রাণী অবশিষ্ট থাকিলোনা। বাস্তবে সেই দিন দ্বিপ্রহরেই একখানা শুয়োর জবাই করিবার ফলে তাহার হেঁশেলে পাঁচ অতিথিকে কয়েকদিন ধরিয়া আপ্যায়ন করিবার মতো অঢেল পরিমাণ মাংস মজুত ছিলো। এমতাবস্থায় ত্বরিৎ খাবারের আয়োজন করিতে হইলে শুয়োরের মাংস ঝলসাইয়া দেওয়া ছাড়া ইহুদী গৃহস্বামীটির আর কোন উপায়ন্তর ছিলোনা। গৃহস্বামী নিজে ইহুদী হওয়ায় ইহুদীদের মতো মুসলমানেরাও যে শুয়োরের মাংস খায়না তাহা সম্পর্কে তাহার সম্যক ধারনা ছিলো। শুধু তাহাই নহে, জীবনের দায় পড়িলে মুসলমানদিগের ধর্মে যে শুয়োরের মাংস খাওয়া দুরস্ত, তাহাও সে জানিতো।

সেইজন্য, মৃতপ্রায় মুসাফিরদিগকে শুয়োরের মাংস দিয়া আপ্যায়ন করিলে যে মুসলমানের শাস্ত্রমতে কোন অসুবিধা হইবেনা এই ভাবিয়া ইহুদীটি শুয়োরের মাংস দিয়াই পাঁচ মুসাফিরকে আপ্যায়ন করিবার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে এইখানে তাহার অতিথিপরায়ণ সজ্জন মননের কারণে সে ভাবিলো, যদি ইহাদিগকে আমি বলিয়া দিই যে ইহাদিগকে শুয়োরের মাংস দিয়া আপ্যায়ন করা হইতেছে, তাহা হইলে উহাদের মধ্যে কেহ কেহ হয়তো উত্তেজিত হইয়া আহারই করিবেনা। আবার কেহ কেহ হয়তো আহার করিলেও জান বাঁচানোর নিমিত্তে সামন্যই আহার করিবে, তৃপ্তি মিটাইয়া খাইবেনা। এহেন ভাবনার উদয় হইবার পর তাহার মনে হইলো, কম বা বেশী যেই পরিমাণই গ্রহন করুকনা কেনো, যেহেতু ইহাদিগকে শুয়োরের মাংসই খাইতে হইতেছে, সেহেতু ইহাদিগকে শুয়োর সম্পর্কে আর কিছু না জানানোই ভালো। তাহা হইলে উহারা তৃপ্তি মিটাইয়া আহার করিয়া দ্রুত সূস্থ্য-সবল হইয়া উঠিবে।

পাপ যদি কিছু হইয়া থাকে তবে তাহার ভার সে নিজেই লইবে। স্বীয় পরিকল্পনা মোতাবেক গৃহস্বামী আর তাহার স্ত্রী মিলিয়া পাঁচ পরহেজগার মুত্তাকীর যথাযথ আপ্যায়ন করিলেন। ঝলসানো মাংসের পর রান্না করা মাংসের ঝোল আসিলো, সাথে আসিলো তুরস্ক দেশের মসলায় ঝলসানো সুস্বাদু কাবাব, কালিয়া, কোফতা, রেজালা এবং আরো নানাবিধ মাংসের পদ। বহুদিন পর এহেন রাজভোগ পাইয়া মুসাফিরেরা একটু বেশী করিয়াই তৃপ্তি মিটাইয়া পানাহার করিলেন। তাঁহাদের তৃপ্তির মাত্রা এতই বেশী ছিলো যে, ইহুদীর গৃহেও মহান আল্লাহ তায়ালা তাহাদের জন্য এইরূপ আতিথেয়তার তকদীর রাখিয়া দিয়াছেন বলিয়া খোদার দরবারে কৃতজ্ঞতা জানাইতে জানাইতে প্রচুর অশ্রুবিসর্জনও দিয়া ফেলিলেন।

শেখ তাজাম খাস দিলে খোদাতালার দরবারে এই বলিয়া প্রার্থনা করিলেন যে এহেন সৎ চরিত্রের অধিকারী ব্যক্তিকে যেন তিনি খাস হেদায়াত দান করেন। অনেকদিন পর যেন রাত্রিরে তাহাদের নিশ্ছিদ্র নিদ্রা সম্ভব হইলো। পরদিন প্রভাতে সূস্থ্যসবল হইয়া ওঠা পাঁচ মুসাফির আবারও মরূর পথে রওয়ানা হইবার সিদ্ধান্ত লইলেন। গৃহস্বামীর সহিত মুসাবিদা করিয়া তাহারা জানিতে পারিলেন যে ঈষাণ বরাবর দশ ক্রোশ হাঁটিলেই মরূভূমি শেষ হইয়া যাইবে, তাহার পর তাঁহাদের নিজ শহর রামহান আর বেশী দূর নহে। ফলতঃ আর একদিবস এক রাত কষ্ট করিয়া হাঁটিলেই তাহারা নিজ শহরে পৌঁছিয়া যাইবেন বলিয়া অনুমান করিলেন।

এক্ষণে গতরাত্তিরের সুস্বাদু ভোজনের সুখস্মৃতি আর তাহার পূর্বের কয়েকদিবসের অনাহারের তীব্র ভয়ংকর স্মৃতির যুগপৎ রোমন্থন করিয়া শেখ তাজাম কহিলেন, "আমীর ছাহেব, সকলে অনুমতি দিলে গৃহস্বামীটিকে আমি এই অনুরোধ জানাইতে চাহি যে, আমাদিগের সহিত একখানা পোটলা করিয়া কিছু গোশ্ত দিয়া দেওয়া হউক। তাহা হইলে অদ্যকার পথচলার ক্লান্তিখানিও কিছুটা লাঘব হয়। " ইহুদীর আতিথ্য যখন গ্রহন করিয়া ফেলিয়াছেনই, তখন তাহার নিকট হইতে কিছু মাংসগ্রহনে আর কি সমস্যা হইবে এই ভাবিয়া বাকীরাও শেখ তাজামের বক্তব্যে সায় দিলেন। কাজী আল মকসুদ গৃহস্বামীটিকে ডাকিয়া কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনপূর্বক তাঁহাদের মনোবাঞ্ছার কথা ব্যক্ত করিলেন। কিন্তু উহা শুনিয়া গৃহস্বামীর মুখ পাংশুবর্ণ ধারণ করিলো।

গৃহস্বামী ভাবিয়াছিলেন যে গতকাল সন্ধ্যায় ইহারা মৃতবৎ ছিলো, আহার না করিলে ইহাদের মৃত্যুও হইতে পারিত। এমতাবস্থায় ইহাদিগকে শুয়োরের মাংস খাওয়ানো দুরস্ত হইলেও, এক্ষণে এহেন তরতাজা মুসলিমদিগকে শুয়োরের মাংস খাওয়ানো অনুচিত হইবে। সে মুসাফিরদিগের নিকট ক্ষমাপ্রার্থনাপূর্বক শুয়োরের মাংসবিষয়ক যাবতীয় সত্য তুলিয়া ধরিলো। সব শুনিয়া আবু উবিলা রাগে উন্মাদপ্রায় হইয়া পড়িলেন। উত্তেজনার আতিশয্যে তাঁহার মুখ হইতে কথা সরিতেছিলোনা, পাশবিক ক্রোধে তাঁহার শশ্রূরাজীর চারিপার্শ্ব ফেনায়িত হইয়া যাইতে লাগিলো।

শেখ তাজামের অবস্থা আরো করুণ রূপ ধারণ করিলো। তাঁহার রাগ কম, কিন্তু কুসংস্কার বড়ও তীব্র। হঠাৎ করিয়াই তাঁহার পাকস্থলীতে তীব্র বেদনা অনুভব করিতে লাগিলেন, ঘড়ঘড় করিয়া বমি করিয়া ইহুদীর উঠানের একাংশ ভাসাইয়া দিলেন। ইবনে আআ'মের চেহারায় কোন ক্রোধের অভিব্যক্তি না দেখা দিলেও মনে মনে তিনি আল মকসুদের উপর ভীষন ক্রোধ অনুভব করিতে লাগিলেন, একই সাথে তাঁহার মুজাকারা আমলে না লইয়া ইহুদীর গৃহে আশ্রয় লইবার ফয়সালা দেয়ার কি খেসারত এক্ষণে দিতে হইতেছে তাহা ভাবিয়া মনে মনে আল মকসুদের উদ্দেশ্যে "এক্ষনে বাহাদুর, সামলাও!", বলিয়া খানিকটা আনন্দও অনুভব করিলেন। সাইয়িদ নাজা'ককে দেখিয়া মনে হইয়াছিলো যে তিনি খানিকটা বিব্রত বোধ করিতেছিলেন, সম্ভবতঃ গতরাত্তিরে ঐভাবে পেট ভরিয়া তৃপ্তির সহিত খাদ্যগ্রহনের স্মৃতি তাঁহাকে বিব্রত করিয়া তুলিয়াছিলো।

আবু উবিলা রাগে কাঁপিতে কাঁপিতে কহিলেন, "আমি তো আগেই বলিয়াছিলাম মুহতারামগণ, এই ইহুদী বদমাশকে খানিকও বিশ্বাস করা ঠিক হইবেনা। খোদার কসম, এই মুহূর্তে ইহার গৃহে অনুসন্ধান করিলে উষ্ট্র আর দুম্বার গোশতও মিলিবে। আমি নিশ্চিত এই পাপিষ্ঠ ইচ্ছা করিয়াই আমাদিগকে শুয়োরের মাংস খাওয়াইয়া, এক্ষণে আবার তাহা বলিয়া দিয়া মজা লুটিতেছে। কসম খোদার, ইহুদীরা এইভাবেই আমাদিগের মুসলমানদের সরলতার সুযোগ লয়!" আবু উবিলার রুদ্রমূর্তি দেখিয়া ইহুদী গৃহস্বামী ভয়ে এইটুকুন হইয়া পড়িলেন। কাজী আল মকসুদ ইশারায় তাহাকে আশ্বস্ত করিলেন, নির্ভয় দিলেন।

কিন্তু কাজীর এহেন ইশারাকে ইঙ্গিত করিয়াই খানিকটা শ্লেষের সহিত শেখ তাজাম কহিতে লাগিলেন, "আমাদিগের আমল আকীদা সব ভাসাইয়া দিলো, আর আপনি উহাকে সাহস দিতেছে!" বলিতে বলিতে তাঁহার উত্তেজনা খানিকটা বাড়িয়া গেলো, তিনি কহিতে লাগিলেন, "হাদীস শরীফে আছে শরীরের যেই অংশ হারাম খাইবে উহার ইবাদত কবুল হইবেনা। এক্ষণে আপনি আমাকে বলেন আমার এই শরীরের রক্তে ছড়াইয়া পড়া অভিশপ্ত শুয়োরের মাংস লইয়া আমি কিরূপে খোদার নবীর সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইবো?" বলিতে বলিতে তাঁহার আবারও বমির উদ্রেক হইলো, তাহা সামলাইতে সামলাইতে ইহুদীর দিকে তাকাইয়া কহিতে লাগিলেন, "আতিথ্য গ্রহনের পরও তোমাদিগকে মুখ ফুটাইয়া ধন্যবাদ জানাইনাই, মনে মনে খানিকটা সংকোচ ছিলো তাহা লইয়া। এক্ষনে তাহা তো নাই-ই, বরং তোমাকে লা'নত দিতেছি। হে পাপিষ্ঠ ইহুদীর সন্তান, তোমার হেদায়াতের জন্য খাসদিলে যে মোনাজাত করিয়াছি তাহা আবার ফিরাইয়া লইলাম! তোমার ওপর অভিশাপ বর্ষিত হউক। " শেখ তাজামের মতো বিনয়ী সজ্জন ব্যক্তির মুখে এহেন বক্তব্য শুনিয়া কাজী আল মকসুদ বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া ভ্রূ কুঁচকাইয়া তাহার দিকে তাকাইয়া রহিলেন।

উহা অবলোকন করিয়া এইবার মুখ খুলিলেন ইবনে আআ'ম, কহিলেন, "কাজী সাহেব, আপনার মতো বিচক্ষণ ব্যক্তিও যে ভুল করিতে পারে এই ঘটনা আমাদিগকে সেই শিক্ষাই দিলো। আপনি যেইভাবে চক্ষুগরম করিয়া আমার ভ্রাতা শেখ তাজামের দিকে তাকাইয়া আছেন, তাহাতে বুঝিয়া লওয়া যায় যে এই মগদুব ইহুদীর মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হইয়াছে। আমাদিগের উপকার অথবা জান বাঁচানো, এইসব কোন উদ্দেশ্যে সে আমাদিগকে আপ্যায়ন করেনাই, শুরু হইতেই সে চাহিয়া আসিয়াছে আমাদিগের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির। আর এক্ষণে তাজামের প্রতি আপনার রুদ্র দৃষ্টি তাহাই প্রমাণ করে। " এক্ষণে সাইয়িদ নাজা'কও বুঝিলেন যে আর কাজী মকসুদ বা ইহুদীর পক্ষে থাকা ঠিক হইবেনা, তিনি কহিতে লাগিলেন, "বুঝিলাম, জান বাঁচানোর জন্য শুয়োরের মাংস আহারেও নিষেধ নাই; কিন্তু জনাবেরা, আপনারা কেহ কি নিশ্চিত করিয়া কহিতে পারেন যে গতরাত্তিরে আমরা যদি শুধু পানি পান করিয়াই নিদ্রা যাইতাম তাহলে আমরা মৃত্যুর কোলে ঢলিয়া পড়িতাম?" খানিকটা দম লইয়া তিনি আবারও বলিতে থাকেন, "বস্তুত হায়াত মউত তো আল্লাহর হাতে, তাহলে আমরা কিসের ভিত্তিতে শুয়োরের মাংস খাইতে পারি? আর তাহা ছাড়া এই ইহুদী পাষন্ড যে ইচ্ছা করিয়া আমাদিগকে শুয়োরের মাংস খাওয়ায়নাই তাহার প্রমাণ কি? সে কেন আমাদিগকে খাওয়া আরম্ভ করিবার পূর্বে জানাইলোনা?" এক্ষনে দুরুদুরু বক্ষে ইহুদী মুখ খুলিলো, কহিলো, "জনাবেরা, আমি ভাবিয়াছিলাম শুয়োরের মাংসের কথা জানাইয়া দিলে আপনারা খাদ্যগ্রহনে আগ্রহ দেখাইবেননা।

" এক্ষনে কাজী তাহার দিকে তাকাইয়া কহিলেন, "আপনার সদুদ্দেশ্যকে আমি অস্বীকার করিতেছিনা, কিন্তু তাহার পরেও জানাইয়া রাখিলে এহেন অহেতুক পরিস্থিতি হইতোনা। " বলিতে বলিতে তিনি স্বীয় কাফেলার লোকদিগের দিকে তাকাইলেন, কহিলেন, "যাহাই হউক, যেহেতু আমার সিদ্ধান্তেই আমরা এই ইহুদীর আশ্রয় গ্রহন করিয়াছি, তাই সমস্যা সমাধানের দায়ও আমার। আগে আমরা নিজ শহরে ফিরি, তাহার পর সকলে মিলিয়া সিদ্ধান্ত লইবো যে কি করা যায়। " এই বলিয়া পরিস্থিতি আপাততঃ শান্ত করিয়া কাজী আল মকসুদ মুসাফিরদিগকে শহর অভিমুখী করিতে সক্ষম হইলেন বটে, তবে শহরে ফিরিবার পর যে আরেকখানা জটিলতর পরিস্থিতিতে তাঁকে পড়িতে হইবে সে বিষয়ে তাঁহার বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইলোনা। প্রভাতে রওয়ানা দিয়া সেই রাত্তিরেই তাঁহারা নিজ শহর রামহানে আসিয়া পৌঁছান।

কপালগুণে রাত্তিরের অন্ধকারে শহরে প্রবেশের ফলে তাঁহাদের জীর্ণশীর্ণ চেহার লোকের নজরে পড়েনাই, সফরের ভয়াবহতা সম্পর্কে শহরের লোকের কোন ধারনাই হয়নাই। পরবর্তীকালে তারিখ আল সফর লিল সিনদাদে লিপিবদ্ধ না করিলে হয়তো এই সম্পর্কিত অনেক কিছুই লোকের অজানা থাকিয়া যাইতো। পরদিন প্রভাতে বহুদিন পর দরবারে আসিয়া কাজীর চক্ষু চড়কগাছ হইয়া যায়। তাঁহার দরবারমহলের সম্মুখের সড়কখানি লোকে লোকারণ্য। ভীড় ঠেলিয়া স্বীয় দরবারে প্রবেশ করিয়া তিনি অবলোকন করেন যে চার গোত্রপতি সেইখানে ভোর হইতেই আসিয়া উপস্থিত।

সাধারণ সম্ভাষনপূর্বক কাজী তাহাদিগকে বলিলেন, "এত তাড়ার তো কিছু আছিলোনা, মুহতারামগণ। আপনারা খানিকটা বিশ্রাম লইয়া তবেই আসিতে পারিতেন। " "জনাব, আপনার কাছে উহার গুরুত্ব না থাকিলেও আমাদের কাছে উহা জীবনের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়!" বলিয়া ইবনে আআ'ম বাকী সভাসদদের পানে চাহিলেন। সকলেই একসাথে ইবনে আআ'মের কথায় সায় দিলেন। তবে তাহাদের সায় ঐ পর্যন্তই ছিলো।

তাহার পর ইহুদীর শুয়োরের মাংসভক্ষন বিষয়ক ঘটনার দফারফা হিসেবে চার গোত্রপ্রধানের তরফ হইতে চার ধরনের ফয়সালার দাবী আসিলো, এবং দ্বিপ্রহরের আহারের নিমিত্তে যখন কাজী দরবার ছাড়িয়া নিজ গৃহের পানে রওয়ানা হইলেন, তখন বাহিরে দাঁড়ানো কাতারে কাতারে মানুষের মুখেও তিনি ঐ চার ধরনের দাবীর কথা শুনিতে পান। আবু উবিলা ও তাঁর গোত্রের দাবী হয় এই যে, ঐ অভিশপ্ত ইহুদীর মৃত্যুর পরোয়ানা জারী করা হউক। তাহার পর তাহাকে ও তার স্ত্রীকে বাঁধিয়া শহরে লইয়া আসিয়া, শহরবাসীর সম্মুখে মৃত্যদন্ড দেয়া হউক। তবে এই প্রস্তাবের সাথে আবু উবিলা এও জানাইয়া রাখেন যে, তাঁহার প্রস্তাব কাজী সাহেব গ্রহন করেন তো ভালো। তা না হইলে যাহা ব্যবস্থা লইবার তাহা লইবার মতো লোক, অর্থ আর অস্ত্রবল তাঁহার নিজেরই আছে।

ইবনে আআ'ম বলিলেন, শুধু একজন ইহুদী বা তার পরিবারকে হত্যা করিলে এই সমস্যার কোন সমাধান হইবেনা। যেহেতু ইহুদীর বাসস্থান ইসলামী রাষ্ট্রের অধীনে পড়েনা, সেহেতু সবার আগে যাহা করিতে হইবে তাহা হইলো শহর হইতে সৈন্য পাঠাইয়া ঐ মরূদ্যান আর তাহার আশেপাশের সবকয়টি মরূদ্যান দখল করিয়া ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম করা। তাহর পরের কর্মটি হইবে ঐসব অঞ্চলে শুয়োরের খোঁয়াড়গুলি সব পুড়াইয়া নষ্ট করিয়া ফেলা। তাহার পর ইহুদীকে শাস্তি দেয়া, তবে মৃত্যুদন্ডের বিরুদ্ধেই তাহার মত। বরং, এইখানে ইবনে আআ'ম এই দাবী জানাইয়া রাখেন যে, ইহুদীর কূটচালের চাইতেও কাফেলার আমীর কাজী আল মকসুদের ব্যর্থতাকেই তিনি বড় বলিয়া মনে করেন।

ফলতঃ কাজী সাহেবের পদত্যাগপূর্বক তাঁহার নিজগোত্রের আবু নিমরকে কাজী নিয়োগের দাবীখানাও তিনি পেশ করিতে ছাড়েননাই। পরবর্তিতে আবু নিমরের ফয়সালা অনুযায়ী বর্তমান কাজীকে যে কোন প্রকারের শাস্তি মাথা পাতিয়া লইতে হইবে। অন্যদিকে শেখ তাজামের দাবীতে কোন ফয়সালার চাইতে আক্ষেপই বেশী ছিলো। বিশেষ করিয়া যদ্দিন পর্যন্ত এই শুয়োরের মাংসের একটি কণাও তাহার শরীরে অবশিষ্ট থাকিবে তদ্দিন পর্যন্ত তাঁহার কোন আ'মলই গৃহিত হইবেনা, তাহার শরীর হইতে তাহার স্ত্রী-সন্তানদের শরীরেও যে ঐ অপবিত্র খাদ্যকণা ছড়াইবেনা তাহার নিশ্চয়তা লইয়াও তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন। তিনি আরো দাবী করিয়াছিলেন যে, অপবিত্র খাদ্য গ্রহনের লা'নত হিসাবে তাঁহার নিজের গোত্রের লোকদের যদি শরীর খারাপ করে, রোগ-ব্যাধি ছড়াইয়া পড়ে তবে তাহার দায় ঐ অভিশপ্ত ইহুদীর সম্পদ হইতে ব্যবস্থা করিয়া দিতে হইবে।

আর সকলে যদি মনে করে এহেন অপকর্মের জন্য ইহুদইিকে মৃত্যদন্ড দেয়া উচিত তবে তাহাতে তাঁহার গোত্রের কোন আপত্তি নাই। সবশেষে জ্ঞানী সাইয়িদ নাজা'কও স্বীয় মতামত পেশ করেন, দাবী জানান যে ইহুদীকে তাহার কৃতকর্মের শাস্তি হিসাবে সসম্মানে মুসলিম হইবার আহবান জানানো হউক, এবং তাহার পাপের তওবা হিসাবে শহরের রাস্তায় প্রকাশ্যে জনসমক্ষে ক্ষমা চাওয়ানো হোক। তিনি জানান যে, যেহেতু শুয়োরের মাংস আহার করিলে নানবিধ রোগব্যধি হয়, সেইহেতু উহা ভক্ষণ করানোর জন্য ইহুদীকে শাস্তি দেয়া দুরস্ত। তবে ইহুদী যদি ইসলাম গ্রহনে অস্বীকৃতি জানায় তবে অবশ্যই তাহার শাস্তি বাড়াইয়া দিতে হইবে। সব শুনিয়া কাজী আল মকসুদ ভীষন মুষড়াইয়া পড়েন।

স্বীয় ইনসাফের বিচারে ইহুদী যে সদুদ্দেশ্যেই তাহাদিগকে শুয়োরের মাংসের কথা না পাড়িয়া আপ্যায়ন করিয়াছে তাহা বুঝিতে তাঁহার কোন অসুবিধা হয় নাই। বস্তুতঃ পরদিন প্রভাতে শেখ তাজাম যদি সঙ্গে লইবার জন্য কিছু মাংস না চাহিত, তাহলে তো ইহারা ঘুণাক্ষরেও টের পাইতোনা যে আগের রাত্তিরে তাহার কি খাইয়া আসিয়াছে। ইহাদের ইনসাফ দেখিয়া তিনি বিস্ময়ে বিমূঢ় হইয়া পড়েন, খানিকটা রাগন্বিতও হন। তবে দরবারের বাহিরে তাহাদের নিজ নিজ গোত্রের কাতারে কাতারে লোকের সমাগমে খানিকটা ভীত বোধ যে তিনি করেননাই তাহা নহে। ফলতঃ সেইদিন সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরিয়া তিনি বুঝিতে পারেন যে ইহার একখানা শাস্ত্রসম্মত ইনসাফমূলক ফয়সালা না করিলে ভীষন বিপদ হইবে।

এমনকি সারা শহরে মারামারিও ছড়াইয়া যাইতে পারে, কারণ সেইদিন বিকালেও তিনি দেখিয়াছেন যে গোত্রসদস্যরা নিজ নিজ গোত্রপতির ফয়সালার পক্ষ লইয়া পরস্পর ভীষন বিতর্কে লিপ্ত। বিতর্ক হইতে যুদ্ধ শুরু হইতে কতক্ষণ! শহরে ফিরিবার পর এইরূপ কঠিন সমস্যা যে খোদাতালা তাঁহার জন্য রাখিয়া দিবেন -- তাহা জানিলে হয়তো সফর আরো লম্বা করিতেই তিনি পছন্দ করিতেন। এহেন বড়মাত্রার সমস্যা না হইলেও, নানাবিধ মামলার ফয়সালা লইয়া মাঝেমাঝে তাঁহাকে উদ্বিগ্ন হইতে হয়, সবচেয়ে ইনসাফের ফয়সালা কি হইতে পারে তাহা লইয়া। এইরূপ ক্ষেত্রে কাজী সাহেব দশ রাকাত নফল নামাজ পড়িয়া আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করেন যাহাতে খোদাতা'লা স্বপ্নে তাহাকে সঠিক ফয়সালার পক্ষে কোন ইশারা দেন। পরবর্তীতে খোদাতালার ইশারা অনুযায়ী তিনি ফয়সালা জারি করেন।

সেইদিন সন্ধ্যায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করিয়া বিবিকে সমস্যার কথা অবগত করিয়া কাজী সাহেব নিজস্ব ব্যক্তিগত অন্দরে প্রবেশ করিলেন। কথিত আছে, সেইরাত্রি সারাটা সময় তিনি নফল নামাজ পড়িয়াছিলেন। ভোররাত্তিরে তাহাজ্জুদ পড়িবার পর তাঁহার বেগম যখন কাজী সাহেবের ব্যক্তিগত অন্দরে ঢোকেন, তখনও তিনি নামাজে। পরবর্তীতে শুইতে যাইবার আগে তিনি বেগমকে কহিয়াছিলেন যে, "বিবি সাফিনা, আমার মন বলিতেছে মহান রাব্বুল আলামীন আজ অবশ্যই একখানা ইনসাফের দিকনির্দেশনা দিবেন। " তবে আক্ষেপের বিষয় এই যে, পরদিন প্রভাতে দরবারে কাজী আল মকসুদ কি ফয়সালা দিয়াছিলেন তাহা আর জানা যায় নাই।

(শেষ) পরিশিষ্ট: ১। তারিখ আল সফর লিল সিনদাদের যেই একমাত্র কপিখানা বাগদাদের উপকন্ঠের একখানা লাইব্রেরীতে পাওয়া যায়, তাহা দেখিয়া বোঝা যায় যে উহার শেষ কয়েকখানি পাতা ছিঁড়িয়া ফেলা হইয়াছে। ইহুদীর ব্যাপারে কাজী আল মকসুদের ফয়সালার অংশটুকু যে ঐ ছেঁড়া পৃষ্ঠাসমূহের শুরুর দিকেই ছিলো, তাহা সহজেই অনুমেয়। ২। বাগদাদীয় সুলতান আল মুদীরের লাইব্রেরীতে তারিখ আল সফর লিল সিনদাদ সংরক্ষিত ছিলো।

উপযুক্ত সাক্ষীসাবুদ না থাকিলেও বর্ণিত আছে যে আল মুদীরের বড়পুত্র শাজাদা ইবনে তামীর ঐ তারিখের শেষ কয়েকখানি পাতা ছিঁড়িয়া নৌকা বানাইয়া খেলিয়াছিলো।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।