When a man has put a limit what he will do, he puts a limit in what he can do
এবারের সেমিস্টার ব্রেকে দেশে যাওয়া হচ্ছেনা, তাই আগে থেকেই ভাবনা-চিন্তা শুরু করেছিলাম, কিভাবে এই ২২টা দিন পার করব?? সিনিয়র ভাইয়াদের কাছ থেকে শুনলাম এ সময়টুকু হয় সবচাইতে বোরিং, খাওয়া-দাওয়া এবং ঘুম ছাড়া আর কোন কাজ নেই! তাই খুঁজে ফিরছিলাম কি করা যায়? সবচাইতে ভাল উপায় হচ্ছে ভার্সিটির কো-কারিকুলার এক্টিভিটিস এ যোগ দেয়া। সেমিস্টার ব্রেকের সময় একমাত্র ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরাই ক্যাম্পাসে থাকার অনুমতি পায়, লোকাল স্টুডেন্টদের নিজ নিজ বাড়িতে ফিরে যাওয়া বাধ্যতামূলক। যোগ দিলাম ওয়েলকামিং কমিটিতে। ওয়েলকামিং কমিটি হল ISD (International Student Division) এর অধীনে একটি স্টুডেন্ট গ্রুপ। এই গ্রুপের কাজগুলো হলঃ- ১) সারাবিশ্ব থেকে আগত নতুন ইন্টারন্যাশনাল ছাত্র-ছাত্রীদের এয়ারপোর্ট থেকে ভার্সিটিতে নিয়ে আসা, ২) এরপর নতুন স্টুডেন্টদের রেজিস্ট্রেশানের যাবতীয় কাজ সম্পন্ন করা, ৩) এরপর তাদের নিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান করা যেমন- Group Binding, Treasure Hunt, Grand Dinner, KL tour ইত্যাদি……
আমি ছিলাম Prep & Tech বিভাগে।
নতুন স্টুডেন্টদের রেজিস্ট্রেশান হল ১৩ এপ্রিল, এরপর থেকেই আমাদের কাজ শুরু। তবে তার আগে শুধু একটিই কাজ- এয়ারপোর্ট থেকে নতুন স্টুডেন্টদের নিয়ে আসা। রেজিস্ট্রেশান যেদিন হবে, মূলত তার ৭/৮ দিন আগ থেকে নতুন স্টুডেন্টরা আসা শুরু করে, এই সাতদিন ওয়েলকামিং কমিটির বিভিন্ন সদস্য KLIA (Kuala Lampur International Airport) গিয়ে নতুন স্টুডেন্টদের রিসিভ করে এবং আমার ডিউটি ছিল ১০ এবং ১১ এপ্রিল। সেই সুবাদে দেখা হয়ে গেল বিশ্বের সবচাইতে ব্যস্ততম এয়ারপোর্টগুলোর অন্যতম এই এয়ারপোর্টটি নিজ চোখে বাস্তবভাবে উপভোগ করার দারুণ এক সুযোগ!!!...........
আমার জীবনের KLIA অংশকে দু’ভাগে ভাগ করতে পারি- ১ম দেখা, ২য় দেখা……
১ম দেখাঃ
এর আগে শুধুমাত্র একবারই এখানে আসা হয়েছিল, যেদিন আমি নিজে নতুন ছাত্র হয়ে এদেশে এসেছিলাম! তখন মাত্র দু’ ঘণ্টা KLIA-তে থাকার সুযোগ হয়েছিল, এরপর তৎকালীন ওয়েলকামিং কমিটি আমাকে ভার্সিটি নিয়ে যায়। সেই প্রথম দিনেই KLIA এর সবকিছু দেখেই আমার মাথা ঘুরে গিয়েছিল, কিন্তু সত্যি কথা বলতে কি, সেদিন KLIA–কে যে অল্প কিছুক্ষণ দেখার অভিজ্ঞতা হয়েছিল, তা ছিল খুবই কম, মাত্র দু’ ঘণ্টা।
কিন্তু সেই “অল্প কিছুক্ষণ” এর মধ্যেই আমি মুখোমুখি হয়েছিলাম আমার জীবনের সবচাইতে আশ্চর্যকর কিছু ঘটনার……
২৭ জুন ২০০৯, ভোর ৭টা - ঘুম ভেঙ্গে গেল হঠাৎ, চোখ খুলে দেখি সকাল হয়ে গিয়েছে। Malaysian Airliners এর ফ্লাইট নং MH 147-এ, জানালার পাশে বসে আমি। প্রথম দেখাতেই মালয়েশিয়ার প্রেমে পড়ে গেলাম। আকাশ থেকে সকাল বেলার অদ্ভূত এক দৃশ্য!!! নিচে তাকিয়ে দেখি যেদিকে চোখ যায়, যতদূর চোখ যায়, শুধু সবুজ আর সবুজ…… এই সবুজের উপর ঠিকড়ে পড়ছে সূর্যের উজ্জ্বল সোনালী আলো!! সেদিনই আমি প্রথম দেখলাম, সূর্যের আলোর রঙ আসলে উজ্জ্বল সোনালী, দূষিত পরিবেশের কারণে মনে হয় বাংলাদেশে সূর্যের আলো হলুদ রঙের মনে হয়। অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম সূর্যের দিকে, আল্লাহর কি সৃষ্টি!!! আবার দৃষ্টি ফেরালাম নিচের সবুজের মধ্যে, এখন এই সবুজের মাঝে সুতোর মত চিকন কিছু দেখা যাচ্ছে! মনে হয় এটা রাস্তা…… প্লেন ধীরে ধীরে নিচে নামছে, পাইলট ঘোষণা করলেন, আর ১৫ মিনিটের মধ্যে প্লেন ল্যান্ড করবে KLIA-তে।
প্লেন যতই নিচে নামছে, সুতোর মত রাস্তাগুলো ততই মোটা হচ্ছে আস্তে আস্তে, ছোট্ট গাড়িগুলো দেখা যাচ্ছে, মনে হচ্ছে যেন পিঁপড়ের দল সারি বেধে কোথাও যাচ্ছে খাবারের সন্ধানে…… প্লেন ল্যান্ড করল ভোর ৭টা ৩০ মিনিটে……
প্রথম বিদেশের মাটিতে পা রাখা, অদ্ভূত এক অনুভূতি। KLIA এ দেখে আমি হতবাক, এত্তো বিশাল এয়ারপোর্ট…… কোন অভিজ্ঞতাই নেই এখন কোথায় যেতে হবে, তাই অন্যান্য যাত্রীর দেখাদেখি তাদের পিছু পিছু চলতে লাগলাম। বেশ কিছুদূর যাবার পর দেখলাম ট্রেনে করে আরো বহুদূর যেতে হবে এয়ারপোর্টের মূল অংশে যাবার জন্য। বেশ কিছুক্ষণ ট্রেনে করে যাবার পর পৌঁছলাম ইমিগ্রেশান ইউনিট এ। ঠিক তখনই ঘটল আমার জীবনের সবচাইতে বিস্ময়কর ঘটনাগুলোর একটি।
তবে তার আগে ফিরে যাই ঠিক ৬ ঘণ্টা পূর্বে……
HSIA (তৎকালীন ZIA)-তে ইমিগ্রেশানের লাইনে দাঁড়িয়ে আছি আমি। মালয়েশিয়া যাচ্ছে বেশিরভাগ যাত্রীই মূলত শ্রমিক এবং এ জন্যই মনে হয় ইমিগ্রেশান ইউনিট এর অফিসারদের আচরণও খুবই বাজে। অবান্তর এবং উদ্ভট সব প্রশ্ন করে যাত্রীকে কিভাবে বেকায়দায় ফেলা যায় এবং এরপর যাত্রীকে উল্টাপাল্টা বুঝিয়ে দিয়ে বলা হয় যে আপনাকে যেতে দেয়া হবেনা, কিছু টাকা-পয়সা দেন তাহলে ইমিগ্রেশান পার করে দিব। বেশিরভাগ যাত্রীই শ্রমিক বলে লেখাপড়া জানেননা এমন অনেকেই আছেন, তাদেরকে বোকা বানানো বেশি সহজ ইমিগ্রেশান ইউনিট এর পশুদের পক্ষে। আমি ইমিগ্রেশানের লাইনে দাঁড়িয়েই দেখছিলাম কিভাবে লাইনে আমার সামনে দাঁড়ানো এক যাত্রীকে এক মানুষরূপী পশু ইমিগ্রেশান অফিসার বেকায়দায় ফেলছিল, প্রথম বিদেশ যাত্রা বলেই আমি বেশ ভয় পাচ্ছিলাম ঐ যাত্রীর অবস্থা দেখে, ভেবেছিলাম ইমিগ্রেশান ইউনিটে মনে হয় এমন আচরণই করা হয় সবাইর সাথে।
পরে মনে হয় ঐ যাত্রীর কাছে বেশ টাকা-পয়সা চেয়েছিল ওরা। এরপর যখন আমার সিরিয়াল এলো, আমি বেশ ভয়ে ভয়ে সামনে গেলাম এবং পাসপোর্ট জমা দিলাম। ইমিগ্রেশান অফিসারটি পাসপোর্ট দেখে যখন বুঝতে পারলো যে এটাই আমার প্রথম বিদেশ সফর, চেষ্টা করলো এর সুযোগ নিতে। একের পর এক আমাকে প্রশ্ন করতে লাগলো আমার বাবার নাম কি, মায়ের নাম কি, গ্রামের বাড়ি কোথায়, বিদেশে কেন যাচ্ছি, কি করতে যাচ্ছি ইত্যাদি ইত্যাদি আরো অবান্তর বেশ কিছু প্রশ্ন সে আমাকে করে……. অথচ এসবকিছুই পরিষ্কারভাবে উল্লেখ করা আছে আমার পাসপোর্ট এবং ভিসায়। তবুও সে বলল তার মতে আমি যেতে পারবোনা, এরপর ইউনিভার্সিটি থেকে আসা অফার লেটারটি আমার কাঁধ ব্যাগ থেকে বের করে দেখালাম।
এরপর সে আমাকে ছাড়তে রাজি হল, দীর্ঘ ১২-১৫ মিনিট চেষ্টা করেও যখন সে এক যাত্রীকে আটকিয়ে তার থেকে কিছু আদায় করতে পারলোনা তখন তার চেহারা বেশ বিধ্বস্ত দেখা গেল। আমি তখন ভেবেছিলাম এটা মনে হয় ইমিগ্রেশানের স্বাভাবিক নিয়ম। কিন্তু ঠিক ৬ ঘণ্টা পর KLIA ইমিগ্রেশান ইউনিটে পাসপোর্ট জমা দিলাম, আমার পাসপোর্ট এবং ভিসা চেক করতে অফিসারটি সময় নিলেন মাত্র ৩০ সেকেন্ড! এরপর আমাকে পাসপোর্ট ফেরত দেয়ার সময় স্মিত হাসি হেসে বললেন,“Welcome to Malaysia. There’s an excellent environment of study waiting for you….. especially in your university. Try hard, may Allah bless you…..” উত্তরে আমি কিছুই বলতে পারলামনা, বলবই বা কি?? আমি তো বিস্ময়ে একদম বোবা হয়ে তাকিয়ে আছি অফিসারটির দিকে। আমি ভেবেছিলাম এখানেও বোধহয় আমাকে HSIA এর পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। এরপর আমি ধন্যবাদ জানিয়ে চলে এলাম।
২য় দেখাঃ
এবার আমি KLIA যাব একজন কমিটি মেম্বার হয়ে। মনের মধ্যে চাপা উত্তেজনা কাজ করছে। এত্তো নতুন স্টুডেন্টের সাথে দেখা হবে, কথা হবে…… নতুন স্টুডেন্টদের কৌতূহলী চাহনী এবং জিজ্ঞাসা সবসময়ই আমাকে বিমোহিত করে, তাদের সাথে অভিজ্ঞতা শেয়ার করার মধ্যে একটা আলাদা আনন্দ আছে।
১০ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৭টায় ভার্সিটি থেকে আমরা ৪ জন- আমি, মামুন (কাশ্মীর), রেজানুর (ইন্দোনেশিয়া), ইসমাইল (সোমালিয়া) ভার্সিটির বাসে করে রওয়ানা হলাম KLIA এর উদ্দেশ্যে যা ভার্সিটি থেকে প্রায় ৯০ কি.মি দূরে, মোটামুটি ৩৫-৪০ মিনিট লেগে যায়। রওয়ানা হয়েছি ১০ মিনিটও পার হয়নি, পৌনে ৮টায় মোবাইলে কল এলো, KLIA ল্যান্ড করেই কল করেছে এক বাংলাদেশী ছাত্র।
ইংরেজীতেই কথা হল তার সাথে, কারণ সে কল করেছিল ওয়েলকামিং কমিটির কাছে, আমার পার্সোনাল মোবাইলে নয়। ইচ্ছে করেই তাকে বলিনি যে আমিও বাংলাদেশী, ভাবলাম KLIA গিয়ে ওকে অবাক করে দিব।
প্রায় সোয়া ৮টায় গিয়ে পৌঁছলাম KLIA তে। ইতিমধ্যে কয়েকজন নতুন ছাত্র পেয়ে গেলাম। এর মধ্যে দু’জন দেখলাম বাংলাদেশী! ওরাও ওয়েলকামিং কমিটিতে একজন বাংলাদেশীকে দেখে মনে হয় বেশ খুশি হল এবং মনে কিছুটা জোর পেল।
আরো দু’জন স্টুডেন্ট পেলাম, একজন এসেছে দুবাই থেকে, কিন্তু সুদানের নাগরিক। এরপর নতুন ছাত্রদের সাথে খাওয়া-দাওয়া হল, ভার্সিটি নিয়ে গল্প হল, মালয়েশিয়া নিয়ে গল্প হল, যার যার দেশ নিয়ে গল্প হল…… সত্যিই নতুন স্টুডেন্টদের কৌতূহলী চাহনি আমাদের সবাইকে বেশ আনন্দ দিল।
এর ফাঁকে বাংলাদেশী দু’জনের সাথে ব্যক্তিগতভাবেও কথা হল। একজনের গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রাম, আরেকজনের নরসিংদী। কথা বলতে বলতে একসময় প্রসঙ্গক্রমে চলে আসলো দেশের এয়ারপোর্টে কোন সমস্যা করেছিল কিনা বিষয়টা…… বেশ কষ্টের সাথে তারা জানালো HSIA এর অবস্থা।
তাদের মুখে আবার শুনলাম সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি, যা ঘটেছিল আমার সময়। তবে এবার পরিস্থিতি আরো ভয়ানক। তাদের মধ্যে একজনের কাছে HSIA ইমিগ্রেশান ৭,০০০ টাকা দাবী করেছিল। তবে তার এক নিকটাত্মীয় এয়ারপোর্টের একজন কর্মকর্তা হওয়াতে তাকে কোন সমস্যা পোহাতে হয়নি, বরং ঘুষ চেয়ে ঐ কর্মকর্তা নিজেই নিজের বিপদ ডেকে এনেছিলেন।
…….ভেবে দেখলাম, একজন বিদেশগামী মানুষ, যে HSC পাশ করতে না করতেই, এত্তো অল্প বয়সে নিজের পরিবার-পরিজন, প্রিয় মানুষ, দেশ সবাইকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে বহু দূরে, এক অজানা ঠিকানায় এবং যাওয়ার কারণ শুধুমাত্র পড়ালেখা।
হয়তো তার মনে অনেক স্বপ্ন আছে একদিন দেশে ফেরত আসবে এবং দেশের জন্য নিজের সবকিছু বিলিয়ে দেবে, কিন্তু দেশত্যাগের সময়ই যদি কিছু নরপশুর কাছ থেকে এহেন ব্যবহার উপহারস্বরূপ পায়, দেশে ফিরে আসার আগ্রহ কি তার আদৌ থাকবে?? হয়তো থাকবে, কিন্তু মনে যে দাগ কেটেছে, তা আজীবনেও মুছে যাবেনা। বরং দেশের এয়ারপোর্টে এমন ব্যবহার পাওয়ার পর যখন বিদেশের মাটিতে পা রেখে সেখানকার এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশান ইউনিটের অফিসাররা তাকে বলে- “Welcome to Malaysia. There’s an excellent environment of study waiting for you….. especially in your university. Try hard, may Allah bless you…..” এই কথাগুলোই তার মনে গেঁথে থাকবে আজীবন। যা বারবার তাকে দেখিয়ে দিবে নিজ জন্মভূমির সাথে অন্য দেশের পার্থক্য……. :-((
………সেদিন বিকেল পর্যন্ত থাকলাম KLIA তে, যতজন নতুন স্টুডেন্ট আসলো তাদেরকে ভার্সিটি পাঠিয়ে দিলাম মামুনের সাথে। আমি, রেজানুর & ইসমাইল রয়ে গিয়েছি, কাল নতুন ছাত্রদের নিয়ে আমরা ভার্সিটি ফেরত যাব এবং অন্য ৩জন ওয়েলকামিং কমিটির মেম্বার আসবে। এয়ারপোর্টে সারাদিন দৌড়াদৌড়িতে ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছি।
সেদিন দুপুরেই হোটেলে দু’টো রুম বুক করে এসেছিল ইসমাইল, এখন সরাসরি গিয়ে রুমে গিয়ে কাত হয়ে যাব বিছানায়।
…….হোটেলে গিয়ে দেখি এটা ফাইভ স্টার হোটেল!! জীবনে কোনদিন এত্তো আলীসান হোটেলে থাকার সৌভাগ্য হয়নি আমার, ভবিষ্যতে হবে কিনা তাও জানিনা। তবে কপালের জোরে কিভাবে যেন মিলে গেল। মালয়েশিয়াতে এখন সারাবিশ্ব থেকে লাখ লাখ পর্যটক আসে এবং সে কারণেই হোটেলগুলোও এখন বিদেশী পর্যটক দিয়ে ভর্তি।
প্রথম বেশ কিছুক্ষণ একটু অন্যরকম লাগছিলো, ঘোরের মধ্যে ছিলাম ফাইভ স্টার হোটেলের সবকিছু দেখে।
সবকিছু এত্তো বেশি সাজানো গুছানো, এত্তো বেশি পরিপাটি যে, নির্বাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম বেশ কিছুক্ষণ। রুমে গিয়ে দেখলাম এ দেখি জাস্ট একটা রুম না, পুরা সংসার পেতে বসা যাবে এখানে! টিভি, ফ্রিজ, ইন্টারনেট, রান্না-বান্নার সুবিধা, সবকিছুই বিমোহিত করল আমাকে। ভাবলাম দু’টো দিন বেশ ভালই কাটবে এই হোটেলে। গোসল করে নামাজ পড়ে কিছুক্ষণ নেট ব্রাউজ করলাম, মেইল চেক করলাম, এবার ঘুমানোর পালা। খুব তাড়াতাড়ি ঘুমোতে হবে, কারণ আগামীকাল ভোর থেকেই আবার নতুন স্টুডেন্টদের আসা শুরু হবে।
তারা যদি এসে আমাদের না পায় তাহলে বেশ সমস্যা হয়ে যাবে। কিন্তু আস্তে আস্তে ফাইভ স্টার হোটেলের এত্তো অভিজাত সব ব্যবস্থা আমার কাছে বিরক্তিকর ঠেকলো। বিছানায় যে আরাম করে ঘুমাবো সেই উপায়ও নেই, বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেই নরম ফোমের কারণে শরীর এক্কেবারে ধনুকের মত বাঁকা হয়ে যায় :-s কি যন্ত্রণা!!! এভাবে হলে ঘুম আসবে কিভাবে? মিস করছিলাম ভার্সিটি হোস্টেলে আমার বিছানাটা, একটা তোষক দেয়া ঐ নরমাল বিছানাটাই সবচেয়ে আরামদায়ক। আস্তে আস্তে ফাইভ স্টার হোটেলের সবকিছুই আমার কাছে একঘেয়ে হয়ে উঠলো। এত্তো সাজানো গোছানো অভিজাত ফাইভ স্টার হোটেলের তুলনায় ভার্সিটি হোস্টেলে আমার রুমটা এতোটা অভিজাত ও পরিপাটি না হলেও, সেখানে হৃদয়ের তৃপ্তি খুঁজে পাই আমি।
সারাদিনের পরিশ্রমের পর এই ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দেবার পরও ঘুম আসছিলোনা। রুমের জানালা দিয়ে KLIA স্পষ্ট দেখা যায়, শুয়ে শুয়ে তাকিয়ে আছি রাতের আলোকিত KLIA এর দিকে। রাতের বেলায় KLIA দেখতে আরো ভয়ানক সুন্দর!!! অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করলাম, প্রতি মিনিটেই একটা বিমান ফ্লাই করছে অথবা ল্যান্ড করছে!!!! আমার এক বন্ধু বলেছিল এটা বর্তমানে বিশ্বের সবচাইতে ব্যস্ততম এয়ারপোর্টগুলোর একটি, সত্যিই তাই। আজ সকালে KLIA পৌঁছেই আমার অবাক হবার পালা শুরু হয়েছিল। যেদিকেই চোখ যায় শুধুই মানুষ আর মানুষ, মনে হচ্ছিল যেন মক্কায় হজ্জ করতে এসেছি!!! এত্তো বিশাল এয়ারপোর্ট, সত্যিই বিশাল।
এত্তোই বিশাল যে, গত নভেম্বরে দেশে গিয়ে আমি বুঝতে পারছিলামনা সত্যিই কি আমি HSIA তে ল্যান্ড করেছি?? নাকি সিলেটের ওসমানীতে নামিয়ে দেয়া হয়েছে আমাকে? কারণ এখানে আসার আগে দেখছিলাম HSIA বিশাল বড়, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে দোতালা ছোট্ট একটা বিল্ডিং :-s
রাত গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু দু’ চোখে কোন ঘুম নেই…. প্রতি মিনিটে প্লেনের ল্যান্ডিং ও টেক-অফ করা দেখছি এবং বের করার ব্যর্থ চেষ্টা করছি এটা কোন এয়ারলাইন্স, এই যন্ত্রচালিত পক্ষীর গন্তব্য কোথায়....???
প্লেন নিয়ে এসব ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ে গেল আমার Mechanics (Statics) শিক্ষক “জাফর সৈয়দ মোহাম্মদ আলী”-র করা একটি প্রশ্নের কথা, যে প্রশ্নটি তিনি ক্লাসের সকল ছাত্র-ছাত্রীর কাছে করেছিলেন। প্রশ্নটির উত্তর হয়তো আমরা সকলেই জানি, কিন্তু প্রশ্নটি ছিল অদ্ভূত ধরনের বিস্ময়কর যা নিয়ে আমরা কেউই কক্ষণো ভেবে দেখিনা……প্রশ্নটা এরকম- “আচ্ছা, তোমরা প্রায়ই খবর পাও যে অমুক দেশে একটি প্লেন যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে ক্র্যাশ করে মাটিতে পড়ে বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে, কিন্তু আজ পর্যন্ত কি কখনো শুনেছ অথবা দেখেছ যে একটি পাখি উড়তে উড়তে দুর্বল হয়ে মাটিতে ভূপাতিত হয়েছে?? অথচ এমন অনেক পাখি আছে যা দীর্ঘদিন ধরে একটানা আকাশে উড়ে বেড়ায়। অথবা এমন কোন পাখি দেখেছ যা বিমানের মত অনেক দূর থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ল্যান্ড করে?? অথবা ছোট্ট মশার কথা চিন্তা করো, যখন এই পতঙ্গটি তোমার শরীরের কোন স্থানে বসে, তখন তোমরা সাথে সাথে থাপ্পড় মেরে মশাটিকে তাড়িয়ে দাও অথবা মেরে ফেলতে চাও। কিন্তু মশাটি কি করে?? মশা কি প্লেনের মত এক মাইল দূরত্বের রানওয়েতে দৌড় দিয়ে তারপর টেক-অফ করে? নাকি মশাকে আঘাত করার জন্য তোমার হাত উঠার সাথে সাথেই সে টেক-অফ করে এবং ইমিডিয়েটলি ল্যান্ড করে তোমার শরীরেরই অন্য আরেক স্থানে!!! ঠিক একই কথা প্রযোজ্য পাখিশিকারী এবং পাখির বেলায়। শিকারীর গুলির আওয়াজ শুনার সাথে সাথেই পাখিটি টেক-অফ করে, পাখির প্রয়োজন হয়না এক মাইল দৌড় দিয়ে তারপর টেক-অফ করতে।
তোমরা কি জানো এর কারণ কি???”
আমাদের মাথা তখন ভোঁ ভোঁ করছে, কি উত্তর দিব আমরা? এ নিয়ে তো কক্ষণোই ভেবে দেখিনি। সত্যিই তো!!! উড়তে উড়তে দুর্বল হয়ে মাটিতে ভূপাতিত হয়েছে অথবা বহুদূর থেকে প্রস্তুতি নিয়ে ল্যান্ড/টেক-অফ করেছে এমন কোন খবর তো আমরা শুনিনি দেখিওনি :-s বরং দেখেছি প্রতি বছর শীতকালে সাইবেরিয়া থেকে ভারতীয় উপমহাদেশে অতিথি পাখি আসে, এবং এটি একটি direct flight, কোন যাত্রা বিরতি ছাড়াই জানিনা এত্তো শক্তি পাখিগুলো কোথা থেকে পায়? তাদের ছোট্ট পেটে তো আর বিমানের মত এত্তো পেট্রোল/খাবার আঁটেনা!!! আমরা সবাই ভাবছিলাম কি উত্তর দিব? সবাই বেশ ঘোরের মধ্যে আছি …… স্যার আমাদের এই প্রতিক্রিয়া দেখে মুচকি হাসলেন এবং বললেন, “এর প্রধান কারণ হল কীটপতঙ্গ/পাখির মধ্যে Flexible wing, আর বিমানের মধ্যে থাকে একদম সাধারণ wing. এখন বিজ্ঞানীরা flexible wing দিয়ে প্লেন তৈরী করার চেষ্টা করছেন যার ফলে পাখির মতো তাৎক্ষণিকভাবে ল্যান্ডিং/টেক অফ করা যাবে। হয়তো একদিন তারা সফল হবে, কিন্তু তারপরও প্লেন ক্র্যাশিং কেউ থামাতে পারবেনা অথবা আবিষ্কার করতে পারবেনা এমন কোন ইঞ্জিন যা দিয়ে দীর্ঘক্ষণ আকাশে উড়ন্ত অবস্থায় থাকা যাবে এবং এখানেই হল মানুষের সৃষ্টি এবং আল্লাহর সৃষ্টির মধ্যে প্রধান পার্থক্য!! আমি তো মাত্র একটি উদাহারণ দিলাম, আল্লাহর এমন অসংখ্য সৃষ্টি আছে যেগুলো নিয়ে আমরা কক্ষণোই ভেবে দেখিনা, ভাবতেও চাইনা বরং আমরা ভীষণ অকৃতজ্ঞ এবং স্বার্থপর!! তুমি নিজের শরীরের দিকেই তাকিয়ে দেখো, এটাই হল আল্লাহর এক রহস্যময় সৃষ্টি”।
সেমিস্টারের শেষ ক্লাসে স্যার আমাদের উদ্দেশ্যে উপদেশস্বরূপ একটি কথাই বলেছিলেন, “তোমরা এখানে এসেছ জ্ঞানার্জনের উদ্দেশ্যে, সার্টিফিকেট অর্জনের উদ্দেশ্য নয়। যত বেশী পারো জ্ঞান লুফে নাও এবং পড়ালেখা শেষে নিজের সকল জ্ঞান ও শক্তি আল্লাহর সকল সৃষ্টির সেবায় খরচ করো, এবং সে যদি তোমার শত্রুও হয়, তবুও একাজে কক্ষণো পিছপা হবেনা।
স্বার্থপর ও লোভী না হয়ে হিংসা ও লোভমুক্ত একটি হৃদয় তৈরী কর”।
স্যারের এত্তোসব কথাগুলো এখনো যেন কানে বেজেই যাচ্ছে… আমি একথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করি যে এমন একজন শিক্ষকের সান্নিধ্য পেয়েছি বলে আমার জীবন ধন্য! প্রথম দিন স্যারকে দেখে খুবই অবাক হয়েছিলাম এবং এখনো হয়ে যাচ্ছি এই ভেবে যে একজন মানুষ এত্তো সাদাসিধেভাবে কিভাবে জীবন ধারণ করে যাচ্ছেন!!! অথচ তার ভিতরটা যে কত্তো গভীর জ্ঞানের আলোয় আলোকিত তা নিশ্চয়ই তাকে দেখে বুঝার সাধ্য নেই আমাদের। স্যার হলেন ভারতের তামিলনাড়ু প্রদেশের চেন্নাই এর অধিবাসী। পড়ালেখা করেছিলেন ভারতের এবং বর্তমান বিশ্বের অন্যতম সেরা ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় IIT এ। এরোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারং এর উপর PhD শেষ করে শিক্ষকতা পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেন।
অথচ তিনি ছিলেন IIT এর সেরা ছাত্র, অসংখ্য লোভনীয় অফার তার কাছে এসেছিল কিন্তু তা তিনি গ্রহণ করেননি। মাঝে বেশ কিছুদিন ভারতের নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে এবং “অগ্নি” মিসাইল প্রজেক্টে তিনি বেশ সফলতার সাথে কাজ করেছেন, এ থেকেই বুঝা যায় স্যার কতোটা মেধাবী ছিলেন। এবং স্যার ছিলেন সত্যিকারের মেধাবী, সকল দিক দিয়েই……
এখনো দেখা হয় স্যারের সাথে, দেখলেই শ্রদ্ধায় মাথা নুয়ে আসে। স্যারের যে রেজাল্ট এবং মেধা, হয়তো পারতেন অনেক ধনী একজন মানুষ হতে, কিন্তু তিনি হয়তো চেয়েছিলেন জ্ঞানার্জনে সবার চাইতে ধনী হতে এবং তার সেই জ্ঞান আমাদের মত নবীনদের মাঝে বিলিয়ে দিতে….এজন্যই মনে হয় পারেননি। শেষ ক্লাসে মনে হয় একারণেই আমাদের সেই উপদেশ দিয়েছিলেন।
কিছুদিন আগে Maher Zain এর একটি গান শুনেছিলাম যার সারমর্ম আল্লাহর সৃষ্টি নিয়ে স্যারের সেই কথাগুলোরই প্রতিধ্বনি মনে হলো আমার কাছে। সত্যিই এত্তোসব চিহ্ন আমাদের আশেপাশেই আছে তবুও কেন মানুষ বিশ্বাস করেনা যে এইসব কিছুর একজন সৃষ্টিকর্তা আছেন?? ভাল লাগলো গানটা, তাই আপনাদের সাথে শেয়ার না করে পারলামনা-
Look around yourselves
Can’t you see this wonder
Spreaded infront of you
The clouds floating by
The skies are clear and blue
Planets in the orbits
The moon and the sun
Such perfect harmony
Let’s start question in ourselves
Isn’t this proof enough for us
Or are we so blind
To push it all aside..
No..
We just have to
Open our eyes, our hearts, and minds
If we just look bright to see the signs
We can’t keep hiding from the truth
Let it take us by surprise
Take us in the best way
(Allah..)
Guide us every single day..
(Allah..)
Keep us close to You
Until the end of time..
Look inside yourselves
Such a perfect order
Hiding in yourselves
Running in your veins
What about anger love and pain
And all the things you’re feeling
Can you touch them with your hand?
So are they really there?
Lets start question in ourselves
Isn’t this proof enough for us?
Or are we so blind
To push it all aside..?
No..
We just have to
Open our eyes, our hearts, and minds
If we just look bright to see the signs
We can’t keep hiding from the truth
Let it take us by surprise
Take us in the best way
(Allah..)
Guide us every single day..
(Allah..)
Keep us close to You
Until the end of time..
When a baby’s born
So helpless and weak
And you’re watching him growing..
So why deny
Whats in front of your eyes
The biggest miracle of life..
We just have to
Open our eyes, our hearts, and minds
If we just look quiet we’ll see the signs
We can’t keep hiding from the truth
Let it take us by surprise
Take us in the best way
(Allah..)
Guide us every single day..
(Allah..)
Keep us close to You
Until the end of time..
Open your eyes and hearts and minds
If you just look bright to see the signs
We can’t keep hiding from the truth
Let it take us by surprise
Take us in the best way
(Allah..)
Guide us every single day..
(Allah..)
Keep us close to You
Until the end of time..
Allah..
You created everything
We belong to You
Ya Robb we raise our hands
Forever we thank You..
Alhamdulillah..
Artist: Maher Zain
Youtube Link: http://www.youtube.com/watch?v=Dm6NtnU0yXw
সোনারবাংলাদেশ ডটকম লিঙ্ক-http://www.sonarbangladesh.com/article.php?ID=2717
আমার ব্লগস্পট লিঙ্ক-http://tariqridwan.blogspot.com/2010/05/blog-post.html
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।