আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

হুমায়ূন আহমেদ বি,এস,সি,

তবু সে তো স্বপ্ন নয়, সব-চেয়ে সত্য মোর, সেই মৃত্যুঞ্জয়

সাধারণত আমি ইন্টারনেট থেকে দেশি লেখকদের বই নামাতে লজ্জা পাই, কারণ এটা লেখক ও প্রকাশককে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করে। সম্প্রতি এক ব্লগার হুমায়ূন আহমেদের এ বছর প্রকাশিত চারটি বইয়ের লিংক দেয়ার পরে কিছুক্ষণ ভেবে শেষ পর্যন্ত একটা অজুহাত বার করলাম। এই বইগুলো সবই আমি বই মেলায় কিনে একজনকে বিদেশে পাঠিয়ে দিয়েছিলাম। তার মধ্যে শুধু 'কাঠপেন্সিল'টা একটু উল্টে-পাল্টে দেখার সুযোগ হয়েছিল প্যাকেট করার আগে এবং তা নিয়ে আগে একটা পোস্ট দিয়েছি। Click This Link আর দু দিন সময় পেলে বাকি গুলোও প্রথমে নিজে পড়েই পাঠাতে পারতাম।

সে হিসেবে এখন যদি ডাউনলোড করে পড়ি, খুব বড় অপরাধ হবে না, মনে হলো। পড়া হয়েছে দুটিঃ 'শুভ্র গেছে বনে' আর 'নলিনী বাবু বি, এস, সি'। প্রথমটা নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। এতে বড়লোকদের যৌণাচার প্রসঙ্গ আছে, সৎ গরীব মেয়ের সাথে বিরাট বড়লোক বাবার পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম হওয়া গাধা টাইপের এক ছেলের (বাস্তবে এমন হয় না ভাই!) প্রেমের গল্প আছে, সেই নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের নায়িকার ভাইটিকে দেশের এক শীর্ষ সন্ত্রাসী বানানো হয়েছে, অথচ বাবার সব সম্পত্তি তার চাচা দখল করলেও সে নিজে কিছুই করে না এর প্রতিকারে! শেষ দিকে ক্লাইমেক্স সৃষ্টির জন্য একেবারে বলিউডি স্টাইলে সব পক্ষের মধ্যে ধরাধরির রেইস আছে। এই বইটা নিশ্চয়ই বিনোদনী সিনেমা বানানোর উদ্দেশ্যে লেখা।

থাক এর কথা। নলিনী বাবুর বইয়ে স্বল্প পরিসরের মধ্যেই অনেক তত্ত্ব কথা আছে। পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন, জীববিজ্ঞান, দর্শন, বাংলা প্রচলিত ধাঁধা, সংস্কৃত শ্লোক, খাদ্যবিজ্ঞান, কি নেই! এমন বিশ্বকোষীয় জ্ঞান আমার নেই, প্রয়োজনও হয় না। যেটুকু ওভারল্যাপ আছে, তাই নিয়ে কিছু বলি এবং কিছুক্ষণের জন্য না হয় আমিই মিসির আলি হয়ে হুমায়ূন কেন এই বইটি লিখেছেন ব্যাখ্যা করা চেষ্টা করি। পদার্থবিজ্ঞানঃ ৩৮ পৃষ্ঠাতে হুমায়ূন সাহেব অভিকর্ষজাত ত্বরণের ফরমুলা জানতে চেয়েছেন নলিনী বাবুর কাছে।

উত্তরটা এতই বিদ্ঘুটে (আসলে এটা ট্রাজেক্টরীর ফলাফল) যে একজন বি, এস, সি স্কুল মাস্টারের কাছ থেকেও আশা করা যায় না। হুমায়ূন বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষা সম্পূর্ণ ভুলে বসে আছেন। তাই আমি পোস্টটার এই নাম দিলাম। কোয়ান্টাম এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট (দূরবর্তী দুটি কণার মধ্যে ওতপ্রোত সম্পর্ক) নিয়ে হুমায়ূনের সাম্প্রতিক অবসেশন প্রসঙ্গে উল্লিখিত পোস্টে কিছু বলেছি। তিনি যা ভাবছেন, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়।

ম্যাক্রো আকারের বস্তুর মধ্যে এই অন্তরঙ্গতার ব্যাপারটা থাকার সম্ভাবনা শূন্য বলাই ভালো, কারণ অনেক কণা এক সাথে চললে তাদের মধ্যে ব্যতিচার হয়ে তরঙ্গ ধর্ম লোপ পায়, সেগুলো আলাদা আলাদা কণায় কোলাপ্স করে। বিষয়টা ছোট ভাইয়ের কাছে তিনি ভালোভাবে বুঝে নিলেই হয়। তাঁর এই কোয়ান্টাম সমান্তরাল ম্যাক্রোবিশ্বসমূহের ধারণাতে তাই কোন সারবস্তু নেই, যদিও কয়েকটি অণুসমষ্টির জন্য এটা খুবই প্রাসঙ্গিক। এর মধ্যে তিনি টেলিপ্যাথিকেও কেন টেনে এসেছেন তা শেষে বলব। রসায়নঃ রসায়নেও অণুদের মধ্যে এন্ট্যাঙ্গলমেন্ট বা জড়াজড়ি থাকতে পারে, একেবারে জ্যামিতিক অর্থে।

টপোলজি বিষয়টি খুবই মজার। ম্যোবিয়াস স্ট্রিপ, ক্লাইন বোতল এগুলো দিয়ে শিশুদের মুগ্ধ করে রাখা যায় অনেকক্ষণ। কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে যাঁরা এসব নিয়ে কাজ করেন তাঁরা জানেন, একমাত্র তথাকথিত “থিওরি অব এভ্রিথিং” ( হা হা) স্ট্রিং তত্ত্ব ছাড়া আর কোথাও টপোলজির তেমন গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োগ নেই। বোরোমীন ও হফ রিং (পৃঃ ৪৭) ছাড়াও অণু-রসায়ন ভালোই চলতে পারে। জৈব রসায়নে বিভিন্ন অণুর মধ্যে বন্ধন সাধারণত ভঙ্গুর হাইড্রোজেন বন্ড দিয়ে তৈরি হয়।

টপোলজিকাল স্ট্যাবিলিটির জন্য খুব শক্ত বন্ড দরকার। জীববিদ্যাঃ দেশি বইয়ের ক্ষেত্রে বিবেক কাজ করলেও, বিদেশি বইয়ের বেলায় সংকোচ নেই আমার। ডকিন্স-এর 'সেলফিশ জীন' বইটা আছে আমার কম্পিউটারে। এখানে ডি'উইট নামে কোন জীববিজ্ঞানীর উদ্ধৃতি (পৃঃ ৬৯) পেলাম না সার্চ দিয়ে। কি ব্যাপার, এটা তবে এলো কোথা থেকে? মস্তিষ্কের ব্যাপারে তিনি বলেছেন ফ্রন্টাল লোবের কাজ নেই কোনো, এটা ছাড়াও চলে।

ভুল। এর অনেক কাজ। এটার ক্ষতি হলে মানুষের আই, কিউ, ছাড়া আর সব কিছুই, তার ব্যক্তিত্ব, জীবনদর্শন সবই বদলে যাওয়ার সম্ভাবনা অনেক। এটা মগজের সব চেয়ে উচ্চমার্গের চিন্তার ক্ষেত্র বলে সবাই মনে করেন। থ্যালামাসকে তিনি চিন্তাশক্তি নিয়ন্ত্রক বলেছেন।

আসলে এই অংশটা চেতনার নিয়ন্ত্রক, যেমন ঘুমিয়ে পড়া, জেগে ওঠার ব্যাপার। হাইপোথ্যালামাসকে বলেছেন আনন্দ বেদনার অনুভূতি-কেন্দ্র। মানুষের ইমোশনের অনেকগুলো জায়গা আছে, পুরো লিম্বিক সিস্টেম। হাইপোথ্যালামাস একটা অংশ। এর অন্য কাজও আছে।

ইমোশনের অনুভূতি সিঙ্গুলেট কর্টেক্স, হিপোক্যাম্পি এই সব জায়গাতেও হয়। এটা অবশ্য ডিটেইলের ব্যাপার। স্কিৎসোফ্রেনিয়া হলে যে অণুটি একটু বেশি পাওয়া যায়, তার ভুল নাম দিয়েছেন। সংস্কৃত শ্লোকঃ 'ন হি সর্ববিদঃ সর্বে' এই কথাটির মানে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়ও নাকি জানতেন না। অবিশ্বাস্য! আমি নিশ্চিত আমার মতো আরো অনেক সংস্কৃতে ক-অক্ষর গো-মাংস লোকই এটা দেখা মাত্র এর অর্থ বুঝতে পারবে।

______________________________________ যাক, জ্ঞানদানপর্ব সমাপ্ত। এবার মিসির আলির জবানিঃ মিসির আলিঃ এই উপন্যাসে হুমায়ূন নিজের জীবনের অনেক ঘটনা মিশিয়ে দিয়েছেন, যেগুলোতে কোনই কাল্পনিক উপাদান নেই। এমন ফরম্যাটে ঝামেলা আছে জেনেও তিনি এ কাজ করেছেন। নিজের প্রিয় মানুষটির কথা একজন কবিতায় (আমার মত অকবি অক্ষম বা অপটু হলেও) যত অনায়াসে নিঃসংকোচে বলতে পারেন, একজন কথাশিল্পীর পক্ষে তা তত সহজ নয়। 'কাঠপেন্সিলের' মতো এখানেও সমালোচকদের ব্যাপারে তাঁর উষ্মা প্রকাশ পেয়েছে।

তবে এরা তাঁর ব্যক্তিগত জীবনের সমালোচক। আসলে এই বইয়ে নিজের ব্যক্তিগত সাফল্য ব্যর্থতার একটা খতিয়ান নেয়ার আংশিক চেষ্টা হয়েছে। সেজন্যই পদার্থবিজ্ঞান বা মনোবিজ্ঞানের বহু সমান্তরাল মহাবিশ্বের অবতারণা, একেকটিতে তাঁর একেক দিকে সাফল্য বা ব্যর্থতা। হুমায়ূন তাঁর ফেলে আসা পরিবারকে খুব মিস করেন, কারণ এমনও হতে পারে যে এখন তিনি তাঁর আগের স্ত্রী আর পরের জনের মধ্যে তত পার্থক্য দেখতে পান না। তাই মনে মনে ভাবেন, যদি এমন হত যে তিনি সমান্তরালভাবে সেই পরিবারেও থাকতে পারতেন।

অবশ্য দুই ভাইয়ের স্মৃতিচারণ থেকেই জানা যায় যে পিতা সারাক্ষণ অতিপ্রাকৃতের চর্চা দিয়ে সন্তানদের মাথায় কিছু অবাস্তব ধারণা শিশুকালে প্রোথিত করেছিলেন। নলিনী বাবু বি, এস, সি, যিনি তাঁর মুসলিম ছাত্রীর প্রেমে পড়েন, আসলে হুমায়ূনের নিজের মুখ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।