আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শত বর্ষে গীতাঞ্জলি


অনেকটা নিরবেই শতায়ু হতে চলেছে কবিগুরুর অমর এই সৃষ্টি। গীতাঞ্জলিকে ঘিরে বাংলা সাহিত্যে যতটা উচ্ছাস, আলোচনা ও গবেষনা হয়েছে ও হচ্ছে, অন্য কোনো গ্রন্থ নিয়ে এতটা আর হয় নি। শত বর্ষ পরেও গীতাঞ্জলির প্রতিটি গান/কবিতা একই রকম আবেদন সৃষ্টি করে। এক অদৃশ্য টানে পাঠককে মোহিত করে!এই অদৃশ্য টানের মূল সুর ঈশ্বর প্রেম, ঈশ্বরস্বত্তায় নিজেকে বিলীন করা, ঈশ্বরের মাঝে নিজেকে নিঃশর্ত আত্নসমর্পন!গীতাঞ্জলির মূল সুর ইশ্বরমুখিতা হলেও তা কোনো সম্প্রদায়-বিশেষের নয়। বিশ্বের বিশালতা ও প্রকৃতির সৌন্দর্য থেকে উৎসারিত এক আধ্যাত্নবোধের সঙ্গে এই বিশ্বাসযুক্ত।

গীতাঞ্জলি কবিগুরুর ১৫৭টি গান/কবিতার সংকলন। গানগুলি রচিত হয় ১৯০৮-০৯ সালে এবং শান্তিনিকেতন থেকে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় আগস্ট,১৯১০ (ভাদ্র,১৩১৭ বঙ্গাব্দ) খৃস্টাব্দে। এই গ্রন্থের প্রথম দিকের কয়েকটি গান গীতবিতান, স্বরবিতান, ব্রহ্মসঙ্গীত, পূজা, পূজা-আনন্দ, পূজা-বিরহ, প্রকৃতি, শেফালি, কেতকী, গীতলিপি প্রভৃতি গ্রন্থে প্রকাশিত হয় এবং কিছু সময় পরে কবিগুরু যে গানগুলো রচনা করেন তাদের পরস্পরের মধ্যে ভাবের ঐক্য থাকায় সবগুলো গানকে তিনি গীতাঞ্জলিতে সংকলিত করেন। গীতাঞ্জলির ভূমিকায় কবিগুরু নিজেই লিখেছেন, “বিজ্ঞাপন এই গ্রন্থের প্রথমে কয়েকটি গান পূর্বে অন্য দুই-একটি পুস্তকে প্রকাশিত হইয়াছে। কিন্তু অল্প সময়ের ব্যবধানে যে-সমস্ত গান পরে পরে রচিত হইয়াছে তাহাদের পরস্পরের মধ্যে একটি ভাবের ঐক্য থাকা সম্বভপর মনে করিয়া তাহাদের সকলগুলিই এই পুস্তকে একত্রে বাহির করা হইল।

শান্তিনিকেতন শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বোলপুর ৩১ শ্রাবণ ১৩১৭” গীতাঞ্জলির গানগুলো মূলত কবিতা। এগুলো সহজ ভাষায়, সাবলীল ছন্দে লিখিত। ভাবধারার দিক থেকে কবিতাগুলোকে বেশ কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, প্রার্থনাঃ বিপদে মোরে রক্ষা করো এ নহে মোর প্রার্থনা , বিপদে আমি না যেন করি ভয় । দুঃখতাপে ব্যথিত চিতে নাই-বা দিলে সান্ত্বনা , দুঃখে যেন করিতে পারি জয় ।

সহায় মোর না যদি জুটে নিজের বল না যেন টুটে , সংসারেতে ঘটিলে ক্ষতি লভিলে শুধু বঞ্চনা নিজের মনে না যেন মানি ক্ষয় । আমারে তুমি করিবে ত্রাণ এ নহে মোর প্রার্থনা , তরিতে পারি শকতি যেন রয় । (৪ নম্বর গান) অন্তর মম বিকশিত করো অন্তরতর হে । নির্মল করো উজ্জ্বল করো , সুন্দর করো হে । জাগ্রত করো , উদ্যত করো , নির্ভয় করো হে ।

মঙ্গল করো , নিরলস নিঃসংশয় করো হে । অন্তর মম বিকশিত করো , অন্তরতর হে । (৫ নম্বর গান) তোমার দয়া যদি চাহিতে নাও জানি তবুও দয়া করে চরণে নিয়ো টানি । আমি যা গড়ে তুলে আরামে থাকি ভুলে সুখের উপাসনা করি গো ফলে ফুলে — সে ধুলা-খেলাঘরে রেখো না ঘৃণাভরে , জাগায়ো দয়া করে বহ্নি-শেল হানি । (১৪৬ নম্বর গান) ঈশ্বরকে না পাবার বেদনাঃ বিশ্বে তোমার লুকোচুরি , দেশ-বিদেশে কতই ঘুরি , এবার বলো , আমার মনের কোণে দেবে ধরা , ছলবে না ।

আড়াল দিয়ে লুকিয়ে গেলে চলবে না । (২৩ নম্বর গান) যদি তোমার দেখা না পাই প্রভু , এবার এ জীবনে তবে তোমায় আমি পাই নি যেন সে কথা রয় মনে । যেন ভুলে না যাই , বেদনা পাই শয়নে স্বপনে । (২৪ নম্বর গান) হেরি অহরহ তোমারি বিরহ ভুবনে ভুবনে রাজে হে । কত রূপ ধ'রে কাননে ভূধরে আকাশে সাগরে সাজে হে ।

সারা নিশি ধরি তারায় তারায় অনিমেষ চোখে নীরবে দাঁড়ায় , পল্লবদলে শ্রাবণধারায় তোমারি বিরহ বাজে হে । (২৫ নম্বর গান) বিশ্ব যখন নিদ্রামগন , গগন অন্ধকার ; কে দেয় আমার বীণার তারে এমন ঝংকার । নয়নে ঘুম নিল কেড়ে , উঠে বসি শয়ন ছেড়ে , মেলে আঁখি চেয়ে থাকি পাই নে দেখা তার । (৬০ নম্বর গান) সে যে পাশে এসে বসেছিল তবু জাগি নি । কী ঘুম তোরে পেয়েছিল হতভাগিনী ।

এসেছিল নীরব রাতে বীণাখানি ছিল হাতে , স্বপনমাঝে বাজিয়ে গেল গভীর রাগিণী । (৬১ নম্বর গান) নিজের অহংকার ত্যাগ ও হৃদয় নির্মল করে সহনশীলতা প্রদর্শনঃ আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে । সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে । নিজেরে করিতে গৌরব দান নিজেরে কেবলি করি অপমান , আপনারে শুধু ঘেরিয়া ঘেরিয়া ঘুরে মরি পলে পলে । সকল অহংকার হে আমার ডুবাও চোখের জলে ।

(১ নম্বর গান) নামাও নামাও আমায় তোমার চরণতলে , গলাও হে মন , ভাসাও জীবন নয়নজলে । একা আমি অহংকারের উচ্চ অচলে , পাষাণ-আসন ধুলায় লুটাও , ভাঙো সবলে । নামাও নামাও আমায় তোমার চরণতলে । (৫৩ নম্বর গান) তোমার সাথে নিত্য বিরোধ আর সহে না — দিনে দিনে উঠছে জমে কতই দেনা । সবাই তোমায় সভার বেশে প্রণাম করে গেল এসে , মলিন বাসে লুকিয়ে বেড়াই মান রহে না (১৫০ নম্বর গান) ঈশ্বরের ক্ষণদর্শনানুভূতিঃ প্রভু তোমা লাগি আঁখি জাগে ; দেখা নাই পাই , পথ চাই , সেও মনে ভালো লাগে ।

ধুলাতে বসিয়া দ্বারে ভিখারি হৃদয় হা রে তোমারি করুণা মাগে । কৃপা নাই পাই , শুধু চাই , সেও মনে ভালো লাগে । (২৮ নম্বর গান) নিভৃত প্রাণের দেবতা যেখানে জাগেন একা , ভক্ত , সেথায় খোলো দ্বার , আজ লব তাঁর দেখা । সারাদিন শুধু বাহিরে ঘুরে ঘুরে কারে চাহি রে , সন্ধ্যাবেলার আরতি হয় নি আমার শেখা । (৫০ নম্বর গান) তুমি এবার আমায় লহো হে নাথ , লহো ।

এবার তুমি ফিরো না হে — হৃদয় কেড়ে নিয়ে রহো । যে দিন গেছে তোমা বিনা তারে আর ফিরে চাহি না , যাক সে ধুলাতে । এখন তোমার আলোয় জীবন মেলে যেন জাগি অহরহ । (৫৭ নম্বর গান) দীন-হীন-পতিতের মাঝে ঈশ্বরকল্পনাঃ এই মলিন বস্ত্র ছাড়তে হবে হবে গো এইবার — আমার এই মলিন অহংকার । দিনের কাজে ধুলা লাগি অনেক দাগে হল দাগি , এমনি তপ্ত হয়ে আছে সহ্য করা ভার ।

আমার এই মলিন অহংকার । (৪১ নম্বর গান) যেথায় থাকে সবার অধম দীনের হতে দীন সেইখানে যে চরণ তোমার রাজে সবার পিছে , সবার নীচে , সব-হারাদের মাঝে । যখন তোমায় প্রণাম করি আমি , প্রণাম আমার কোন্খানে যায় থামি , তোমার চরণ যেথায় নামে অপমানের তলে সেথায় আমার প্রণাম নামে না যে সবার পিছে , সবার নীচে , সব-হারাদের মাঝে । (১০৭ নম্বর গান) নিন্দা দুঃখে অপমানে যত আঘাত খাই তবু জানি কিছুই সেথা হারাবার তো নাই । থাকি যখন ধুলার'পরে ভাবতে না হয় আসনতরে , দৈন্যমাঝে অসংকোচে প্রসাদ তব চাই ।

(১২৬ নম্বর গান) অসীম-সসীমের লীলাতত্বঃ কোথায় আলো , কোথায় ওরে আলো । বিরহানলে জ্বালো রে তারে জ্বালো । রয়েছে দীপ না আছে শিখা , এই কি ভালে ছিল রে লিখা — ইহার চেয়ে মরণ সে যে ভালো । বিরহানলে প্রদীপখানি জ্বালো । (১৭ নম্বর গান) ধনে জনে আছি জড়ায়ে হায় , তবু জান , মন তোমারে চায় ।

অন্তরে আছ হে অন্তর্যামী , আমা চেয়ে আমায় জানিছ স্বামী — সব সুখে দুখে ভুলে থাকায় জান , মম মন তোমারে চায় । ছাড়িতে পারি নি অহংকারে , ঘুরে মরি শিরে বহিয়া তারে , ছাড়িতে পারিলে বাঁচি যে হায় — তুমি জান , মন তোমারে চায় । (২৯ নম্বর গান) জগতে আনন্দযজ্ঞে আমার নিমন্ত্রণ । ধন্য হল ধন্য হল মানবজীবন । নয়ন আমার রূপের পুরে সাধ মিটায়ে বেড়ায় ঘুরে , শ্রবণ আমার গভীর সুরে হয়েছে মগন ।

(৪৪ নম্বর গান) আমার নামটা দিয়ে ঢেকে রাখি যারে মরছে সে এই নামের কারাগারে । সকল ভুলে যতই দিবারাতি নামটারে ওই আকাশপানে গাঁথি , ততই আমার নামের অন্ধকারে হারাই আমার সত্য আপনারে । (১৪৩ নম্বর গান) প্রকৃতির মাঝে ঈশ্বর বন্দনাঃ আজ ধানের খেতে রৌদ্রছায়ায় লুকোচুরি খেলা । নীল আকশে কে ভাসালে সাদা মেঘের ভেলা । আজ ভ্রমর ভোলে মধু খেতে , উড়ে বেড়ায় আলোয় মেতে ; আজ কিসের তরে নদীর চরে চখাচখির মেলা ।

(৮ নম্বর গান) আমরা বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ , আমরা গেঁথেছি শেফালিমালা । নবীন ধানের মঞ্জরী দিয়ে সাজিয়ে এনেছি ডালা । এসো গো শারদলক্ষ্মী , তোমার শুভ্র মেঘের রথে , এসো নির্মল নীল পথে , এসো ধৌত শ্যামল আলো-ঝলমল বনগিরিপর্বতে । এসো মুকুটে পরিয়া শ্বেত শতদল শীতল-শিশির-ঢালা । (১১ নম্বর গান) মেঘের'পরে মেঘ জমেছে , আঁধার করে আসে , আমায় কেন বসিয়ে রাখ একা দ্বারের পাশে ।

কাজের দিনে নানা কাজে থাকি নানা লোকের মাঝে , আজ আমি যে বসে আছি তোমারি আশ্বাসে । (১৮ নম্বর গান) আজি শ্রাবণ-ঘন-গহন-মোহে গোপন তব চরণ ফেলে নিশার মতো নীরব ওহে সবার দিঠি এড়ায়ে এলে । প্রভাত আজি মুদেছে আঁখি , বাতাস বৃথা যেতেছে ডাকি , নিলাজ নীল আকাশ ঢাকি নিবিড় মেঘ কে দিল মেলে । (১৮ নম্বর গান) আজ বারি ঝরে ঝর ঝর ভরা বাদরে । আকাশ-ভাঙা আকুল ধারা কোথাও না ধরে ।

শালের বনে থেকে থেকে ঝড় দোলা দেয় হেঁকে হেঁকে , জল ছুটে যায় এঁকেবেঁকে মাঠের'পরে । (২৭ নম্বর গান) আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে । তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে কোরো না বিড়ম্বিত তারে । আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো , আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো , এই সংগীত-মুখরিত গগনে তব গন্ধ তরঙ্গিয়া তুলিয়ো । এই বাহির ভুবনে দিশা হারায়ে দিয়ো ছড়ায়ে মাধুরী ভারে ভারে ।

(৫৫ নম্বর গান) জননীরূপে ঈশ্বরকল্পনাঃ তোমার সোনার থালায় সাজাব আজ দুখের অশ্রুধার । জননী গো , গাঁথব তোমার গলার মুক্তাহার ! চন্দ্র সূর্য পায়ের কাছে মালা হয়ে জড়িয়ে আছে , তোমার বুকে শোভা পাবে আমার দুখের অলংকার । (১০ নম্বর গান) জননী , তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে । জননী , তোমার মরণহরণ বাণী নীরব গগনে ভরি উঠে চুপে চুপে । তোমারে নমি হে সকল ভুবন-মাঝে , তনু মন ধন করি নিবেদন আজি ভক্তিপাবন তোমার পূজার ধূপে ।

জননী , তোমার করুণ চরণখানি হেরিনু আজি এ অরুণকিরণ রূপে । (১৪ নম্বর গান) ইংরেজী অনুবাদ: গীতাঞ্জলি'র কবিতা/গানগুলোর অনুবাদ শুরু করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্বয়ং। ৫৩টি গানের অনুবাদ গীতাঞ্জলি: দ্য সং অফারিংস‎ গ্রন্থে সংকলিত হয়। রবীন্দ্রনাথ সবগুলো কবিতা/গানের অনুবাদ সম্পন্ন করেন নি। গীতাঞ্জলি'র সবগুলো কবিতা/গানগুলোর অনুবাদ যারা করেছেন তাদের মধ্যে আছেন ব্রাদার জেমস এবং ব্রিটিশ কবি ও অনুবাদক জো উইন্টার।

নিচে গীতাঞ্জলি কাব্যের ১২৫ নম্বর গানটি উদ্ধৃত হল: “আমার এ গান ছেড়েছে তার সকল অলংকার তোমার কাছে রাখেনি আর সাজের অহংকার। অলংকার যে মাঝে প’ড়ে মিলনেতে আড়াল করে, তোমার কথা ঢাকে যে তার মুখর ঝংকার। তোমার কাছে খাটে না মোর কবির গরব করা– মহাকবি, তোমার পায়ে দিতে চাই যে ধরা। জীবন লয়ে যতন করি যদি সরল বাঁশি গড়ি, আপন সুরে দিবে ভরি সকল ছিদ্র তার। ” এই কবিতাটির ইংরেজি অনুবাদ করেন রবীন্দ্রনাথই (Gitanjali, verse VII): "My song has put off her adornments. She has no pride of dress and decoration. Ornaments would mar our union; they would come between thee and me; their jingling would drown thy whispers." "My poet's vanity dies in shame before thy sight. O master poet, I have sat down at thy feet. Only let me make my life simple and straight, like a flute of reed for thee to fill with music." “গীতাঞ্জলি: দ্য সং অফারিংস‎” ইংরেজী ভাষায় অনূদিত রবীন্দ্রনাথের প্রথম সংকলনগ্রন্থ।

“গীতাঞ্জলি” নামটি বিশ্লেষন করলে দাঁড়ায় গীত+অঞ্জলী=গীতাঞ্জলি। গীত বা Song ও অঞ্জলী বা Offerings থেকেই কবিগুরু এই গ্রন্থটির নামকরণ করেন Song Offerings। অনূদিত কবিতাগুলি পাশ্চাত্যে খুবই সমাদৃত হয়। কিন্তু গ্রন্থদুটির নাম অভিন্ন হলেও ইংরেজী গীতাঞ্জলিতে বাংলা গীতাঞ্জলি'র একচ্ছত্র আধিপত্য নেই। রবীন্দ্রনাথ বাংলা গীতাঞ্জলি'র ১৫৭টি গান/কবিতা থেকে ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে (Song Offerings) মাত্র ৫৩টি স্থান দিয়েছেন।

বাকি ৫০টি বেছে নিয়েছেন গীতিমাল্য, নৈবেদ্য, খেয়া, শিশু, কল্পনা, চৈতালি, উৎসর্গ, স্মরণ ও অচলায়তন থেকে। গীতিমাল্য থেকে ১৬টি, নৈবেদ্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে ৩টি, কল্পনা থেকে ১টি, চৈতালি থেকে ১টি, উতসর্গ থেকে ১টি, স্মরণ থেকে ১টি এবং অচলায়তন থেকে ১টি কবিতা/গান নিয়ে তিনি ইংরেজি গীতাঞ্জলির বিন্যাস করেছেন। অর্থাৎ ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে তিনি মোট ৯টি গ্রন্থের কবিতা বা গানের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। গীতাঞ্জলি: দ্য সং অফারিংসে প্রথম গান হিসেবে কবিগুরু গীতিমাল্যের ২৩ নম্বর গানটিকে স্থান দিয়েছেন। আমারে তুমি অশেষ করেছ এমনি লীলা তব।

ফুরায়ে ফেলে আবার ভরেছ জীবন নব নব। কত যে গিরি কত যে নদীতীরে বেড়ালে বহি ছোটো এ বাঁশিটিরে, কত যে তান বাজালে ফিরে ফিরে কাহারে তাহা কব। তোমারি ওই অমৃতপরশে আমার হিয়াখানি হারালো সীমা বিপুল হরষে উথলি’ উঠে বাণী। আমার শুধু একটি মুঠি ভরি দিতেছ দান দিবসবিভাবরী, হল না সারা কত-না যুগ ধরি, কেবলই আমি লব। যার ইংরেজী অনুবাদ কবিগুরু নিজেই করেছেনঃ "Thou hast made me endless, such is thy pleasure. This frail vessel thou emptiest again and again, and fillest it ever with fresh life. This little flute of a reed thou hast carried over hills and dales, and hast breathed through it melodies eternally new. At the immortal touch of thy hands my little heart loses its limits in joy and gives birth to utterance ineffable. Thy infinite gifts come to me only on these very small hands of mine. Ages pass, and still thou pourest, and still there is room to fill." অনুবাদের ইতিহাস: ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের শুরুর দিকে রবীন্দ্রনাথের জাহাজযোগে লণ্ডন যাওয়ার কথা ছিল।

যাত্রার পূর্বে তিনি অর্শ রোগের কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং পদ্মা নদীতে নৌকায় বিশ্রাম নিতে শুরু করেন। এ সময় তিনি তাঁর গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থ থেকে সহজ ইংরেজীতে অনুবাদ শুরু করেন। পরবর্তীতে গীতাঞ্জলি ৫৩টি এবং গীতিমাল্য, নৈবেদ্য, খেয়া প্রভৃতি আরো নয়টি কাব্যগন্থ থেকে ৫০টি - সর্বমোট ১০৩টি কবিতার অনুবাদ নিয়ে একটি পাণ্ডুলিপি তৈরী করেন। এই পাণ্ডুলিপি সঙ্গে করে রবীন্দ্রনাথ ২৭ মে ১৯১২ বোম্বাই বন্দর থেকে বিলেত যাত্রা করেন। তিনি লন্ডনে পৌঁছান ১৬ জুন।

এ সময় ইউলিয়াম রোদেনস্টাইনের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় এবং পাণ্ডুলিপিটি তাকে দেয়া হয়। ১৯১২ খ্রিস্টাব্দের শেষের দিকে লণ্ডনে ইন্ডিয়া সোসাইটি কর্তৃক গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। সঙ্গ অফরিংস-এর ভূমিকা লিখেছিলেন স্বয়ং কবি ইয়েটস্। এ ভূমিকাটি ছিল একই সঙ্গে আন্তরিক ও যথেষ্ট প্রশস্তিতমূলক। ভূমিকাটির কিছু অংশ এমনঃ “I have carried the manuscript of these translations about with me for days, reading it in railway trains, or on the top of omnibuses and in restaurants, and I have often had to close it lest some stranger would see how much it moved me. These lyrics-- which are in the original, my Indians tell me, full of subtlety of rhythm, of untranslatable delicacies of colour, of metrical invention--display in their thought a world I have dreamed of all my live long. The work of a supreme culture, they yet appear as much the growth of the common soil as the grass and the rushes. A tradition, where poetry and religion are the same thing, has passed through the centuries, gathering from learned and unlearned metaphor and emotion, and carried back again to the multitude the thought of the scholar and of the noble.” নিজ অনুবাদে রবীন্দ্রনাথ বেশ স্বাধীনতা নিয়েছিলেন।

আক্ষরিক তো নয়ই বরং ভাবানুবাদেরও বেশি ; কখনো কবিতাংশ সংক্ষেপিত করা হয়েছে কখনো বা শুধু ভাবার্থ করা হয়েছে ; কেবল কবিতার ভাবসম্পদ অক্ষত রাখা হয়েছে। ইংরেজিভাষী সমালোচকরা সানন্দে তাঁর অনুবাদের উৎকর্ষতা স্বীকার করেছেন। তবে এ উৎকর্ষতার ক্রমাবনতি হয়েছিল বলে মনে করা হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ইংরেজ পাঠক ও সমালোচক এবং রবি-জীবনীকার এডওয়ার্ড টম্পসন মন্তব্য করেছেন, "প্রথম দিকের অনুবাদ ছিল নিখুঁত ও মনোরম ; শেষের দিকে অযত্নে ও নৈমিত্তিকভাবে অনুবাদের কাজ সারা হয়েছে"। তবে স্বকৃত অনুবাদ নিয়ে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের মনেই দ্বিধা-দ্বন্দ্ব ছিল।

ইয়োরোপে যাওয়ার আগে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়ে শিলাইদহে কিছু দিন কাটান, তখন সময় কাটানোর ছলেই তিনি গীতাঞ্জলি’র অনুবাদে হাত দেন। কিন্তু প্রিয় কবিতাগুলোর অনুবাদ তাঁর কাছে সন্তোষজনক মনে হয়নি, মনে হয়েছিল ‘school-boy exercise'। গীতাঞ্জলির ডাউনলোড লিংক। সুত্রঃ ১. রবীন্দ্র-রচনাবলী, ভাষা প্রযুক্তি গবেষণা পরিষদ। ২. গীতাঞ্জলি ৩. Gitanjali - Song Offerings ৪. উইকিপিডিয়া ৫. ড. সৌমিত্র শেখর, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য জিজ্ঞাসা।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।