আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

এক যুগে কালীগঞ্চের বন্দকাটি গ্রামে যৌন নিপীড়নে ৫ শিশু নিহত, ৫০ শিশু আহত অবশেষে শিশু যৌন নিপীড়নের অভিযোগে মোবারক গ্রেপ্তার

মানুষে মানুষে সমানাধিকারে বিশ্বাস করি

একের পর এক শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটছে। ইতিমধ্যে যৌন নিপীড়নের পর পাঁচজন শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। অর্ধাশতাধিক এ ধরণের ঘটনা ঘটলেও কোনো প্রতিকারের ব্যবস্থা হয়নি। খুঁজে পাওয়া যায়নি শিশু যৌন নিপীড়নকারীদের। অবশেষে বৃহস্পতিবার রাতে এক শিশু যৌন নিপীড়নের ঘটনায় একজনকে আটক করে শনিবার সকালে পুলিশে সোপর্দ করা হয়েছে।

বর্বরচিত এসব ঘটনা ঘটছে সাতীরার কালীগঞ্চ উপজেলার বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বন্দকাটি ও কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের রামনগর গ্রামে। এ ঘটনার পর ওই এলাকার মানুষের মধ্যে নতুন করে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। সাতক্ষীরা শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দুরে কালীগজ্ঞ উপজেলা সদর। সেখান থেকে পূর্ব দিকে পিচঢালা ১৪ কিলোমিটার পথ পেরুয়ে চারদিকে আম, জাম, লিচু, জামরুল, কাঁঠালসহ বিভিন্ন ফলগাছে ভরা ছায়া ঢাকা গ্রামের নাম বন্দকাটি। প্রকৃতি যেন নিজে হাতে সাজিয়ে রেখেছে গ্রামটি।

শুক্র এবং শনিবার আমার ছুটির দিন। গত শনিবার সকাল ৮.৩০ আমার এক প্রিয় মানুষের ফোন, “মাসুম ১০ মিনিটের মধ্যে প্রস্তুত হতে পারবে? একটি বিশেষ ফোন পাচ্ছি কিন্তু সত্য-মিথ্যা যাচাই না করে বোঝা যাচ্ছে না বছরের পর বছর এমন ঘটনা কিভাবে ঘটছে?”। সাতক্ষীরা থেকে দু’জন বের হয়ে পড়লাম মটর সাইকেলে। গ্রামে সকালে সরেজমিনে যেয়ে জানা গেল একের পর এক ঘটে যাওয়া সব লোমহর্ষক ঘটনা। গত একযুগ ধরে বন্দকাটি গ্রামে ছোট ছোট শিশুদের রাতে তুলে নিয়ে যেয়ে কে বা কারা যৌন নিপীড়ন করছে।

যৌন নিপীড়ন করার পর পাঁচটি শিশুকে হত্যাও করা হয়েছে। প্রায় ৫০টির মতো যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটলেও একটিরও কোনো প্রতিকার হয়নি। কেউ থানাও অভিযোগ করেনি। যৌন নিপীড়নে পর যেসব শিশুরা বেঁচে আছে তারা অধিকাংশ অসুস্থ। বন্দকাটি গ্রামে বর্ষিয়ান আব্দুল গফুর ও মুক্তিযোদ্ধা সামছুর রমহান সরদার জানান, প্রায় এক যুগ আগের কথা।

হঠাৎ করে এক রাতে একটি শিশু মায়ের পাশে শুয়ে থাকা অবস্থায় উধাও হয়ে গেল। ভোরবেলা তাকে পাওয়া গেল জখম অবস্থায়। মলদ্বার দিয়ে রক্ত ঝরছে। যৌনাঙ্গ তবিত। কে বা করা এ ঘটনা ঘটালো তার কোনো হদিস করা গেল না।

কয়েকদিন যেতে না যেতে একই ঘটনা ঘটলো গ্রামের আর একটি বাড়িতে। দিনের পর দিন বাড়তে থাকলো। কোনো প্রকার কুল কিনারা করা গেল না। তারা আরও জানান, যেসব বাড়ি থেকে শিশু তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে তার প্রত্যেকেই গরীব এবং অশিক্ষিত। বন্দকাটি গ্রামে তাসলিমা খাতুন জানান, তাদের চার মাসের শিশু নিয়ে স্বামী-স্ত্রী ঘুমিয়ে ছিল রাতে।

কে বা কারা তার শিশুটি কোলের মধ্যে থেকে থেকে নিয়ে যায় তুলে। ভোরবেলা বাড়ি থেকে দেড়শ‘ গজ দুরে পুকুরের পাশে রাস্তার উপর শিশুটিকে পাওয়া যায়। একই ধরনের কথা বলেছেন, জেলেপাড়ার সুখদেব মণ্ডল( এরা জেলে সম্প্রদায়, অনেক ক্ষেত্রে বারান্দায় ঘুমায়)। তার তিন মাসের মৃত শিশুটিকে পাওয়া যায় বাড়ি থেকে ৫০০ গজ দুরে। একই এলাকার তজিমুদ্দিন গাজী জানান, তার মেয়ের পাঁচ মাসের শিশুটিকে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় বাড়ি থেকে আড়াইশ‘ গজ দুরে বিলের মধ্যে।

তারা জানায় প্রত্যেকটি শিশুর মলদ্বার ও যৌনাঙ্গ ছিল তবিত। শিশু রাতে তুলে নিয়ে যেয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটনায় আতঙ্কে ও ভয়ে এলাকা ছেড়ে চলেও গেছেন কয়েকজন। বন্দকাটি গ্রামে কয়েকজন মা বলেন, প্রায় প্রতিরাতে তাদের শিশুসহ কারো না কারো শিশু তুলে নিয়ে যেতো কে বা কারা। তারপর যৌন হয়রানি করে দুরে বিলের মধ্যে অথবা পুকুর পাড়ে ফেলে রেখে যেত। শিশুদের খুজেঁ না পেলে বন্দকাটি গ্রামে হাফেজ গাজীর ছেলে মোবারক গাজী খুঁজে এনে দিত।

নির্যাতনের শিকার ওইসব শিশুদের এখনও চিকিৎসা দিতে হচ্ছে অনেককে। অনেকেই স্বাভাবিকতা হারিয়ে ফেলেছে। তারা আরও জানায়, যে বাড়ির শিশুকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়, তার আগে মোবারক ওই বাড়িতে যেয়ে শিশুটির খোঁজখবর নেয়। যৌননিপীড়নের ঘটনা ঘটনার পর শিশুটি খুঁজে পাওয়া গেলে সে আর ওই বাড়ির দিকে ভুলেও পা মাড়ায় না। শিশু খুঁজে পাওয়া ও শিশু হারিয়ে যাওয়ার আগে ওই বাড়িতে যাওয়ায় এলাকার মানুষ জন তাকে সন্দেহ করে।

বছর পাঁচেক আগে এলাকার মানুষ বিষয়টি নিয়ে এক বৈঠকে বসেন। সেখানে মোবারক গাজী ভুল স্বীকার করে তার কৃতকর্মের জন্যে মা চায়। এবং গ্রামে এ ধরণের ঘটনা ঘটলে তিনি দায়ী থাকবেন বলে মুচেলেকা দেন। বৈঠকে বন্দকাটি গ্রামে আব্দুল গফুর, মুক্তিযোদ্ধা ছামছুর রহমান সরদার, মোহাম্মাদ আলী মোড়ল, রজব আলী গাজী, ছামছুদ্দিন গাজীসহ প্রায় দেড়শ‘ মানুষ উপস্থিত ছিলেন। ওই বৈঠকের পর গ্রামে ওই ধরণের অপ্রীতিকর কোনো ঘটনা ঘটেনি দীর্ঘদিন।

বন্দকাটি গ্রামের পাশ্ববর্তী গ্রাম রামনগর গ্রামের চৌকিদার আলেক গাজীর ছেলে আবু বকর গাজী(২৭) জানায়,বৃহস্পতিবার রাতে বাড়িতে তিনি ও তার স্ত্রী তাদের চার মাসে শিশু নিয়ে রাতে ঘুমিয়ে ছিলেন। রাত তিনটার দিকে তাদের শিশুটি চিৎকার দিয়ে ওঠে। ঘুম ভেঙ্গে যাওয়ায় তিনি দেখতে পান মোবারক গাজী দৌড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। পরে তারা দেখতে পান শিশুটির মলদ্বার দিয়ে রক্ত ঝরছে। যৌনাঙ্গ তবিত।

ওই রাতে তিনি বিষয়টি প্রতিবেশিদের জানান। পরেরদিন বন্দকাটি গ্রাম থেকে মোবারক গাজীকে ধরে নিয়ে এসে স্থানীয় কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেনে কাছে সোপর্দ করা হয়। আমরা মোশারফ হোসেনের কাছে জানতে চাই কেন ঐ ব্যক্তিকে এখনও পুলিশে সোপর্দ করা হয়নি। হতচকিত চেয়্যারম্যান পুলিশকে খবর দেন, উপস্থিত একজন পুলিশ সহ-উপ-পরিদর্শক আবার জ্বিন-ভুত খুঁজছিল! আমি কিছু কথা বলার পর আসমিকে পুলিশ নিয়ে যায়। একই সাথে শিশুটিকে সাতক্ষীরা সদর হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করি।

আতিক ভাই (ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন) ফোনে জানালেন তিনি ঢাকায়, ডিউটি ডাক্তারকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বৃহস্পতিবার নতুন করে রামনগর গ্রামে শিশুকে রাতে তুলে নিয়ে যেয়ে যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটায় এলাকার জেলেপাড়ার কমলা দাসী, ভাদ্রী দাসী, কিনি দাসী, বন্দেকাটি গ্রামের নূরনাহার, ফজিলা খাতুন, রামনগর গ্রামের রহিমা খাতুনসহ অনেকে বলেন, এলাকায় কিভাবে থাকবো। সারারাত আগের মতো জেগে পাহারা বসাতে হবে। না হলে অন্যত্র চলে যেতে হবে। মোবারক গাজী তার বিরুদ্ধে অভিযোগ অস্বীকার করে জানায়, তিনি শিশুদের ভালোবাসেন এ জন্য কখনও কখনও কারো বাড়িতে যেয়ে আদর করে।

কিন্তু ওই অকাজের সঙ্গে জড়িত নন। সাতক্ষীরা সদর হাসপাতলের ডা, অলোক কুমার সরকার জানান, শিশুটির মলদ্বার রক্তাক্ত ও যৌনাঙ্গ ছিঁড়ে গেছে। তবে শিশুটির অবস্থা উন্নতির দিকে। তার মতে, এ ধরণের জঘন্য কাজা কোনো সুস্থ মানুষ করতে পারে না। যে বা যারা করেছে তারা বিকৃত ম¯তৃস্কের।

কৃষ্ণনগর ইউপি চেয়ারম্যান মোশারফ হোসেন জানান, বিষয়টি তিনি উভয় পরে কাছ থেকে শুনেবুঝে মোবারক গাজীকে কালীগজ্ঞ থানায় সোপর্দ করেছেন। কালীগজ্ঞ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো: ফরিদউদ্দিন বললেন সাতক্ষীরায় একটি কনফারেন্সে ছিলেন, তাকে ঘটনা জানানোয় তিনি সেখান থেকে সাতীরা সদর হাসপাতালে শিশুটিকে দেখতে যান। তিনি বলেন, শুনতে পাচ্ছি মোবারক গাজী অনেক দিন ধরে এ ধরণের অপকর্ম করে আসছে। বিষয়টি তদন্ত না করে বিস্তারিত বলা যাবে না। শিশুটির পিতা আবু বকর গাজী বাদি হয়ে একটি মামলা দায়ের করেছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের সংশোধিত ২০০৩ এর ৯(৪)(খ) ধারায় মামলা গ্রহণ করা হয়েছে। রোববার সাতক্ষীরার উদ্ধর্তন বিচারিক হাকিম মেয়েদি আল মাসুদের আদালতে হাজির করা হলে তিনি মোবারক আলীকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। আমার প্রশ্ন হলো, এতবছর ধরে এমন একটি জঘণ্য ঘটনা ঘটছে অথচ কেউ এ বিষয়ে তেমন উচ্চবাচ্য করল না! পুলিশ, প্রশাসন, স্থানীয় সরকারের তাহলে কাজটি কী? আর এনজিওগুলো করে টা কী? এদের নাকি সারাদেশে বিরাট কাজ(পড়ুন অকাজ!)। ঐ অঞ্চলে কর্মরত মানবাধিকার বিষয়ক এনজিও, পুলিশ এবং জনপ্রতিনিধিদের প্রকাশ্য বিচার চাই সবার আগে। ইস! যে শিশু ৫টি মারা গিয়েছে তাদের প্রত্যেকের বাড়িতে গিয়ে আমার কান্না পাচ্ছিল।

বিশেষ করে মায়েদের আহাজারি শুনে। আর আমাদের এই দায়িত্বপ্রাপ্ত পশুগুলো এ আওয়াজ পায়নি আজও।


এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।