আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাইছলামির সংসদ



এ পালার আওয়ামী লীগ সরকার তার শেষ বাজেট সংসদে পাস করেছে। ২ লাখ ২২ হাজার ৪৯১ কোটি টাকার এত বড় বাজেট আগে কখনো বাংলাদেশে পাস হয়নি, পেশও হয়নি। সমালোচক বিশ্লেষকরা প্রথাগত সমালোচনা এবং বিশ্লেষণ করেছেন। তাতে কোনো রকমফের অতীতে হয়নি, এবারও না। কেউ বলেছেন উচ্চাভিলাষী, কেউ বলেছেন গণমুখী, কেউ বলেছেন গণবিরোধী, কেউ বলেছেন গরিব মারার- ধনীকে আরও ধনী করার বাজেট, ইত্যাদি।

আবার অনেকেই বলেছেন নির্বাচনী বাজেট। যে ভাষা বা শব্দেই বলা হোক, বাজেটঘনিষ্ঠ এ শব্দগুলো আমাদের খুব পরিচিত। প্রতিবছর বাজেট এলেই এই শব্দগুলো শুনতে হয়। ইচ্ছা বা অনিচ্ছায় শোনা শব্দগুলোর সঙ্গে আমাদের একটা মাখামাখি হয়ে আছে। এখন আগে থেকেই বলে দেয়া যায় কোন দল তাদের বাজেট আলোচনায় কোন শব্দ ব্যবহার করবে।

সুতরাং বাজেটের তথাকথিত আলোচনা বা সমালোচনায় ব্যবহৃত শব্দ নিয়ে জনগণের মধ্যে স্বস্তি আছে কিনা জানিনা, অস্বস্তি ‘নেই’ বলতে পারি হলফ করে। ফখরুদ্দিন-মঈন উদ্দিন পরবর্তী আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরের কোনো বাজেট অধিবেশনে যোগ দেয়নি বিরোধী দল বিএনপি। তারা সংসদের বাইরে থেকে বিকল্প বাজেট প্রকাশ করেছে। এবার বিকল্প বাজেটের পথে না গিয়ে, তারা বাজেট অধিবেশনে যোগ দিয়েছে। বাজেট বা দেশের জাতীয় সঙ্কটের উপর আলোচনা না করে, তাদের নারী সদস্যরা কোমরে কাপড় বেঁধে লিপ্ত হয়েছে আদিম ঝগড়ায়।

হায়রে হায় ঝগড়া। কে কত বেশি অরুচিকর শব্দ প্রয়োগ করতে পারে, কত মিথ্যা বানোয়াট তথ্য দেয়া যায়, কার কাপড় কতটা খোলা যায়, অবতীর্ণ হয়েছে সেই প্রতিযোগিতায়। সেরের উপর সোয়া সের হয়ে গর্জে উঠেছে সরকারি দল। তারা কেন পিছিয়ে থাকবে? সংসদে অনভিপ্রেত টানটান কদর্য প্রতিযোগিতা চলেছে ঘণ্টার পরে ঘণ্টা। একজন লিপ্ত হয়েছে কুরুচির বিষোদগারে- অন্যরা শেয়ালের মতো টেবিল চাপড়ে হুক্কাহু করে সমর্থন যুগিয়েছে।

তাদের শব্দের ব্যবহার এবং অঙ্গভঙ্গি দেখে চারদিকে ঢিঁ ঢিঁ পড়ে গেছে। পত্রিকায়, টেলিভিশনে, চায়ের কাপে, ড্রইং রুমে, পাড়ায়, মহল্লায়, প্রবাসে, ফেসবুকে ছি ছি’র শোর উঠেছে। সমালোচনার ঝড় মহাসেনকে হার মানিয়েছে। এই সুযোগে অনেকেই সংসদের সংরক্ষিত মহিলা আসন তুলে দেয়ার দাবি করেছে। কেউ কেউ বলেছে, তানজেনিয়া, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ ছাড়া পৃথিবীর অন্য কোনো সভ্য দেশে সংরক্ষিত মহিলা আসনের ব্যবস্থা নেই।

বাংলাদেশের সংসদ থেকে মহিলাদের সংরক্ষিত আসন তুলে দেয়ার সময় এসেছে। বিশিষ্ট কলাম লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ একহাত বাড়িয়ে বলেছেন, সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা থাকলে দেশে গণতন্ত্র থাকবে না। প্রায় সকলের ক্ষোভের পাথর ছুটেছে সংরক্ষিত মহিলা আসনের দিকে। ফেসবুকে দাবি উঠেছে সংসদ অধিবেশন সম্প্রচারের সময় টিভির পর্দায় ১৮+ লটকে দেয়া হোক। বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ থেকে সংরক্ষিত মহিলা আসন তুলে দেয়ার পক্ষে আমিও।

তবে যে অভিযোগে সংরক্ষিত আসনব্যবস্থা বাতিলের কথা বলা হচ্ছে তার সঙ্গে একমত নই। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসন তুলে দিয়ে ঐ ৩০টি আসন বিশিষ্ট নাগরিকদের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে। যেখানে মনোনীত হবেন শুধু সুশিক্ষিত বিশিষ্ট নাগরিকগণ, যারা কখনোই তথাকথিত স্মার্ট নেতানেত্রীদের সঙ্গে ভোটের যুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন না। প্রায় দেড় কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি ছড়িয়ে আছেন পৃথিবী জুড়ে। যাদের টাকা দেশের জাতীয় বাজেটের নিয়ামক- কোটার ভিত্তিতে তাদের জন্যও থাকতে পারে সংরক্ষিত আসন।

প্রবাসীরা শুধু ইউরো ডলার কামাই করেন না, অর্জন করেন বাস্তবভিত্তিক, আধুনিক এবং বিজ্ঞানসম্মত অভিজ্ঞতাÑ যা কাজে লাগানো যেতে পারে দেশের কল্যাণে। যুবক প্রবাসীদের অনেকেই মনে করেন, বাংলাদেশের জনগণের তুলনায় বর্তমানের নেতানেত্রীরা অনেক স্মার্ট। অনেক সভ্য এবং রুচিশীল। তাদের ভাষায়- আমাদের জনজীবনের কোথায় অশ্লীলতা নেই? দুর্নীতি, ধাপ্পাবাজি, অসভ্য খিস্তি নেই কোথায়? একবার ভাবুন তো- সর্বক্ষণ যে অশ্লীল মানুষের বেষ্টনীতে নেতানেত্রীরা থাকেন, যে পরিমাণে তেল আর তোষামোদির খীরে লুটোপুটি করেন, সেই তুলনায় তারা কি অনেক সভ্য নয়? আমাদের গণমানুষের চরিত্র কি? ভোটের সময় আমাদের চরিত্র কেমন হয়? কম আর বেশি- দেশের সবাই দুর্নীতি, অশ্লীলতা বা খিস্তিখেউড়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কেউ পছন্দ করে আওয়ামী নেতানেত্রীর মুখের খিস্তি, কেউ পছন্দ করে বিএনপির, এই যা পার্থক্য।

নেতানেত্রীকে ঘিরে থাকা চার পাশের মানুষের চরিত্র কি? তাদের সঙ্গে যদি ভালো ব্যবহার করা হয়, ভদ্র ভাষায় কথা বলা হয়, তবে কি নেতানেত্রীর চেয়ার থাকবে? থাকতে দেবে? দেবে না, অকারণেই উল্টাবে সকাল বিকাল। যে নেতা তার কর্মীদের সঙ্গে যত বেশি কদর্য ব্যবহার করতে পারে, কারণে অকারণে পাছায় লাথি দিতে পারে, তার কর্মীবাহিনী তত বেশি শক্ত, সক্রিয়। বাংলাদেশে ভালো ব্যবহারের ভাত নেই, বিশেষ করে রাজনীতিতে। নেতা তার কর্মীর সঙ্গে তুই তুকারি করলে কর্মী গর্ববোধ করে, খুশি হয়। সুতরাং নেতানেত্রীরা সেভাবেই অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে।

গোটা বাংলাদেশের কোথাও একজন রাজনীতিক দেখানো যাবে না, যে অকথ্য ভাষার ব্যবহার ছাড়া কথা বলে। ক’দিন আগে ফেসবুকে একটা ভিডিও ক্লিপ দৃষ্টিগোচর হয়, নিখোঁজ বিএনপি নেতা ইলিয়াস আলী পুলিশের দিকে (সম্ভবত পুলিশের বাধায় অফিসে ঢুকতে না পেরে) বৃদ্ধাঙ্গুল তুলে বলছেন, ‘বিএনপি অফিসের চুলও (চুলের হিন্দী উচ্চারণে) ফালাইতে পারবেন না, বিএনপি আবার ক্ষমতায় আসবে’। কাদিয়ানিবিরোধী আন্দোলনের নেতা মুফতি নূর হোসাইন নূরানীকে দেখেছিলাম, স্টেজে দাঁড়িয়ে নিজের এক কর্মীকে লাথি দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। ঘরে-বাইরে এদের আসল চেহারা এমনই। খামোখা সংসদে গিয়ে অভিনয় করার দরকার কি? আসল রূপেই তো ভালো।

তারাও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, সমর্থকরাও খুশি হয়। তাই যদি না হবে তবে কেন সংসদে একজন অশালীন কথা বললে অন্যরা টেবিল থাপড়ে সমর্থন যোগায়? প্রতিপক্ষ কেন একই ভাষায় উত্তর দেয়? জনগণ কেন পক্ষে বিপক্ষে সেøাগান তোলে? সাংবাদিক, লেখকরা কেন পক্ষে বিপক্ষে কলম ধরে? ইনিয়ে বিনিয়ে অশ্লীলতাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে? সংসদ কার্যপ্রণালীর ১৫নং বিধি মোতাবেক স্পিকার কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না? দলীয় প্রধানরা কেন ব্যবস্থা নেন না? সত্যি কথা হলো- আমাদের জনগণ যা সেই তুলনায় নেতানেত্রীরা অনেক সভ্য। তারা যে সংসদে এর বাচ্চা ওর বাচ্চা, এর ছেলে ওর ছেলে বলে কথা বলেন না এটাই অনেক বেশি। পান খেয়ে একে অপরের গায়ে পিক ছিটান না এতেই শুকরিয়া। আমরা যে গণতন্ত্রের কথা বলি সেই গণতন্ত্রের জন্ম খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতকে গ্রিসের এথেন্সে।

সেই গণতন্ত্রের কোথাও বলা নেই সংসদ সদস্যরা দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের সংবিধানে বলা আছে। ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কোনো সংসদ সদস্য নিজ দলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থা বাতিল করেছে, কোনো আওয়ামী সাংসদ যদি এর সঙ্গে একমত নাও হয় তবু সে এই বিলের বিরুদ্ধে ভোট দিতে পারবে না। যদি দেয় তার সংসদ সদস্য পদ টিকবে না।

এটা কোন গণতন্ত্র, কেমন গণতন্ত্র? এথেন্সে জন্ম নেয়া গণতন্ত্রের এমন অশ্লীল রূপ তো পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না! বুঝতে বাকি থাকে না- এটা হাসিনা খালেদার গণতন্ত্র অথবা বাংলাদেশি গণতন্ত্র। বাংলাদেশের নিজস্ব গণতন্ত্রের বলয়ে খিস্তি করার, অন্যের কাপড় খোলার অবাধ স্বাধীনতা ভোগ করেন নেতানেত্রীরা। সংসদে যখন একদল অন্যদলের বিরুদ্ধে খিস্তি করে, অপমান করে তখন বুঝতে হবে এটা তাদের দলীয় বিল, এর বিরুদ্ধে কেউ অবস্থান নিলে বা খিস্তিতে অংশ (টেবিল চাপড়ে) না নিলে তার সদস্যপদ থাকবে না। এমনটাই হাসিনা খালেদাদের সিদ্ধান্ত। দলের সদস্যপদ রক্ষার জন্য হলেও তাদের খিস্তি করতে হয়।

শুধু তাই নয়, সংসদের বাইরে এমপি মন্ত্রীদের বাস্তব চেহারা কি দেখি? ছাত্র সময় থেকেই চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কমিশনবাজির সঙ্গে জড়িত। প্রায় সবার নামে হত্যা, গুম, দুর্নীতিসহ মাল্টি কালার মামলা হয়েছে। কেউ প্রকাশ্যে পিস্তল উঁচিয়ে তাড়া করছে তার ভোটারদের। কেউ পরিদর্শনের নাম করে টিভি ক্যামেরার সামনে সড়ক কর্মকর্তাদের লাঞ্ছিত করছে। সাংবাদিক পেটাচ্ছে, শিক্ষকসহ উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের চড়-থাপ্পড় মারছে।

সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে প্রকৌশলী, ম্যাজিস্ট্রেট, ডাক্তার, উকিল, পুলিশ, মুক্তিযোদ্ধা কেউই রেহাই পাচ্ছে না এদের হাত থেকে। যাদের ভোটে নির্বাচিত হয়ে এরা সংসদে- হরতাল অবরোধের নামে তাদেরই দোকান, গাড়ি ভাংছে, আগুন দিচ্ছে। সংসদে যখন বাজেট অধিবেশন চলছে ঠিক সেই সময় খবর প্রকাশিত হয়েছে, জুন মাসের প্রথম ২১ দিনেই প্রবাসীরা বৈদেশিক মুদ্রা পাঠিয়েছেন ৭৭ কোটি ৪২ লাখ ২০ হাজার মার্কিন ডলার। সদ্য সমাপ্ত (২০১২-১৩) অর্থবছরে প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের মোট পরিমাণ ১ হাজার ৪৪৬ কোটি ৫ লাখ মার্কিন ডলার। যা গতবছরের তুলনায় ১২ দশমিক ৫ শতাংশ বেশি।

এর আগে ২০১১-১২ অর্থবছরে ১ হাজার ২৮৪ কোটি ৩৪ লাখ ও ২০১০-১১ অর্থবছরে ১ হাজার ১৬৫ কোটি ৩ লাখ মার্কিন ডলার পরিমাণ টাকা পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রায় একই সময় ২৪ জুন তারিখে খবর প্রকাশিত হয়েছে, ২০১২ সালে সুইজ ব্যাংকে বাংলাদেশিদের গচ্ছিত টাকার পরিমাণ ১৯০৮ কোটি ডলার। এছাড়া সিঙ্গাপুর, মালেশিয়া, দুবাই, ইতালি, জার্মানি ইংল্যান্ড, আমেরিকাসহ আরও অনেক দেশে আছে হাজার কোটি ডলার, ইউরো। কারা রেখেছে এসব টাকা? প্রবাসীরা বা দেশের সাধারণ মানুষ? না, এসব টাকার প্রায় ৮০ শতাংশ রেখেছেন রাজনীতিকরা। যারা ঘরে বাইরে সংসদে খিস্তি করেন।

প্রবাসীদের রক্ত পানি করা কোটি কোটি ইউরো, ডলার, পাউন্ড, রিয়াল, রিঙ্গিতে পুষ্ট হয়ে সংসদে উচ্চাভিলাষী বাজেট দেন। যারা ইউরোপ আমেরিকায় সেকেন্ড হোম নির্মাণ করেন। http://www.shaptahik.com/v2/?DetailsId=8455

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.