সভাপতি- বিক্রমপুর সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক পরিষদ, সম্পাদক ঢেউ, সভাপতি- জাতীয় সাহিত্য পরিষদ মুন্সীগঞ্জ শাখা
বাল্যবিভোর লেখক
হুমায়ুন আজাদ জন্মেছিলেন কামারগাঁও গ্রামে, ২৮ এপ্রিল অর্থাৎ মধ্য বৈশাখে। তখন নানা বাড়িতে জন্ম নেয়াটাই রীতি ছিল। কামার গাঁও ছিল একটি গাঁছপালা দ্বারা আবৃত ছায়া ঢাকা পাখি ডাকা সমতল গ্রাম। বাঁশবন আর ঝোপ-ঝাড়ে পূর্ণ ছিল তখন। তিনি বড় হয়েছেন তাঁর পৈত্রিক বাড়ি রাড়িখাল গ্রামে।
এখানে ১৫ বছর পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্নভাবে বড় হয়েছেন। ভাগ্যকুল ও রাড়িখাল ইউনিয়ন দুটি পাশাপাশি পদ্মার তীর ঘেষে অবস্থিত। তবে রাড়িখালে তাঁর পৈত্রিক বাড়িটি পদ্মা থেকে মাইল খানেক ভেতরে। বৈশাখে তাঁর জন্ম বলেই হয়তো এটা তার প্রিয় মাস। এর অগ্নি তাকে সুখ দিত।
অনেক বৈশাখে তিনি সোনাগলা তীব্র রোদের ভিতর হেটেছেন। চারদিকে রোদের গলিত সোনা দেখেছেন। এই গনগনে বৈশাখের তীব্রতা হয়তো জন্মের সময় ঢুকেছিল তাঁর ভিতরে। ২৭ ফেব্রুয়ারি মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হওয়ার কদিন আগে ৬ ফেব্রুয়ারী ০৪ তিনি ভাগ্যকুলের তরুণ অনুরাগীদের বলে গিয়েছিলেন চৈত্রের তীব্র দাবদাহ দেখতে গ্রামে আসবেন। যদিও সম্ভব হয়নি আক্রান্ত হয়ে ব্যাংককের বুমরুনগ্রাদ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকায়।
তিনি বড় হয়েছেন রাড়িখালের প্রকৃতির মধ্যে। রাড়িখালের উত্তরে বিশাল আড়িয়াল বিল। তাঁর মধ্যে নিবিড়ভাবে জড়িয়েছিল আড়িয়াল বিলের সৌন্দর্যতা। রাড়িখাল গ্রামটি হচ্ছে পুকুরের গ্রাম। পুকুরের পর পুকুর।
পুকুরের পাশে পাড়া। এই গ্রাম নিয়ে তিনি লিখেছেন- রাড়িখাল: ঘুমের ভিতর নিবিড় শ্রাবণধারা। রাড়িখাল-ভাগ্যকুলের শৈশব স্মৃতি নিয়ে লিখেছেন, 'ফুলের গন্ধে ঘুম আসে না'। তাঁর ভালাবাসার গ্রামকে সাজিয়েছেন রূপের বর্ণনায়। তাঁর শৈশব নানাভাবে তাঁর লেখায় এসেছে।
তাঁর লেখার প্রধান উৎস তাঁর শৈশব। তার প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'অলৌকিক ইস্টিমার' পদ্মা নদীতে চলতে থাকা এই স্টীমারের শব্দ শুনেই ঘুমের ভেতর জেগে উঠতেন। নিবিড়ভাবে জড়িয়ে ধরতেন ট্রাওজার। 'নিজের সঙ্গে নিজের জীবনের মধু'; 'শ্রাবণের বৃষ্টিতে রক্ত জবা' এমনকি তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস 'পাক সার জমিন সাদবাদ' এ যে শ্যামসিদ্ধির মঠ এর কথা বলেছেন। যে মঠ ধ্বংস হলে নায়কের চোখে ভেসে উঠে তাঁর শৈশবের মঠ।
ফিরে আসেন মৌলবাদীদের নরক থেকে সূর্যোদয়ের পথে। সেই মঠটিও দেখেছেন শৈশবে। 'সব কিছু ভেঙ্গে পড়ে' উপন্যাসে মাহবুব এর ভাঙ্গন পর্ব শুরু হয়েছিল রাড়িখালেই। হুমায়ুন আজাদের সৃষ্টিশীলতা জুড়ে রয়েছে তাঁর শৈশব। ছবির মতো শৈশব ভেসে উঠতো তাঁর সাহিত্যে।
তিনি চাঁদ নিয়ে লিখেছেন, রাতের চাঁদ ছিল প্রিয় সাদা বেলুনের মতো কিংবা পানু আপার ঠোঁটের হাসির মতো। মাছরাঙা নিয়ে লিখেছেন, পুকুরের আকাশে ধ্রুব তারার মতো জ্বলজ্বল করে ঝাপিয়ে পড়ে মাছরাঙা। তার লাল তরোয়ারের মতো ঠোঁট ঢুকে যায় পাবদার লাল হৃদপিন্ডে। পিঠে নিয়ে লিখেছেন, পিঠে তৈরি হচ্ছে: মায়ের আঙুলের ছোঁয়ায় কেমন রূপসী আর মিষ্টি হয়ে উঠেছে চালের আটা। সন্ধ্যের পরে মাটির চুলোয় জ্বলছে আম কাঠের লাল আগুন।
যেনো লাখ লাখ গোলাপ লাল হয়ে ফুটেছে চুলোর ভিতর। কচুরিফুলকে বলেছেন, পুকুরের ঝাড়বাতি। লাউডগা নিয়ে লিখেছেন, সব গাছই তো স্বপ্ন দেখে আকাশের কিন্তু লাউডগা স্বপ্ন দেখে দিগন্তের। আজো লাউডগা তার শেকড় ছাড়িয়ে ভিটে পেরিয়ে হাত বাড়িয়ে দেয় দিগন্তের দিকে- ঘাসের উপর পড়ে থাকে এক দীর্ঘ সবুজ চঞ্চল সুদূর পিয়াসী স্বপ্ন। সরপুঁটিকে বলেছেন, পানির নিচের আলো।
মাংসের কবিতা হল সরপুঁটি। রাড়িখাল তাঁকে জীবনভর ডাক পেরেছে। তিনি ডাক ছেড়েছেন রাড়িখাল রাড়িখাল বলে। ১২ আগস্ট জার্মানীতে মৃত্যুবরণের পরে এখন চীর নিদ্রায় শুয়ে আছেন, মিশে আছেন রাড়িখালেই।
বাল্যকাল তাকে সবসময় স্বপ্ন দেখাতো- হয়তো তাঁর মতো বাল্যবিভোর আর কেউ ছিল না বাংলায়।
বারবার তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, কেমন ছিলেন বাল্যকালে; কিন্তু দেখতে পান নি। তাঁর ছায়া দেখেছেন: একেকবার তাঁর মুখ ভেসে উঠে, সে দাঁড়ায় বাড়ির উত্তর দিক, পথ দিয়ে হেটে যায়; কিন্তু দেখতে পেয়েছেন গ্রাম, জল, মেঘ, শিশির, ধান, ঝড়, মাছের লাফ আর মানুষ। তিনিই ছিলেন বাল্যকালে সবচেয়ে সুখী, সবচেয়ে স্বাপ্নিক। ঘাস দেখে তিনি স্বপ্ন দেখতেন, কচুরি ফুল দেখে স্বপ্ন দেখতেন, এলিয়ে পড়া ধান দেখে স্বপ্ন দেখতেন; যদিও রাড়িখাল গ্রামে ওগুলো স্বপ্নের ব্যাপার ছিল না, ছিল বাস্তব। গ্রামে তিনি ছাড়া আর কারো চোখে কচুরিফুলকে মনে হতো না পৃথিবীর সুন্দরতম ফুল, দইকুলির দিকে আর কেউ বিভোর হয়ে তাকায়নি তাঁর মতো; জ্যৈষ্ঠের ভোরে হঠাৎ বর্ষায় তাঁর মতো কেউ প্লাবিত হয় নি।
বিদ্যালয়ে সব সময় শুনতের সাফল্যের কথা। বিক্রমপুর ধনীদের এলাকা। এখানে ওখানে ছড়িয়ে থাকে ধনপতিরা। তাই স্বাভাবিক ভাবেই আলোচনা হতো কে কতো বড়ো, কতো ধনী, কতো শক্তিমান হয়েছে, সেসব; কেউ কবি বা লেখক হয়েছেন তা কখনো শুনেন নি। তিনি স্বপ্ন দেখতেন এমন কিছু হতে যা কখনো কেউ হতে চায় নি রাড়িখালে।
তাঁর ইচ্ছে করতো বিদ্যাসাগর হতে, রবীন্দ্রনাথ হতে। তিনি দেখতে পেতেন বালক বিদ্যাসাগরকে। যে কলকাতার দিকে হাঁটতে হাটতে শিখে ফেলেছে ইংরেজি সংখ্যা, যার কালো রঙ ঝিলিক দিয়ে উঠতো তাঁর চোখে; দেখতে পেতেন বালক রবীন্দ্রনাথকে বন্ধ বারান্দা থেকে যে তাকিয়ে আছে অনন্তের দিকে। নবম-দশম শ্রেণী থেকেই তিনি পুরোনো বাজে কথা বাদ দিতে শুরু করেন, অতীতের দিকে তাকাতে থাকেন গভীর সন্দেহে, ধর্মে কোনো মহিমা খুঁজে পান না, প্রথা থেকে দ–রে সরিয়ে রাখেন নিজেকে; মনে হতে থাকে অতীতের চেয়ে ভবিষ্যৎ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ, অতীতের সব কিছুই মহৎ নয়। তাঁর ভেতর এক মূর্তিবিনাশী জন্ম নিতে থাকে; তখন থেকেই পুরোনোকে, অতীতকে ছেড়ে দিতে থাকেন।
তাঁর জীবনে মরে যেতে থাকে প্রথা, বিশ্বাস আর নিরর্থক নির্দেশগুলো। পরে তাই তাকে আকৃষ্ট করে যা অভিনব সৌন্দর্যমণ্ডিত, যাতে রয়েছে অভিনব চিন্ত, যা প্রথাবিরোধী। ২৭ ফেব্রুয়ারী আক্রান্ত হওয়ার ছয় মাস পরে ২৭ আগস্ট রাড়িখালে তাঁর নিজ বাড়িতে সমাহিত করা হয়। যে রাড়িখালকে বুকের মধ্যে ধারণ করে ছিলেন আমৃত্যু। সেই রাড়িখালের বুকেই ঠাঁই নিয়েছেন মৃত্যুর পরে।
রাড়িখালের পৈত্রিক ভিটায় শুয়ে আছেন চিরনিদ্রায়। ভালবাসার গ্রামকে তিনি এবং গ্রাম তাঁকে আঁকড়ে ধরে আছে চিরভালবাসার বন্ধনে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।