আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশরক্ষায় শাহাদাতের ৯ বছরেও রাষ্ট্রীয় সম্মান পাননি ৩ জওয়ান



ঐতিহাসিক বড়াইবাড়ী দিবস আজ। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী ২০০১ সালের এই দিনে কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার বড়াইবাড়ীতে হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। রাতের আঁধারে বড়াইবাড়ী বিডিআর ক্যাম্পসহ আশপাশের এলাকা দখল করে নিতে আক্রমণ চালিয়েছিল ভারতীয় বাহিনী; কিন্তু তাদের সেই আক্রমণের দাঁতভাঙা জবাব দিয়েছিল দেশপ্রেমিক বিডিআর ও স্থানীয় এলাকাবাসী। বিডিআর-জনতার সম্মিলিত প্রতিরোধ ভারতীয় বাহিনীকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করে। তত্কালীন বিডিআর মহাপরিচালক আ ল ম ফজলুর রহমানের তথ্য অনুযায়ী বড়াইবাড়ী যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর চার শতাধিক সদস্য নিহত হয়েছিল।

বিভিন্ন সভা-সেমিনারে দেয়া বক্তব্যে তিনি একাধিকবার এ তথ্য জানিয়েছেন। অপরদিকে বিডিআরের শাহাদাত বরণ করেন ৩ জন। নিজের জীবন দিয়ে ৩ বিডিআর সদস্য দেশের মাটি রক্ষা করেন; কিন্তু তাদের আজও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা না দেয়ায় ক্ষুব্ধ বড়াইবাড়ী এলাকার মানুষ। নতুন প্রজন্মের স্থানীয় যুবকরা বলেন, মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি বা দেখার সৌভাগ্য হয়নি; কিন্তু ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভারতীয় বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করতে যে যুদ্ধ রচিত হয়েছিল তাকে সত্যিকার অর্থে আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ মনে হয়েছে। ১৮ এপ্রিল রাত থেকে যুদ্ধ চলে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত।

যুদ্ধে বিডিআরের ল্যান্স নায়েক ওয়াহিদ মিয়া, সিপাহী মাহফুজুর রহমান ও সিপাহী আবদুল কাদের শহীদ হন। গুরুতর আহত হয়েছিলেন আরও ৬ জন। ২০ এপ্রিল যুদ্ধ থামার পর বিডিআর-বিএসএফ পতাকা বৈঠকে ১৬টি লাশ ও দু’জন আত্মসমর্পণকারী বিএসএফ সদস্যকে হস্তান্তর করা হয়। আমার দেশ-এর রৌমারী প্রতিনিধি আতাউর রহমান গতকাল সরেজমিনে বড়াইবাড়ী পরিদর্শন করে জানান, সেদিনের কথা মনে করে এখনও গ্রামের মানুষ আতঙ্কে রাত কাটায়। বড়াইবাড়ী গ্রামের ২৪০ পরিবারের ১ হাজার ২০০ মানুষের সময় কাটে উদ্বেগ-উত্কণ্ঠায়।

গ্রামের ইউসুফ মাস্টার, আনসার আলী, বাদশা মিয়া জানান, প্রতি রাত জেগে মানুষ এখনও গ্রাম পাহাড় দেয়। ৮ জন করে ৭টি গ্রুপে সার্বক্ষণিক পাহারায় থাকে। তাদের সহযোগিতা করেন স্থানীয় বিডিআর ক্যাম্পের সদস্যরা। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, ২০০১ সালের ১৮ এপ্রিল ভোর সাড়ে ৩টায় ভারতীয় বাহিনী বড়াইবাড়ী দখলের উদ্দেশ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশের ভেতরে প্রবেশ করে। রাতের আঁধারে বড়াইবাড়ী বিডিআর ক্যাম্প দখলে নেয়ার চেষ্টা চালায় তারা।

রাতে ধানক্ষেতে পানি দিতে আসা মিনহাজ উদ্দিন নামের এক যুবককে রাস্তায় পায় ভারতীয় বাহিনী। তার কাছে জানতে চায় বিডিআর ক্যাম্প কোন দিকে। সে ঘটনা বুঝতে পেরে বিডিআর ক্যাম্পের উল্টো দিকে তাদের দেখিয়ে দেয়। ভারতীয় বাহিনী সেদিকে রওনা করলে মিনহাজ উদ্দিন জীবন বাজি রেখে বিডিআর ক্যাম্পে চলে আসে এবং ভারতীয় বাহিনী প্রবেশ করার সংবাদ দেয়। এ সংবাদ পেয়ে প্রস্তুতি নেন বিডিআর ক্যাম্পের সদস্যরা।

এরই মধ্যে রাস্তায় টহল বিডিআর পেয়ে গুলি চালায় ভারতীয় বাহিনী। এদিকে প্রস্তুতি নিয়ে ক্যাম্প থেকে পাল্টা গুলি চালায় বিডিআর। শুরু হয় যুদ্ধ। ভারতীয় বিশাল বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে অটল থাকে ক্যাম্পের ২৫ বিডিআর। সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলে স্থানীয় জনগণও।

আক্রমণের সংবাদ পেয়ে জামালপুর থেকে সকাল ১০টায় লে. কর্নেল শায়রুজ্জামানের নেতৃত্বে অতিরিক্ত ফোর্স সেখানে পৌঁছায়। এতে যুদ্ধ আরও তীব্র রূপ নেয়। ১৮ এপ্রিল থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত চলে এ যুদ্ধ। ভারতীয় বাহিনী মরিয়া হয়েও বিডিআর ক্যাম্প দখলে নিতে পারেনি। একপর্যায়ে প্রাণে বেঁচে থাকা দুই বিএসএফ সদস্য আত্মসমর্পণ করে।

তবে এর আগে প্রথম আক্রমণেই বিডিআর ক্যাম্প দখলে নিতে না পেরে ভারতীয় বাহিনী গ্রামের ৮৬টি বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। এদিকে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান রুহুল আমিন জানান, শাহাদাত বরণকারী ৩ বিডিআর জওয়ানের স্মরণে স্থানীয় লোকদের নিয়ে তিনি বিডিআর ক্যাম্পের পাশে শহীদ মিনার তৈরি করেছেন। প্রতিবছর ১৮ এপ্রিল স্থানীয় জনগণ শহীদ মিনারে বিডিআর সদস্যদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর পাশাপাশি মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করে। আমাদের বেগমগঞ্জ প্রতিনিধি আজাদ ভূঁইয়া জানান, বড়াইবাড়ী যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী জওয়ান ল্যান্স নায়েক ওয়াহিদের পরিবারের খোঁজখবর রাখে না কেউ। বড়াইবাড়ী যুদ্ধে দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষায় শাহাদাত বরণ করেন তিনি।

আজ তার নবম শাহাদাত বার্ষিকী। কেউ তাদের খোঁজখবর না রাখলেও এ উপলক্ষে মরহুমের পরিবার-পরিজন গ্রামের বাড়ি বেগমগঞ্জের কাদিরপুর গ্রামে কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল ও দোয়ার আয়োজন করেছে। নবম শাহাদাত বার্ষিকী উপলক্ষে শহীদের মা মাফিয়া খাতুনের কাছে জানতে চাইলে তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, ‘হুত জি মরলে কেমন লাগে বাবা’। তিনি বলেন, ছেলে হারার বেদনা যে কেমন এটি একমাত্র মা জননী ছাড়া পৃথিবীর কেউ বুঝে না।

কাউকে বোঝানোও যায় না এবং এটি বলে বোঝানোর মতোও নয়। তিনি বলেন, ছেলের মৃত্যু সংবাদ শুনে দীর্ঘদিন পাগলের মতো ছিলেন তিনি। এখনও ছেলে শহীদ ওয়াহিদের কথা মনে পড়লে কলিজা ফেটে যায়। ওয়াহিদের স্ত্রী সখিনা খাতুন জানান, স্বামী শহীদ হওয়ার পর ১ লাখ টাকার একটি চেক ছাড়া সরকার ও বিডিআরের হেডকোয়ার্টার থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাননি তারা। গত ১৩ অক্টোবর ২০০৯ সালে আমার দেশ-এ নিউজ ছাপা হওয়ার পর বিডিআরের ফেনী ব্যাটালিয়ন থেকে একজন হাবিলদার এসে খোঁজখবর নেন এবং পিলখানা থেকে তাদের সমস্যা জানতে চাওয়া হয়।

কিন্তু বড় ছেলে দেলোয়ার ওয়াহিদ চাকরির জন্য ২০০৫ সালে তিনবার বিডিআর হেডকোয়ার্টার পিলখানায় গেলেও তাকে ভেতরে প্রবেশ করতে দেয়া হয়নি। অভাব-অনটন আর দুঃখ-কষ্টে জীবন যাচ্ছে তাদের। শহীদ ওয়াহিদের স্ত্রী সখিনা খাতুন আরও জানান, তার স্বামীর মৃত্যুর পর আমার দেশ কর্তৃপক্ষ বিশেষ করে পত্রিকার চেয়ারম্যান মাহমুদুর রহমান যে সম্মান তাদের দেখিয়েছেন, তাতে তারা ভীষণ আনন্দিত ও খুশি। ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা প্রতিনিধি ফেরদৌস আলম জানান, বড়াইবাড়ী যুদ্ধে শহীদ বিডিআর জওয়ান সিপাহী আবদুল কাদের মুক্তাগাছার সন্তান ছিলেন। তার পরিবারের সদস্যরাও জানিয়েছেন তাদের খোঁজ এখন আর কেউ রাখে না।

বাড়ির পাশে তার কবরটিও অরক্ষিত। পুত্রশোকে ২০০৫ সালে মা ইন্তেকাল করেন। মা মারা যাওয়ার আগে দেশের মাটির জন্য জীবনদানকারী ছেলের রাষ্ট্রীয় সম্মান দেখে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সেই প্রত্যাশা পূরণ হয়নি। শহীদ কাদেরের ছোট ভাই আবদুল বারেক জানান, গত বছর আমার দেশ কর্তৃপক্ষ তাদের সম্মাননা দিয়েছে।

দৈনিক আমার দেশ-এ ধারাবাহিক প্রতিবেদনে বড়াইবাড়ী শহীদদের বিষয়ে সংবাদ প্রকাশের পর অনেকেই শহীদের কবর দেখতে আসেন। তবে কবরটি সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থা এখনও নেয়া হয়নি। বড়াইবাড়ী যুদ্ধে শাহাদাত বরণকারী আরেক সিপাহী মোঃ মাহফুজের বাড়ি জয়পুরহাটে। তার পরিবার-পরিজনের খবর কেউ রাখে না বলে জানান শহীদের আত্মীয়-স্বজনরা। প্রসঙ্গত, গত বছর দৈনিক আমার দেশ’র প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বড়াইবাড়ীর ৩ শহীদ পরিবারকে দেশরক্ষায় তাদের বীর সন্তানদের অবদানের জন্য আনুষ্ঠানিক সম্মাননা এবং ৫০ হাজার করে নগদ টাকা দেয়া হয়।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।