বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
রামপ্রসাদ সেন: বাংলার অন্যতম শ্রেষ্ট ভক্তিগীতির রচয়িতা। অত্যন্ত উদাসী মানুষ ছিলেন। কলকাতায় এক জমিদারের কাচারিতে মহুরির কাজ করতেন ... কখন যে ঘোরে পড়ে জমিদারির হিসাবের খাতায় লিখে ফেলতেন গান ... যে গান এমন কী বাংলার শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে মুগ্ধ করেছিল।
একবার কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পথে নদীর পাড়ে রামপ্রাসাদের গান শুনে মুগ্ধ হন ... নবাব তারপর সাধক কবিকে নৌকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে আরও গান শোনেন ... যে গানের পরতে পরতে বৈরাগ্যের প্রবল হাতছানি... অন্তরে প্রবল বৈরাগ্য নিয়ে সংসারে বেঁচে থেকে রামপ্রসাদ অবিশ্যি গৃহত্যাগ করেননি ... মায়ের উদ্দেশে লেখা একটি গানে বলেছেন: ‘আমি কি দুঃখেরে ডরাই। ’ ...
রামপ্রসাদ সেন মূলত কবি। সব কবিই কি আর গান গাইতে পারেন। রামপ্রসাদ গানও গাইতে পারতেন। ছিলেন ধর্মনিষ্ট কালীসাধক, যে কারণে তাঁর সংগীত ও কাব্য প্রতিভা দেবী কালীর চরণে অর্পণ করেছিলেন।
তবে তাঁর সব গানই যে কেবল দেবী কালীর চরণে সমর্পিত -তা কিন্তু নয়। কেননা, রামপ্রসাদের গানের বাণীতে রয়েছে মানবঅভিজ্ঞতাপ্রসূত চিরন্তন সত্যের প্রতি দিকনির্দেশ। রামপ্রসাদের সর্বপ্রেক্ষা নন্দিত গানটির প্রাথমিক চরণগুলি স্মরণ করি-
মন রে কৃষিকাজ জান না
এমন মানব জনম রইল পতিত
আবাদ করলে ফলত সোনা।
গানটি যেন বাঙালির কৃষিসমাজের প্রতিচ্ছবি । বাঙালির সংস্কৃতির সঙ্গে কৃষিসমাজের সংযোগ নিবিড়।
আজও আমরা বাঙালিরা বৈশাখের প্রথম দিবসে লাল রঙের মাটির বাসনে পান্তা ভাত খাই।
রামপ্রসাদের গান সেই বাঙালির কৃষিসমাজের নান্দনিক প্রতিনিধি ...
কিন্তু, রামপ্রসাদ সেন কোন্ সময়ের মানুষ? কবে বেঁচেছিলেন তিনি?
রামপ্রসাদ সেন এর সময়কাল ১৭২০ থেকে ১৭৮১ খ্রিষ্টাব্দ। অর্থাৎ, অষ্টাদশ শতক। যে শতকে বাংলার সমাজে একই সঙ্গে ভাঙন ও পরিবর্তনের সুর বাজছিল। নবাব সিরাজউদ্দেীলা (১৭৩৩-১৭৫৭) ক্রমশ আটকে যাচ্ছেন ইংরেজ বেনিয়া ও স্থানীয় রাজাকারদের ষড়যন্ত্রের জালে।
নদীয়ায় রাজত্ব করছেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়। তাঁর শাসনকালেই বাংলায় ইংরেজ শাসন কায়েম হয় এবং মুসলিম রাজত্বের অবসান ঘটে।
এমন এক পরিস্থিতিতে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কুমারহট্ট গ্রামে ১৭২০ সালে রামপ্রসাদ সেন জন্মগ্রহন করেন। পিতার নাম রামরাম সেন। তিনি ভেষজ ঔষুধের ব্যবসা করতেন।
রামরাম সেন এর কিছু কাব্য প্রতিভা ছিল বলে জানা যায়। যা হোক। রামপ্রসাদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ছেলেবেলায় অবশ্য পাঠশালায় পড়েছেন। এরপর পারিবারিক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন।
ব্যবসার প্রয়োজনে সংস্কৃত ভাষা শিখতে হয়েছিল। তবে ব্যবসার প্রতি আগ্রহ ছিল না, আগ্রহ ছিল সংগীত ও কবিতার প্রতি। পিতা তখন ফারসি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করেন। ফারসি ভাষার জ্ঞান তার গানেও পড়েছিল। যেমন ‘মন রে কৃষিকাজ জান না’ গানটির একটি চরণ-
কালী নামে দেওরে বেড়া, ফসলে তছরুপ হবে না ।
‘তছরুপ’ শব্দটি লক্ষণীয়। রামপ্রসাদের আরও অনেক গানে ফারসি শব্দের আধিক্য লক্ষ করা যায়। উনিশ শতকের লালনের অনেক গানেও আমরা সেরকম আরবি-ফারসির মিশেল লক্ষ করি। নজরুল যে মনোরম লক্ষণটিকে অপ্রতিরোধ্য ভাবে বহাল রেখেছেন কুড়ি শতকের মধ্য ভাগ অবধি।
এ হল আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ধারাবাহিকতার নজীর।
যা হোক। পিতার মৃত্যুর পর সংসারে আর্থিক অসচ্ছলতা ঘনিয়ে আসে। ১৮ বছরের কিশোরের কাজের সন্ধানে
পাড়ি জমাতে হয় কলকাতায় । আগেই একবার বলেছি- রামপ্রসাদ কলকাতায় জমিদারের কাচারিতের মুহুরির কাজ নেন। একদিন সেরেস্তায় দপ্তরের খাতায় জমিদার ‘আমায় দেও মা তহবিলদারী’ গানটি দেখতে পেলেন।
এভাবে রামপ্রসাদের সংগীত প্রতিভার পরিচয় পেয়ে জমিদার মুগ্ধ হন এবং রামপ্রসাদকে মুহুরির কাজ থেকে অব্যাহতি দেন। শুধু তাই নয়, মাসিক ৩০ টাকা বৃত্তি মঞ্জুর করে রামপ্রসাদকে দেশে চলে যেতে বলেন। অস্টাদশ শতকের মাঝামাঝি মাসিক ৩০ টাকা কিন্তু কম টাকা নয়!
যা হোক। রামপ্রসাদ কুমারহট্ট গ্রামে ফিরে আসেন। এবং সংগীত রচনায় নিমগ্ন হন।
গান নিজেই লিখতেন নিজেই সুর করতেন। যে গান ২০০/২৫০ বছর পরও বাঙালির হৃদয়ে অম্লান। আজও বাংলাদেশের সন্দীপনের কন্ঠে শোনা যায় ‘মন রে কৃষিকাজ জান না’ ...এপাড় বাংলা-ওপাড় বাংলার বাঙালি গানের অসাধারন মমার্থ বুঝে মাথা দোলায়। কে বলবে এ গান রচনার পর ২০০ বছরের অধিক কাল কেটে গেছে। রামপ্রসাদী সুরের এ গান যেন চিরন্তন।
রামপ্রসাদের বলা হয় রামপ্রসাদী সুর। যে রামপ্রসাদী সুর পরবর্তীকালের বাঙালির সুরকারদের প্রভাবিত করেছিল। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ রামপ্রসাদী সুরে কয়েকটি দেশাত্মবোধক গান সৃষ্টি করেছেন।
আলোচনার এ পর্যায়ে রামপ্রসাদের একটি গান পাঠ করা যাক।
মায়ের এম্নি বিচার বটে।
যেজন দিবানিশি দুর্গা বলে, তার কপালে বিপদ ঘটে। ।
হুজুরেতে আরজি দিয়ে মা, দাঁড়িয়ে আছি করপুটে।
কবে আদালতে শুনানি হবে মা, নিস্তার পাব এ সঙ্কটে। ।
সওয়াল-জবাব করব কি মা, বুদ্ধি নাইকো আমার ঘটে।
ওমা ভরসা কেবল শিববাক্য ঐক্য বেদাগমে রটে। ।
প্রসাদ বলে শমন ভয়ে মা, ইচ্ছে হয় পালাই ছুটে।
যেন অন্তিমকালে জয়দুর্গা ব’লে, প্রাণ ত্যজি জাহ্নবীর তটে।
।
বাংলা গানের একটি মূলভাব এ গানে রয়েছে। পরবর্তীকালে লালন লিখেছেন-
অগতির না দিলে গতি
ঐ নামে রবে অখ্যাতি ...
নাম শুনেছি পতিতপাবন ...
রামপ্রসাদের গানে আমরা একজন মাকে পাই ।
কে তিনি?
করুণাময় গোস্বামী তাঁর ‘বাংলা গানের বিবর্তন’ বইতে লিখেছেন,‘ রামপ্রসাদ শ্যামাসংগীত রচনা করে নতুন ধারার সৃষ্টি করেন। ’
শ্যামাসংগীত কি?
শ্যামাসংগীত হল দেবী কালী বা শ্যামা বা শক্তির উদ্দেশে রচিত এক ধরনের ভক্তিগীতি।
এর অপর নাম শাক্তগীতি। রামপ্রসাদের গানে যে মায়ের কথা রয়েছে-তিনিই কালী বা শ্যামা বা শক্তি। খ্রিষ্টীয় দ্বাদশ-ত্রয়োদশ শতকে বাংলায় বৈষ্ণবধর্মের পাশাপাশি শাক্তধর্মের উদ্ভব ঘটে এবং একে ঘিরেই শাক্তগীতি চর্চার একটি ক্ষীণ ধারার প্রচলন ঘটে। রামপ্রসাদ শাক্তগীতি চর্চার ক্ষেত্রে প্রাণসঞ্চার করেন। শ্যামাসংগীত রচনা করে ভক্তিগীতির চর্চার ক্ষেত্রে নতুন ধারার সৃষ্টি করেন।
রামপ্রসাদের চেষ্টা ছিল শক্তি সাধনাকে নীরস শাস্ত্রাচার ও তান্ত্রিকতা থেকে মুক্ত করে একটি সহজ আবেদন পূর্ণ সাংগীতিক অভিব্যক্তি দান করা। যেমন, মন রে কৃষিকাজ জান না গানের শেষ দুটি চরণ এরকম-
গুরু বপন করেছেন বীজ, ভক্তি করি তায় সেঁচ না ।
তবে একা যদি না পারিস মন, রামপ্রসাদ কে ডেকে নে না । ।
আগেই একবার বলেছি যে সে সময় নদীয়ার রাজা ছিলেন কৃষ্ণচন্দ্র রায়।
তিনি রামপ্রসাদের গান শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। রাজসভায় রামপ্রসাদকে যোগ দিতে আহবান জানান। বিষয়বিমূখ রামপ্রসাদ প্রত্যাখান করেন। (কতকিছু যে শেখার আছে এই সাধক কবির কাছ থেকে! কৃষ্ণচন্দ্র রায়-এর প্রস্তাব প্রত্যাখান করা সহজ কথা!) এর পর কৃষ্ণচন্দ্র রায় কি করলেন? রামপ্রসাদকে বেঁধে আনতে লাঠিয়াল পাঠিয়ে দিলেন?
না।
রামপ্রসাদকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধিতে ভূষিত করেন।
তাঁর ভরণ-পোষণের জন্য একশত বিঘা নিষ্কর জমি দান করলেন।
বাংলার ইতিহাস এমনই বিস্ময়কর।
তখন বলেছিলাম। একবার কলকাতা থেকে মুর্শিদাবাদ যাওয়ার পথে নবাব সিরাজউদ্দৌলা নদীর পাড়ে রামপ্রাসাদের গান শুনে মুগ্ধ হন। নৌকায় আমন্ত্রণ জানিয়ে আরও গান শোনেন।
সিরাজউদ্দৌলা কি বাংলা জানতেন?
জানি না। তবে নবাব গান বাংলাতেই শুনেছিলেন। তখন বলেছিলাম। ... তবে ব্যবসার প্রতি আগ্রহ ছিল না, আগ্রহ ছিল সংগীত ও কবিতার প্রতি। পিতা তখন ফারসি ভাষা শেখানোর ব্যবস্থা করেন।
ধরে নিলাম নবাব সিরাজউদ্দৌলা ও রামপ্রসাদ সেনের মধ্যে কথা হয়েছিল ফারসি ভাষায়। ... নবাব কিন্তু বাংলা গানই শুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন।
বাংলার ইতিহাস এমনই বিস্ময়কর।
শ্রীচৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩) যে ভাববিপ্লব ঘটিয়েছিলেন-তাতে বাংলার সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ সমর্থন জুগিয়েছিলেন। আবদুল মমিন চৌধুরী লিখেছেন, ‘ (আলাউদ্দীন হোসেন শাহ) শ্রীচৈতন্য এর প্রতি তিনি খুবই শ্রদ্ধাশীল ছিলেন এবং তাঁকে তিনি (শ্রীচৈতন্য) ঈশ্বরের অবতার বলে মনে করতেন।
শ্রীচৈতন্যের ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে হোসেন শাহ সার্বিক সুবিধা প্রদান করেছেন। (বাংলাপিডিয়া)
বাংলার ইতিহাস এমনই বিস্ময়কর।
আসুন আমরা বাংলার ইতিহাস-এর প্রতি আরও মনোযোগী হই।
রামপ্রসাদের মৃত্যু সম্বন্ধে নানা কথা প্রচলিত রয়েছেন। একবার প্রতিমা বিসর্জনের সময় রামপ্রসাদ নদীর জলে
ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
আসল ঘটনা আমরা অনুমান করতে পারি। বিরহ সইতে না পেরে শ্রীচৈতন্যদেব নীলাচলে জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন ...কিংবা মৃত্যু সম্বন্ধে কবিসুলভ কৌতূহল টেনে নিয়ে গেছে সলিল সমাধিতে ...
তথ্য উৎস:
১ করুণাময় গোস্বামী রচিত ‘বাংলা গানের বিবর্তন’।
২ খান মোঃ সাঈদ রচিত বাংলা পিডিয়ার একটি নিবন্ধ ।
উৎসর্গ: পরম সুহৃদ মেঘদূত।
রামপ্রসাদের গানের লিঙ্ক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।