লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। পাঁচ টাকার কয়েন
মোহাম্মদ ইসহাক খান
আমার আল্লাহ-নবীজির নাম, দিলে দুইডা পয়সা, খাইমু মুরগীর রান। আমার আল্লাহ-নবীজির নাম ... ...
দয়া কইরা দুইডা ট্যাকা কইরা যান গো দান, আমার আল্লাহ-নবীজির নাম।
আখেরাতে সওয়াব পাইবেন পাহাড়সমান ... ...
কত টাকা কত পয়সা এদিক ওদিক চইলা যায়, গরীবেরে দান করিলে আখেরাতে পাওয়া যায় ... ...
ভিখিরির দরাজ গলা। পেশার খাতিরে তার গলা এমন দরাজ হতে হয়েছে। যেকোনো মানুষই পেশা তথা পেটের খাতিরে সবরকম অভিযোজন করে নিতে পারে। এমন কোন পেশা যদি থাকতো যে মানুষকে উড়তে হবে, তবে নিশ্চয়ই সৃষ্টিকর্তা পাখার ব্যবস্থা করে দিতেন। তাই ভিখিরিদের গলার আওয়াজ হয় পিলে চমকানো।
সাধারণত এমন কোন ভিখিরি পাওয়া যায় না, যার গলার স্বর অতি মিহি, মোলায়েম। তাদের গলা এমন হতে হয়, যাতে রাস্তার এক মাথা থেকে আরেক মাথা পর্যন্ত সবাই শুনতে পায়। যত বেশী মানুষ শুনতে পাবে, ততই বেড়ে যাবে তার ভিক্ষা পাবার সম্ভাবনা।
আমিও শুনতে পেয়েছি। একটু পর পর গানের কথা বদলে ভিক্ষা চাইছে ভিখিরি।
বেশীরভাগ গানেই পরকালের কথা। প্রতিটি গান এক থেকে দুই লাইনের। তাকে একটা টাকা দান করলে কত পুণ্য হবে, তাই বলে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইছে।
এখানে নতুন এসেছে নিশ্চয়ই। ভিখিরিদের মৌজা-এলাকা নির্ধারিত থাকে, একজনের এলাকায় আরেকজন ভিক্ষা করতে পারে না।
এই ভিখিরি হয়তো আগের জনের কাছ থেকে জায়গাটা কিনে নিয়েছে। তারা বাড়িগাড়ি কিনতে পারে না, ভিক্ষার জায়গা কিনতে পারে, কাজেই তাই কেনে।
আমার পকেটে সাধারণত খুচরো পয়সা থাকে না, থাকলেও আমার ভীষণ তাড়া থাকে বলে ভিখিরিকে পয়সা বের করে দেয়ার অবসর হয় না। আজ কিন্তু আমি থামলাম, গলির মোড়ে পৌঁছে পকেট হাতড়ে বের করলাম পাঁচ টাকার চকচকে একটা কয়েন। ভিখিরির টোল খাওয়া থালাটার ওপরে ছেড়ে দিলাম।
ঠং করে একটা আওয়াজ হল।
ভিখিরি অন্ধ নয়, চোখে দেখে। কিন্তু ভ্রূক্ষেপও করলো না, নির্বিকারচিত্তে পরের গানটার লাইন ধরল। দয়া কইরা দুইডা ট্যাকা কইরা যান গো দান, আমার ... ...
আমি ভিখিরির নির্লিপ্ততা দেখে চমৎকৃত হলাম বৈকি। এই ভিক্ষার পয়সাই তার একমাত্র রুটিরুজি, তার অন্য কোন উপায়ে খাবারের সংস্থান নিশ্চয়ই হয় না।
তারপরও সে কত অনাদরের সাথেই না ভিক্ষা করছে, যেন এই পাঁচ টাকার কয়েনটা তার পাওনাই ছিল। এখন তার মনোযোগ পরের মানুষটির দিকে, যে তার সামনে এসে থামবে, তার প্লেটে ঝনাৎ করে আরেকটা কয়েন কিংবা টাকার নোট ফেলবে।
প্রতিদিন ছোট বড় কত ঘটনাই তো ঘটে। সব মনে রাখলে মস্তিষ্ক ভারী হয়ে যায় বলেই হয়তো মস্তিষ্ক সব মনে রাখে না। অপ্রয়োজনীয় ঘটনাগুলো ঝেড়ে ফেলে দেয়, মুছে ফেলে।
আমারও সারাদিন আর ভিখিরির কথা মনে রইলো না।
পরদিন অবচেতন মনেই কিনা জানি না, গলির মোড়ে পৌঁছে আবার আমার পকেটে হাত চলে গেল, এবং আশ্চর্য, আবারো বেরিয়ে এলো একটা পাঁচ টাকার কয়েন। কে জানে, ভিখিরির কপালে হয়তো লেখা আছে, এখন থেকে রোজ আমার কাছ থেকে সে পাঁচ টাকার একটা কয়েন পাবে।
আবারো ঠং করে আওয়াজ, আবারো ভিখিরি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলো। দরাজ গলায় গান ধরল, যেন আমাকে দেখতেই পায় নি।
তার কালো মাড়ির নিচ দিয়ে কালচে জিহ্বা ওঠানামা করছে, মোটামুটি কুৎসিত দৃশ্য।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ, তারা অনাদর পেয়ে অভ্যস্ত নই। একজন অভাজন ভিখিরির কাছ থেকে তো নয়ই। তবুও ভিখিরির এই আচরণ আমার বেশ লাগে। পৃথিবীতে কত রকম মানুষ পাওয়া যায়, ভাল মানুষ, খারাপ মানুষ, প্রতারক মানুষ, ভণ্ড মানুষ, রাগী মানুষ, চিমসে মানুষ।
কিন্তু নির্লিপ্ত স্বভাবের মানুষ খুব কম আছে। তাই হয়তো আমার ভাল লাগে। তাই হয়তো আমি আশা করি না, পয়সা পড়ার ঠং করে আওয়াজটা হবার পর ভিখিরি রাস্তার সবাইকে শুনিয়ে বলবে, "আল্লাহ আপনের ভালা করুক, ধনেজনে বরকত দিক। "
মানুষ বিচিত্র কাজ করতে পছন্দ করে। তাই আমি হিসাব রাখতে শুরু করেছি, এই ভিখিরিকে আমি কতদিন যাবত পাঁচ টাকা করে দিচ্ছি।
কুড়িদিন হলে একশো টাকা হবে, আমি তিন অংকে পৌঁছতে পারবো। রেকর্ড বইতে লিখে রাখবে না কেউ, তারপরও আমি গুণে যাচ্ছি। কেন কে জানে।
উনিশদিন হয়ে গেছে, পঁচানব্বই টাকা আমি সেই নির্লিপ্ত ভিখিরির টোল খাওয়া পুরনো থালায় ফেলেছি। আজ বিশদিন হবে বলেই কীনা জানি না, বেশ উত্তেজনা অনুভব করছি!
কিন্তু গলির মোড়ে তো সেই ভিখিরি নেই।
এসেছে আরেকজন। এত কম সময়ের ব্যবধানেই চলে গেল সে?
নতুন যে এসেছে, সে একেবারেই দুর্বল, মাটিতে বসে আছে। আগের ভিখিরি সারাদিন ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো, যেন কোন ক্লান্তি নেই। সারাদিন একই ভাবে চেয়ে যেত, "দয়া কইরা দুইডা ট্যাকা ... ..."
আর এই ভিখিরি? না, এর ভিক্ষা করার ভঙ্গিটা মোটেও আকর্ষণীয় (!) নয়। অনেকক্ষণ ধরে ঝিম মেরে বসে আছে, হঠাৎ করে চেঁচিয়ে উঠছে, "আল্লাহ!" আবার ঝিমুনি, আবার চেঁচিয়ে ওঠা।
কে জানে, আমার পকেটের চকচকে পাঁচ টাকার কয়েনটি হয়তো এরই বেশী প্রাপ্য। কিন্তু আমি দিলাম না। মনে মনে বলছি, কোথায় গেল সেই ভিখিরি, যাকে এই পাঁচ টাকার কয়েনটি দিলে আমার একশো টাকা পূর্ণ হবে, আমি তিন অংকে পৌঁছতে পারবো?
নিতান্তই অযৌক্তিক চিন্তাভাবনা। সেই ভিখিরি আমার আপনজন কেউ নয়, মাত্র উনিশদিনের পরিচয়। হয়তো অনেক দূরে কোথাও চলে গেছে, আর কোনদিনও আসবে না।
হয়তো মরেই গেছে, অসুখবিসুখ হয়ে। তারপরও আমার মনে হল, এই পাঁচ টাকা শুধু সে-ই পেতে পারে, অন্য কেউ নয়।
বললে কেউ বিশ্বাস করবে কীনা জানি না, গত চার বছর ধরে সেই পাঁচ টাকার কয়েনটি পকেটে নিয়ে আমি ঘুরে বেড়াচ্ছি। সেই ভিখিরিকে যদি পাই, তবেই দিয়ে দেবো। চার বছরে কয়েনটা বেশ মলিন হয়ে এসেছে।
হোক। মানুষ তো কত বড় বড় পাগলামো করে, আমারটা নিশ্চয়ই ততো বড় কোন পাগলামো নয়। সবার প্রিয় লেখক থাকে, প্রিয় নায়ক থাকে, প্রিয় গায়ক থাকে। আমার না হয় একজন প্রিয় ভিখিরি ছিল, চলে গেছে। যতদিন তাকে না পাবো, ততদিন হয়তো এই পাঁচ টাকার কয়েনটা, এই তুচ্ছ জড়বস্তুটি আমার পকেটের কোণায় বসে খচখচ করতে থাকবে।
বলতে থাকবে, আমি আছি, আমি আছি।
(২৩ মে, ২০১৩)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।