মানুষ আর প্রাণীর মধ্যে পার্থক্য হলো-চেতনাগত ও সংস্কৃতিগত।
মুক্তির সংগ্রামের নবতর অধ্যায়ে পথচলা
http://www.biplobiderkotha.com
সব স্বাধীনতাই 'মুক্তি-সংগ্রাম' হয় না। আবার সব 'মুক্তি-সংগ্রাম'ই স্বাধীনতা অর্জন অপরিহার্য করে না। কিন্তু বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামটি ছিল একইসঙ্গে স্বাধীনতা এবং মুক্তির সংগ্রাম।
বিশ্বে অনেক স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠা হতে দেখা গেছে।
তার অধিকাংশের স্বাধীনতা অর্জনের সঙ্গে মুক্তির সংগ্রামের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সেগুলো ছিল প্রধানত সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদী দেশ ও শক্তির মধ্যকার দ্বন্দ্ব-সংঘাত এবং সাম্রাজ্যের ভাগবাটোয়ারার ফসল। এশিয়া-আফ্রিকা-লাতিন আমেরিকার উপনিবেশগুলোতে কৃত্রিমভাবে রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণ করে 'স্বাধীন দেশ' স্থাপনের উদাহরণও এক্ষেত্রে প্রযোজ্য। স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই ধারা বদলে যায় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার অবসানের সময় থেকে। এসব স্বাধীন দেশের অধিকাংশই ঔপনিবেশিক এবং নয়া (অর্থনৈতিক) ঔপনিবেশিক বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে প্রকৃত জাতীয় মুক্তির ধারায় অগ্রসর হওয়ার পথ গ্রহণ করে।
'মুক্তি সংগ্রামে'র ধারণার মধ্যে দুটি উপাদান আছে। একটি হলো জাতীয় মুক্তি এবং অপরটি হলো অর্থনৈতিক, সামাজিক, শ্রেণীগত শোষণ-মুক্তি। জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে প্রধান ইস্যুটি হলো সাম্রাজ্যবাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ শোষণ-আধিপত্য থেকে মুক্তি। জাতীয় মুক্তি অর্জন আপনাআপনি শোষণ-মুক্তি এনে দেয় না। একটি হলো জাতিগত শোষণ থেকে মুক্তি, অন্যটি হলো শ্রেণীগত শোষণ থেকে মুক্তি।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামের সাথে মুক্তি সংগ্রামের এই দুই উপাদানই কোনো না কোনো পরিমাণে ও উপায়ে যুক্ত ছিল। এক গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। তিল তিল করে গড়ে ওঠা বহুদিনের বহুমাত্রিক গণসংগ্রাম প্রস্তুত করেছিল সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রামের পটভূমি। আন্দোলন-সংগ্রামের ধারাবাহিক প্রবাহে রচিত হয়েছিল আমাদের 'মুক্তি-সংগ্রাম', যার শীর্ষ পর্যায়ের নয় মাসের পর্বটি হলো মহান 'মুক্তিযুদ্ধ', আর মুক্তিযুদ্ধের প্রত্যক্ষ ফসল হলো আমাদের 'স্বাধীনতা'।
পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণে পূর্ববঙ্গের জনগণের ওপর ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অব্যাহত শোষণের সঙ্গে যুক্ত হয় পাঞ্জাবভিত্তিক পাকিস্তানি শাসকদের ঔপনিবেশিক ধরনের অতিরিক্ত আরেকটি শোষণের বোঝা।
এই অর্থনৈতিক শোষণকে নিরঙ্কুশ করার জন্য পাকিস্তানি শাসকশ্রেণী শুরু করে বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতি-ঐতিহ্য-জাতীয় চেতনা-ভাবাদর্শ প্রভৃতির বিরুদ্ধে হিংস্র আক্রমণ এবং জাতিগত শোষণ, বৈষম্য ও নিপীড়নের এক নিষ্ঠুর অধ্যায়। গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলোকে দু'পায়ে দলন করে চালানো হয় দমন-পীড়ন-নির্যাতনের স্টিমরোলার। প্রথমেই হামলা আসে দৃঢ়চেতা আদর্শনিষ্ঠ কমিউনিস্ট ও বামপন্থিদের ওপর। অবশ্য পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীলতা সম্পর্কে শিগগিরই বোধোদয় ঘটে বাঙালি মধ্যবিত্তের স্বার্থের প্রতিনিধিত্বকারী মুসলিম লীগের একটি প্রভাবশালী অংশের মধ্যে। গঠিত হয় আওয়ামী লীগ।
এই বোধোদয় ছড়িয়ে পড়ে ব্যাপক জনগণের মধ্যে। পরিস্থিতি তাড়াতাড়িই পাল্টে যেতে থাকে। '৪৮ থেকে শুরু হওয়া ভাষা আন্দোলন, '৫২-এর শহীদ দিবস, '৫৪-এর নির্বাচনে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্টের কাছে মুসলিম লীগের ভরাডুবি ইত্যাদি ঘটনা বাঙালির জন্য এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, জাতীয় অধিকার, সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলের অবসান, মজুর-কিষানের রুটি-রুজির অধিকার ইত্যাদি প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দাবি ও স্লোগানগুলো গণচেতনা এবং গণসংগ্রামের মুখ্য ইস্যুতে পরিণত হয়।
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় মন্ত্রিত্ব-প্রধানমন্ত্রিত্ব পদ প্রদানসহ নানা প্রলোভনের জালে বাঙালি বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদী নেতৃত্বকে আবদ্ধ করেও গণচেতনা ও গণআন্দোলনের প্রগতিমুখীনতাকে পাকিস্তানি শাসকরা বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়।
অবশেষে ১৯৫৮ সালে এক জটিল অরাজক পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়ে সেই অজুহাতে সামরিক শাসন জারির মাধ্যমে একনায়কত্ববাদী স্বৈরতন্ত্রের নিগড়ে বাঙালির সংগ্রামকে অবরুদ্ধ করার পদক্ষেপ নেয় পাকিস্তানি শাসকরা। সেই অবরোধ ভেঙে আবার শুরু হয় গণসংগ্রামের উত্তাল প্রবাহ। গণআন্দোলন ও গণচেতনার ক্রমবর্ধমান র্যাডিক্যালাইজেশন ঘটতে থাকে। '৬২, '৬৪, '৬৬ এবং সবশেষে '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, আইয়ুব শাহির পতন, '৭১-এর নির্বাচন, ২১ দফা, ৬ দফা, ১১ দফা এসব সংগ্রাম ও গণদাবির মধ্য দিয়েই সৃষ্টি হয় '৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি।
মুক্তিযুদ্ধের নীতি ও আদর্শগত মৌলিক চরিত্র ও উপাদান রূপ পায় এই সুদীর্ঘ রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-মতাদর্শিক গণসংগ্রামের প্রক্রিয়াতেই।
সেই চরিত্র ও উপাদানের কয়েকটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের কথা এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।
প্রথমত, মুসলিম লীগের 'ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের' সঠিক বাস্তবায়ন তথা সেই প্রস্তাবে উলি্লখিত ভারতের মুসলমানদের জন্য (একাধিক) রাষ্ট্র-সমষ্টি প্রতিষ্ঠার জন্য মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়নি। পাকিস্তানের বঞ্চিত বাঙালি মুসলমানদের বৈষম্য দূর করতে ধর্মভিত্তিক দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতেও খণ্ডিত পাকিস্তানে একটি 'বাংলাস্থান' প্রতিষ্ঠা করা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ছিল না। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিক্রিয়াশীল ও সাম্প্রদায়িক দ্বিজাতিতত্ত্ব নেতিকরণ করে বাঙালির জাতীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে আদর্শগত একটি বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন নতুন অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ছিল মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য।
দ্বিতীয়ত, আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ কেবল পাকিস্তানের রাষ্ট্র কাঠামো ভেঙে তার পূর্বাঞ্চলে আরেকটি নতুন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নিছক একটি 'বিচ্ছন্নতাবাদী' প্রয়াস ছিল না।
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শুধু একটি রাজনৈতিক ভূগোলের বিষয়ও ছিল না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ছিল সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী অগ্রসরমান 'জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের' এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাই রণাঙ্গনে ও দেশজুড়ে মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার মুখে মুখে অন্যতম স্লোগান হয়ে উঠেছিল 'বিশ্বজোড়া দুটি নাম_ বাংলাদেশ আর ভিয়েতনাম'। মুক্তিযুদ্ধের চ্যালেঞ্জিং ও ভাগ্য নির্ধারণমূলক চূড়ান্ত পর্বে তাই সোভিয়েত ইউনিয়নসহ সমাজতান্ত্রিক শিবির এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো সুদৃঢ়ভাবে আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। এর ফলেই সম্ভব হয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ প্রত্যক্ষভাবে সপ্তম নৌবহরসহ হানাদার পাকবাহিনীর পক্ষে নেমে পড়া সত্ত্বেও এই প্রবল পরাক্রান্ত শক্তিকে পরাজিত করে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করা।
তৃতীয়ত, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের তথাকথিত মুসলিম জাতীয়তাবাদকে নাকচ করে অসাম্প্রদায়িক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের পথ অবলম্বনই শুধু করেনি, তা 'বাজার অর্থনীতির' পুঁজিবাদী নীতির বিপরীতে সমাজতন্ত্র অভিমুখীন অর্থনৈতিক-সামাজিক বিকাশের পথনির্দেশও সুস্পষ্ট করেছিল। স্বাধীন দেশে যে সংবিধান রচিত হয়েছিল ('৭২ সালের সংবিধান) তার প্রস্তাবনায় লেখা হয়, 'আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক-প্রতিষ্ঠা সমাজের যেখানে সব নাগরিকের জন্য ... রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য ... নিশ্চিত হইবে। ' রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি প্রসঙ্গে বলা হয়েছিল 'জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, ... রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে। ' এবং '... সাম্যবাদী সমাজ লাভ নিশ্চিত করিবার উদ্দেশ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করা হইবে। ' আরো বলা হয়েছিল যে, 'রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে ... এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি প্রদান করা।
' এই সংবিধানে স্পষ্টভাবে 'পরিকল্পিত অর্থনৈতিক বিকাশ', নাগরিকদের জন্য 'অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসাসহ জীবনধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা', 'সকল নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা', 'মানুষে-মানুষে সামাজিক ও অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপ' ইত্যাদির কথা ।
'৭২-এর সংবিধান থেকে এই কয়েকটি উদ্ধৃতির মাধ্যমেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র। রাষ্ট্র পরিচালনার চারটি মূলনীতির মধ্য দিয়ে সে চরিত্র মূর্ত হয়েছিল। পঁচাত্তরের পরে সেই রাষ্ট্রীয় মূলনীতিগুলো থেকে দেশকে সরিয়ে আনা হয়েছে। সুদীর্ঘ গণসংগ্রামের ধারা ও এক নদী রক্তের ফসল '৭২-এর সংবিধানকে ক্ষতবিক্ষত করা হয়েছে।
মুক্তি-সংগ্রামের উপাদানগুলোকে অপসারণ করে রাষ্ট্রকে বহুলাংশেই মুক্তিযুদ্ধ পূর্ব সময়ের পাকিস্তানি ধারায় ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও ধারায় দেশকে ফিরিয়ে আনার কাজটি বর্তমানে তাই সবচেয়ে অগ্রগণ্য রাজনৈতিক কর্তব্য।
রক্তের দামে কেনা মুক্তি-সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের পুনরুদ্ধার করতে আজ প্রয়োজন নতুন আরেকটি 'মুক্তিযুদ্ধ'। রচনা করা প্রয়োজন মুক্তি-সংগ্রামের নবতর অধ্যায়। তবে একটি কথা।
বিজয় অর্জনের পর তা যেন আবার আগের মতো হাতছাড়া না হয়ে যায়, এবার সে জন্য আগেভাগেই প্রস্তুত হতে হবে।
-মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।