আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

লোগাং গণহত্যা ও কফিনে পেরেকবিদ্ধ জাতীয় বিবেক

নীরব বয়ান

আজ ১০ এপ্রিল। ১৯৯২ সালের এই দিনে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার পানছড়ি উপজেলাধীন লোগাং-এর এক গুচ্ছগ্রামে বিভৎস গণহত্যা সংঘটিত হয়। আঠারো বছর পেরিয়ে গেলো এ হত্যাকান্ডের বিচার হয়নি। হবে বলেও মনে হয় না, কেননা জাতির বিবেক আজ কফিনে পেরেকবিদ্ধ। তারপরও প্রশ্ন রাখি, সরকার যদি ‘৭১-এ সংঘটিত যুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার করতে পারে, ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে পারে তাহলে নিজের দেশের সেনামদতে সংঘটিত এ লোগাং গণহত্যার বিচারও সরকার করবে কি? আমরা কি বিচারের আশা করতে পারি? নাকি এখানেও পাহাড়ী-বাঙালির রকমভেদ হবে? লোগাং গণহত্যায় আমার এক দাদু (আপন দাদুর বোনের স্বামী)ও তার পাশের বাড়ির এক প্রতিবন্ধী যুবক আগুনে পুড়ে মারা যায়।

সেনাবাহিনী ও বাঙালিরা মিলে পুরো গুচ্ছগ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। এতে ৫৫০টি ঘর পুড়ে যায়। সেনাবাহিনীর মতে, ঐ ঘটনায় ১২ জন, আর প্রাক্তন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান সমিরণ দেওয়ানের দেয়া হিসাব অনুসারে ১৩৮ জন লোক মারা যায়। অন্যদিকে স্থানীয়সূত্র অনুসারে ১১০০ জন লোক মারা যায়। এরা সবাই পাহাড়ী।

বেশির ভাগ হলো শিশু ও বৃদ্ধলোকজন। তাদের কী অপরাধ ছিল? পাহাড়ী বলে? ঘটনার সূত্রপাত হয় লোগাং বাজারের জনৈক কবির হোসেনের মৃত্যূকে ঘিরে। কবির হোসেনের গলায় আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গিয়েছিল, কিন্তু কিভাবে, এবং কে বা কারা তাকে মেরেছিল তা জানা যায়নি। নিজেদের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে কোন বাঙালি মারা গেলে বা খুন হলে তার দায়ভার সহজেই পাহাড়ীদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। যত দোষ নন্দ ঘোষ।

এখানেও যথারীতি বাঙালিরা দোষ চাপিয়েছিল শান্তিবাহিনীর উপর। কিন্তু প্রশ্ন হলো, উদোরপিন্ডি বুদোর ঘাড়ে চাপানো কেন? শান্তিবাহিনীরা দোষ করে থাকলে সেটার জন্যে নিরীহ গ্রামবাসীরা দায়ী হবে কেন? তাদের উপর নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালানো কেন? আরো একটি বিষয় উল্লেখ্য, ঘটনার কিছুদিন আগে ঐ কবির হোসেন নারী ধর্ষণের চেষ্টার অপরাধে শাস্তি পেয়েছিল। তার মৃত্যুর পেছনে ঐ ঘটনাও একটি কারণ ছিল কি না তা বাঙালি বা সেনাবাহিনীরা কেউই খতিয়ে দেখেনি। তদন্ত কমিটিগুলোকে এ বিষয়ে তদন্ত করতে সেনাবাহিনী বাধা সৃষ্টি করেছিল। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, যারা এ গণহত্যায় মারা গিয়েছিল তারা সবাই গুচ্ছগ্রামবাসী।

গুচ্ছগ্রামটা লোগাং বাজারের খুব কাছে। মূলত বাঙালিদের বসবাস ছিল বাজারের মধ্যে। বাজার ও গুচ্ছগ্রামের চারদিকে সবসময় সেনা প্রহরা থাকত, এখনো আছে। সেখানে শান্তিবাহিনীর পক্ষে সেনাবাহিনীর নিরাপত্তা বেষ্টনী ভেদ করে বাজারে প্রবেশ করা সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। অন্যদিকে, সেনাবাহিনীরা লোগাং এলাকার বিভিন্ন গ্রাম থেকে ও শরণার্থী শিবির থেকে পালিয়ে আসা পাহাড়ী পরিবারগুলোকে গুচ্ছগ্রামে জড়ো করেছিল নিরাপত্তা দেওয়ার নাম করে।

অনেকটা ফার্মে মুরগী পালনের মত। সেনাবাহিনীদের আরো উদ্দেশ্য ছিল, শান্তিবাহিনীদেরকে গ্রামবাসীদের থেকে দূরে রাখা। সেনাবাহিনীর এ কৌশলটা ছিল ভিয়েতনামে মার্কিন বাহিনী অনুসৃত ‘কৌশলগত পল্লীর’ মডেল অনুসারে (এ কথাটা চট্টগ্রামের জনৈক প্রাক্তন জেলাপ্রশাসক পরিস্কারভাবে তুলে ধরেছেন তার লেখায়: দেখুন Broken Promises, at Click This Link)। কিন্তু সেই রক্ষকরাই ভক্ষকে পরিণত হয়েছিল। পূর্বেই উল্লেখ করেছি, লোগাং গণহত্যায় অনেক লোক মারা যায়।

সংখ্যা কত তা নিয়েও বিভ্রান্তি রয়েছে। কোন কোন হিসাব মতে ১২ জন, আবার কোন কোন সূত্র মতে ১১০০ জন। তবে তৎকালীন খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করে ১৩৮টি লাশ গুণেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন। খাগড়াছড়ির তখনকার ব্রিগেডিয়ার শরীফ আজিজও তা স্বীকার করেছিলেন, যদিও পরে সেনাবাহিনীর পক্ষে বলা হয়েছিল ১২ জন লোক মারা গিয়েছিল। অন্যদিকে বাঙালি আহত হয়েছিল ৪ জন।

এ গণহত্যার পেছনে সেনাবাহিনীর ভূমিকা সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক। যাদের উপর নিরাপত্তা বিধান করার দায়িত্ব অর্পন করা হয়েছিল তারাই পাহাড়ী বিদ্বেষী হয়ে বাঙালিদের লেলিয়ে দিয়েছিল নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর। সেনাবাহিনীর ঐ ব্রিগেডিয়ার বলেছিলো, “শান্তিবাহিনী ও বাঙালিদের মধ্যে মারামারি ফলে এ ঘটনা ঘটে”। কিন্তু প্রশ্ন হলো, মারামারি বন্ধ করার জন্যেই তো সেনাবাহিনীকে সেখানে পাঠানো হয়েছে। তাহলে, এইটা কি তাদের ব্যর্থতা নাকি নিরবতা? আর সেনাবাহিনীর নাকের ডগায় বাঙালিরাই কিভাবে সাহস পায় ৫৫০টি ঘর পুড়ে দেওয়ার? কিভাবে বাঙালিরা অক্ষত থাকে (মাত্র ৪ জন আহত হয়), আর পাহাড়ীরাই বেশি সংখ্যায় মারা যায়?এই উত্তর কি সেনাবাহিনী দিতে পারবে?সেনাবাহিনী কেন তদন্ত সংস্থাগুলোকে তদন্ত করতে দেয় নি?কেন তারা ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়ী-বাঙালি লোকজনের সাথে কথা বলতে দেয়নি? লোগাং-এর এ গণহত্যায় দেশে বিদেশে ব্যাপক প্রতিবাদের ঝড় উঠে।

অবশেষে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্যে তৎকালীন খালেদার নেতৃত্বাধীন জাতীয়তাবাদী সরকার অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি সুলতান হোসেন খানকে (পরে তিনি দুদকের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন)দিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। ঐ তদন্ত প্রতিবেদনের কী হাল হয়েছিল জানা নেই। কারোর বিচার হয়েছিল বলেও জানা নেই। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, কোথায় বিচারকের বিবেক? কোথায় জাতির বিবেক?স্বাধীন দেশে গণহত্যার বিচার হয় না। জাতির বিবেক কি কফিনে পেরেকবিদ্ধ হয়ে গেছে? পরিশেষে আরও প্রশ্ন জাগে, মানবতাবিরোধী এসব হত্যাযজ্ঞ কেন আদিবাসীদের প্রাণের উৎসব বৈসু-সাংগ্রাই-বিজু (বৈসাবি)-এর আগে ঘটে? আদিবাসীদের প্রাণ, সংস্কৃতি সবকিছু কি নি:শেষ করে দেওয়ার জন্যে? লোগাং-এর গণহত্যা ঘটেছিল বৈসাবি-র কয়েকদিন আগে।

শোকে বেদনায় মূহ্যমান হয়ে সে বছর আদিবাসীরা বৈসাবি উৎসব বর্জন করেছিল। এবছরও বাঘাইহাটে ফেব্রুয়ারীতে ঘটে গেল আরো একটি নারকীয় ঘটনা। সেখানকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলো আজও থিতু হতে পারেনি। জীবন চলছে অনিশ্চিত পথে। তাই অনেকে এবারও বৈসাবি উৎসব বর্জনের ডাক দিয়েছে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সাথে সমব্যথী হতে।

প্রশ্ন জাগে, রাষ্ট্র তুমি কার? জাতির বিবেক তুমি কোথায়? বিবেক তুমি কি শবযাত্রার পথে?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.