যে বয়সে মানুষ স্মৃতি চারণ করে আনন্দ পায় আমার বয়স তার ধারে কাছেও নয়। তবুও পুষ্পকরথ সম্পাদক কবি হাফিজ রশিদ খান এর অনুরোধ রাখতে গিয়ে এই লেখার অবতারণা। এই লেখাটিকে সে অর্থে স্মৃতিচারণও বলা যাবে না কেননা এটি মূলত আমি কি করে সবুজ আড্ডার একজন হয়ে উঠলাম তারই কাহীনি। আরো নির্দিষ্ট করে বললে বলতে হয় সবুজের সাহিত্য আড্ডার অংশ হয়ে উঠলাম তার বয়ান। শুরুতে লেখার শিরোনামের জন্য অনুজপ্রতিম কবি আহসান আলম এর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি ।
সবুজ আড্ডা নিয়ে আমার লেখার শিরোনামের জন্য তার কবিতার পংক্তিটিই যুতসই বলে আমার কাছে প্রতীয়মান হয়েছে যদিও আজ আর তার কবিতার শিরোনামটি আমার স্মৃতিতে অবশিষ্ট নেই। মার্কিন মুল্লুক প্রবাসি আহসান নিশ্চয় আমার এ অক্ষমতাকে ক্ষমা করে দিবে। স্কুলের গণ্ডি পেরুনোর আগেই আমি অধিকমাত্রায় রাজনীতি সচেতন হয়ে পড়েছিলাম। এর জন্য আমার পারিবারিক পরিবেশ যেমন দায়ী ছিল তেমনি বাংলাদেশের রাজনৈতিকতার ইতিহাসও অনেকাংশে দায়ী । বিশেষ করে আমার বাবা এবং তার কিনে আনা পত্র-পত্রিকা ও তার সংগ্রহে থাকা বই পুস্তকও ঐ বয়সে আমার অতিমাত্রায় রাজনীতি সংবেদনশীলতার কারণ বলে আমার এখন মনে হয় - সেটি আমার জন্য পরবর্তী জীবনে ভালো কী মন্দ হয়েছে সে প্রশ্ন এখানে অবান্তর।
এত কথা কেন বলছি সে প্রশ্ন পাঠকের মনে উঠতেই পারে বা এসবের সাথে সবুজ আড্ডার সম্পর্কসূত্রই বা কী - আদৌ কেউ যদি এ লেখা পড়তে শুরু করেন আর কি! উনিশশো সাতাশি সালের ফেব্রুয়ারি
মাসটি আমার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি সময় ছিল। সে সময় আমি ছাত্র ইউনিয়ন ( বাংলাদেশের কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্র সংগঠন ) চট্টগ্রাম নগর শাখার পাঁচলাইশ থানার কার্যক্রমের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি এবং তার পরের মাস অর্থাৎ মার্চের দশ তারিখ থেকে ছিল আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা। সবুজ আড্ডার উদ্যোগে তখন গঠিত হয় বারটি সাংস্কৃতিক ও ক্লাব সংগঠনের সমন্বয়ে ”চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক সম্মিলনী” বা ”চসাস”। এই চসাসের উদ্যেগে তৎকালীন কাপাসগোলা পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে পালিত হয় মহান একুশে ফেব্রুয়ারি নানান আয়োজনে যেটি বর্তমানে কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় । সেখানে আমার সম্পৃক্তি ছিল ঐ চসাস এর অর্ন্তভুক্ত বার সংগঠনের একটি কাপাসগোলা সূর্যরাগ ক্লাবের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হিসাবে।
সেই সময় নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববার বয়সই আমার ছিল বটে। সেই ”চট্টগ্রাম সাংস্কৃতিক সম্মিলনী” র একুশ আয়োজনে সম্পৃক্তির সূত্রে এবং ঐ আয়োজনের একজন সনিষ্ঠ কর্মী হিসাবে তখন সবুজ আড্ডার প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদেরকে কাছ থেকে দেখার সুযোগ ঘটেছিল যদিও ঘনিষ্ট হওয়া বলতে যা বুঝায় তা হয়ে ওঠেনি। সেটা ছিল আনেকটা সম্ভ্রমের দৃষ্টিতে দূর থেকে তাকানো। বিশে ফেব্রুয়ারি রাতে ইয়াসিনুল হক মিঠু ভাই, মাসুদ বকুল , শামসুদ্দিন আহমদ, প্রয়াত শামীম ভাই ( বুয়েটের ছাত্র ছিলেন পরে কুমিল্লায় বোনের বাড়িতে পুকুরে সাঁতার কাটতে গিয়ে হার্ট এ্যটাকে মারা যান) এবং আমিসহ আরো কয়েকজন মিলে পুরো চকবাজার এলাকা জুড়ে ছাত্র ইউনিয়ন এর পক্ষে হাতে লেখা একুশ এর ডাক এবং এরশাদ এর স্বৈরাচার বিরোধী স্লোগান সংবলিত পোষ্টারিং করি। এটি ছিল পাঁচলাইশ থানা শাখা ছাত্র ইউনিয়ন এর চকবাজার ওয়ার্ডের কার্যক্রমের অংশ।
যা পরের দিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি দিনের আলো ফোটার আগে কে বা কারা তুলে ফেলে। সেদিন পূর্ব প্রস্তুতি অনুসারে সন্ধ্যার পর থেকেই কাপাসগোলা পৌর বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে চসাস আয়োজিত একুশের অনুষ্ঠান চলছিল। আমি সদস্য সংগঠনের অংশ হিসাবে সেখানে স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব পালন করছিলাম। এমন সময় আমাদের কাপাসগোলার কয়েকজন বন্ধু এসে আমাকে আর বকুল ভাইকে একা স্কুল গেইটের বাইরে যেতে বারণ করলো কেননা সেখানে তার আগের রাতে পোষ্টার লাগানোর অপরাধে আমাদেরকে শায়েস্তা করার জন্য একদল ছাত্রলীগ কর্মী অপেক্ষা করছিল। এটি আমরা সবুজ আড্ডার বড়ভাইদেরকে জানালে তারা আমাদের দু’জনকে অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পরে তাদের সাথে বের হওয়ার পরামর্শ দিল।
আমি ব্যক্তিগতভাবে কিছুটা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম কারণ আমার মাধ্যমিক পরীক্ষা ছিল অত্যাসন্ন। সেদিন অনুষ্ঠানের সফল সমাপ্তি শেষে যারা আমাদেরকে নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন তারা হলেন কবি হাফিজ রশিদ খান, শিল্পী শফিকুর রহমান, কবি শ.ম. বখতিয়ার, কবি এজাজ ইউসূফী, কবি সোহেল রাব্বি (অকাল প্রয়াত) এবং গল্পকার রাশেদ মাহমুদ। সবুজ আড্ডার অগ্রজ সদস্যদের সাথে আমাদেরকে বের হতে দেখে আক্রমণোদ্যত ঐ ছাত্রলীগের বন্ধুরা দ্রুত ঐ স্থান থেকে সটকে পড়ে। সেদিন যারা নিরাপদে বাড়ি পৌঁছে দিয়েছিলেন অগ্রজপ্রতিম দায়িত্বশীলতায় তারাই পরবর্তীতে হয়ে উঠেছেন আমার সবুজ আড্ডার অত্যন্ত আপনজন এবং নানাভাবে অনুপ্রেরণার উৎস। মজার ব্যাপার হলো সেই ছাত্রলীগের বন্ধুরাও দ্রুত এরশাদ স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে সহযোদ্ধা হয়ে উঠেছিল।
এখানে উল্লেখ্য যে চসাস আয়োজিত ঐ একুশের অনুষ্ঠানমালা ছিল চট্টগ্রামে কেন্দ্রিয়ভাবে জতীয় দিবস পালনের ঐ ধরণের প্রথম অনুষ্ঠান। অনান্য আনেক বিষয়ের মতো সবুজ আড্ডা এক্ষেত্রেও পথিকৃতের ভূমিকা পালন করে। ঘটনাটির এখানে উল্লেখের প্রাসঙ্গিকতা হলো ১৩ নং কাপাসগোলা রোডে অবস্থিত ”সবুজ হোটেল এন্ড রেষ্টুরেন্ট” এ আমি আগেও আনেকবার গিয়েছি সবাই যেসব কারণে ও অকারণে নানা রেষ্টুরেন্টে যায়। কিন্তু সেখানকার সৃজনশীল অংশের সাথে যুক্ত হয়ে পড়ার দিনক্ষণ আরো অনেক পরের কাহিনী। সবুজ এর মালিক তনয় শাজাহান ভাই ভালো ফুটবল খেলতেন সেই সুবাদে বা অন্য কোন কারণেও হতে পারে সেখানে প্রায়শ তৎকালীন জাতীয় দলের ও নানা ক্লাবের তারাকা খেলোয়াড়দের দেখা মিলত - ফুটবল এবং ক্রিকেট নির্বিশেষে।
যদিও তখন বাংলাদেশ জুড়ে ক্রীড়া উন্মাদনার কেন্দ্রাস্থি ছিল ঐ ফুটবলই। সেই সূত্রেও দূ’একবার কৈশোরিক কৌতুহল আমাকে টেনে নিয়ে গিয়ে থাকবে সবুজ হোটেলে। আমি মূলত নিয়মিত সবুজ হোটেলে যেতে শুরু করি আমার রাজনৈতিক অগ্রজ ও বন্ধুদের সাথে এবং প্রায়শ পূর্বতন বিন্যাসের যে সবুজ তার শেষ প্রান্তে দুটো বড় টেবিল ছিল সেখানে গিয়ে আমরা বসতাম। চা পরোটার সাথে রাজনীতি এবং এরশাদ বিরোধী আন্দোলন, তার গতি প্রকৃতি, নিজেদের করণীয় ও কখনো কখনো অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের বন্ধুদের সাথেও এ সংক্রান্ত তাদের ভাবনা এবং সেগুলো নিয়ে দারুণ উত্তপ্ত বিতর্কে সময় কেটে যেত।
মাধ্যমিক পাশ করে স্কুল এর গণ্ডি পেরিয়ে যখন কলেজ এ প্রবেশ করি তখনও আমার মগজের প্রতিটি কোষে ছড়িয়ে ছিল ছাত্র রাজনীতির নানান বিন্যাস এবং সেই কারণে অথবা পারিবারিক আবহের কারণে সাহিত্য পাঠের প্রতি আমার এক ধরণের প্রবল ঝোঁক ছিল।
উনিশশো সাতাশি সালের ডিসেম্বরে পত্রিকার পাতায় দেখতে পেলাম বই পড়া প্রতিযোগিতার খবর , একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য। আয়োজক বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র, চট্টগ্রাম। সদস্য হ্ওয়ার জন্য যেতে হবে সেন্ট প্লাসিডস্ স্কুলের লাইব্রেরী কক্ষে। সেই ডিসেম্বরের এক বিকালে বই পড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহনের লক্ষে চলে গেলাম পাথরঘাটাস্থ সেন্ট প্লাসিডস্ স্কুলের লাইব্রেরী কক্ষে। মনে বিনি পয়সায় কিছু বই পড়ে ফেলতে পারা এবং এক হাজার টাকা মূল্যমানের বই পুরস্কার প্রাপ্তির সম্ভাবনার লোভ ।
তখন শীতের বিকেল প্রায় সন্ধ্যায় গড়িয়েছে। কক্ষের ভিতরে একটি একশ ওয়াটের বাল্বের ম্লান আলোর নীচে বসে আছেন একজন গম্ভীর চেহারার রূপবান যুবক , পরণে পাঞ্জাবী চোখে কার্বন ফ্রেমের চশমা। তিনি আর কেউ নন আমাদের প্রিয় দেবাশীষ দা, লিরিকের শিল্পকলা সম্পাদক (আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা থেকে ) দেবাশীষ রায়। পাঠক হয়তো ভাবছেন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের বই পড়া প্রতিযোগিতা কার্যক্রমের সাথে সবুজ আড্ডার সম্পর্ক সূত্র কী! আছে বই কি, আছে - এটা মোটেও ধান ভানতে শিবের গীত নয়। সেখানে পরিচয় হয় কবি হোসাইন কবির (তৎকালীন সংগঠক, বিসাকে চট্টগ্রাম ), কবি জিললুর রহমান, গল্পকার সালাউদ্দিন মোহাম্মদ মারুফ, গল্পকার প্রয়াত মোহাম্মদ আলী শাহ, কবি সুবীর কর, ম.ই. খান সাজু এবং আরো অনেকের সাথে।
উনারা সবাই তখন প্রতি শুক্রবারে নন্দনকাননস্থ বোস ব্রাদার্সে আড্ডা দিতেন এবং তাদের একটি প্রকাশনা ছিল ‘স্বনন’ নামে। সেই বিসাকে’র বই পড়া প্রতিযোগিতায় আমি এক হাজার টাকার বই পুরস্কার হিসাবে পাই । বইগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর “চিলে কোঠার সেপাই”। এক পর্যায়ে কবির ভাইয়ের প্রস্তাবে আমরা অর্থাৎ মোঃ সাহেদুল আলম, কবি শারদ মাযহার, আশীষ সেনগুপ্ত রূপু, দিপঙ্কর নাথ এবং আমি বিসাকের স্কুল কর্মসূচি পরিচালনার সাথে যুক্ত হয়ে পড়ি। সেই সূত্রে আমরাও বিশেষ করে আমি এবং শারদ মাযহার স্বননের আড্ডায় নিয়মিত যেতে শুরু করি এবং সবুজ হোটেলে আমার বসার স্থানে পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে।
সাহিত্য বিষয়ে যারা আড্ডা দেন তারা ক্যাশ কাউন্টার সংলগ্ন চার চেয়ার সমেত পরপর দুটি টেবিলে বসে আড্ডা দিতেন। আমি কখন যে ঐ রাজনৈতিক বন্ধুদের আড্ডার টেবিল ছেড়ে সৃজনশীল আগ্রজদের সাথে বসতে শুরু করেছিলাম আজ আর তার সঠিক দিনক্ষণ মনে নেই। এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ১০ই নভেম্বর, ১৯৮৭ সালের শহীদ নূর হোসেন এর আত্মদান যখন বৃথা হয়ে গেল এবং রাজনীতির চালচিত্র যখন পাল্টে যেতে লাগল আমিও আস্তে আস্তে রাজনীতি বিষয়ে আমার আগ্রহ হারিয়ে ফেললাম। ক্রমশ জড়িয়ে পড়তে লাগলাম সাহিত্যিক বলয়ে। আমার এই বদলে যাওয়া নিয়ে কবি জিললুর রহমানকে তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন এর নগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক আতিক ভাই বলেছিলেন ”জিললুর আরো একজনকে বুঝি কবি বানিয়ে ফেললে” যদিও তখন পর্যন্ত আমি একটি কবিতাও লিখিনি।
কেবল আড্ডায় অগ্রজদের সদ্য লেখা কবিতা কি গদ্য কি গল্পের নিবিষ্ট পাঠক হয়ে উঠছি। কখনো দু’একটি মন্তব্য তারুণ্যের সহজাত দুঃসাহসে করে ফেলে নিজের কমজানা জ্ঞান নিয়ে সভয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়ার জন্য অপেক্ষা করছি এক কাপ চায়ের ভগ্নাংশে চুমুক দিতে দিতে। একদিন কবির ভাই দশ কপি লিরিক নিয়ে সেন্টপ্লাসিডস স্কুলস্থ বিসাকে কার্যালয়ে যান । সেটি ছিল লিরিকের ষষ্ট সংখ্যা, নিকারাগুয়ার কবি নিকোলাস গ্যিয়েনকে নিবেদিত। সেখানে কবির ভাইয়ের একটি লেখা ছিল।
কবি ময়ুখ চৌধুরী’র প্রথম কাব্য গ্রন্থ ”কালো বরফের প্রতিবেশী” নিয়ে আলোচনা। আমরা যারা বিসাকে’র সাথে যুক্ত তারা সবাই কবির ভাইয়ের লেখা পড়ার জন্য আবদার করে স্ব -উদ্যোগে বিসাকে প্রকাশিত আসন্ন পত্রিকার জন্য সংরক্ষিত ” সৌজন্য সংখ্যা” সীল মেরে লিরিক গুলো ভাগাভাগি করে নিয়ে নিই। আমার ভাগের লিরিকের ষষ্ট সংখ্যার সেই কপিটি এখনো আমার কাছে আছে, যদিও কবির ভাই সেগুলো এনেছিলেন আমাদের কাছে বিক্রি করবেন বলে। বেচারা কবির ভাই! সেখানে আনেক লেখার সাথে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর উপর একটি সংখ্যা প্রকাশের বিজ্ঞাপন যারপর নাই আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। বিসাকে’র বইপড়া প্রতিযোগিতায় পুরস্কার প্রাপ্তির কল্যাণে ততদিনে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের “চিলেকোঠার সেপাই” কয়েকবার পড়া হয়ে গেছে।
অন্যঘরে অন্যস্বর, খোঁয়ারি, দুধভাতে উৎপাত, মিলির হাতে ষ্টেনগান এসব গল্পগ্রন্থেরও পাঠ চলছে নানান জন থেকে নিয়ে। সবুজের আড্ডায় অনিয়মিতভাবে নিয়মিত যাচ্ছি কখনো সকালে কখনো সন্ধ্যা বেলা। সবার সাথে আস্তে আস্তে আলাপ পরিচয় ঘটছে। স্বনন এর আড্ডায়ও প্রতি শুক্রবার যাচ্ছি সন্ধ্যায়। সেই সূত্রে ঊনিশো নব্বই সালের ফেব্রুয়ারিতে প্রকাশিত কবি ইব্রাহিম আজাদের একটি কবিতার বই “যখন মুছে গেল দিগন্ত রেখা” আমাকে দেন সবার প্রিয় দামণি (কবি অরুণ দাশগুপ্ত) দৈনিক আজাদীর সাহিত্য পাতায় আলোচনা করার জন্য।
আমি ঐ কাব্য গ্রন্থের একটি আলোচনা লিখে সসংকোচে দামণিকে দিয়ে আসি তার বৌদ্ধ মন্দির সংলগ্ন বাসায় এবং পরের শুক্রবার তিনি লেখাটি আজাদীর সাহিত্যের পাতায় ছাপিয়েও দেন এবং এই প্রথম আমার লেখা কোন গদ্য ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত হয়। সেদিন সন্ধ্যায় বোসের আড্ডায় গেলে প্রয়াত গল্পকার মুহাম্মদ আলী শাহ বাংলা একাডেমীর একুশে গ্রন্থমালা সিরিজের সৈয়দ আলী আহসান এর “সমালোচনা” বইটি উপহার দেন আমার লেখার একটি গঠনমূলক সমালোচনা সমেত। অর্থাৎ ঐ আলোচনায় আরো কি কি বিষয় আসতে পারতো বা কোথায় কোথায় পুনরাবৃত্তি হয়েছে, কাব্যগ্রন্থের আলোচনায় ডঃ সেলিম জাহানের দৈনিক সংবাদে প্রকাশিত একটি লেখা থেকে যে উদ্ধৃতি আমি ব্যবহার করেছি তা যথার্থ হয়েছে কিনা ইত্যাদি ইত্যাদি। সে বছর চট্টগ্রাম থেকে আনেকগুলো কবিতার বই প্রকাশিত হয় মুদ্রণশিল্পের সহজলভ্যতার কল্যাণে। এবং এগুলোর মান যে যথার্থ নয় সে কথা বলাই বাহূল্য এবং যারা সিরিয়াস ভাবে লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত তাদের সে সুযোগ অর্থাৎ প্রকাশিত হবার সুযোগ ঘটেনি অনুমেয় কারণে।
নব্বুই সালের শুরু থেকেই বাংলা নামক দেশে অনেক নেতির মধ্যেও অনেক ইতিবাচক ঘটনা ঘটতে থাকে এবং আমার ব্যক্তিগত জীবনেও। কলেজের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হই সারাদেশ তখন এরশাদের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল। সবুজে প্রতিদিন সকাল সন্ধ্যায় যেতে থাকি নানা বিষয়ে আড্ডা হয় এর মধ্যে বিশেষভাবে ঘনিষ্টতা গড়ে উঠে লিরিক সম্পাদক কবি এজাজ ইউসূফীর সঙ্গে। মূলত তাঁর আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা প্রকাশের ঘোষণা এবং আমার ইলিয়াসে মুগ্ধতা পরস্পরকে আরো ঘনিষ্ট করে থাকবে হয়তোবা। তবে যেটি তাঁর প্রতি আমাকে অধিক আগ্রহী করে তোলে তা তাঁর হার না মানার জেদ এবং শেষ মূহুর্ত পর্যন্ত লড়ে যাওয়ার যৌক্তিক কৌশল।
ফলে প্রতিদিন নানা বিষয়ে, প্রসঙ্গে ও অনুষঙ্গে তাঁর সাথে সবুজে এবং সবুজের বাইরে উদাস চত্বরে (সবুজ হোটেলের পাশে সোবহানীয়া এক্সরে কিনিকের নীচে এবং সামনের চত্বরটি সবুজের আড্ডারুদের কাছে ঐ নামেই চিহ্নিত ছিল) তর্কে লিপ্ত হতাম কখনো কখনো কুতর্কেও এবং নিজের জানার পরিধির সীমাবদ্ধতা মেনে নিয়ে বাড়ি ফিরে যেতাম পরের দিন আরো প্রস্তুত হয়ে পূর্ণ উদ্যমে ফিরে আসার প্রত্যয়ে। ইতিমধ্যে আরো অনেক এর সঙ্গ নানা কারণে প্রিয় হয়ে উঠতে লাগলো। কবি জিললুর রহমানের সাথে সেই বিসাকে থেকেই পরিচয় এবং সবুজে তা আরো প্রগাঢ় হয়ে উঠতে লাগলো কতকটা ভাবনার গঠনগত সাযুজ্যের কারণে বেশীরভাগটাই তাঁর ভাবনার যুক্তিবোধ আমার যৌক্তিক মানস গঠনে সহায়ক হয়ে উঠছিল বলেই। এভাবে ভাবনার তন্তুতে সম্পর্কের সূত্রগুলো ঐ আড্ডার টেবিলেই বিন্যস্ত হয়ে উঠতে লাগলো। ঊনিশো নব্বুই এর মার্চ মাসেই সবুজ আড্ডায় গঠিত হলো সাহিত্য মঞ্চ এবং প্রথম উদ্যোগ শহীদ মিনার সংলগ্ন মুসলিম হল, চট্টগ্রাম-এ দিনব্যাপী “মেঘ বলে চৈত্রে যাবো” শীর্ষক কবিতা পাঠ, কবিতা বিষয়ক আলোচনা এবং সেমিনার।
ঊনিশশো অষ্টাশি সালের প্রতিবাদী কবিতা ঊৎসবের পরে এটাই ছিল চট্টগ্রামে সব চেযে বড় কবিতা বিষয়ক কোনো আয়োজন যা সকল প্রতিষ্ঠানিকতা এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছিল। মঙ্গল প্রদীপ জ্বালিয়ে অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেছিলেন বিশিষ্ট চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরী , উদ্বোধনী কবিতা পাঠ করেছিলেন প্রয়াত কবি ওহিদুল আলম,সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছিলেন কবি সৈয়দ রফিকুল আলম এবং বিশেষ অথিতি ছিলেন কবি সায়ীদুর রহমান। দুই অধিবেশনে বিন্যস্ত কবিতা সম্মেলনের প্রথম অধিবেশনের প্রথম পর্ব কবিতা পাঠ –- এ সভাপত্বি করেন কবি জিললুর রহমান এবং দ্বিত্বীয় ও তৃতীয় পর্বে সভাপতিত্ব করেছিলেন যথাক্রমে প্রয়াত কবি সোহেল রাববি এবং করিম আবদুল্লাহ। দ্বিত্বীয় অধিবেশন এর প্রবন্ধ পাঠ ও আলোচনা পর্বে “বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতা” শিরোনামে প্রবন্ধ পাঠ করেন কবি হাফিজ রশিদ খান , আলোচনায় অংশগ্রহন করেন কবি অরুণ দাশগুপ্ত, কবি শিশির দত্ত, গল্পকার মহীবুল আজিজ এবং কবি এজাজ ইউসুফী। এছাড়াও একক ও বৃন্দ আবৃত্তি পরিবেশন করেন যথাক্রমে বিশ্বজিত সেনগুপ্ত, শামসুন্নাহার কলি, শোয়েব নাঈম, শব্দ সড়ক এবং চর্চা আবৃত্তি সংসদ।
গান পরিবেশন করেন মিহির নন্দী, নারায়ণ চন্দ্রশীল ্ও মায়া চক্রবর্তী এবং তবলায় সঙ্গত করেছিলেন জলি চৌধুরী। আমি আর কবি সোহেল রাব্বি অনুষ্ঠানের আগের কোন এক রাতে সারারাত ধরে শহরের বিভিন্ন জায়গায় শিল্পী মোহাম্মদ ইউনুস এর করা পোষ্টার লাগাই। শুরু করি সবুজ হোটেল থেকে এবং ভোরে এসে আবার সবুজে বসে নাস্তা করি। সে এক অপরূপ স্মৃতি। সারারাত আমি আর সোহেল ভাই একটা রিকশায় করে ঘুরে ঘুরে পোষ্টার সাঁটছি সারা শহরের নানান দেয়ালে।
যখনই রিকশা চলছে তখনই সোহেল ভাই তাঁর এরিন মোরের বনেদী কৌটো খুলে ঐ তামাকের সাথে সেই তামাক মিশিয়ে সিগারেট বানাচ্ছেন আর বলছেন ” বুঝলি পুলক ---- কবি হলেন দাশবাবু” আর স্মৃতি থেকে একটার পর একটা জীবনানন্দের কবিতা আউড়ে চলেছেন সারারাত ধরে। শামসুর রাহমান, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এবং আল মাহমুদও বাদ যাননি সেই রাত্রি পরিক্রমায়। রাহমানের “সেই মাতেয়ালা রাইতে” কবিতাটি আর কোনদিন সোহেল ভাইয়ের কণ্ঠে শোনা হবেনা। জানি না সেখানে এমন মাতেয়ালা রাত মিলে কিনা! যেখানে কবি সোহেল রাববি অকালে চলে গেছেন কাউকে কিছুই না বলে এ দেশের বাস্তবতা ছেড়ে যেখানে “ আগুনের ফুলকীগুলো কেবলই শ্মশানের বাহবা বাড়ায়”। নিশির নৈরাজ্য এই যে সে বয়সের ব্যবধান কেন অনেক কিছুই ভুলিয়ে দেয়।
সম্পর্কের সূত্রগুলোকে নৈকট্য দান করে। যেমনটা করেছিল সেই চৈত্রের হালকা হিম রাতে। আমি বয়সের ব্যবধান পেরিয়ে তাঁর অনুজ প্রতিম বন্ধু হয়ে উঠতে পেরেছিলাম। সসংকোচ আমাকে সোহেল ভাইই সস্নেহ প্রশ্রয়ে আপন করে নিয়েছিলেন তাঁর ঐ তামাকের ভাগ দিয়ে যা সেদিনের হিমেল হাওয়ায় অত্যন্ত সুপেয় মনে হয়েছিল। আমরা যখন রাত দুইটার দিকে মুসলিম হলে পোষ্টার লাগাতে যাই তখন পুলিশ আসে এবং আমাদের ঐ অনুষ্ঠান বিষয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিল।
যদিও স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পুলিশ সেদিন আমাদের আর কিছুই করেনি। পরের দিন সকালে আমরা সবুজ থেকেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাই পোষ্টার লাগাতে তখন আমি সবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি কিন্তু ক্লাশ তখনও শুরু হয়নি। সেদিন জিললুর ভাইও আমাদের সাথে ছিলেন। আসার পথে শাটল ট্রেনে মজার একটি ঘটনা ঘটে। সোহেল ভাই যথারীতি তার এরিন মোরের টিন খুলে তামাক বানিয়ে নিজে সেবন শেষে বিগত রাতের অভ্যাস বশত আমার দিকে অবশিষ্ট অংশটি বাড়িয়ে দিলেন।
আমি কিন্তু সসংকোচে ফিরিয়ে দিচ্ছিলাম কারণ সেখানে জিললুর ভাই আছেন, বড় ভাই তার সামনে কেমনে তামাক সেবন করি। তো সোহেল ভাই বিষয়টা বুঝে উঠতে পারছিলেন না বলে আমি তাকে কানে কানে কথাটা বললাম। তিনি সরাসরি জিললুর ভাইকে বললেন “দেখ দেখ জিললুর পুলক আমার সাথে দিব্যি চালিয়ে যাচ্ছে আর তোকে সংকোচ করে সে সিগারেট নিচ্ছে না”। বেশ একটা হাসির রোল পড়ে গেল আমার বিবেচনার ধরন দেখে। সেই সাহিত্য মঞ্চের “কবিতা সম্মেলনে” এ গৃহীত প্রস্তাবাবলী পাঠ করেছিলাম আমি এবং বেশ নার্ভাস ছিলাম।
কেননা এত বড় পরিসরে এর আগে আমার যে আর মঞ্চে উঠবারই সুযোগ ঘটেনি। খুব সুন্দর মঞ্চসজ্জ্বাটি করেছিলেন শিল্পী মাসুদ চৌধুরী। এই আয়োজনের মধ্যেমে আমি এজাজ ভাইয়ের সাংগঠনিক দক্ষতাকে আরো প্রত্যক্ষভাবে উপলব্ধি করি। শিল্পী শফিফুর রহমানও অত্যন্ত তৎপর ছিলেন এই আয়োজনকে সফল করে তুলতে। যা হোক এভাবে নানান আয়োজন ও ঘটনার ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে আমাদের দিনগুলি রাতগুলি চলে যাচ্ছিল তরতর করে।
আমার তখন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত ক্লাশ শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয আর সবুজ আড্ডা এই দুই পাঠশালার আমি নিয়মিত এবং নিবিষ্ট ছাত্র। একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিসংখ্যান ক্লাশে আমার এক তরুণ শিক্ষক আমাকে দাঁড় করিয়ে একটি প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করলেন এবং আমি যথারীতি সদুত্তর দিতে ব্যর্থ হলাম কিছুটা জিজ্ঞাসিত হবার
আকস্মিকতায় এবং ততোধিক বিষয়টা জানা না থাকার কারণে। তারপর আমার ঐ তরুণ শিক্ষক মন্তব্য করলেন “অনেককে রাত আটটা দশটা অবধি রেষ্টুরেন্টে আড্ডা মারতে দেখা যায় কিন্তু ঐভাবে সময় কাটিয়ে আর যাই হোক বি.বি.এ পড়া যাবে না। ” বলাই বাহুল্য যে তিনিও সবুজ হোটেল এন্ড রেষ্টুরেন্টের একজন নিয়মিত পর্যটক এবং মন্তব্যটি আমার উদ্দেশ্যেই করা।
পুরো ক্লাশ আমার দিকে ঘুরে তাকিয়েছিল দেখে নিতে যে তাদের সহপাঠি হিসাবে এ আবার কোন চিড়িয়া এসে জুটলো যে কিনা পড়ার টেবিলে থাকার সময়ে রেষ্টুরেন্টের আড্ডার টেবিলকে অধিক আপন জ্ঞান করে। তো এভাবেই সবুজের সাথে তার সৃজনশীল আড্ডার সাথে আমি ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়ি। কোন একদিন যেতে না পারলে মনে হয় বুঝি সারাদিন কোন একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজই অসমাপ্ত থেকে গেছে। কতদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাশ শেষ করে শাটল ট্রেনে ভ্রমণের উদ্দাম আনন্দের লোভকে সম্বরণ করে বাসে চড়ে দ্রুত চলে এসেছি সবুজের আড্ডায় তার কোন ইয়াত্তা নেই। এর মধ্যে নব্বুই এর গণ অভ্যূত্থান সফল হয়েছে দেশে চলছে বিচারপতি সাহাবুদ্দিন আহমদ এর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্ন্তবর্তীকালীন শাসন।
আমার বি.বি.এ প্রথম বর্ষের ফাইনাল পরীক্ষা স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের শেষ সময়ে শুরু হয়েছিল , দু’টো পরীক্ষা শেষ হবার পর গণ অভ্যূত্থান এর কারণে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আরো দুটি পরীক্ষা হয় এবং পরের পরীক্ষার আগের দিন বাইশে ডিসেম্বর চাকসু’র বিজয় মিছিলে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির হামলা চালায় এবং ফারুক নামে একজন ছাত্র নিহত হয় শত শত ছাত্র এবং শিক্ষক আহত হয়। বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। আর আমার জুটে যায় অফুরন্ত অবসর এবং খানিকটা অনিশ্চয়তাও। তবুও সময় কেটে যেতে থাকে সকাল বিকাল দু’বেলা সবুজে আড্ডা মেরে।
আড্ডার কত রকমের প্রসঙ্গ। তরতাজা সব লেখা নিয়ে তখন সবাই আড্ডায় আসতেন - হাফিজ ভাই , এজাজ ভাই , হাবিব আহসান, জিললুর রহমান, রাশেদ মাহমুদ, সাজিদুল হক - সেকি চুলচেরা বিশ্লেষণ, সেকি সমালোচনা আলোচনার ঝড়। কত লেখক , কত বই এর নাম যা আমি আগে কখনো শুনিনি। জিলুলুর ভাই কি হাফিজ ভাই, এজাজ ভাই কি মাসুদ ভাই ( মাসুদ জামান ), যার কাছে বইটি আছে তার থেকে ধার নিয়ে পড়ে ফেলবার অদম্য আগ্রহ। কেউ কেউ সাগ্রহে বাড়িয়ে দেন আরো একজন তরুণ ঋদ্ধ হবে বলে আবার কেউ কেউ দেখান অদ্ভুত সব অজুহাত।
তবুও সময় এগিয়ে চলে। এজাজ ভাই লিরিকের সপ্তম সংখ্যা বের করবেন যেটি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা হিসাবে প্রকাশিত হবার কথা ছিল কিন্তু যা নানা কারণে হয়নি। ফলে একটি অন্তবর্তীকালীন সংখ্যা লিরিক বের করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। তিনি আমাকে বললেন চট্টগ্রাম থেকে সম্প্রতি প্রকাশিত সব কাব্যগ্রন্থ নিয়ে একটি আলোচনা লিখতে। আমি কথা অনেক বলি বটে আড্ডার টেবিলে কিন্তু লিখতে বসে তো আর লিখতে পারি না।
সব বই আছে সামনে সব কিছু আছে তবুও। আড্ডায় গেলে এজাজ ভাই জিজ্ঞাসা করেন কতদূর লিখলাম। আমি তো লা জবাব । এজাজ ভাই ঝানু সম্পাদক। আমার এই অপ্রকাশের বেদনা তিনি বুঝতে পারেন এবং যা লিখেছি তাই দেখাতে বলেন ।
একদিন তাকে আমার বিচ্ছিরি হস্তাক্ষরে লেখা সেই আলোচনাটি দেখায় এবং তার চেহারার রং বদল আমার মধ্যে এক ধরণের অস্বস্তি তৈরী করে। আমি বুঝতে পারি কিছুই হয়নি। তিনি আমাকে অভয় দেন বলেন এটি একটি প্রথাগত লেখা যেখানে কেবল তথ্য আছে যেমন কার বই , কখন প্রকাশিত হয়েছে, কয়টি কবিতা আছে ইত্যাদি। তিনি আরো বলেন “নিশ্চয়ই এগুলো এ লেখার প্রাসঙ্গিক তথ্য তবে আরো অনেক কিছু সংযোজন করলে পরে এটি একটি অন্যরকম এবং ছোট কাগজের লেখা হয়ে উঠবে”। কি কি বিষয় বিবেচনায় নিতে হয় একটি গ্রন্থ আলোচনা করতে হলে তা তিনি সেদিন আমাকে হাতে কলমে শিখিয়ে দিয়েছিলেন অগ্রজের পরম মমতায়।
একজন তরুণকে প্রকাশিত হবার ভঙ্গি এবং বিকশিত হবার প্রেরণা দু ’টোই জুগিয়েছিলেন সেদিন আমার ঐ কাচুঁমাচু অবস্থা থেকে উত্তোরণ এর লক্ষে। এবং ইতিপূর্বে আজাদীতে প্রকাশিত হ্ওয়া আলোচনাটিকে আমার কাছে বালখিল্য রচনা মনে হতে থাকে। লিরিকের সেই সপ্তম সংখ্যা দিয়ে আমার সাথে ছাপাখানার বিশেষ করে টেডল মেশিনে ছাপার যে প্রযুক্তি তার সাথে প্রথম পরিচয় হয়েছিল। এজাজ ভাই আর আমি ফেব্রুয়ারি ১৯৯১ সালে প্রায় প্রতিদিন সকালে চলে যেতাম ১২, কবি নজরুল ইসলাম সড়কের শ্রী শ্যামাচরণ কবিরাজ ভবনের নীচতলায় অবস্থিত মডার্ণ প্রেসে, প্রুফ দেখার জন্য। প্রুফ দেখারও যে কায়দা কানুন আছে তাও সেই থেকে শেখা।
জানি না মডার্ণ প্রেসের স্বত্ত্বাধিকারী জনাব এ.কে.এম নাসির উদ্দিন প্রিয় নাসির ভাই আজ কোথায়। যেদিন লিরিক সপ্তম সংখ্যাটি আলোর মুখ দেখবে সেদিন ছিল ২১শে ফেব্রুয়ারী ,১৯৯১। বিশ তারিখ রাত্রে আমি আর এজাজ ভাই বাইণ্ডারকে বলে এসেছিলাম যে তারপরের দিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি ভোররাতে আমাদেরকে কিছু কপি বাধাঁই করে দিতে হবে, সবটা না হলেও। এজাজ ভাইয়ের সাথে আমার কথাছিল যে ভোর সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে আমি অলি খাঁ মসজিদের মোড়ে তার জন্য অপেক্ষায় থাকব। তখনো বাংলাদেশে মোবাইল যুগ শুরুই হয়নি।
তখন দেশ জুড়ে প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সংসদ নির্বাচনের ডামাঢোল তুঙ্গে, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় উত্তোরণের প্রথম ধাপ চলছে, ২৭শে , ফেব্রুয়ারি নির্বাচন। যথাসময়ে আমি অলি খাঁ মসজিদের মোড়ে গিয়ে হাজির হলাম এবং দেখতে পেলাম আগের রাতেও দিব্যি দাড়িঁয়ে থাকা অলি খাঁ মসজিদ সংলগ্ন জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের নির্বাচনী ক্যাম্পটি কে বা কারা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি অস্বস্তি নিয়ে অপেক্ষা করছি এমন সময় রিকশা নিয়ে এজাজ ভাই এলেন এবং আমরা বাইণ্ডারের কাছ থেকে লিরিক নিয়ে চলে গেলাম শহীদ মিনারে। সেখানে সারাদিনে আমরা লিরিকের প্রায় সব কপিই বিক্রি করে ফেললাম। তখনও সবাই ২১শে ফেব্রুয়ারীর দিনে নতুন সব প্রকাশনা বা একুশের সংকলন নিয়ে আসতেন শহীদ মিনারে।
কবি ইব্রাহিম আজাদ আমার লেখাটির প্রসঙ্গে এজাজ ভাইয়ের কাছে ঐ দিনই তার ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন এই বলে যে “তোয়াঁরা লেইখতা , গুরা পোয়া উগ্গা দিয়েরে কিল্লাই লেখাইয় দে ভাই”। পরে এজাজ ভাই আমাকে এটা বলেন । মানে লেখাটি বেশ প্রতিক্রিয়া তৈরী করেছিল সে সময়। পরে দৈনিক পূর্বকোণ এর সাহিত্য সাময়ীকিতে কবি বিশ্বজিৎ চৌধুরী সেবার একুশেতে প্রকাশিত কয়েকটি ছোট কাগজ নিয়ে একটি প্রতিবেদনমূলক আলোচনা লেখেন্। সেখানে লিরিকের আলোচনার প্রায় পুরো অংশটি ব্যয় করেন এই অর্বাচীন এক নবীশি লেখকের রচনা নিয়ে।
অথচ লিরিকের সপ্তম সংখ্যাটি দেশী - বিদেশী সাহিত্যের, কবিতার নানান লেখায় পূর্ণ ছিল। সেদিন আমি বুঝে যাই যে লেখা কর্মের কারিগরকে কিভাবে লিখতে হবে অর্থাৎ কিভাবে লিখলে পরে একটি লেখা হয়ে ঊঠবে। এভাবে সবুজ আডডা ও আড্ডার সারথিরা আমাকে আমি হয়ে উঠতে সহায়তা করেন। ঊনিশশো একানব্বই সালের পুরোটা জুড়ে বাংলাদেশ তাকিয়ে ছিল এর নতুন গণতানন্ত্রিক সরকারের কর্মকান্ডের দিকে আর আমরা ব্যস্ত ছিলাম “লিরিক” আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা নিয়ে। এজাজ ভাই একদিন সবুজে ওপার বাংলার তরুণ পাইনের একটি লেখা নিয়ে আসেন যা সদ্য ডাকে এসেছে ।
শিরোনাম “বিপ্রতীপতার গদ্য”, এ রকম অদ্ভূত সুন্দর সরল রেখার মত হাতের লেখা আমি আর জীবনে দেখিনি। কথায় যেমন বলে মুক্তোর মত হস্তাক্ষর ঠিক তেমনি - না না সেরকম নয় যেন কেউ পাণ্ডুলিপি টাইপে টাইপ করেছে। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা নিয়ে দু ’টো বেদনার কথা মনে জমা হয়ে আছে হাহাকার মিশ্রিত আক্ষেপের মতো। গল্পকার শাহাদুজ্জামান আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এর সাক্ষাৎকার নেবেন লিরিকের জন্য। তাই তিনি সবুজে এসেছেন সহযোগি হিসাবে তার সাথে “লিরিক” পরিবারের কেউ যেন অংশগ্রহন করে তার অনুরোধ নিয়ে।
এজাজ ভাই আমাকে বললেন তার সঙ্গে সেই ঐতিহাসিক সাক্ষাৎকার গ্রহনের জন্য ঢাকা যেতে। সেদিন দুপুরেই রওয়ানা হতে হবে। আমি বাবার অনুমতি নেওয়ার জন্য বাসায় গেলাম কিন্তু বাবা আমাকে ঢাকা যেতে দিতে নারাজ। তখন আমার বদলে মাসুদ ভাই অর্থাৎ মাসুদ জামান শাহাদুজ্জামান এর সঙ্গী হলেন আমি বঞ্চিত হলাম ইতিহাস হবার সুবর্ণ সুযোগ থেকে। লিরিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা বের হবে সবুজ আড্ডার তরুণতম সদস্য এবং লিরিকের একজন হিসাবে আমারও একটি লেখা ছাপা হবে সেই বাসনায় আমিও একটি গদ্য লিখতে শুরু করলাম “চিলেকোঠার সেপাই” এর চরিত্র হাড্ডি খিজিরকে নিয়ে।
সেই লেখা আমি প্রথম দেখায় বর্তমানে মার্কিন প্রবাসী সেই সময়ে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সহপাঠী মোরশেদ আলম রুমো-কে। সে পড়ার পর চেহারাকে খুব গম্ভীর করে আমাকে বলেছিল কেমন যেন একটু বাংলা বিভাগের ছাত্ররা পরীক্ষা পাশের জন্য নোট করে না সে রকম হয়ে গেছে। ঠিক সাহিত্যিক রচনা একে বলা যাবে না। তার মন্তব্যে আমি একেবারে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিলাম। তারপর সেই লেখাকে অনেক ঘষে মেঝে দুরুদুরু বক্ষে সম্পাদনা পরিষদের সামনে উপস্থাপন করলাম, সবুজের পাশে উদাস চত্বরে ।
সম্পাদকীয় নীতির প্রশ্নে আপোষহীন জিললুর ভাই এবং সম্পাদক স্বয়ং লেখাটি নাকচ করে দিলেন। সেই লেখাটি আরো পরিমার্জিত হবার পরে ছাপা হয় কবি হাবিব আহসান ও কবি সাজিদুল হক সম্পাদিত “সুদর্শন চক্র ” দ্বিতীয় সংখ্যায়। তখন সবে একটা দু ’টো কবিতা কি পদ্য লিখতে শুরু করেছি মাত্র। পরিচয় হলো “অব্যয়” সম্পাদক কবি সুমন ইসলাম এর সাথে, এই সবুজেই। হাফিজ ভাইয়ের “লোহিত ম্যণ্ডোলিন” বের হলে আমাকে তিনি একটা কপি দিয়ে বললেন আলোচনা লিখতে।
বইটির অত্যন্ত সুলিখিত ফ্ল্যাপ পড়ে মুগ্ধ হয়ে পড়ি এবং লিখিত আলোচনাটি ঐ ফ্ল্যাপ এর গণ্ডি পেরুতে পারে না। লিখে দেখাতে নিয়ে আসি আড্ডায় । এজাজ ভাই বললেন এতো আমার লেখা! তোমার উপলব্ধি বা মতামত কোথায়। তখন জানতে পারি “লোহিত ম্যণ্ডোলিন” এর নামহীন ফ্ল্যাপটির রচনাকার কে। জিললুর ভাই এবং এজাজ ভাইয়ের তীব্র সমালোচনায় ঐ লেখাটি ছিঁড়ে উদাস চত্বরের পাশের ড্রেনে ফেলে দিই।
একদিন এজাজ ভাই একটি সদ্য লেখা কবিতা সবুজে আমাকে আর জিললুর ভাইকে পড়তে দেন। কবিতার বিষয় আড্ডারই একজন কবি তাকে নিয়ে ব্যক্তিগত আক্রোশ সমৃদ্ধ! একটি কবিতা লিখে কোথাও ছাপিয়েছে এটি তারই প্রতিক্রিয়া। এজাজ ভাই একটু রগচটা, বদমেজাজি মানুষ। আড্ডায় সহজে কেউ তার বিরুদ্ধাচরণ করে না। আমি আর জিললুর ভাই তার স্নেহের প্রশ্রয়কে পুজিঁ করে ঐ কবিতাটিকে পোষ্টমর্টেম করি।
তিনি ঐ কবিতাটি আর কোথাও ছাপাননি এবং পরের দিন একটি নতুন কবিতা লিখে নিয়ে আসেন আমাদের সমালোচনার জবাবে। যেটি পরে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ “স্বপ্নাদ্য মাদুলি” তে স্থান পায়, শিরোনাম “ সংক্ষোভ”। আরো কত স্মৃতি , কতো বেদনা ও অনুরাগ গাথা মনের মেরুনে রাঙিয়ে উঠছে, কতো মুখ ও মুখোশ কতো আবয়ব ভেসে উঠছে স্মৃতির পর্দায় তার সব কী ধারন করা যায়। না সব কিছু লেখা যায়। ঐ লিরিক আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যার সূত্র ধরে সবুজে তখন নিয়মিত আসতেন শিল্পী ঢালী আল মামুন, নাট্যকার মিলন চৌধুরী, ডাঃ মোহাম্মদ আলী বাবু এবং আরো অনেকে।
তাদের স্বজ্ঞা সমৃদ্ধ সাহচর্য আমার এবং সবুজ আড্ডার আরো অনেককে ঋদ্ধ করেছে নিঃসন্দেহে। তখন সবুজ আসলেই প্রবহমান এক সৃজন সায়র - কত নদী সরোবর এই সবুজের মোহনায় এসে মিশে যাচ্ছে আবার কত শাখা ও প্রশাখা নিয়ে সবুজের বুড়ি ছুঁয়ে বেরিয়ে পড়ছে তার নিজ নিজ লক্ষে - কর্মে ও সৃজনে। শহর চট্টগ্রাম ও উভয় বাংলায় প্রথা বিরুদ্ধতার অনন্য অঙ্গন হয়ে ঊঠেছিল সবুজ তখন। হাফিজ ভাই প্রকাশ করলেন “ বাংলাদেশের উপজাতি ও আদিবাসীঃ অংশীদারিত্বের নতু।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।