কাগজের সবচেয়ে বড় পাইকারি বাজারটি পুরান ঢাকার নয়াবাজারে। রাজধানী তো বটেই, কাগজ বিকিকিনিতে এটি দেশের সবচেয়ে জমজমাট স্থান। এখানেই জিন্দাবাহার লেনে রয়েছে নূরজাহান পেপার মার্কেট। আমদানি করা বিদেশি কাগজ ব্যাপকভাবে বিকিকিনির কারণে এটি 'বিদেশি কাগজের মার্কেট' নামেও বেশ পরিচিতি পেয়েছে। আর এ পরিচিতি এনে দিয়েছে ৯টি প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট।
এই সিন্ডিকেট প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে প্রকাশ্যেই শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কাগজের অবৈধ ব্যবসা চালাচ্ছে। বাংলাদেশ প্রতিদিনের অনুসন্ধানকালে সংশ্লিষ্ট ও স্থানীয় সূত্রে এমন অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, বৈধ চালান, ভ্যাট রসিদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ছাড়াই দিনের পর দিন নূরজাহান মার্কেট থেকে অবৈধ উপায়ে আমদানির কাগজ বিক্রি চলছে। এ ব্যাপারে কাস্টমস, শুল্ক গোয়েন্দা, বন্ড কমিশনারেট ও ভ্যাট কর্তৃপক্ষের নজরদারি নেই। দেশীয় কাগজ কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে সম্প্রতি এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করা হলেও কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এতে কোটি কোটি টাকার রাজস্ব হারাচ্ছে সরকার।
স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, নূরজাহান পেপার মার্কেটে কোরিয়া, চীন ও ভারত থেকে আমদানি করা আর্ট কার্ড, আর্ট পেপার ও ডুপ্লেক্স বোর্ড মিলছে সহজেই। এখানে আমদানি করা কৃষ্ণ, হানসল, গোড়া, পাণ্ডা, নিম্বো, ড্রাগন, শ্রিয়া ও মরিয়েম ব্র্যান্ডের কাগজ চাইলেই পাওয়া যাচ্ছে। কয়েকজন ক্রেতা ও বিক্রেতা জানান, নয়াবাজারের কিছু পাইকারি কাগজ বিক্রেতা ও আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেটটি বিনাশুল্কে আমদানির কাগজ প্রকাশ্যেই বিক্রি করছে। ব্যাক টু ব্যাক এলসি সুবিধায় আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন বার্ড ইন্টারন্যাশনাল, অ্যানি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মমতাজ অ্যান্ড সন্স, সোহেল ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল, মহসিন অ্যান্ড ব্রাদার্স এবং কবির অ্যান্ড ব্রাদার্স খোলাবাজারে কাগজ বিক্রি করছে।
আর বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান জিয়া ট্রেডিং, সুজন এন্টারপ্রাইজ, কবির অ্যান্ড ব্রাদার্স ও আইনুল হক আইনের তোয়াক্কা না করে বিক্রি-নিষিদ্ধ কাগজ অধিক মুনাফায় বাজারে ছাড়ার পাশাপাশি মজুদও করছে। নয়াবাজারের এসব প্রতিষ্ঠানের গুদাম থেকে ভ্যাট চালান, ফ্যাক্টরি চালান ছাড়াই রাতের আঁধারে ছোট ছোট কাভার্ড ভ্যান ও রিকশা ভ্যানে তুলে দেওয়া হচ্ছে আমদানি করা বিভিন্ন ধরনের কাগজ। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা ব্যবসায়ীরা না জেনে অবৈধ পন্থায় বাজারজাত করা কাগজ কিছুটা কম মূল্যে কিনে নিচ্ছেন। এই কাগজ বিক্রিতে আইনগত ঝুঁকির বিষয়টি খুচরা বিক্রেতাদের অনেকে জানেনই না।
সরেজমিনে জানা গেছে, ওয়্যারহাউস বা প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার নামে প্রয়োজনের অতিরিক্ত আমদানি করা কাগজও অসাধু ব্যবসায়ীরা নিয়ে আসছে নয়াবাজারের নূরজাহান মার্কেটে।
প্রয়োজনীয় নথিপত্র ছাড়া এসব চালানও ট্রাকে করে আসে রাতের অাঁধারে। সাধারণ ব্যবসায়ী ও বিক্রেতারা বিষয়টি জেনে-দেখেও প্রভাবশালী সিন্ডিকেটের ভয়ে মুখ বুজে থাকেন। অনুসন্ধানে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ভারত থেকে কাগজ আমদানির নামে চোরাকারবারিতে জড়িয়েছে একটি চক্র। তারা ভারতের কৃষ্ণ ব্র্যান্ডের কাগজ বেনাপোল বন্দর দিয়ে দেশে আনছে। সম্প্রতি কুষ্টিয়ার নূরুজ্জামান বিশ্বাস নামে এক ব্যবসায়ীর একটি চালান এসেছে এই স্থলবন্দর দিয়ে।
এই চালানের পুরো কাগজই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে খোলাবাজারে। সূত্র জানায়, সম্প্রতি রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে বাইরে বিক্রির সময় দুই ট্রাক কাগজ আটক করে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ। এরপর খোঁজ নিতে গিয়ে দেখা যায়, যে প্রতিষ্ঠানের নামে এসব কাগজ আনা হয়েছে এর কোনো অস্তিত্ব নেই। বাস্তবে চালান ধরা পড়লেই কৌশলে প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড বদলে ফেলা হয়। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে লাইসেন্স নিয়ে এমন অপতৎপরতা চালাচ্ছে বলে গোয়েন্দা নজরদারিতে ধরা পড়েছে।
তারা একেক সময় একেক প্রতিষ্ঠানের নাম ব্যবহার করে। তবে আইনের সীমাবদ্ধতার দোহাই দিয়ে এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
অভিযোগ করলেও প্রতিকার মেলে না : নয়াবাজারে শুল্কমুক্ত সুবিধায় আমদানি করা কাগজের কালোবাজারির বিরুদ্ধে অভিযোগ করেও প্রতিকার পাচ্ছেন না ক্ষতিগ্রস্ত দেশীয় কাগজ কারখানার মালিকরা। সম্প্রতি বাংলাদেশ পেপার মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএমএ) পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে দৃষ্টি আকর্ষণ করে কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। বিপিএমএ স্ট্যান্ডিং কমিটির (শুল্ক ও ভ্যাট) চেয়ারম্যান বেলায়েত হোসেন ২৮ মে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক বরাবর একটি আবেদন করেন।
সেখানে তিনি বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধার অপব্যবহার ও মিথ্যা ঘোষণায় আমদানি করা ডুপ্লেঙ্ বোর্ডের শুল্ক ফাঁকি বন্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। আবেদনে বলা হয়, এই অপতৎপরতার কারণে স্থানীয় কাগজ শিল্প চরম সংকটে পড়ছে। নয়াবাজারের জিন্দাবাহার লেনের নূরজাহান পেপার মার্কেটের জিয়া ট্রেডিং, সুজন এন্টারপ্রাইজ, কবির অ্যান্ড ব্রাদার্স, আইনুল হক পেপার, মেসার্স গোল্ডেন বোর্ড ইন্টারন্যাশনাল, অ্যানি ট্রেড ইন্টারন্যাশনাল, মমতাজ অ্যান্ড সন্স, সোহেল ট্রেডিং ইন্টারন্যাশনাল ও মহসিন অ্যান্ড ব্রাদার্স এই অবৈধ ব্যবসায় জড়িত। কাস্টমস এক্সাইজ অ্যান্ড ভ্যাট কমিশনারেটের (ঢাকা দক্ষিণ) কমিশনার বরাবর ৪ জুন একইভাবে আরেকটি আবেদন করা হয়। আবেদনে শুল্ক ও মূল্য সংযোজন কর (মূসক) ফাঁকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানানো হয়।
নয়াবাজার এলাকার ব্যবসায় ও বিপণন থেকে রাজস্ব আদায়ের দায়িত্ব এই কর্তৃপক্ষের। জানা গেছে, অভিযোগের এক মাস ১৪ দিন পর ১৭ জুলাই ঢাকা দক্ষিণের অফিস থেকে কোতোয়ালি বিভাগে এ ব্যাপারে খোঁজ নিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে মাত্র।
ঢাকা দক্ষিণ কমিশনারেটের কমিশনার শাহনাজ পারভিনের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বলেন, 'আমরা এ ব্যাপারে তৎপরতা শুরু করেছি। মূল্য সংযোজন কর না দিয়ে বা অবৈধ পন্থায় ব্যবসা করলে আমাদের এখতিয়ার অবশ্যই আছে। আমরা এনবিআরের সিএ সেল থেকে আমদানির তথ্য সংগ্রহ করছি।
' এদিকে বিষয়টিতে নজর নেই বন্ড কমিশনারেটেরও। জানা গেছে, পুরান ঢাকার প্রতিষ্ঠানগুলো কমিশনারেটের চার নম্বর বিভাগের অধীন। এসব প্রতিষ্ঠানের নাম ভাঙিয়েই চলে কাগজের অবৈধ ব্যবসা। সাধারণ কাগজ ব্যবসায়ীরা বলছেন, বন্ড কমিশনারেটকে কোনো প্রকার প্রমাণ বা রাজস্ব না দিয়েই কাগজ বিক্রি করছে চিহ্নিত প্রতিষ্ঠানগুলো। দীর্ঘদিন এমনটা চলে এলেও এ ব্যাপারে কখনোই কোনো তদন্ত হয়নি।
ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে জানতে চাইলে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদফতরের মহাপরিচালক খন্দকার আমিনুর রহমান বলেন, 'আমরা একটি অভিযোগ পেয়েছি। তা খতিয়ে দেখছি। ' তিনি অগ্রগতির ব্যাপারে একই বিভাগের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন। মোস্তাফিজুর রহমানের সঙ্গে কয়েকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি বারবারই বলেন, 'আমরা বিষয়টি দেখছি। ফাইলটি কোথায় আছে, তা খুঁজে বের করা হচ্ছে।
' সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, নয়াবাজারের কাগজের মার্কেট থেকে মাত্র আধা কিলোমিটার দূরে বংশালে ভ্যাট কমিশনারেটের কোতোয়ালি বিভাগ। অথচ এমন বেআইনি কর্মকাণ্ড তদারকিতে দীর্ঘদিনেও এই বিভাগের কোনো তৎপরতা নেই। অভিযোগ রয়েছে, ভ্যাট কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করেই চলছে কালোবাজারি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।