আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদায় ‘কমলা বিপ্লব’

সাংবাদিক

বিদায় ‘কমলা বিপ্লব’ শান্তনু দে ‘বিলকুল চুপসে গিয়েছে কমলা বিপ্লবের বাহারি বেলুন। ’ বিশ্ব পুঁজিবাদের ডাকসাইটে মুখপত্র দ্য ইকনমিস্টে অসহায় আর্তনাদ। পাঁচ বছর আগে, শুরুর ডিসেম্বরের সেদিন সি এন এনে ‘লাইভ’ — রাতআকাশে আতসবাজির রোশনাই, হাড় কাঁপানো ঠান্ডাকে উড়িয়ে ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের রাস্তায় উদ্বেলিত জনতা, ওড়াচ্ছেন কমলা পতাকা, সপ্তাহ দু’য়েক আগে ‘জালিয়াতির’ রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে আদালত বাতিল ঘোষণা করায় তাঁদের কেউ আনন্দে কাঁদছেন, কেউ নাচছেন — আর সি এন এনের চোখে তামাম দুনিয়া দেখছে ‘ঘুমন্ত ইউক্রেনিয়রা জেগে উঠছেন তাঁদের (মেড ইন ইউ এস এ) স্বাধীনতা রক্ষায়। ’ ক’দিন বাদেই তাঁদের নায়ক ভিক্টর ইউশচেঙ্কোর ভরাট গলায় ‘পরিবর্তনের’ প্রতিশ্রুতি। ‘আজ থেকে সমস্ত কিছু পরিবর্তন হয়ে যাবে ইউক্রেনে।

আমরা (সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে ভেঙে) স্বাধীন ছিলাম চোদ্দ বছর, কিন্তু আমরা মুক্ত ছিলাম না, আজ থেকে....। ’ সেদিনের উচ্ছ্বাসে আজ বিষাদের ‌আঁধার। ২০০৫এর এপ্রিল, সেদিন ৫৩শতাংশ ইউক্রেনিয় বলেছিলেন, তাঁদের দেশ চলেছে সঠিক রাস্তায়। এখন, ৮১শতাংশের স্থির বিশ্বাস, তাঁরা চলেছেন ভুল অভিমুখে। অর্থনৈতিক স্বাধীনতার বিশ্বায়িত সূচকে নিচের দিক থেকে সতেরো নম্বরে ইউক্রেন, রাশিয়া এবং বেলারুশের নিচে।

বিদায় কমলা বিপ্লব। গোহারান হেরেছেন ওয়াশিংটনের বাইপ্রোডাক্ট, কমলা বিপ্লবের ফসল ভিক্টর ইউসচেঙ্কো, যা মার্কিন স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থের জন্য গুরুতর আঘাত। মাত্র পাঁচ বছরেই মোহভঙ্গ। বিসর্জনের বাজনা। প্রথম রাউন্ডেই বিদায় ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত মিত্র।

কমলা বিপ্লবের ‘আইকন’ ইউসচেঙ্কো পেয়েছেন সাকুল্যে ৫শতাংশ ভোট। স্পষ্ট প্রত্যাখ্যান। আর ২০০৪এর নির্বাচনে জয়ী হয়েও যিনি ওয়াশিংটনের নিঃশব্দ অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি হতে পারেননি, তৃতীয় রাউন্ডে পরাজিত হয়েছিলেন ইউসচেঙ্কোর কাছে, সেই ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ ৩৬শতাংশ ভোট পেয়ে শীর্ষস্থানে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোট পাওয়া ইউলিয়া তিমোশেঙ্কোর মুখোমুখি। তিমোশেঙ্কো এখন প্রধানমন্ত্রী, পেয়েছেন ২৫শতাংশ ভোট।

এবং শেষে কমলা বিপ্লবের নমনীয় মুখ ‘কমলা রাজকন্যা’ তিমোশেঙ্কোকে হারিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ। একসময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ইয়ানুকোভিচকে দুনিয়া চেনে মস্কোপন্থী হিসেবে। বিদায় ন্যাটো। স্বাগত কৃষ্ণসাগরে রুশ নৌবহর। ইয়ানুকোভিচের এই জয় ওয়াশিংটনের জন্য বড় ধাক্কা।

কমলা জমানার অবসান পরিবর্তন ঘটাবে পূর্ব ইউরোপের ক্ষমতার ভারসাম্যে। নিশ্চিতভাবেই এটি ঠান্ডা যুদ্ধ-উত্তর পূর্ব ইউরোপে আমেরিকার সবচেয়ে আকাঙ্খিত ভূরাজনৈতিক প্রজেক্টের বিপর্যয়ের প্রতীক হয়ে থাকবে, বিশেষ করে যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা বেড়েই চলেছে। ওয়াশিংটনের লক্ষ্য ‘গুয়াম’ দেশগুলি। সোভিয়েত-উত্তর চারটি দেশ : জর্জিয়া, ইউক্রেন, আজারবাইজান এবং মলদোভা। রাশিয়াকে বাদ দিয়ে কাস্পিয়ানের তেল ও গ্যাস ইউরোপে নিয়ে যাওয়ার জন্য নতুন এনার্জি করিডোর নির্মাণে এই গুয়ামের রয়েছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা।

পাশাপাশি, বাকি ইউরোপের সঙ্গে রাশিয়াকে ‘কর্ডন’ করে রয়েছে এই গুয়াম। জর্জিয়া মানে ককেশাসে আমেরিকার শক্ত ঘাঁটি। একইসঙ্গে মধ্য এশিয়ার প্রবেশদ্বার। বস্তুত, এই মুহূর্তে জর্জিয়া হলো ইউরোপের এনার্জি হাইওয়ে। তিন বছর আগেও আজারবাইজানের রাজধানী বাকু তেল উত্তোলন কেন্দ্রের তেল ইউরোপে যেত রুশ পাইপলাইন দিয়ে।

যা ছিল ইউরোপের জ্বালানির প্রাথমিক উৎস। এখন সেই বাকুরই লক্ষ লক্ষ ব্যারেল তেল ১ হাজার মাইল পাইপলাইন দিয়ে জর্জিয়ার রাজধানী তিবিলিসি হয়ে যাচ্ছে তুরস্কের বন্দর সিচানে। রাশিয়াকে এড়াতে শয়ে শয়ে কোটি ডলার খরচ করা হয়েছে নাবুকো গ্যাস পাইপলাইনের জন্য — যা বাকু থেকে তিবিলিসি হয়ে গিয়েছে তুরস্কে। একসময়ে সোভিয়েত অর্থনীতির প্রাণভোমরা ছিল এই অঞ্চলের তেল। সোভিয়েত বিপর্যয়ের পর এই অঞ্চলের তেলের ওপর মস্কোর নিয়ন্ত্রনকে ভেঙে দিতে চায় আমেরিকা।

ওয়াশিংটনের লোলুপ নজর পড়ে মধ্য এশিয়া, ককেশিয় অঞ্চলসহ কাস্পিয়ান ও কৃষ্ণসাগরের তেলের ওপর। যেখানে ইউক্রেনকে ব্যবহার করা হতো সাবেক সোভিয়েত অর্থনীতিগুলিকে একীকরণে মস্কোর প্রয়াসে ভাঙন ধরানো এবং রাশিয়ার পুনরুত্থানের সম্ভাবনাকে নিকেশ করার কাজে। ঐতিহাসিক কারণেই রাশিয়া-ইউক্রেনের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। আসলে ইউক্রেনের জ্বালানি গ্যাস আসে রাশিয়া থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারদরের থেকে অনেক কম দামে মস্কো এই গ্যাস সরবরাহ করতো।

তাছাড়া, ইউক্রেনের প্রায় অর্ধেকই রুশ বংশোদ্ভূত। এঁদের বড় অংশ রাশিয়াতে কর্মরত, অথবা পড়াশুনা করেন। ইউক্রেনের বহির্বাণিজ্য প্রধানত রাশিয়ার সঙ্গে। অর্থাৎ, অর্থনীতির প্রশ্নে ইউক্রেন অনেকটাই রাশিয়ার ওপর নির্ভরশীল। এমন একটি দেশ নিজেদের স্বার্থেই রাশিয়ার সঙ্গে বৈরি সম্পর্ক চাইতে পারে না।

কিন্তু আমেরিকা চায়নি ইউক্রেনের রুশ ঘনিষ্ঠতা। আসলে সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে গঠিত নতুন রাষ্ট্রগুলির সব ক’টিকেই কব্জা করতে চেয়েছে ওয়াশিংটন। সেই লক্ষ্যেই নতুন ব্লুপ্রিন্ট। রঙিন বিপ্লব। নাগরিক অধিকারের নতুন তত্ত্বে মগজ ধোলাইয়ের প্রাণান্তকর চেষ্টা।

যৌথ অধিকারের চেয়ে ব্যক্তিগত অধিকারকে বড় করে দেখানোর অনিবার্য পুঁজিবাদী প্রয়াস। উদ্দেশ্য পরিষ্কার। এক খন্ডিত, সংখ্যালঘু নাগরিক সমাজ গড়া। এমন এক সমাজ, যেখানে ব্যক্তির পরিচয় থাকলেও, সে হবে আত্মকেন্দ্রিক, রাজনীতিবিমুখ, অরাজনৈতিক। আদতে অধিকার বিমুখ।

আমেরিকায় রাষ্ট্রপতি বদলায়। কিন্তু পালটায় না লক্ষ্য। আইজেনআওয়ার থেকে ওবামা — লক্ষ্য একই। অন্য রাষ্ট্রকে কবজা করা, বাজার দখল করা। শুধু লক্ষ্যপূরণে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ বিভিন্ন সময়ে বদলায় তার মুখোশ।

রঙিন বিপ্লব যেমন একুশ শতকে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের নয়া মুখোশ। মার্কিন-বিরোধী সরকারকে ‘রক্তপাতহীন, অহিংস আন্দোলনের’ মাধ্যেমে উচ্ছেদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে ‘বিপ্লব’ শব্দটিকে। কোনও ফুল বা রঙয়ের সঙ্গে বিপ্লব শব্দটিকে বেমালুম জুড়ে দিয়ে টার্গেট করা হচ্ছে সেই দেশটিকে। গড়ে তোলা হচ্ছে মুক্ত (সুশীল) সমাজ। মার্কিন অর্থে, মার্কিন মদতে, মার্কিন প্রশিক্ষণে তৈরি মার্কিনপন্থী নানা গোষ্ঠী।

নেপথ্যে সক্রিয় সহযোগিতায় থাকছে সি আই এ, মার্কিন দূতাবাস আর মার্কিন অর্থে পুষ্ট এন জি ও। আর তাদের দিয়ে তথাকথিত ‘নাগরিক আন্দোলনের’ মধ্যে দিয়ে অসত্য তথ্য পরিবেশন করে মানুষকে বিপথে পরিচালিত করা। ২০০০, অক্টোবর। বুলডোজার বিপ্লব। যুগোস্লাভিয়ার রাষ্ট্রপতি মিলোসোভিচ সরকারের পতন।

এক্ষেত্রে কোনও ফুল, কিংবা রঙয়ের নাম ব্যবহার করা না হলেও, রঙিন বিপ্লবের ছক অনুযায়ীই মার্কিন অর্থ সাহায্যে নানা সংস্থার মাধ্যমে তৈরি করা হয় কৃত্রিম বিক্ষোভ। আর দুনিয়া দেখে বৈধ মিলোসোভিচ সরকারের পতন। এরপর ২০০৩, নভেম্বর। জর্জিয়া। গোলাপ বিপ্লব।

মার্কিন স্বার্থ-বিরোধী নীতি গ্রহনের জন্য রাষ্ট্রপতি এডওয়ার্ড শোভার্দানাজের পতন। ২০০৪, ২১নভেম্বর। ইউক্রেন। কমলা বিপ্লব। ২০০৫।

কিরগিজিস্তান। টিউলিপ বিপ্লব। ইরাকে পার্পেল (নীল বেগুনি) বিপ্লব। ইরানে সবুজ বিপ্লব। মার্কিন প্রশাসনের অন্দরের খবর ফাঁস করে দিয়ে সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসের প্রতিবেদন, ইউক্রেনের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে সাহায্য করা থেকে মার্কিন নেতাদের সঙ্গে সেদেশের বিরোধী নেতা ভিক্টর ইউসচেঙ্কোর দেখা করিয়ে দেওয়ার জন্য বুশ প্রশাসন তার আগের দু’বছর ধরে খরচ করে সাড়ে ৬কোটি ডলার।

আর একাজে মুখ্য ভূমিকা নেয় মার্কিন সরকারের সাহায্যে চলা তিনটি ফাউন্ডেশন — ন্যাশনাল এনডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (এন ই ডি), যারা সরাসরি সাহায্য পায় মার্কিন কংগ্রেস থেকে। ইউরেশিয়া ফাউন্ডেশন, যারা সাহায্য পায় মার্কিন বিদেশ দপ্তর থেকে। রেনেসাঁ ফাউন্ডেশান, জর্জ সোরসের সংগঠন, যারা সরাসরি সাহায্য পায় মার্কিন বিদেশ দপ্তর থেকে। আটের দশকের গোড়ায় তৈরি এই এন ই ডি-ই নয়ের দশকে নিকারাগুয়াতে মার্কসবাদী সান্দিনিস্তা সরকারকে পরাস্ত করতে বিরোধীদের হাতে তুলে দিয়েছিল ১কোটি ৫লক্ষ ডলার। এই সংস্থাই ২০০২এ, ভেনেজুয়েলার নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি উগো সাভেজের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভ্যুত্থানে মদত দিয়েছিল।

যা ভেনেজুয়েলার সংসদ, বিচারব্যবস্থা এবং সংবিধানকে সাময়িকভাবে অকেজো করে দিয়েছিল। নিও লিবারেল মিডিয়ার ভাষায়, যা ছিল ‘নাগরিক সমাজের অভ্যুত্থান’। এন ই ডি’র প্রথম কার্যকরী সভাপতি অ্যালেন ওয়েনস্টাইনের অকপট স্বীকারোক্তি, ‘আজ আমরা যেসব কাজ করে চলেছি, পঁচিশ বছর আগে সেকাজই গোপনে করতো সি আই এ। ’ একসময়ে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের অঙ্গরাজ্য। রাশিয়ার পর এখন ইউক্রেন ইউরোপের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাষ্ট্র।

পশ্চিমে পোল্যান্ড, স্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি। দক্ষিণ-পশ্চিমে রোমানিয়া ও মলদোভা। দক্ষিণে কৃষ্ণসাগর ও আজভ সাগর। পূবে ও উত্তর-পূবে রাশিয়া। উত্তরে বেলারুশ।

দক্ষিণে ক্রিমেয়া উপদ্বীপ স্বায়ত্তশাসিত ক্রিমেয়া সাধারণতন্ত্র পড়ছে ইউক্রেনের সীমান্তের মধ্যেই। খনিজসম্পদে সমৃদ্ধ দেশটির অধিকাংশ এলাকা কৃষিকাজে উপযোগী উর্বর সমভূমি। ১৯৯১তে, ইউক্রেন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ইউক্রেনের এই ঘোষণা সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দ্বিতীয় রাউন্ডে ইয়ানুকোভিচ পেয়েছেন ৪৮.৯৫শতাংশ ভোট।

তিমোশেঙ্কো পেয়েছেন ৪৫.৪৭শতাংশ ভোট। নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীর তুলনায় ৩.৫শতাংশ ব্যবধান নিয়ে রাষ্ট্রপতি ইয়ানুকোভিচ। ঘোষণা করেছে দেশের কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন। ‘অবাধ ও সুষ্ঠু ভোটের’ দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছে আন্তর্জাতিক মহল। আন্তর্জাতিক পর্জবেক্ষকদের মতে , ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনের এক তাক লাগানো প্রদর্শনী।

’ তবু পরাজয় মেনে নিতে অস্বীকার করেছেন তিমোশেঙ্কো। কারচুপির অভিযোগ এনে তুলেছেন পুনর্গণনার দাবি। নির্বাচনে হেরে গিয়েও আঁকড়ে রয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর পদ। নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যেতে পারেন আদালতে। যদিও সেটা আদৌ ‘প্রাজ্ঞ দিদ্ধান্ত হবে না’ বলে জানিয়েছে ব্রিটিশ দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট।

লক্ষনীয়, ইয়ানুকোভিচ রুশপন্থী বলে পরিচিত হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন তিমোশেঙ্কোর অভিযোগকে সমর্থন করেনি। ইয়ানুকোভিচের দল পার্টি অব দি রিজিওনসের সহসভানেত্রী অ্যানা জার্মান সংবাদ সংস্থা অ্যাসোসিয়েট প্রেসকে জানিয়েছেন, ইয়ানুকোভিচ পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সের্গেই তিগিপকোর (কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্কের প্রাক্তণ প্রধান, যিনি রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের প্রথম রাউন্ডে ছিলেন তিন নম্বরে, পেয়েছিলেন ১৩শতাংশ ভোট) নাম বিবেচনা করছেন। যদি তা সফল হয়, তবে তা কমলা বিপ্লবের জন্য হবে আরেকটি বড় ধাক্কা। ইয়ানুকোভিচের জয়ে তাঁকে ফোনে অভিনন্দন জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রপতি বারাক ওবামা। অভিনন্দন জনিয়ে বার্তা পাঠিয়েছেন ন্যাটো’র মহাসচিব।

বার্তা পাঠিয়েছেন ইউরোপীয় ইউনিয়নের সভাপতি। পশ্চিমের নেতাদের এই অভিনন্দনের জবাবে ইয়ানুকোভিচ স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন, ন্যাটো’র সদস্য হওয়ার কোনও অভিপ্রায় ইউক্রেনের নেই। ন্যাটো’র সদস্য হওয়ার জন্য মরিয়া ছিলেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইউশচেঙ্কো। যার পিছনে ছিল মার্কিন রাষ্টরপতি জর্জ বুশের প্রশাসনের জোরালো সমর্থন। কিন্তু ওয়াশিংটনের বিপুল উৎসাহ, উদ্দীপনা সত্ত্বেও, ১০০৮এ বুখারেস্টে ন্যাটোর বৈঠকে জার্মানি ও ফ্রান্স এই উদ্যোগে জল ঢেলে দেয়।

তাদের সঙ্গত উদ্বেগ ছিল, এই পদক্ষেপ রাশিয়ার সঙ্গে বৈরিতা বাড়াবে। তবু ন্যাটো তার বিবৃতিতে বলে, জর্জিয়ার সঙ্গে ভবিষ্যতে ইউক্রেনও যোগ দেবে ন্যাটোতে। ‘ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার কোনও প্রশ্নই ওঠে না’, সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ইয়ানুকোভিচ, রুশ চ্যানেলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। বরং, ‘যৌথ ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী ইউক্রেন’, জানিয়ে দিয়েছেন তিনি। ‘সেইসঙ্গে রুশ রাষ্ট্রপতি দিমিত্রি মেদভেদেভ এব্যাপারে যে উদ্যোগ নিয়েছেন, তাকে আমরা সমর্থন জানাতে প্রস্তুত।

’ বলেছেন তিনি। পাশাপাশি, কৃষ্ণসাগরের উপকূলে ক্রিমেয়া উপদ্বীপে বন্দরনগরী সেবাস্তোপোলে রুশ নৌঘাঁটির মেয়াদ পুনর্বিবেচনার স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়েছেন তিনি। সেবাস্তোপোলে রুশ নৌঘাঁটি নিয়ে চুক্তি হয় ১৯৯৭এর মে’তে। মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা ২০১৭তে। বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ইউশচেঙ্কোর লক্ষ্য যেমন ছিল ইউক্রেনকে টেনে ন্যাটোতে নিয়ে যাওয়া, রাশিয়াকে লক্ষ্য করে ইউক্রেনের ভূখন্ডে ক্ষেপনাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা, তেমনই সেবাস্তোপোলে সোভিয়েত-যুগের এই নৌঘাঁটি থেকে রুশ নৌবাহিনীকে হটিয়ে ন্যাটো’র বাহিনীকে ঢোকানোর জন্য মরিয়া ছিলেন।

বিপরীতে ইয়ানুকোভিচ এই চুক্তির পুনর্বিবেচনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, একইসঙ্গে জর্জিয়া ভেঙে বেরিয়ে আসা দক্ষিণ ওসেতিয়া এবং আবখাজিয়া, যার ওপর গত বছর একতরফাভাবে আক্রমণ করেছিল ওয়াশিংটনের বিশ্বস্ত দেশ জর্জিয়া, তাদের স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি সময় যে জর্জিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে প্রচুর সমরাস্ত্র পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি ভিক্টর ইউশচেঙ্কো। সেইসঙ্গেই সেনা অভিযানের সময় পাঠিয়েছিলেন ইউক্রেনের সামরিক বিশেষজ্ঞদের। রুশ ভাষা, রুশ স্কুল, রুশ টেলিভিশন চ্যানেল গুটিয়ে দেওয়ার নীতি নিয়েছিলেন ইউশচেঙ্কো।

ইয়ানুকোভিচ চান, রুশ ভাষাকে ইউক্রেনের (যা দেশের একমাত্র সরকারী ভাষা) সঙ্গে সমান, বা প্রায় সমান মর্যাদা দিতে। চান রাশিয়ার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সুসম্পর্ক। রাশিয়া যাতে ডব্লিউ টি ও-তে সদস্যপদ পায়, সেব্যাপারে চান সাহায্য করতে। সরকারীভাবে ফল ঘোষণার পরেই মেদভেদেভ তাঁকে রাশিয়া সফরে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে ‘পশ্চিমের অযথা ভয়ের যে কোনও কারণ নেই’, সেই বার্তাও দিয়েছেন ইয়ানুকোভিচ।

জয়ের পর পশ্চিমের প্রথম পত্রিকা ‘দ্য টেলিগ্রাফ’কে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ‘তিনি রাশিয়ার দালাল’ এই মন্তব্য শুনে হেসে উড়িয়ে দিয়েছেন। বলেছেন, তাঁর নতুন অবস্থানে উপকৃত হবে পশ্চিম। এমনকি ইউক্রেনের ওপর দিয়ে ইউরোপে যে রুশ পাইপলাইন গিয়েছে, তার ওপর যে হুমকি রয়েছে, তিনি চান তার চিরতরে অবসান। বলেছেন, ‘আমি আসলে ইউক্রেনিয়দের পক্ষে। ’ একইসঙ্গে বলেছেন, ‘কমলা বিপ্লবের (আমেরিকার কলকাঠি) ঘটনা আজ আর গোপন নয়।

এটা আমরা জেনেছি, বুঝেছি অনেক আগেই। আজ আমরা ইতিহাসের নতুন পৃষ্ঠা খুলেছি। তাকিয়ে আছি ভবিষ্যতের দিকে। ’

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.