পতাকায় ফালগুন মানচিত্রে বসন্ত
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা তথা বিশ্বসাহিত্যের বরপুত্র। গীতাঞ্জলি সেই বরে মূল্যায়িত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব দরবারে পরিচিত করেছে বাঙালির সমৃদ্ধ সংস্কৃতির ধারকরূপে। বিলেতে ইন্ডিয়া সোসাইটি ১৯১২ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কিছু কবিতা ও গানের ইংরেজি গদ্যানুবাদ নিয়ে গীতাঞ্জলি গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্য ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার অর্জন করে বাংলা সাহিত্যকে বিশ্ব-আসনের সম্মানশিখরে তুলে ধরেন।
যে গীতাঞ্জলির জন্য তিনি নোবেল অর্জন করেন তার সম্পর্কে আজও অনেকের মধ্যে ভুল ধারণা আছে।
অনেকে মনে করেন গ্রন্থটি কবির বাংলা গীতাঞ্জলির অবিকল ইংরেজি অনুবাদ এবং এই অনুবাদের ফসল তাঁর এই নোবেল পুরস্কার অর্জন। ইংরেজি গীতাঞ্জলির কথা উঠলেই অনেকের মনে পড়ে যায় অনেক গানের মধ্যে সেই গান- 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে'। এ যেন গান নয় ঈশ্বরের প্রতি আত্মসমর্পণের সত্যিকার প্রকাশ! অথচ গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে এই গানটির স্থান মেলেনি।
নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত ইংরেজি গীতাঞ্জলির পরিচয় দিতে গিয়ে রবীন্দ্র-সমালোচক এবং জীবনীকাররাও বলেন, গ্রন্থটি গীতাঞ্জলি, গীতিমাল্য, খেয়া, নৈবেদ্য প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া কবিতাগুলোর অনুবাদের সংকলন, কিন্তু ওই প্রভৃতির ব্যাখ্যা কোথাও সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়নি।
রবীন্দ্রনাথের ১০৩টি গান ও কবিতার অনুবাদ নিয়ে ইংরেজি গীতাঞ্জলি রচিত হয়েছে।
বাংলা গীতাঞ্জলির ১৫৭টি গান ও কবিতা থেকে ১০৪টি বাদ দিয়ে মাত্র ৫৪টি ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে সন্নিবেশিত হয়েছে। গীতিমাল্য থেকে ১৬টি, নৈবেদ্য থেকে ১৫টি, খেয়া থেকে ১১টি, শিশু থেকে ৩টি, কল্পনা থেকে ১টি, চৈতালী থেকে ১টি, উৎসর্গ থেকে ১টি, স্মরণ থেকে ১টি এবং অচলায়তন থেকে ১টি অর্থাৎ ৫০টি গান এবং কবিতা বর্ণিত গ্রন্থগুলো থেকে নেয়া হয়েছে। মোট ন’টি কাব্যগ্রন্থ থেকে ১০২টি গান ও কবিতা এবং অচলায়তন নাটক থেকে একটি গানের অনুবাদ সংকলিত করে ইংরেজি গীতাঞ্জলি সাজানো হয়েছে ১০৩টি গান ও কবিতা দিয়ে।
বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে নেয়া এই ১০৩টি কবিতা এবং গান মূল গ্রন্থগুলোর ধারাবাহিকতা বজায় রেখে সংকলনে সাজানো হয়নি। ইংরেজি গীতাঞ্জলির প্রথম কবিতা/গান 'আমারে তুমি অশেষ করেছ' গীতিমাল্যে’র তেইশ নম্বর, দ্বিতীয় কবিতা/গান তুমি 'যখন গান গাহিতে বলো' ও তৃতীয় কবিতা/গান 'তুমি কেমন করে গান কর হে গুণী'; মূল গীতাঞ্জলির যথাক্রমে আটাত্তর ও বাইশ নম্বর, চতুর্থ কবিতা/গান 'আমার সকল অঙ্গে তোমার পরশ'- নৈবেদ্যের পঁচাত্তর নম্বর, পঞ্চম কবিতা/গান 'তুমি একটু কেবল বসতে দিও কাছে' গীতিমাল্যের বিশ নম্বর- এভাবেই সাজানো হয়েছে ইংরেজি গীতাঞ্জলির কবিতা কিংবা গানগুলো।
শিশু থেকে গৃহীত কবিতা তিনটি এই গ্রন্থে পাশাপাশি দেখতে পাওয়া যায়। পঁচানব্বই নম্বর কবিতা 'জীবনের সিংহদ্বারে পশিনু যে ক্ষণে ইংরেজি কবিতা নৈবেদ্য কাব্যের ঊনাশি ও নব্বই নম্বরের দুটি কবিতা অবলম্বনে রচিত। নৈবেদ্য নব্বইয়ের শেষাংশ পঁচানব্বইতে সংযোজিত করা হয়েছে। গীতাঞ্জলির ইংরেজি অনুবাদে কোথাও কোথাও মূল কবিতার অংশবিশেষও বাদ পড়েছে, কবিতা/গান আটচল্লিশ, একষট্টি ও একশ’ দুই নম্বরে তার প্রতিফলন ঘটেছে।
১৯১২ সালে লন্ডনের ইন্ডিয়ান সোসাইটি ইংরেজি গীতাঞ্জলির সীমিত সংস্করণ বের করার পর ম্যাকমিলান অ্যান্ড কোং কর্তৃক এটি পূর্ণরূপে প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯১৩ সালের মার্চে এবং দু’বার পুনর্মুদ্রিত হয় এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই মাসে।
তিন বার পুনর্মুদ্রিত হয় সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাসে। নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে দু’বার করে পুনর্মুদ্রিত হয়। ১৯১৪ থেকে ১৯২১ সাল পর্যন্ত প্রতি বছরই গ্রন্থটি পুনর্মুদ্রিত হতে থাকে। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯১৪ সালে চার বার, ১৯১৫ সালে তিন বার, ১৯১৭ সালে দু’বার, ১৯১৮ সালে দু’বার, ১৯১৯ সালে দু’বার পুনর্মুদ্রিত হয়। এরপর থেকে গ্রন্থটির চাহিদা কমতে থাকে যার ফলশ্রুতিতে ১৯২৬, ১৯২৯, ১৯৩২ ও ১৯৩৮ সালে গীতাঞ্জলি মাত্র একবার করে পুনর্মুদ্রিত হয়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইংরেজি গীতাঞ্জলি গ্রন্থটি উইলিয়াম রদেনস্টাইনকে উৎসর্গ করেন। রদেনস্টাইন তার বন্ধু ছিলেন। নিজের কবিতার আস্বাদ অন্যকে দেবার জন্যই প্রথমে কিছু কবিতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজে অনুবাদ করে তাকে পড়তে দেন। রদেনস্টাইন কবিতাগুলো নিজে পড়েন এবং পরবর্তীতে বিলেতের সুধী সমাজের কাছে তা উপস্থাপন করেন। রদেনস্টাইন সে সময় যাদের কাছে ঠাকুরের লেখা উপস্থাপন করেন তাদের মধ্যে ডবলিউ বি ইয়েটস ছিলেন উল্লেখযোগ্য।
ইংরেজি গীতাঞ্জলিতে ষোল পৃষ্ঠার একটি বড় ভূমিকার অবতারণা করেছেন ডবলিউ বি ইয়েটস। তিনি ভূমিকার প্রথমেই উল্লেখ করেছেন- “দিন কয়েক আগে একজন বিশিষ্ট বাঙালি চিকিৎসককে আমি বলেছিলাম, আমি জার্মান ভাষা জানি না, তবু যদি কোনো জার্মান কবির অনূদিত কাব্যরচনা আমাকে আলোড়িত করে তাহলে ব্রিটিশ মিউজিয়ামে গিয়ে তার জীবন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে কিছু জানার জন্য ইংরেজিতে লেখা বই খুঁজে বের করতাম। অথচ যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এই গদ্যানুবাদগুলো আমার রক্তের মধ্যে অভূতপূর্ব আলোড়ন সৃষ্টি করেছে তার জীবন ও চিন্তাধারা সম্পর্কে কিছুই জানতে পারব না যদি না কোনো ভারতীয় পর্যটক সে সম্পর্কে আমাকে কিছু বলেন। আমার মুগ্ধতার কাছে যেন খুব স্বাভাবিক বলেই মনে হলো, কেননা তিনি বললেন, আমি প্রত্যেক দিন রবীন্দ্রনাথ পড়ি, তার এক একটি ছত্র পড়া মানে জগতের সব দুঃখ ভুলে যাওয়া। আমি বললাম, দ্বিতীয় রিচার্ডের আমলে কোনো ইংরেজকে পেত্রার্ক কিংবা দান্তের কোনো অনুবাদ গ্রন্থ পড়তে দিলে তিনি তার প্রশ্নাদির জবাব পাবার মতো কোনো বই খুঁজে পেতেন না, তাকে ফোরেন্সের কোনো ব্যাঙ্কার অথবা কোনো সওদাগরের কাছে জিজ্ঞেস করতে হতো, যেমন আমি আপনার কাছে জানতে চাইছি।
আমি কেবল জানি এই কবিতাগুলো অতি সমৃদ্ধ ও অত্যন্ত সরল এবং আপনার দেশে নতুন রেনেসাঁর জন্ম হয়েছে, কিন্তু এ বিষয়ে লোকমুখে শোনা ছাড়া জানবার আর কোনো উপায় নেই। তিনি বললেন, আমাদের অন্যান্য আরও অনেক কবি রয়েছেন কিন্তু তার সমক কেউ নেই। আমরা এটাকে রবীন্দ্রযুগ বলি। ...”
কবি ইয়েটস স্বয়ং রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলো অনুবাদ করেছেন কি-না তা নিয়ে একটি অনর্থক তর্কও আছে। ইয়েটসের আগে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেয়ে যাওয়ায় ইয়েটসের ক্ষোভে এবং রবীন্দ্রনাথের প্রতি তার বিরূপ আচরণ আলোচিত হয়েছে, যদিও ইয়েটস গীতাঞ্জলির পাণ্ডুলিপি পড়ে গভীরভাবে অভিভূত হয়েছিলেন।
ট্রেনে, বাসে যেখানেই সময় পেতেন সেখানেই তিনি এটি পড়তেন এবং তাঁর অভিভূত রূপটি প্রকাশ না করার জন্য কাউকে দেখলেই তা লুকিয়ে ফেলতেন। ইয়েটস বলেছেন- “তখনকার সময়ে রবীন্দ্রনাথকে জানার মতো বিদেশে কোনো বই ছিল না। ” প্রবাসী ভারতীয়রাই তার লেখা পাঠ করে সবাইকে শোনাত। অনেকটা তার ওপর ভর করেই গীতাঞ্জলিতে ইয়েটস সুন্দর একটি ভূমিকার অবতারণা করেছেন।
রবীন্দ্রনাথের স্বপ্ন তিনি নিজের স্বপ্নের সঙ্গে মিলিয়েছেন।
যুবতী তার সজ্জায় প্রেমিকের মালা থেকে খসে পড়া ফুল কিংবা নিদেনপে একটি পাপড়ি খোঁজে। বধূ শূন্য ঘরে স্বামীর প্রত্যাবর্তনের জন্য অপো করে, ফুল-নদী, শঙ্খধ্বনি, ঘনবর্ষা অথবা তীব্র দাবদাহ- এ সবই যেন তার কাছে মিলন অথবা বিরহের প্রতিচ্ছবি মনে হয়েছে। রবীন্দ্র রচনার গভীর পাঠের মধ্যে ইয়েটস এ ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হয়েছেন।
সুইডিস একাডেমি ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নোবেল পুরস্কার দেয়া প্রসঙ্গে বলে- “তার গভীর সংবেদনশীল, সতেজ ও সুন্দর কবিতার জন্য; যার দ্বারা পরম নৈপুণ্যের সঙ্গে তিনি ইংরেজি ভাষান্তরের মাধ্যমে তার কাব্যিক চিন্তা-চেতনাকে প্রতীচ্যের সাহিত্যের একটি অংশে পরিণত করেছেন। ”
রবীন্দ্রনাথের ইংরেজি ভাষা ছিল অনেকটা বাইবেলের ভাষার মতো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ইংরেজি সম্পর্কে ই. জে. টমসন বলেন, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবার পর তার কাছে অসংখ্য চিঠি আসতে থাকে। যার ভাষা ছিল অনেকটা বিদ্রুপাত্মক এবং অপমানজনক। জনৈক মহিলা তার কাছে লেখেন, তার ধারণা গীতাঞ্জলি অনুবাদ করেছেন সি.এফ. এন্ডুজ। তিনি ই.জে. টমসনের কাছে এন্ডুজের ঠিকানা জানতে চান এবং এন্ডুজ ও রবীন্দ্রনাথের স্বারসহ একটি গীতাঞ্জলির কপি চান যেন তিনি তা তার সংগ্রহে রাখতে পারেন। ভারতের আরও একজন ইংরেজ কর্মকর্তা গীতাঞ্জলির ভাষা নিয়ে প্রকাশ্যে হৈচৈ করেন এবং কোন ইংরেজ এটি লিখেছেন তার ঠিকানা জানতে চান।
এর অবশ্য যথেষ্ট কারণ ছিল। টমসন নিজেই বলেছেন, রবীন্দ্রনাথ আর্টিকেল লিখতে খুব স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন না। তিনি ইডয়মের অপব্যবহারও করতেন। I took my shelter না লিখে তিনি লিখতেন I took shelter- এখানেই ইরেজদের ইংরেজির সঙ্গে তার ইংরেজি লেখার পার্থক্য ছিল। পার্থক্য যাই থাক তিনি তো শুধু গীতাঞ্জলির কবি নন তিনি কবিগুরু-বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর- এই সত্যে বিশ্বসাহিত্যে পৃথিবী প্রলয় না হওয়া পর্যন্ত মানুষের হৃদয়ে ভালোবাসায় আসীন হয়ে থাকবেন।
প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি, দুঃখ-বেদনায়, সুখ-কষ্টে আমরা গাইতেই থাকব- 'আমার মাথা নত করে দাও হে তোমার চরণধুলার তলে!'
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।