আপাতত কিছু বলবোনা
যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার এক ঐতিহাসিক গ্রাম। কৃষি বিপ্লবের কারণে গ্রামটি ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। পরিবেশ সচেতন গ্রামবাসী সেকেলে চাষ পদ্ধতির পরিবর্তে বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ভিত্তিক নতুন কৃষি আন্দোলনে কৃষি বিজ্ঞানী, কৃষিবিদদের জড়িত করে গাইদঘাট গ্রামসহ যশোর ও মাগুরা জেলার ৪০টি গ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ২৬টি কৃষি ক্লাবের মাধ্যমে এখানকার ৪০টি গ্রামের ৭০ হাজার মানুষ বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে দেশের কৃষি ইতিহাসে নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে। পরিবেশ সচেতন বিজ্ঞানমনস্ক প্রগতিশীল কৃষকরা বহু পোকাকে ফসলের ক্ষেতে ছেড়ে দিয়ে, নেপথালিনের সাহায্যে শত্রু পোকাকে তাড়িয়ে, কেরোসিন ও গুল দিয়ে পোকা দমন করে বছরে ১,৫০০ মেট্রিক টন সবজি আর ৫৯৪ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করে আয় করছে ২ কোটি টাকা।
এ কারণে গ্রামটি দেখতে দেশ-বিদেশের খ্যাতিমান বিজ্ঞানীরা এসেছেন। গ্রামের সাধারণ মানুষগুলো মাটি, বাতাস আর পানিকে পুজি করে গাইদঘাটে যে মডেলের ভিত্তি রচনা করেছেন সেই মডেল এখন সর্বত্র ছড়িয়ে দেয়ার সময় এসেছে।
গাইদঘাট গ্রামের মহিলারাও সবুজ বিপ্লবের সৈনিক। গাইদঘাট বাংলাদেশের অন্য আর ১০টি গ্রামের মতোই একটি গ্রাম। একটা সময় অভাব এ গ্রামকেও খাবলে খেতে চেয়েছে।
গ্রামবাসী সে সময় যে কোনো মা� ে � িকই ফসল ফলাতো, সে ফসল ঘরেও তুলতো কিন্তু তাতে বছরের খাবার ঘরে আসতো না। এ কারণে দারিদ্র্যের সঙ্গে প্রতিনিয়ত গ্রামবাসীর লড়াই করতে হতো। গ্রামের মানুষ সচ্ছলভাবে বাচার স্বপ্ন দেখতো কিন্তু স্বপ্ন স্বপ্নই থেকে যেতো, তা আর বাস্তবায়িত হতো না। এভাবেই কেটে গেছে শত বছর। অবশেষে ২০০১ সালে কৃষক সংগ� ক আইয়ুব হোসেন আর প্রগতিশীল চেতনার বিএ পাস যুবক লক্ষ্মণচন্দ্র মন্ডল গাইদঘাট গ্রামের অভাব দূর করার জন্য এগিয়ে আসেন।
তারা দফায় দফায় গ্রামবাসীর সঙ্গে কথা বলেন। মুক্তির পথ খোজেন। গ্রামবাসীকে বোঝানোর চেষ্টা করেন আমাদের মাটি আছে, আলো আছে, পানি আছে, মুক্ত বাতাস আছে। আরো রয়েছে পরিশ্রমী মানুষ। এ অমূল্য পুজি নিয়ে আমরা যুদ্ধ করবো।
গ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাবো। ভাতের অভাব দূর করবো। আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে আমরা আমাদের পুজি বিনিয়োগ করে ফসলে গোলা ভরবো। আইয়ুব আর লক্ষ্মণের এমন মন্ত্রে গ্রামবাসী সংগ� িত হয়। তারা এ দুজনের নেতৃত্বে গ্রাম উন্নয়নে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনের জন্য এগিয়ে আসে।
শুরু হয় নতুন গল্পের। যে গল্প সবুজের, যে গল্প ফসলের, যে গল্প গাইদঘাট গ্রাম পরিবর্তনের।
২০০১ সালে সরকারের কোনো রকম সহযোগিতা ছাড়াই দেশ ও জাতি গ� নের লক্ষ্যে উচ্চতর বিজ্ঞানসম্মত প্রযুক্তি ভিত্তিক কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়নের লক্ষ্যে গ� ন করা হয় গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্র। লক্ষ্মণচন্দ্র মন্ডল আর আইয়ুব হোসেন এ কেন্দ্রের সঙ্গে বিজ্ঞানী, কৃষিবিদ, কৃষি কর্মীদের সম্পৃক্ত করে সবুজের বন্দনা শুরু করেন। গাইদঘাট গ্রামে শুরু হয় কৃষিযজ্ঞের।
২০০২ সালে এ যজ্ঞে গ্রামবাসীর ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে আসেন আইপিএম সিআরএসপির কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. রেজাউল করীম, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. সৈয়দ নুরুল আলম। পরে কৃষি উন্নয়নের এ কর্মকান্ডের সঙ্গে আরো যুক্ত হন বারির কৃষি বিজ্ঞানী ড. শাহাবুদ্দিন, ড. আবদুর রহমান, ড. মনোয়ার হোসেন, ড. আবদুর রাজ্জাকসহ দেশের খ্যাতিমান কৃষি বিজ্ঞানীরা। কৃষক আর কৃষি বিজ্ঞানীরা জোটবদ্ধ হয়ে দেশের প্রথম আইপিএন পদ্ধতিতে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ প্রকল্প গ্রহণ করেন। গাইদঘাট গ্রামের সব কৃষক এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত হয়ে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদন করে দেশ-বিদেশের প্রশংসা অর্জন করেন। এর পাশাপাশি গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের অধীনে যশোর ও মাগুরা জেলার ৪০টি গ্রামের ৭০ হাজার গ্রামবাসীকে নিয়ে গ� ন করা হয় ২৬টি কৃষি ক্লাব।
বর্তমানে ২৬টি কৃষি ক্লাবের ২ হাজার ২২১ জন কৃষক ৯ হজার ২৩১ হেক্টর জমিতে বিষমু্ক্ত সবজি উৎপাদন করছে। পাশাপাশি আধুনিক পদ্ধতিতে ধান, পাট অন্যান্য ফসলের চাষ করা হচ্ছে। ক্লাবগুলোকে কেন্দ্র করে কৃষকরা বিজ্ঞানীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার ভিত্তিতে নতুন এক কৃষি আন্দোলন শুরু করেছে।
একজন আইয়ুব হোসেনের গল্প
বাংলাদেশের সব কৃষি বিজ্ঞানী কৃষিবিদ এক নামে আইয়ুব হোসেনকে চেনেন। প্রাতিষ্� ানিক শিক্ষা কম থাকলেও তিনি একজন স্বশিক্ষিত প্রগতিশীল কৃষক।
তাকে আধুনিক কৃষি বিপ্লবের নায়কও বলা যেতে পারে। আইয়ুব হোসেন মনে করেন, বাংলাদেশের কোনো অভাব নেই। গাইদঘাটের পুজি আলো, বাতাস, পানি আর মাটি। এ পুজি বিনিয়োগ করে গাইদঘাট গ্রাম থেকে অভাবের দৈত্যকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। আলো, বাতাস, পানি ও মাটি বাংলাদেশের ৮৫ হাজার গ্রামেই রয়েছে।
এগুলোকে পুজি করে এ ৮৫ হাজার গ্রাম কেন্দ্রিক বাংলাদেশকেও সামনে এগিয়ে নেয়া সম্ভব। আইয়ুব হোসেন এভাবেই আমাদের দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা নীরবে কাজ করে যাচ্ছেন।
আইয়ুব হোসেনের জন্ম গাইদঘাট গ্রামের পাশের গ্রাম কটুরাকান্দি গ্রামে। এখন তার বয়স ৪৭। বাবা মৃত আবু বক্কার শিকদার।
আইয়ুবের এক ছেলে ও এক মেয়ে। কিন্তু তিনি ঘরের বাধনে বন্দি নন, সংসারের মোহে স্বার্থপর নন। তিনি কাজ করছেন এ দেশের গরিব কৃষকদের জন্য। ছেলেবেলাতেই কৃষকদের মুক্তির জন্য বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। এ কারণে বাবা তাকে ত্যাজ্য করেন।
আইয়ুব হোসেন গ্রাম ছেড়ে বোহেমিয়ান জীবনযাপন করেছেন। আশির দশকে ঝিনাইদহের কালীগঞ্জের মহেশ্বরচান্দা গ্রামের কৃষক ওমর আলীকে সঙ্গে নিয়ে ওই গ্রামকে স্বনির্ভর করে ইতিহাস তৈরি করেছেন। এখন তিনি গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের সভাপতি। গাইদঘাট গ্রাম ছাড়াও আশপাশের ৪০টি গ্রামের কয়েক হাজার কৃষকের নায়ক তিনি। তারই নেতৃত্বে ওই ৪০টি গ্রামে আধুনিক কৃষি বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে।
একজন লক্ষ্মণচন্দ্র মন্ডল
লক্ষ্মণচন্দ্র মন্ডল কৃষক ও সাংবাদিক। গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের সেক্রেটারি তিনি। ২০০১ সালে লক্ষ্মণ আর আইয়ুব হোসেন দুইয়ে মিলে গাইদঘাটে কৃষি বিপ্লবের বীজ বপন করেছিলেন। তাদের বপিত বীজ থেকে জন্ম নেয়া গাছ আজ ফুলে ফুলে ছেয়ে গেছে। গাইদঘাট গ্রামের পাশের গ্রাম খানপুরে লক্ষ্মণের বাড়ি।
বাবা মৃত অভিলাস মন্ডলও ছিলেন কৃষক। লক্ষ্মণ বিএ পাস করে লেখালেখি শুরু করেছিলেন। স্থানীয় পর্যায়ের সংবাদপত্র ছাড়াও তিনি জাতীয় সংবাদপত্রগুলোতেও সাংবাদিকতা করেছেন। এক পর্যায়ে তিনি সবুজ বিপ্লবের মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে কৃষিকাজ শুরু করেন। এখন নিজের ২১ শতক জমিতে বেগুন চাষের পাশাপাশি গাইদঘাট আর তাদের প্রতিষ্� িত কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের অধীন ৪০টি গ্রামে বিষমুক্ত সবজি ফসল উৎপাদন করে লক্ষ্মণ গ্রামগুলোকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
ইওরোপ, আমেরিকা, ঢাকা, জয়দেবপুর ও ময়মনসিংহের কৃষি বিজ্ঞানীদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করা, ভালো বীজ সংগ্রহ করা, শত্রু পোকা গ্রামে নিয়ে আসা ছাড়াও লক্ষ্মণ গ্রামের কৃষকদের সংগ� িত করে তাদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতিতে ভূমিকা রাখছেন। এ প্রসঙ্গে লক্ষ্মণ বললেন, বৃহত্তর যশোর জেলার পিছিয়ে পড়া কৃষকদের ভাগ্য উন্নয়নে, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য, পুষ্টিহীনতা ও ভাতের অভাব দূর করার জন্য, জীববৈচিত্র্য রক্ষার জন্য কৃষি নির্ভর বাংলাদেশকে গড়ার জন্য আমরা সম্মিলিতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। গাইদঘাট আমাদের মডেল। নিশ্চয় একদিন এই মডেল সারা বাংলাদেশকে আলোকিত করবে। সমগ্র বাংলাদেশে বিষমুক্ত সবজি উৎপাদিত হবে।
নেপথালিনের কতো গুণ
নেপথালিন দিয়ে পোকা দমন আশ্চর্য মনে হলেও গাইদঘাট গ্রামে প্রথম নেপথালিনের সাহায্যে পোকা দমন করে গ্রামের কৃষকরা বিষমুক্ত সবজি চাষে যুগানত্মকারী অধ্যায় রচনা করে। জানা যায়, ২০০৪ সালে দেশে প্রথম লক্ষ্মণ চন্দ্র মন্ডল সবজি ও ধানক্ষেতে নেপথালিন ব্যবহার করে পোকা দমনে সফল হন। ফসলের ক্ষেতে ১০/১৫ হাত দূরত্বে কঞ্চি পুতে সেই কঞ্চির মাথায় দেয়া হয় একটি করে নেপথালিন। নেপথালিনের গন্ধে শত্রু পোকারা পালিয়ে যায়। ফড়িং, গান্ধী পোকাসহ অন্যান্য শত্রু পোকা নেপথালিনের গন্ধে ভুলেও ফসলের ক্ষেতে আসে না।
নেপথালিনের মাধ্যমে পোকা দমনের এ পদ্ধতি ম্যাজিকের মতো কাজ করে। এ কারণে এখন গাইদঘাটের সব কৃষক বিষের পরিবর্তে নেপথালিন ব্যবহার করছেন। আর গাইদঘাটের কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের বার্তা পেয়ে মাগুরার শালিখা উপজেলার পিয়ারপুর, আড়ুয়াকান্দি শতখালি, হারিসপুর, কুশখালী, ছান্দ্রা, শবলহাট, যশোরের বাঘারপাড়ার রাঘবপুর, খানপুর, ক্ষেত্রপালা, দৌলতপুর, পা� ান পাইকপাড়া, ইন্দ্রা, রামপুর, বহুবিলা, কটুরাকান্দি, মথুরাপুর, সেকেন্দারপুর, মীর্জাপুর, দাদপুর, লেবুতলা, কোদালিয়া, জহুরপুর, নোঙরপুর গ্রামের কৃষকরাও নেপথালিন টোপ ব্যবহার করছেন। জানা যায়, এক বিঘা জমিতে ৪০/৫০টি নেপথালিন লাগে। যার দাম মাত্র ১৬ টাকা।
এছাড়া গাইদঘাটের কৃষকরা পোকা দমনের জন্য কেরোসিন ও গুল ব্যবহার করছেন। কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ধান একটু বড় হলে ১ বিঘা জমিতে ১০০ গ্রাম কেরোসিন আর দুই কৌটা গুল মিশিয়ে ইউরিয়ার সঙ্গে উপরি প্রয়োগ করা হয়। ধান গাছে থোড় হলে দ্বিতীয় দফায় একইভাবে ওই মিশ্রণ দেয়া হয়। ওই মিশ্রণ দেয়ার কারণে ধানে আর পোকা লাগে না। এছাড়া যদি কোনো কারণে শত্রু পোকা দেখা যায় তাহলে গ্রামের কৃষকরা এক কেজি নিম ফল থেতো করে ভিজিয়ে পাচ কেজি পানির সঙ্গে মিশিয়ে ধানক্ষেতে স্প্রে করেন।
এতে পোকা দমন হয়।
এছাড়া গ্রামের কৃষকরা সবজি ক্ষেতে বিষ প্রয়োগ না করে ফেরোমন ট্রাপ বা বায়োজেন্ট বন্ধু পোকা ফসলের ক্ষেতে ছেড়ে দেয়। বন্ধু পোকার গন্ধ পেয়ে শত্রু পোকা এটার সঙ্গে মিলিত হতে চায় এবং ফেরোমন ট্রাপে আটকে মারা যায়। অন্যদিকে বন্ধু পোকা শত্রু পোকাকে মেরে ফেলে। কৃষকরা জানায়, সেফ এগ্রোবাইটেক লিমিটেড নামে একটি কম্পানি বন্ধু পোকা কৃষকদের মধ্যে বিনামূল্যে সরবরাহ করছে।
কিন্তু আগামী দিনগুলোতে ওই প্রতিষ্� ান থেকে বন্ধু পোকা কিনে নিতে হবে। এ প্রসঙ্গে কৃষকদের বক্তব্য হচ্ছে, পরিবেশ রক্ষার জন্য কৃষককে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান করার জন্য কৃষি বিভাগের উচিত আগ্রহী কৃষকদের বন্ধু পোকা বিনা মূল্যে সরবরাহ করা। জানা যায়, বিষ না দিয়ে গাইদঘাটসহ আশপাশের ৪০টি গ্রামের কৃষকরা এখন পরিবেশ সচেতন হয়ে অভিনব সব কৌশলে পোকা দমন করছেন।
সফল যারা নায়ক তারা
গাইদঘাট গ্রামের অনেকেই তিনবেলা খেতে পায়নি। না খেয়ে থেকেছে।
অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাজিত হয়েছে। এখন কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের মাধ্যমে কৃষকরা সচেতন হয়ে সংগ� িত হয়েছে। আধুনিক চাষ পদ্ধতি প্রয়োগ করে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তন করেছে। অনেক কৃষকই এখন মোটরসাইকেল চালিয়ে ফসলের ক্ষেতে যান। মোবাইলে পাইকারি বাজারের খোজখবর নেন।
এক সময়ের সহায় সম্পদহীন কৃষক নজরুল ইসলাম, হুমায়ুন কবীর খান, অমল বিশ্বাস, অননত্ম বিশ্বাসসহ আরো অনেকে প্রচন্ড পরিশ্রম করে আধুনিক চাষ করে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। জমি কিনেছে। গরু-ছাগলের মালিক হয়েছে। গ্রামের কৃষকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার পরিবর্তনের হওয়ায় গ্রামের সেই চিরচেনা দৃশ্য পাল্টে গেছে। এখন শিশুরা বই-পুস্তক নিয়ে স্কুলে যায়।
করলা ক্ষেতে কাজ করতে করতে কৃষক মোবাইলে কথা বলে, জেনে নেয় সবজির বাজার দর। নিজে ট্রাক ভাড়া করে সবজির চালান পা� ান ঢাকায়। নতুন নতুন বীজের সন্ধানে তারা কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউটের সঙ্গে যোগাযোগ করে। নিজেরা চাদা তুলে পালা-পার্বণে গ্রামে খেলাধুলা আর গান-বাজনার আয়োজন করে গ্রামকে আনন্দমুখর করে তোলে। এভাবেই কৃষি বিপ্লবের ম্যাজিকে গাইদঘাটসহ আশপাশের গ্রামের কৃষকরা দারিদ্র্যকে পরাজিত করে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
সর্বশেষ গত ১২ আগস্ট আমেরিকার কৃষিবিজ্ঞানী ড. পিগ্যাপামিন গাইদঘাট পরিদর্শন করেছেন। এছাড়া দেশের খ্যাতিমান প্রায় সব বিজ্ঞানী গাইদঘাটের ফসলের ক্ষেত দেখে প্রশংসা করেছেন। ২০০৩ সালে কৃষিমন্ত্রী মতিউর রহমান নিজামী, ২০০৫ সালে কৃষিমন্ত্রী এম কে আনোয়ার ও ২০০৭ সালে কৃষি সচিব আবদুল আজিজ গাইদঘাট পরিদর্শন করেছেন। গাইদঘাটের কৃষি বিপ্লব দেখার জন্য ঝিনাইদহ, পাবনা, রাজশাহী, কুমিল্লা, মেহেরপুর, বরিশাল জেলার কৃষকরা এসেছেন। খুলনা ইউনিভার্সিটির কৃষি বিভাগের ছাত্রছাত্রীরা গাইদঘাট গ্রাম থেকে কৃষিকাজ শিখেছেন হাতে-কলমে।
গাইদঘাটকে মহিলারাও সাজাচ্ছেন
গাইদঘাট গ্রামের কৃষি বিপ্লবের সৈনিক নারী-পুরুষ উভয়ই। পুরুষের পাশাপাশি গ্রামের মহিলারাও গাইদঘাটের ফসলের মা� কে সবুজ করেছেন। সবুজ সবজি ক্ষেত থেকে করলা-ঝিঙে তুলে ঝুড়ি ভরেছেন। স্বামীর সঙ্গে অথবা পরিবারের অন্যান্য কৃষকের সঙ্গে মহিলারাও সবুজ বিপ্লবের মার্চপাস্টে অংশ নিয়ে নিজেরা ইতিহাস গড়ছেন। গ্রামকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।
শোভা রানী কর এমনই এক কৃষাণী। স্বামী অশোক কর ১০ শতক জমিতে করলার চাষ করেছেন। শোভা আর তার স্বামী মিলে ক্ষেতে বীজ বপন করেছে। ক্ষেতে পানি সেচ দিয়েছে। মাচা তৈরি করেছে।
এখন সেই করলা লতা তাদের ভালোবাসায় ক্ষেতে অপূর্ব শোভার সৃষ্টি করেছে। শোভা প্রতিদিন ভোরে করলা ক্ষেতে আসেন। আদর-সোহাগে বেধে দেয়া মাচায় হাত রাখেন। করলা তোলেন। শোভার শ্রমের কারণে একদিকে চাষের খরচ কমেছে অন্যদিকে ফলনও বৃদ্ধি পেয়েছে।
সে নিজেও চাষকাজ সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে উ� ছে। এ প্রসঙ্গে শোভা বলেন, নিজের ক্ষেতে শ্রম দিতে লজ্জার কি? সংসারের কাজ সেরে অবসরে মা� ে কাজ করি। তাতে জমি চাষে খরচ কমে যায়। আবার মনেও আনন্দ থাকে। শোভার মতো গাইদঘাটার ফসলের ক্ষেতে কাজ করে তৃষ্ণা রানী ও সারথী রানী।
তৃষ্ণার স্বামী মনি কুমার, সারথীর স্বামী বাবুরাম বিশ্বাস সবজি ক্ষেতে কাজ করেন। তাদের জমি না থাকলেও অন্যের ক্ষেত পরিচর্যা করে তারা বাড়তি আয় করেন। তাদের মতো অনেকেই গাইদঘাটের ফসলের মা� ে শস্য ফলান। ফুল ফোটান।
সমস্যা ও সম্ভাবনা
গাইদঘাট কৃষি প্রযুক্তি বাস্তবায়ন কেন্দ্রের অফুরনত্ম সম্ভাবনা রয়েছে।
এ মডেলটি দেশের অন্যান্য গ্রামে বাস্তবায়িত করতে পারলে ফসলের উৎপাদন অনেক অংশে বেড়ে যাবে। গ্রামের আর্থ-সামাজিক অবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে। কেন্দ্রটি এ পর্যন্ত যা কিছু করেছে তা শুধু নিজেদের প্রচেষ্টার মাধ্যমেই সম্ভব হয়েছে। সরকারি কোনো সাহায্য-সহযোগিতা গ্রামের কৃষকরা পায়নি। জানা যায়, এখানকার উৎপাদিত বিষমুক্ত সবজি ২০০৬ সালে যুবক নামের একটি সংগ� ন বাজার দরের চেয়ে ১৫ শতাংশ বেশি দাম দিয়ে কিনেছে।
কিন্তু সব ধরনের সবজি সরবরাহ করা সম্ভব হয়নি বলে এখন আর যুবক সবজি কিনছে না। কৃষকরা জানায়, তারা পার্শ্ববর্তী পুনেরহাট, সীমাখালী, ভাটারবাজার, খাজুরা বাজারে সবজি বিক্রি করে। কিন্তু তারা ন্যায্য দাম পায় না। ব্যাপারী-পাইকাররা এক হয়ে সবজির দাম নির্ধারণ করে দেয়। ফলে কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ সমস্যা দূর করার জন্য বারির বিজ্ঞানীরা দেশ-বিদেশে যোগাযোগ করছেন। আগামী মৌসুমে কয়েকটি সংস্থা বিষমুক্ত সবজি কেনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। কৃষকদের ভাষ্য হচ্ছে, আমাদের সবজি বিদেশে রফতানির উদ্যোগ নেয়া হোক। আমরা চাই ন্যায্যমূল্য আর স্থায়ী সবজি বাজার। এছাড়া গাইদঘাট গ্রামের অভ্যনত্মরীণ সব রাস্তা কাচা যে কারণে সবজি পরিবহনে বাধার সৃষ্টি হয়।
গ্রামবাসীর দাবি, গ্রামের রাস্তাঘাট উন্নয়নে সরকারের পদক্ষেপ নেয়া দরকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।