আমি পূজারী,শুধুই তোমার প্রেমের
Click This Link ১ম পর্ব
Click This Link ২য় পর্ব
অনেকক্ষণ ধরে সমুদ্র স্নান করে আমরা ফিরে আসি আমাদের রুমে। গোসল সেরে রেডী হই সবাই। উদ্দেশ্য দুপুরের খাবার,তারপর যাব হিমছড়ি।
বৈশাখী রেস্তোরায় ব্যাপক একটা খাওয়া দিলাম সবাই। রুপচাদা আর ভাত।
জোশ খাবার। সবাই গলা পর্যন্ত খেলাম মনে হয়। তারপর সেখানে চা খেয়ে কিছুক্ষণ বসে থাথাকলাম। এই সুযোগে আমি পুনমের কথা তুললাম। বললাম যে সে যা বলেছে তা সত্য।
তাতেও কোন কাজ হল না। কেউ তাকে রাখতে রাজি হল না। আমি আর কোন কথা বলতে চাইলাম না। চুপ মেরে গেলাম।
রেস্তোরা থেকে বের হয়ে রাস্তায় আসলাম।
আমি রিকশা ঠিক করলাম। ৩০ টাকা করে ভাড়া চাইলো। মোট চারটা ঠিক করলাম।
উঠতে যাব,এমন সময় মিলু ডাক দিল, “এই আমীন শোন”।
আমি ওর দিকে তাকালাম।
সে আমাকে হাত দিয়ে ইশারা করল আমাদের পিছনে।
আমি তাকালাম। পুনম হাটছে রাস্তার পাশ ধরে। আসলেই কক্সবাজার শহরটা ছোট। আবার দেখা হয়ে গেল।
আমি মনে মনে খুশি হলেও ভাব ধরলাম দেখিনি। আমি আবার এই কাজ গুলো খুব ভাল পারি। রেজা বলল, “আমিন যাতো ওকে ডাক”।
আমি বললাম, “পারব না”।
আমি যাচ্ছিনা দেখে লিয়া গেল।
দেখি হাত ধরে ডেকে আনছে।
আমি একটু সরে গেলাম। সে আসতে চাচ্ছিল না মনে হয়,মুখ দেখে বোঝা যায়। কাছে আসার পর লিয়া বলল, “তুমি তো আজ রাতেই ব্যাক করবে,তাই না?”
“হুম”।
“বিকেলে নাকি রাতে?”
“রাতে”।
“তাহলে এক কাজ কর আমাদের সাথে হিমছড়ি চল। ভাল লাগবে। রাতে এসে তোমাকে আমরা বাসে তুলে দেব”।
“আপনাদের সমস্যা হবে তো আমি থাকলে। আসলে আমারই ভুল হয়েছে।
এভাবে বাড়ি থেকে হুট করে বের হয়ে আসা ঠিক হয় নি একা একা”।
“আরে তুমি আর একা নও। আমরা সবাই আছি”,মিলু বলে পাশ থেকে। “ঘুরতে আসছি চল ঘুরে আসি”।
“না, আপনারা যান।
আমি যাব না”।
“ওই তুই কিছু বলছিস না কেন?”আমাকে ডাক দেয় সুমন।
আমি বলি, “তোরাই বল। আমি কেন বলব”।
একটু থেমে বলি, “চল পুনম আমাদের সাথে”।
কি করবে বুঝতে পারে না। আমি বলি, “একা একা এই শহরে একটা মেয়ের থাকা ঠিক হবে না”।
কথাতে মনে হয় কাজ হল। সে রাজী হয়ে গেল।
পাশ থেকে কবির আর মাসুদ দেখি আমাকে চোখ মারল।
আমি আর কিছু বললাম না এই মুহুর্তে।
আরো একটা রিকশা ঠিক করা হল। আমি আর পুনম উঠলাম।
আধা ঘণ্টা লাগল হিমছড়ি যেতে। আমি আগেও দেখেছিলাম।
আসলে যতটা সুন্দর সবাই বলে আমার কাছে ততটা লাগে না কেন জানিনা। তারপরেও ভাল লাগে।
সবাই মিলে বেশ অনেকক্ষণ সময় কাটালাম সেখানে। দৌড়ঝাপ,চিল্লাপাল্লা,ছবিতোলা সবকিছুই হচ্ছিল ইচ্ছেমত।
মাসুদ আর কবির বেশ পোজ দিয়ে ছবি তুলল।
মজার বিষয় হল,মাসুদ যে ভাব ধরে তোলে,কবিরের ঠিক সেই মত তুলতে হবে। যতক্ষন না একইরকম হচ্ছে,ততক্ষণ চলতে থাকবে। বেশ মজার।
আমরা ঝরনার পানিতে পা ভিজে বসে থাকলাম অনেকটা সময় । কী ঠাণ্ডা পানি!চারদিকে সবুজ আর সবুজ।
টিলার ফাকে ঝরনা। খুব বড় না হলেও বাংলাদেশের অন্যতম,তাই প্রতিদিন প্রচুর মানুষ আসে দেখার জন্য।
পুনম এখানেও আমাদের একটা গ্রুপ ছবি তুলে দিল। আমি তার ছবি তুলতে চাইলাম,কিন্তু সে তুলতে দিল না। তার নাকি ছবি তুলতে ভাল লাগেনা।
সবাই মিলে পাহাড়ে উঠলাম। খুব উচু না। তবুও আমাদের জন্য কষ্টই হল। একে অপরকে টেনে তুলতে হল। পুনম দেখলাম প্রানপণ চেষ্টা করছে একা একা ওঠার ।
বুঝতে পারলাম সে কারো হাত ধরতে চাচ্ছে না। কিন্তু তাকে শেষ পর্যন্ত আমাকে ডাকতেই হল। আমি তার হাত ধরে টেনে তুললাম।
জীবনে প্রথম কোন মেয়ের হাত ধরলাম। আমার ভেতরে কেমন যেন একটা অনুভুতির খেলা হয়ে গেল।
আমি কাউকে বুঝতে দিলাম না। আচ্ছা পুনমের মাঝেও কি সেরকম কিছু হয়েছিল?জানি না। তার মুখ দেখে তো কিছু বুঝলাম না।
আচ্ছা আমার মুখ দেখে সে কি কিছু বুঝেছিল?
পাহাড়ের উপরে ছোট ছোট কুটির আছে। আমরা একটা ভাড়া করে বসলাম সেখানে।
আমাদের নিজেদের খাবার ছিল,ভাগাভাগি করে খেয়ে নিলাম।
উপর থেকে দূরে সমুদ্র দেখা যায়। দূরে তাকালে নিজেকে খুব ছোট্ট মনে হয়। যতদূর চোখ যায় শুধু সমুদ্র দেখা যায়। নীল পানি আর পানি।
মাঝে মাঝে চিক চিক করে ওঠে ঢেউ। সত্যি দেখার মত একটা যায়গা।
হঠাত করে রোদ পড়ে আসে। মেঘ করতে থাকে। আমরা বুঝতে পারি বৃষ্টি হবে।
তাড়াতাড়ি ফিরে আসার জন্য রওনা দেই। আস্তে আস্তে আরো বেশি মেঘ জমে যায়।
আমরা রিকশাতে থাকতেই বৃষ্টি নামে। কলাতলির প্রায় কাছে চলে এসেছিলাম। আর একটু পরে বৃষ্টি নামলে কি হত?তাহলে আর ভিজতে হত না আমাদেরকে।
আমরা ভিজলে সমস্যা ছিল না,পুনমকে নিয়ে হল যত সমস্যা। ওকে তো ফিরে যেতে হবে আজকে। এভাবে ভেজা ড্রেসে যাবে কিভাবে। মেয়েটা যে আর কোন ড্রেস আনেনি।
আমরা রুমে ফিরে গা মুছে জামা কাপড় পাল্টালাম।
লিয়া তার রুমে গিয়ে পুনমকে তার জামা পরতে দিল। তারপর সবাই একটা রুমে জড় হলাম।
সবাই চুপচাপ। ট্যুরটা কি মাটি হবে নাকি!ধ্যুর,বৃষ্টি আসার আর টাইম পেল না। মেজাজ সবার গরম হতে লাগল।
আমি তখন আবার ভাবতে লাগলাম কিভাবে পুনমকে ঢাকা পাঠানো যায়। তাকে তো পাঠাতে হবে নাকি।
বৃষ্টি কমবে বলে মনে হচ্ছে না। এভাবে মেয়েটিকে ছাড়া ঠিক হবে কিনা ভাবলাম।
হঠাত দেখি ইমরান বলল, “এই আবহাওয়ার মাঝে পুনমের ফিরে যাবার দরকার নাই।
আসছে যেহেতু ঘুরে যাক আমাদের সাথে। পরে আবার কবে না কবে আসে”।
রেজা বলে, “কিন্তু ঘুরব কিভাবে যদি এরকম ভাবে বৃষ্টি হয়?”
“তাও ঠিক”,সাড়া দেয় সুমন আর মিলু।
কবির নিচে গেল।
কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে বলল, “এরকম বৃষ্টি নাকি কিছুই না।
রাত পোহালে নাকি বোঝাই যায় না আগের রাতে বৃষ্টি হয়েছিল। তাই আমাদের উচিত সেন্ট মার্টিন যাবার টিকিট কাটা। কি বলিস আমীন?”
“আমি মাফ চাই। একবার যা হইছে আর চাই না তা হোক”,আমার জবাব।
“আরে না,তুই যা।
খারাপ হইছে কি কিছু”,সুমন ফোড়ন কাটে।
আমরা অপেক্ষা করতে থাকি কখন বৃষ্টি থামে। রাত সাড়ে দশটার দিকে থামল। আমরা খেতে বের হলাম। খাবার পর আমি আর আসিব টিকিট কাটতে গেলাম।
মোট দশটা টিকিট কিনলাম এবার। পুনম যেহেতু যাচ্ছে আমাদের সাথে। ওর টাকাটা আমাকেই দিতে হল।
আমি অবাক হই মেয়েটা টাকা পয়সা ছাড়া কিভাবে সাহস করল বাড়ি থেকে বের হতে। তাও আবার কক্সবাজার আসার জন্য।
গাধা একটা। আমাদের সাথে পরিচয় না হলে কি হত আল্লাহই জানে।
রুমে ফিরে এসে সবাইকে জানিয়ে দিলাম সকাল ৬টার মাঝে রেডি থাকতে। আমাদের কে এখান থেকে টেকনাফ নিয়ে যাবার জন্য বাস সাড়ে ৬টায় ছাড়বে। সেখান থেকে পরে জ়াহাজে নেয়া হবে।
পুনম আছে লিয়ার ঘরে। সুমন আমার সাথে থাকবে। বেচারা নিতান্তই ভাল বলে কিছু বলল না,নইলে আমার খবর ছিল।
সারাদিন বেশ দৌড়ঝাপ করছি। বিছানায় শোয়ার সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়ি।
***
ভোরে ঘুম ভাংলো মাসুদের ডাকে। সে আমাদের ভোরের পাখি। খুব ভোরে নাকি সে সমুদ্র দেখতে গিয়েছিল। ব্যাটার মনে বেশ ভাব আছে বলা যায়। এত সকালে ঘুম থেকে উঠে গিয়ে সমুদ্রের গর্জন শোনার মাঝে নাকি ব্যাপক একটা ফিলিংস আছে।
আমরা তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে নিলাম। ট্র্যাভেলস এর গাইড ফোন করেছিল। রাস্তায় থাকতে বলেছে। আমরা বের হলাম হোটেল থেকে। তখনো ভোর বেলাই আছে।
আবছা কুয়াশা কুয়াশা ভাবটা এখনো কাটেনি।
মিলুর মনে হয় বেশি ক্ষিদে পেয়েছিল। সে বিস্কুট কিনে খাওয়া শুরু করল। আমরাও ওর প্যাকেটে ভাগ বসালাম। এক প্যাকেটে তো হল না,আবার দুই প্যাকেট কিনতে হল।
লিয়া আর পুনম দেখি শাড়ি পরেছে। লিয়ার শাড়িই পরেছে পুনম। দুজনকে অপরূপ লাগছে। হাল্কা সবুজে লিয়া ভাবিকে বেশ মানিয়েছে,আর পুনম পরেছে গোলাপি শাড়ি। সুমন দেখি আড়চোখে তার বৌকে দেখছে আর মিটি মিটি হাসছে।
সবাই বসে আছি। একটা মাইক্রো আসল। আমাদের জন্য। বুঝলাম না ১০ জন যাব কিভাবে এটাতে!
তারপরেও ঠাসাঠাসি করে বসতে হল। আসিব আর ইমরানের বেশ অসুবিধাই হচ্ছিল।
মোটা হলে যা হয় আর কি!
মাইক্রো যাচ্ছে টেকনাফের দিকে। এক সাথে অনেকগুলো গাড়ি যাচ্ছে এক লাইনে। গাইড বলল যে সবগুলো নাকি টেকনাফেই যাবে। সবাই আমাদের মত ঘুরতে যাচ্ছে।
আমাদের সকালের নাস্তা গাড়িতেই দিল।
কিন্তু যায়গা নেই দেখে সেখনে খেতে পারলাম না। ঠিক করা হল গাড়ি থেকে নেমে খাওয়া হবে। আমি প্যাকেট খুলে দেখলাম ভেতরে পরোটা আর ভাজি,সাথে একটা করে মিনারেল ওয়াটার এর বোতল।
সবাই মিলে গান ধরা হল। অন্তাক্ষরি খেলা হল।
আবার সবাইকে গান গাইতে হল। পুনমে গানের গলা দেখলাম খুব ভাল। গান টান পারে হয়ত।
অনেক বড় জার্নি না হলেও আমাদের অনেক টাইম লাগল। রাস্তা খুব সুবিধার না।
আকা বাকা। উচু নিচু। ভাঙ্গা। ব্রীজ।
ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম।
ঝাকিতে ঘুম ভেঙ্গে দেখি সবাই ঘুমায়। সবাইকে ডাক দিলাম। দেখালাম পাশে একটা নদী,আমাদের বাম পাশে। গাইড বলল, “নাফ নদী,ওপারেই মায়ানমার। ” খেয়াল করে দেখলাম কাটা তারের বাউণ্ডারি দেখা যায়।
খুব আসতে আসতে যাচ্ছে মাইক্রো। ডানে উচু উচু পাহাড় আর ডানে নাফ নদী। আকা বাকা রাস্তা। আমার ভয় করতে লাগল। কী ভয়ংকর রাস্তা রে বাবা!একটু এদিক সেদিক হলেই শেষ,সোজা নদীর মাঝে।
এভাবে দেখতে দেখতে আমরা জাহাজ ঘাটে আসি। আমি ভাবছিলাম সত্যি সত্যি জাহাজ হবে। দেখি না। আসলে একটা লঞ্চ। আমাদেরটার নাম কুতুবদিয়া।
আমরা নামলাম গাড়ি থেকে।
নেমে আগে আমাদের কাজ হল খাওয়া। খেলাম যা ছিল।
খাওয়া শেষে পুনম এসে জিজ্ঞেস করল, “কেমন হল আপনার ঘুম?আপনি তো আবার ঘুম পাগল শুনলাম”।
“কে বলল তোমাকে?”আমি লজ্জা পেয়ে বললাম।
“তাতো বলা যাবে না,তবে এখানকার কেউ বলেছে এটুকু নিষচিত থাকতে পারেন”।
“ও তাই বুঝি। আমি ভাবলাম তুমি স্বপ্নে দেখেছ!”
সে হা হা করে হাসতে থাকে। আমি তার সাথে সামিল হই। দুজনে বসে গল্প করতে থাকি।
আমি তার মাকে ফোন করে জানাতে বলি যে সে কোথায় যাচ্ছে। সে বলে যে সে রাতেই নাকি তার মাকে জানিয়ে দিয়েছে লিয়ার ফোন থেকে।
আমি লিয়ার দিকে তাকাই। দেখি ও আর সুমন হাত ধরে হাটছে। ভালোই লাগে দেখতে ওদের।
বেশ মানিয়েছে। আমাদের বন্ধু মহলের প্রথম জুটি।
বাকি সবাই আশেপাশে হাটছে। ভাব ভঙ্গি ধরে ছবি তুলছে। মজা করছে ইচ্ছেমত।
আমাকে পুনম বলে তাদের সাথে যাবার জন্য। আমি না বলে তার সাথেই বসে থাকি।
দূরে জাহাজ দেখা যাচ্ছে,মানে লঞ্চ দেখা যাচ্ছে। গাইড এসে বলে যায় জাহাজ ছাড়তে আর মাত্র তিরিশ মিনিট লাগবে।
আমি হাসি মনে মনে।
মাত্র তিরিশ কেন?আরো বেশি লাগলেও আমার কোন সমস্যা নাই। ভালই তো গল্প করছি আমরা। আমি আর পুনম।
***
লঞ্চে ওঠার সময় হয়ে গেছে। আমরা উঠলাম একে একে।
বাশ দিয়ে বানানো হয়েছে জেটি। মাঝে মাঝে ভাঙ্গা,আবার নড়বড়েও দেখা যায়। আমার নিজেরই ভয় লাগতে থাকে এই ভেবে যে কখন ভেঙ্গে পড়ে যাই পানিতে। সবারই মনে হয় ভয় লাগছে,সবার মুখই শুকনো দেখাচ্ছে।
খুব সাবধানে হাটতে হল আমাদেরকে।
একটু এদিক সেদিক হলেই পড়ে যাবে যে কেউ। প্রচুর মানুষ তাড়াহুড়ো করে উঠছে। তাদের দেখলেই আমার গায়ে কাটা দিচ্ছিল।
আমরা লাইন ধরে উঠছি। প্রথমে আমরা ছেলেরা উঠলাম।
তারপর লিয়া আর পুনমের পালা। জ়েটি থেকে লঞ্চে ওঠাও জায়গাটাতে একটু ফাকা। খুব বেশি সাবধানে চলতে হল সেখানে। সুমন লিয়া কে ধরে ওঠালো। পুনম মনে হয় ফাকাটা দেখে ভয় পাচ্ছিল।
সে দাড়িয়ে থাকে। সুমন না হয় লিয়াকে তুলে দিল,তাকে তুলে দেবে কে?
আমি হাত বাড়াই। সে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু ভাবে মনে হল। অবশ্য কোন উপায় না দেখে সেও তার হাত বাড়িয়ে দিল।
আমি হাত ধরলাম তার।
তাকে হাত ধরে লঞ্চে ওঠালাম। সে আমার হাত ছেড়ে দিয়ে লিয়ার পাশে গিয়ে দাড়াল। সবাই দেখি আমার দিকে তাকিয়ে মুচকী হাসছে। আমি লজ্জায় মাথা নিচু করে থাকলাম।
আমি সবার সামনে থেকে চলে গেলাম। গিয়ে বসলাম জাহাজের সামনের ফাকা জায়গাটাতে। সেখানে লোকজন ভীড় করে আছে। বসার বেঞ্চ আছে কিন্তু সবাই দাড়িয়ে। আমি বেঞ্চে গিয়ে বসলাম।
মনে মনে কত কি যে ভাবছিলাম!
হাসি পেল আমার। একা একা হাসছি এমন সময় আমাদের গ্রুপটাও সেখানে হাজির হল।
মিলু দৌড়ে গিয়ে জাহাজের সামনে পোজ দিয়ে ছবি তুলল। রেজা আর মাসুদ মিলে টাইটানিক স্টাইলে ছবি তুলল। দেখাদেখি কবির আর আসিব।
পরে মিলু আর ইমরান। ভালই লাগছিল এসব দেখতে।
মাঝে মাঝে আড়চোখে খেয়াল করছিলাম পুনমকে। দেখি সে মাথা নিচু করে আছে। মাঝে মাঝে সেও আমার দিকে তাকাচ্ছে মনে হল।
আচ্ছা আমাদের মাঝে কি কোন কেমিস্ট্রি চলছে?কাকে বলি সে কথা।
সবাই আমাদের কে ডেকে নিয়ে গেল জাহাজের পিছন দিকে। প্রথমে লিয়া আর সুমনের ডুয়েট ছবি তোলা হল। তারপর আমাকে আর পুনমকে ডাকা হল।
আমি বুঝলাম না আমাদেরকে কেন ডাকা হল?সুমন আর লিয়া তো স্বামী-স্ত্রী।
ওরা ডুয়েট ছবি তুলতেই পারে,কিন্তু আমরা কেন?
তারপরেও আমার যে ইচ্ছে হচ্ছিল না তা না। আমি রাজি ছিলাম মনে মনে। পুনমের একটু সাড়া পেলেই হত। না কোন ইঙ্গিত পেলাম না তার পক্ষ থেকে।
কি আর করার।
আমি হাল ছেড়ে দিলাম।
গিয়ে বসলাম আমাদের সিটে । পুনম আমার পাশেই বসল।
বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আমি উঠে গেলাম। বাইরে গিয়ে দাড়ালাম।
লঞ্চ ছেড়ে দিয়েছে। পাশের লঞ্চ গুলোও ছেড়েছে। সবাই পাল্লা দিয়ে ছুটে চলেছে আমাদের দেশের একেবারে শেষ সীমানার দিকে,সেন্ট মার্টিনে।
খেয়াল করলাম পুনম এসে আমার পাশে দাড়িয়েছে।
“আপনি কি মাইন্ড করেছেন তখন?”সে জিজ্ঞেস করল আমাকে।
“কখন?”
“ওই যে সবাই ছবি তুলতে চাইল আর আমি তুললাম না,তখন”।
“আরে না। মাইন্ড করব কেন?”
“না,মনে হল তাই বললাম”।
“না,না”।
এভাবে আমাদের আরেক দফা গল্প শুরু হল।
আমাদের ফ্যামিলি,তাদের ফ্যামিলি,প্রিয় বিষয়গুলো,পছন্দের জিনিসগুলো এবার হল আমাদের কথা বলার বিষয়।
বেশ ভালভাবেই কথা বলছিলাম আমরা। আমি চেষ্টা করছিলাম তার কাছে আমাকে পুরোপুরি প্রকাশ করার। আমার ধারনা সে তাই করছিল। পরে অবশ্য সিওর হয়েছিলাম।
এভাবে কখন যে আমাদের লঞ্চ সাত সাগর আর তের নদী পার হয়ে সেন্ট মার্টিনে চলা আসছে টেরও পাইনি। টের পেলাম মাসুদের ডাকে। এই যে মহামান্য নব ভাবুক জুটি ,আমরা চলে এসেছি । আসুন এবার নামুন।
আমরা হেসে উঠি।
আমি ঘড়ি দেখি। পাক্কা তিন ঘণ্টা আমরা গল্প করেছি।
আমরা মাসুদের সাথে হাটতে থাকি। সে আমাদেরকে আমাদের দলে নিয়ে আসে। আমি কোন দিকে না তাকিয়ে মিলুর পাশে দাড়াই।
আর পুনম গিয়ে লিয়ার হাত ধরে দাঁড়ায়।
বুঝতে পারি সবার নজর আমার আর পুনমের দিকে।
কিছুক্ষণ সেখানে থেমে থেকে সবাই নামতে থাকি জাহাজ থেকে,আমাদের শেষ গন্তব্যস্থলে।
***
ট্র্যাভেলস লিমিটেডের লাঞ্চ প্যাকেট দেবার কথা ছিল। কিন্তু দিল না।
আমাদেরকে একটা হোটেলে নিয়ে গেল। আমাদেরকে খেতে দেওয়া হল সুন্দরী মাছ আর ভাত। অবশ্য যদি কারো ইচ্ছে হয় তবে সে অন্য কিছুও খেতে পারবে।
আমি সুন্দরী মাছ খেলাম। শুধু আমি না,আমাদের বেশির ভাগই মাছ খেলাম।
আলু ভর্তাটা বেশ ছিল। আসিব আর মাসুদ মুরগি খেল।
আমি বুঝলাম না মাছটার নাম সুন্দরী কেন রাখা হল!মনে হয় মাছ টা দেখতে খুব সুন্দর। তবে এখন দেখে আর তা বোঝার উপায় নেই।
খাবার সময় দেখি আমাদের সামনের টেবিলে একটা মেয়ে বসে আছে।
খারাপ না,চলে। আমি সবাইকে দেখালাম ইশারায়। সবাই দেখতে লাগল।
এই না দেখে পুনম খেপে গেল মনে হয়। আসলে ব্যাপারটা হল-একটা মেয়ে কখনই অন্য মেয়েকে সহ্য করতে পারে না।
আর যদি সেই মেয়েটি একটু সুন্দরী হয় তবে তো কথাই নাই।
আমি আর তাকালাম না সেই দিকে।
খাওয়া শেষে বের হলাম সবাই হোটেল খুজতে। যে অবস্থা তাতে মনে হয় না ভাল কোন হোটেল পাওয়া যাবে না। তারপরেও বের হলাম দেখি পাওয়া যায় কিনা।
হোটেল খুজতে গিয়ে মহা সমস্যায় পরলাম। কোনটাই পছন্দ হয় না। বুঝলাম না,এত নামকরা জায়গা,অথচ কোন ভাল হোটেল নাই। বেশির ভাগেরই বাজে কন্ডিশন।
খারাপের ভাল থেকে একটা পছন্দ করলাম।
তারপরেও দেখি সেটি ছিল সেন্ট মার্টিনের সবচেয়ে ভাল হোটেল। তাড়াতাড়ি ড্রেস চেঞ্জ করে বের হলাম সবাই। গোসল করব বাংলাদেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপে।
সবাই বের হলাম গোসল করার জন্য। কিন্তু কোন দিক দিয়ে বের হতে হবে,কোন দিকে গেলে ভাল হয় তার কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
একটা গাইড হলে মন্দ হত না।
কাছালাছি দেখি বেশ কয়েকটা পিচ্চি ঘুরঘুর করে। ডাক দিলাম একটারে। সবগুলো দৌড়ে আসল।
“স্যার গাইড লাগবে”, “আই অ্যাম এ স্মল গাইড”, “ভাল হেপ্ল করতে পারি”, “ভাল ছবি তুলে দিতে পারি” নানা রকম কথা বলছিল তারা।
তাদের মাঝে সবচেয়ে পিচ্চিটাকে বেছে নিল আমাদের অতিথি,পুনম।
আমরাও অমত করলাম না।
পিচ্চিটা সোজা নিয়ে গেল আমাদের সাগরপাড়ে।
আবার সেই লাফ-ঝাপ,পানিতে দৌড়ানো। মজা আর মজা।
পুনম এবার আমাদের সাথে যোগ দিল। সে আমার ট্রাউজার পরে এসেছে। এটা আবার সবাই টেরও পেয়ে গেছে এবং ইতিমধ্যে আমাকে এ নিয়ে টিটকারিও করা হয়েছে বেশ।
আমি আর মিলু মিলে একটা বোট ভাড়া করলাম,ঐ যে যেগুলো বাতাস ভরে দিলে ফুলে ওঠে। এক ঘণ্টার জন্য।
প্রথমে তিন জন উঠলাম। কিছুক্ষণ পর আরো তিনজন।
সুমন সাধ করল শুধু তারা দুজনই উঠবে। তাদেরকে ছাড় দেয়া হল। ইমরান সাতার পারে না,সে উঠবে না।
পুনমের এখনো ওঠা হয়নি।
একবার বলল সে উঠবে না। পরে আমি বলাতে রাজি হল। তবে শর্ত হল আমাকে তার সাথে উঠতে হবে।
আমি আর না করলাম না।
গেলাম তার সাথে। আমি বোট চালালাম,সে শুধু বসে থাকল।
সবার থেক একটু দূরে গেলে সে গুনগুন গান ধরল। হাত দিয়ে পানি ছুয়ে দিল। নৌকা দোল দিতে লাগল।
আমি ঝাড়ি দিলে খিক খিক করে হাসতে থাকে। আমিও মজাই পেলাম বেশ। একটা মেয়েকে নিয়ে সমুদ্রে কখনো এভাবে বোটে উঠব,তাও আবার তার মাঝি হয়ে….আমি জীবনে কখনো স্বপ্নেও ভাবিনি।
নিজেকে খুব লাকী মনে হতে থাকে। কিন্তু কেন মনে হচ্ছিল তা বলতে পারব না।
আসলে বলা সম্ভব না।
আমি মনে মনে অনেক কিছু ভাবতে থাকি,হারিয়ে যেতে থাকি কোন এক কল্পনার জগতে। পুনম পানি ছিটে দেয় আমার গায়ে,আমি সম্বিত ফিরে পাই। “কি জনাব,আপনার নৌকায় কি আমাকে সারাজীবন ভাসাবেন নাকি?”
আমি কিছু বলি না। ভাবি,পারলে কি খারাপ হত?
থাক,ভেবে কোন লাভ নেই।
এটা দুজনই জানি ভাল করে।
ফিরে আসি তীরে। সবাই গোসল সারি।
তারপর ব্যাক করি হোটেলে। এরপর যাব প্রবাল দেখতে।
বিকেল হয়ে গেছে। তাই একই সাথে সূর্যডোবাও দেখা হবে।
আমি আর আসিব আগেই যাই। আসিব কোত্থেকে জানি কিছু পোলাপাইন জোগাড় করছে। সে তাদের নিয়ে বিজি হয়ে পড়ে।
আমি খালি পায়ে প্রবালের উপর হাটতে যাই। না সম্ভব না। পরে আবার স্যাণ্ডেল পরে নেই।
ভাটার টানে পানি নেমে যাচ্ছে আর আস্তে আস্তে প্রবালগুলো মাথা বের করছে। আমি হাটা দেই সামনের দিকে।
যত পানি কমে ,তত প্রবাল বের হয় আর আমি ততই ভেতরে যাই। মাঝে মাঝে ভয় লাগে যদি পানি হঠাত করে বেড়ে যায়!
সবাই এসে পড়েছে। একসাথে বিকেলটা কাটাতে খারাপ লাগছে না। সবাই মিলে এখন ভেতরের দিকে যাচ্ছি। আর ভয় লাগছে না আমার।
হা হা হা।
ছবি তুললাম আমরা। কবির যে কত স্টাইলে ছবি তুলছে তা আর নাই বা বললাম।
তবে আফসোস থাকল এই জন্য যে আমরা সূর্যডোবা দেখতে পারলাম না। মেঘ ছিল আকাশে।
আমরা ডাব খেয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। ততক্ষণে রাতের খাবারের টাইম হয়ে গেছে। সবাই মিলে খেয়ে এলাম।
এসেই কেউ কেউ ঘুম দিল। আমি,কবির আর আসিব মিলে রাতে বের হলাম।
বাজারে গেলাম,উদ্দেশ্য মাছ ভাজি খাব।
পছন্দমত একটা বের করে অর্ডার দিলাম ভাজতে। কিছুক্ষন পর খেয়ে আমরা জেটিতে গিয়ে গল্প করালাম। গল্পের টপিক ছিল পুনম। আমি তাকে নিয়ে কি ভাবছি,আরো কিছু মনে আছে কিনা আমার,পুনমের মতামত কি,সে কিছু বলছে কিনা এইসব।
আমি অবশ্য কিছু বলি নি ওদেরকে।
হটাত বুঝতে পারি আমাদের তিনজনেরি পেটে গন্ডগোল। চুরি করে একাএকা এসে আমাদের মাছ খাওয়া ঠিক হয়নি বোধহয়।
গিয়ে শুয়ে পড়ি। কিন্তু ঘুমুতে পারিনি শান্তিমত।
পেট আমাকে ঠিকমত ঘুমুতে দেয়নি।
পরদিন যাব নিঝুম দ্বীপ। সারাদিন ঘুমুতে পারব না,রাতে ফিরে যাব। ঘুম না হলে যে সমস্যা হয়ে যাবে ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়ি শেষ রাতের দিকে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।