চলার পথ অনেক, সত্য পথ একটাই
মাজার বা গোরস্তান। পুণ্যময় জায়গা হিসেবে যার পরিচিতি। প্রতিদিন এতে সমাবেশ ঘটে বহু পুণ্যার্থীর। সেজদা, বাবার নাম করে বিলাপ ইত্যাদি নানান পদ্ধতিতে প্রার্থনা করে থাকে কেউ কেউ। তবে মাজারকে পুণ্যময় স্হান মনে করে ইবাদত করার এই রুসুম চালু থাকলেও এর বাস্তবতা বড়ই তিক্ত।
নামে-বেনামে যেসব মাজার বাংলাদেশে গড়ে উঠেছে খোঁজ নিয়ে দেখা যায় সেখানে এ নামে হয়তো কোনো বুযুর্গই ছিলেন না কিংবা থাকলেও তাদের আদর্শ ছিল ঠিক এর বিপরীত। কবরকে মাজার বানিয়ে উদ্দেশ্যমুলক ব্যবসা আজ দেশজুড়েই। কিন্তু এসব অবৈধ পন্হার সম্পুর্ণ বিপরীতে ব্যতিক্রমধর্মী সুন্নত তরিকায় কবর জিয়ারতের অনুপম আদর্শে একটি গোরস্তান গড়ে উঠেছে ঢাকার মিরপুরের শেওড়াপাড়ায়। মিরপুর-১০ থেকে মুল শহরে যাওয়ার পথে প্রায়ই দেখি এ গোরস্তানটিকে। ঢাকা শহরে রাস্তার পাশে মাজারমুক্ত কবর বা গোরস্তান কল্পনাতীত একটি ব্যাপার।
একদিন তাই ঘটনা জানতে চলে গেলাম সেখানে। কী অদ্ভুত এক শান্ত পরিবেশ! চারপাশে নিবিড়-নীরবতা। নেই কোলাহল। নেই মাটি কামড়ানো বিলাপ। ইটের দেয়ালে ঘেরা নতুন-পুরাতন কবরগুলোর ওপর নেই সিমেন্টের পলেস্তরা।
আছে শুধু বিস্তৃত সবুজের গালিচা। সরু দুর্বাঘাসের ভাঁজে ভাঁজে কিছু নতুন কবরের ঢিবি। তিনপাশে কংক্রিটের বিশাল দালান। একপাশে বিশ্বরোড। এরই মাঝখানে ষাট বছরের এই পুরনো কবরস্হানটি যে আজও শিরিকের হাতছানি থেকে মুক্ত, এটি রাজধানীর এক অনুকরণীয় নিদর্শন।
গোরস্তানের পশ্চিমপাশে টানানো বিশাল এক সাইনবোর্ড। ধবধবে সাদা রঙের ওপর লাল-সবুজের হরফে লেখা কিছু নির্দেশাবলী। প্রথমে কবর জিয়ারতের সুন্নত তরিকা। যেমন-কবরবাসীর সম্মানে জুতা খোলা, সালাম দেয়া, সুরা ফাতিহা ও চার কুল পড়া, কেবলামুখী হয়ে দাঁড়ানো ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও কবরে নিষিদ্ধ কাজ যেমন কবর পাকা করা, গিলাফ লাগানো, চুম্বন করা, সেজদা করা, টাকা ও মোমবাতি দেয়া ইত্যাদি তেরটি নিষিদ্ধ বিষয় সম্পর্কে নিন্দা করা হয়েছে তাতে।
আনুমানিক আট-দশ কাঠা জমির ওপর নির্মিত এই গোরস্তান এক সময় পারিবারিক হলেও পরে তা গণকবরস্হানের রুপ ধারণ করে।
শেওড়াপাড়ার এই গোরস্তানে ঠিক কতটি কবর রয়েছে তার কোনো সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে ধারণা করা হয়, শুরু থেকে এ পর্যন্ত সহস্রাধিক ব্যক্তিকে দাফন করা হয়েছে এতে। রাস্তায় কতক্ষণ দাঁড়ালেই চোখে পড়ে অসংখ্য মানুষ লাইন ধরে জিয়ারত করছেন। তারা সুন্নত তরিকায় কবরের পাশে দাঁড়িয়ে মৃতের উদ্দেশে সালাম, চার কুল, সুরা ইয়াসিন এবং বিভিন্ন দোয়ার মাধ্যমে ছওয়াব বকশে দিচ্ছেন।
এখানে নেই কবরবাসীর নামে লালসালু টানানো, টাকা কিংবা সিন্নি বিলিয়ে পুণ্য অর্জনের অযৌক্তিক কার্যাবলী।
সুন্নত তরিকায় কবর জিয়ারত ও নাজায়েজ পন্হা থেকে মুক্ত রাখতে এলাকার কিছু সাহসী মানুষের রয়েছে জোরাল পদক্ষেপ। শেওড়াপাড়া জামে মসজিদের ইমাম মুফতি ছিফাতুল্লাহ সাহেবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে তিনি জানান, আমাদের এই গোরস্তানটি এককালে অযত্মে অবহেলায় পড়েছিল। লোকজন জায়েজ-নাজায়েজ উদ্দেশ্য নিয়ে আসা-যাওয়া করত। আমি একাধিক জুমায় কবর জিয়ারতের শরীয়তসম্মত বিধান নিয়ে সবিস্তারে আলোচনা করেছি।
মুসল্লিরা আমাকে সাহস জুগিয়েছেন। তাদের নিয়ে মসজিদ কমিটির পরামর্শক্রমে আবুল হাশেম সাহেবের অর্থায়নে চলতি বছরের শুরুতে কাজটি সম্পন্ন করা হয়। মানুষজন এখন সুন্নত তরিকায় কবর জিয়ারতে অভ্যস্ত হচ্ছে। সাইন বোর্ড টানানোর পরদিন থেকে জনসাধারণ সেই অনুযায়ী জিয়ারত করছে এবং এই কাজের জন্য তারা উদ্যোক্তাদের সাধুবাদ জানিয়েছে। এলাকাবাসী আটান্ন বছর বয়সী আবুল হোসেন সাহেব জানালেন তার সন্তুষ্টিমুলক অভিমত-আমি মাসে প্রায় ২৫ দিনই জিয়ারত করি।
কবর দেখলে মনে এক ধরনের ভীতি জন্মে। কারণ এখানে আমাকেও একদিন যেতে হবে। তাই এর সঙ্গে যদি আগে থেকেই সম্পর্ক হয়, কবরবাসী যাতে কিছু ছওয়াব লাভ করে সেজন্য জিয়ারত করি। বড় কথা হলো এখানে সুন্নত তরিকায় জিয়ারত হয়, শিরিক-বিদআত করা হয় না-এটা ভালো লাগে।
রাসুল সা. কবর পুজা নিয়ে যে আশঙ্কা করেছিলেন আজকের বাংলাদেশের বহু গোরস্তান-মাজারের দিকে তাকালে তারই কিছু তিক্ত প্রতিচ্ছবি দেখা যায়।
যা মানুষের জন্য ধ্বংসাত্মক পরিণতি বয়ে আনে। অথচ চিন্তাশীল মানুষের একটু মেহনতে মানুষ বাঁচতে পারে এই কুফুরী ও শিরিক থেকে। শেওড়াপাড়া গোরস্তানের মতো সুন্নতি পরিবেশে কবর জিয়ারতের অনুপ্রেরণা যদি ছড়িয়ে দেয়া যায় দেশব্যাপী তাহলে সব কবরস্হান-গোরস্তানই পুণ্যের স্হানে পরিণত হবে।
**************************
রো ক ন রা ই য়া ন
আমার দেশ, ০৯ আগষ্ট ২০০৮
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।