আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝড়রে উপহার ‘‘ সীতাকুন্ড জাহাজ ভাঙ্গা শল্পি’’ (র্পব-১)


ঝড় শুধুই স্বপ্ন ভাঙ্গে, তছনছ করে জনপদ। ঝড় মানে মহা প্রলয়, ঝড় জীবজগতের অবিরাম শত্র“। পৃথিবীর ইতিহাসে ঘটে যাওয়া সব কয়টি ঝড়ের স্বরূপ এমনই। কিন্তু ষাটের দশকে ঠিক এর উল্টো চরিত্র নিয়ে একটি ঝড় সীতাকুণ্ড উপকুলে আবির্ভূত হয়েছিল । সম্ভবত উপরিউক্ত কলঙ্কগুলো ঘুচাতে বদ্ধ পরিকর ছিল সে।

তাই তো সীতাকুণ্ড তথা বাংলাদেশের জন্য মঙ্গল দূত হয়ে আসার সময় উপহার নিয়ে এসেছিল একটি গ্রীক জাহাজ “এমভি কুইন আল পাইন”। একসময় মঙ্গল দূত ঝড়টি চলে যায় কিন্তু উপজেলাবাসীর জন্য ফৌজদার হাটে রেখে যায় তার উপহার ২০ হাজার টন ওজনের জাহাজটি। এরপর অনেকদিন এই জাহাজটি সেই উপকূলে পড়েছিল অবহেলা অনাদরে। তখনো কেউ বুঝেনি যে এটি আসলেই একটি আলাদ্দিনের চেরাগ! এরপর জাহাজটির উপর নজর পড়ে স্থানীয় কিছু পুজিঁপতির। মজার ব্যাপার হল তারাও জাহাজটি ভাঙ্গার চেষ্টা করেনি, তারা জোর চেষ্টা চালিয়েছিল এমভি কুইন আলপাইনকে সচল করে সমুদ্রে ভাসানোর।

কিন্তু দীর্ঘ চেষ্টা করেও সচল করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে সচলের চেষ্টার টাকা তুলতেই জাহাজটি ভেঙ্গে বিক্রির সিদ্ধান্ত নেন তারা। ডাকা হয় তৎকালীন চিটাগাং ষ্টিল মিলের ইঞ্জিনিয়ার সিরাজুল ইসলামকে। তার তৎত্ত্বাবধানে শুরু হয় সীতাকুণ্ড তথা বাংলাদেশে প্রথম জাহাজ ভাঙ্গার কাজ। ভাঙ্গা হতে থাকল জাহাজ আর বিক্রি হতে থাকল এর মূল্যবান লোহা, ফার্নিচার, ক্রোকারিজ, ইঞ্জিন, জেনারেটর, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা, ইলেকট্রনিক রাডার, চিকিৎসা সরঞ্জাম, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, অসংখ্য প্রকার ষ্টিল সরঞ্জাম সহ শত শত প্রকার দ্রব্য। সম্পূর্ণ জাহাজটি বিক্রির পর দেখা গেল অকল্পনীয় লাভ হয়েছে এই জাহাজ ভেঙ্গে।

ফলে সংশ্লিষ্টদের অস্তিমজ্জায় মিশে গেল এক ভয়ংকর নেশা। একটাই চিন্তা জাহাজ আনা আর ভাঙ্গা। ক্রমাগত যোগাযোগ আর চেষ্টা এনে দিল রাস্তা। মালেশিয়া, থাইল্যান্ড, চীন প্রভৃতি দেশ থেকে একটি দুটি করে জাহাজ আনা হল। বাড়তে থাকল ব্যবসার পরিধি।

এর মাঝে ঘটে গেল ভারত-পাক, এবং বাংলাদেশ-পাকিস্থান যুদ্ধ। যুদ্ধে দেশগুলির বেশ কিছু জাহাজ নষ্ট হল, সুযোগ কাজে লাগাল ব্যবসায়ীরা। জমজমাট ব্যবসা কেন্দ্রে পরিনত হল সীতাকুণ্ড। এক জাহাজ খুলে দিল অবারিত সম্ভাবনার দ্বার। জাহাজকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠতে থাকল, স্ক্রাপ ব্যবসা, লৌহ- ইস্পাত ব্যবসা, রি-রোলিং মিল, ফার্নিচার শপ, মেশিনারি শপ সহ অসংখ্য কর্মসংস্থান।

ফলে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাজের প্রয়োজনে এখানে এসে বাঁচার চেষ্টা করল হাজার হাজার অভাবী মানুষ। জায়গাজমি কিনে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকল কেউ কেউ। স্থানীয় জায়গা সম্পত্তির দাম বাড়ল ৫০ গুন পর্যন্ত। অনেক দরিদ্র হল ধনী। সেই সাথে দিন দিন বিস্তার লাভ করল জাহাজ ভাঙ্গা শিল্প।

আর ১৯৭১ থেকে ৮৩ সালে তো শিপ ইয়ার্ড ব্যবসার সুবর্ণ যুগে পরিনত হয়েছিল। সে সময় উপজেলার বার আউলিয়া থেকে ফৌজদার হাটের ৭কি.মি. এলাকায় শিপ ইয়ার্ডের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পেয়ে ৮৪ এ উন্নীত হয়েছিল। শিপ ব্রেকার্স এসোশিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জাফর আলমের মতে এ সময় প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে এই কর্মকান্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েছিল দেশের অর্ধকোটি মানুষ। তখন সরকার এই খাত থেকে বার্ষিক ৯শ কোটি টাকা পর্যন্ত রাজস্ব আদায় করত। এক-একটি ইয়ার্ডকে ঘিরে গড়ে উঠল বহুমুখী ব্যবসা।

দেশ পেল একটি ভাসমান লৌহখনি। বদলে গেল উপকুলীয় জীবন যাত্রার মান। সঙ্গত কারণেই ইয়ার্ড মালিকরা বার বার সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে ছিল জাহাজ ভাঙ্গা কার্যক্রমকে শিল্প হিসাবে গন্য করা হোক। কিন্তু ১৯৯৬সালের ১৮ই জুন ইস্যুকৃত এক চিঠিতে শিল্প মন্ত্রনালয় ¯পষ্ট জানিয়ে দেয় এ কার্যক্রম কে কোন ভাবেই শিল্পের স্বীকৃতি দেওয়া সম্ভব নয়। বর্তমানে এটি নৌ-পরিবহন মন্ত্রনালয়ের অধীন।

প্রকৃত অর্থে রাজস্ব আদায় ছাড়া দেশের এই মহামূল্যবান সম্পদটিকে রক্ষা করতে স্বয়ং সরকারি কর্তৃপক্ষের কোন সহযোগিতাই ছিল না। মোবাইল, কম্পিউটার বিহীন সে যুগে জাহাজ ভাঙ্গা শিল্পের দ্রুত প্রসারের জন্য অতি প্রয়োজনীয়, টি এন্ড টি সংযোগ, কিংবা জাহাজকাটার প্রয়োজনীয় এলপি গ্যাস এবং আহত শ্রমিকদের জন্য জরুরী চিকিৎসা সেবা কিছুই দেয়নি সরকার। এমন কি ৮০ এর দশকের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে উপকুলের বিভিন্ন অংশে চর পড়তে শুরু করলে হঠাৎই অনেক গুলি ইয়ার্ডের এক সাথে স্থান পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। একদিকে কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগ করে জাহাজ কেনা তার উপর তড়িঘড়ি করে ইয়ার্ড় পুনঃস্থাপনের ব্যয় বহন করতে গিয়ে বেশিরভাগ ইয়ার্ড মালিক দিশেহারা হয়ে পড়লে ও সাহায্যের হাত বাড়ায়নি সরকার। ফলে ব্যবসা ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় অনেক ইয়ার্ড মালিক।

ফলে ৮৪টি ইয়ার্ডের মধ্যে বন্ধ হয়ে যায় ৪০টিরও বেশি। এরই সাথে যুক্ত হয় বাংলাদেশ থেকে এই শিল্পকে ধ্বংস করার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। যে ষড়যন্ত্র এখনো বিদ্যমান। ইয়ার্ড সংখ্যা আরো কমে ২৫টি নেমে আসে একসময়। কিন্তু সে অনেক আগের কথা।

অনেক চরাই উৎরাই পেরিয়ে এই শিল্প এখন আবারো মাথা উঁচু দাড়িয়েছে। দিন দিন লোহার চাহিদা বৃদ্ধির সাথে বাড়ছে শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডও। বর্তমানে প্রায় ১শ ইয়ার্ডে জাহাজ ভাঙ্গা চলছে। আর এ পর্যন্ত অনুমতি পেয়েছে মোট ১৪৯টি শিপ ইযার্ড। ফলে অদূর ভবিষ্যৎতেই এই শিল্প দেশের অর্থনীতিকে আমূল বদলে দেবে বলে সংশ্লিষ্টরা অভিমত প্রকাশ করেন।


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.