আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আইনবিরোধী গঠনতন্ত্র মেনে নিয়েছে ইসি!



সংশোধন করার পরও আওয়ামী লীগ ও বিএনপির গঠনতন্ত্র গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের পরিপন্থীই রয়ে গেছে। আর এই আইন পরিপন্থী গঠনতন্ত্রকে বৈধ বলে মেনে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। আইনে বারণ থাকলেও আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রে ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদ এবং বিএনপির গঠনতন্ত্রে ছাত্রদল ও শ্রমিকদল দল-সহযোগী সংগঠন হিসেবে রয়ে গেছে। দুটি দলই গঠনতন্ত্রের সংশ্লিষ্ট ধারায় 'তবে' প্রত্যয় যোগ করে সহযোগী সংগঠনগুলোকে মূল দল থেকে আলাদা করে দেখানোর কৌশল গ্রহণ করেছে। তাদের এ কৌশলে সন্তুষ্ট ইসি।

কয়েক দিনের মধ্যেই দল দুটিকে ধন্যবাদপত্র পাঠানো হবে বলে জানা গেছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির আইন পরিপন্থী এ গঠনতন্ত্রকে নির্বাচন কমিশন বৈধ বলে মেনে নেওয়ায় আইন বিশেষজ্ঞ এবং ইসি সচিবালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের অনেকেই বিস্ময় ও হতাশা প্রকাশ করেছেন। তাঁদের মতে, দুটি দলের গঠনতন্ত্রই স্পষ্টভাবে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের পরিপন্থী। এ ধরনের গঠনতন্ত্রকে বৈধতা দেওয়া হলে ইসিকে যেকোনো সময় আইনি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড়াতে হতে পারে। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বিচারপতি গোলাম রাব্বানী দুটি দলের গঠনতন্ত্রকেই গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মন্তব্য করেন।

তিনি বলেন, 'বিধান অনুযায়ী যেসব সংগঠন দলের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয়, সেসব সংগঠনের নাম দলের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ থাকতে পারে না। ইসি কিভাবে আওয়ামী লীগ-বিএনপির গঠনতন্ত্রকে বৈধ বলে মেনে নিল তা আমার বোধগম্য নয়। তাঁরা দুটি দলেরই গঠনতন্ত্রের আইনগত মারাত্দক ভুল লক্ষ করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মনে হচ্ছে, তারা গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০-বি ধারা পড়তে ভুলে গেছেন। একই সঙ্গে তাঁরা আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্রের ২৫-বি ধারা এবং বিএনপির গঠনতন্ত্রের ১৪ ধারাও লক্ষ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।

তা না হলে এমন গঠনতন্ত্র তাঁরা অনুমোদন করতেন না। এ জন্য আমি আওয়ামী লীগ বা বিএনপিকে দায়ী করব না। এ দায় ইসিকেই বহন করতে হবে। ' তিনি আরো বলেন, 'ইসির উচিত দল দুটিকে আবারও গঠনতন্ত্র সংশোধনের তাগিদ দেওয়া। জেনারেল ক্লজেজ অ্যাক্ট-এর ২১ ধারায় তাদের সেই ক্ষমতা রয়েছে।

' একই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'কিছুটা সমস্যা থাকলেও আওয়ামী লীগ-বিএনপির গঠনতন্ত্র আমরা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছি। আমাদের অর্জন শত ভাগ হবে_এটা আমরা আশা করি না। তবে আমরা যে রাজনৈতিক দলগুলোকে মোটামুটি একটা আইনি কাঠামোর মধ্যে আনতে পেরেছি সেটা কম বড় অর্জন নয়। সব অর্জন একদিনে হবে না, সময় লাগবে। রাজনৈতিক দলগুলোর নিয়মতান্ত্রিক চর্চায় একসময় সবই ঠিক হয়ে যাবে।

' তিনি আরো বলেন, 'এ বিষয়ে কারো আপত্তির পরিপ্রেক্ষিতে আদালত যদি আমাদের দিক-নির্দেশনা দিত, সে ক্ষেত্রে আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে সুবিধা হতো। বাইরের দেশে এ ধরনের আইনি ত্রুটি ধরা পড়লে সাধারণ আদালত তা সংশোধনের জন্য দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। ' গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৯০-বি/১/বি/৩ ধারায় বলা হয়েছে, শিক্ষক, ছাত্র ও বিভিন্ন পেশার সদস্য এবং আর্থিক, বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানের শ্রমিকদের সমন্বয়ে রাজনৈতিক দলের কোনো অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন থাকতে পারবে না। তবে ছাত্র, শিক্ষক, শ্রমিক বা চাকরিজীবীরা নিজস্ব কর্মক্ষেত্রে স্বাধীনভাবে সংগঠিত হতে পারবে এবং গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক চর্চার জন্য তারা সংগঠন বা ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবে। নির্বাচনের আগে ২০০৮ সালের ৮ অক্টোবর ইসির সঙ্গে সংলাপে আওয়ামী লীগ গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের এই ধারাটির বিরোধিতা করে।

তখন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) ড. এ টি এম শামসুল হুদা নিজেই আওয়ামী লীগকে গঠনতন্ত্রে 'তবে' প্রত্যয় যোগ করার কৌশল বাতলে দিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতাদের পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেছিলেন, 'আপনারা অলিখিতভাবে মাঠে ছাত্র বা শ্রমিক সংগঠন রাখেন, কিন্তু গঠনতন্ত্রে তা উল্লেখ করা যাবে না। ' শেষ পর্যন্ত 'তবে ছাত্রলীগ, শ্রমিক লীগ ও আইনজীবী পরিষদ নিজ নিজ গঠনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হবে'_এই অংশটুকু গঠনতন্ত্রে যোগ করার শর্তে ইসি আওয়ামী লীগের সঙ্গে একমত হয়। সে অনুযায়ী ২২ অক্টোবর আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট ধারাটি সংশোধন করে অস্থায়ী গঠনতন্ত্র ইসিতে জমা দেয়। একই কৌশল অনুসরণ করে বিএনপিও।

২০০৯ সালের ২৪ জুলাই কাউন্সিলের মাধ্যমে আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ওই দিনই ইসিতে জমা দেয়। কিন্তু এই সংশোধিত গঠনতন্ত্রে তারা ইসির দেওয়া শর্ত থেকে সরে গিয়ে গঠনতন্ত্রের ২৫-বি ধারায় ছাত্রলীগ, শ্রমিকলীগ, স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদ ও আওয়ামী আইনজীবী পরিষদকে সহযোগী সংগঠন হিসেবে উল্লেখ করে। এ কারণে ইসি গত বছরের ১৯ নভেম্বর গঠনতন্ত্রের সহযোগী সংগঠনের তালিকা থেকে এই চার সংগঠনের নাম বাদ দেওয়ার তাগিদ দিয়ে আওয়ামী লীগকে চিঠি দেয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে ৩ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য এইচ টি ইমাম ও গবেষণা সম্পাদক নুহ আলম লেনিন ইসির সঙ্গে বৈঠক করেন। জানা গেছে, ওই দিন আওয়ামী লীগের এ দুই নেতার চাপের মুখে ইসি থেকে হতাশা প্রকাশ করে জানানো হয়েছিল, আওয়ামী লীগের এই গঠনতন্ত্র গ্রহণ করতে হলে আইন সংশোধন করতে হবে।

যদিও বৈঠক শেষে নির্বাচন কমিশনার মুহাম্মদ ছহুল হোসাইন বলেছিলেন, 'আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে, আইনজীবীদের রাজনীতি করার অধিকার থাকা উচিত। বিষয়টি আমরা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছি। কিন্তু সহযোগী সংগঠন হিসেবে অন্য তিনটি সংগঠন থাকতে পারে না। ' এরপর আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ছাড়াই গঠনতন্ত্র সংশোধন করে ২০ ডিসেম্বর তা ইসিতে জমা দেয়। এতে ২৫-বি ধারায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ মহিলা আওয়ামী লীগ, কৃষক লীগ, যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, আইনজীবী পরিষদ, তাঁতী লীগ ও যুব মহিলা লীগ আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন বলে গণ্য হবে।

তবে শ্রমিক লীগ ও ছাত্রলীগ তাদের স্ব স্ব গঠনতন্ত্র দ্বারা পরিচালিত হবে। বিএনপির কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয় গত বছরের ৮ ডিসেম্বর। তারা ইসিতে গঠনতন্ত্র জমা দেয় গত ২১ জানুয়ারি। শেষ পর্যন্ত তারাও আওয়ামী লীগের কৌশল অবলম্বন করে। 'তবে' প্রত্যয় যোগ করে গঠনতন্ত্রের ১৪ ধারায় বলা হয়েছে, ছাত্রদল ও শ্রমিকদল তাদের নিজ নিজ গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে।

ইসি সচিবালয়ের আইন বিশ্লেষকদের মতে, এর মাধ্যমে দুটি দলই তাদের গঠনতন্ত্রে পরোক্ষভাবে ছাত্র ও শ্রমিক সংগঠনকে সহযোগী সংগঠনের মর্যাদা দিয়েছে।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.