শাফি সমুদ্র
কপালের ঘাম মুছে এ্যান্থনি গাছের নিচে ধপ করে বসে তার লম্বা দুই পা ছড়িয়ে দেয় রাস্তার দিকে। চোখে ঘুম ঘুম নিয়ে কিছুক্ষণ ঝিমুতে থাকে। যখন এ্যান্থনির চোখ বন্ধ হয়ে আসে ঠিক তখন পায়ের উপর দিয়ে পিঁপড়ার দল হেঁটে যায়, লাল পিঁপড়া আর কালো পিঁপড়া। এ্যান্থনি টের পেয়ে ধীর চোখে সারিবদ্ধ পিঁপড়ার হেঁটে যাওয়া দ্যাখে। আনন্দ পায়।
পিঁপড়ার সাথে গল্প করে। আঙুলের ডগায় একটা পিঁপড়ার বাচ্চা তুলে নিয়ে আদর করে। চুমু খায়। পিঁপড়াদের সাথে গল্প করতে করতে তার কপালের ঘাম শুকিয়ে আসে। পকেট থেকে একটুকরো সাদা কাগজ বের করে পিঁপড়াকে কাগজের উপর রাখে।
যতোবার ও কাগজের উপর থেকে বেরিয়ে যেতে চায় ঠিক ততোবারই এ্যান্থনি আঙুল দিয়ে সরিয়ে কাগজের মাঝখানে নিয়ে আসে।
তার স্থির পায়ের উপর দিয়ে এবার কালো রঙের পিঁপড়ে হেঁটে যেতে দেখে আরেকটা পিঁপড়ার বাচ্চা তুলে এনে কাগজের উপর রাখে। খুব ভালোভাবে পিঁপড়ের দু'টোকে দ্যাখে। ওদের সাথে খেলা করে। কথা বলে।
অনেক্ষণ ধরে দুই রঙের দুই পিঁপড়াকে মুখোমুখি করে দেয়। কিন্তু যতোবারই মুখোমুখি করে দেয় ততোবারই পরষ্পর মিলিত হয়ে পিঁপড়া দু'টো দুই দিকে চলে যায়। খুব বিরক্ত হয়ে ওঠে এ্যান্থনি। ওদের সাথে ঝগড়া শুরু করে দেয়। এক পর্যায়ে আখের চিনি আর খেজুরের গুড় খাওয়ার লোভ দেখায়।
তবুও ওরা এ্যান্থনির কথা শোনেনা। দু'টোকে কোন ভাবেই সমান্তরালে হাঁটাতে পারেনা। রাগে বিড়বিড় করতে থাকে। আবার সোনাযাদুমনি বলে মিষ্টি করে ডাকও দেয়।
যে গাছের নিচে বসে আছে এ্যান্থনি, সেটি একটি প্রাচীন অশ্বত্থগাছ।
প্রায় দেড়শ বছর ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে এখানে। প্রতিদিন সূর্যের ভয়ে লুকিয়ে থাকা বাদুড়গুলো এই অশ্বত্থের ডালেই আশ্রয় নেয় প্রায় একশ বছর ধরে। এই বাদুড় এবং চামচিকাদের সাথে এ্যান্থনির খুব সখ্যতা। ওরাও তাকে বন্ধুর মতো গ্রহণ করে। এ্যান্থনির মাথার উপর কখনো কখনো চামচিকাগুলো এসে বসে, গায়ে জড়িয়ে থাকে।
ওদের সাথেও নানান রকম গল্প করে। গান শোনায়। একবার গ্রামের এক বজ্জাত বালক জিয়াল গাছের আঁঠা দিয়ে ফাঁদ পেতে রেখেছিলো। ঐ ফাঁদে চামচিকার একটি বাচ্চা আটকে ছিলো সারাদিন। আক্রান্ত চামচিকাটি ভয়ে কিচ্মিচ করে, কান্নাকাটি করে।
তখন মা চামচিকাটিও ওর চারিদিক দিয়ে ঘুরঘুর করতে থাকে। কোনভাবেই পায়ে জড়ানো আঁঠা ছাড়াতে পারছিলো না। বাচ্চা চামচিকার অন্যান্য বন্ধুরাও এসে ওই বাচ্চাটির অসহায় চিৎকার চেচামেচি দেখে ওরাও চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে। এমন সময় এ্যান্থনি ঐ অশ্বত্থের নিচে এগুলো দেখতে পায়। সেও ঐ বাচ্চাটির কষ্টের ভাগি হয়।
খুব যতেœর সাথে চমচিকার পায়ের আঁঠা ছাড়িয়ে দেয়। তখন ওদের চিৎকার চেচামেচি থেমে যায়। তারপর এ্যান্থনি অনেক্ষণ হাত দিয়ে ওকে আদর করে ছেড়ে দেয়। বাচ্চাটি উড়ে গিয়ে ওর বন্ধুদের সাথে মিশে যায়। তারপর থেকে ওদের সাথে এ্যান্থনির বন্ধুত্ব ও ভাবের শুরু হয়।
এ্যান্থনির মন খারাপ হলে ওরা বুঝতে পারে। আবার যখন খুব বেশি মন ভালো থাকে তখনো চামচিকাগুলো আনন্দ পায় ওকে ঘিরে ওড়াউড়ি করে। আর মন খারাপের সময় এ্যান্থনির হাঁটুর উপর চড়ে বসে ছোট্ট চামচিকাগুলো। ছোটছোট চোখে তাকিয়ে থাকে তার দিকে। কিচমিচ করে ওর সাথে কথা বলে, এ্যান্থনি সায় দেয়।
তারপর প্রাণ খুলে ওদের সাথে কথা বলে। তার ভিতরের কষ্টগুলোও মুহূর্তে হারিয়ে যায়।
আর বাদুড়ের দল মাথার উপরে যখন ঘুমিয়ে থাকে, এ্যান্থনি ওদের ঘুমানোগুলো খুব মজা করে দ্যাখে, উপভোগ করে। সন্ধ্যা হলে ওরা উড়ে যায়। ওদের ওড়াটাও দ্যাখে।
একটা বাদুড় কখনো উড়তে পারেনা। জন্মাবধি ওর ডানাভাঙা। অশ্বত্থের ডালে সবসময় ঝুলে থাকে। এ ডাল ও ডাল করেই তার জীবন যায়। এ্যান্থনি ওর নাম রেখেছে নিজের নামে।
ওকেও এ্যান্থনি বলে ডাকে। কিভাবে যেন এ্যান্থনি ওর জীবনের ভিতরে অই বাদুড়টিকে খুঁজে পায়। যাকে ওর জীবনের ভিতরে খুঁজে পায় তার নামই ওর নামের সাথে মিলিয়ে রাখে। এ্যান্থনি বিশ্বাস করে পৃথিবীর সমস্ত প্রাণীর বৈশিষ্ট্য-আচারণ, প্রকৃতির সমস্ত রূপ প্রত্যেক মানুষের ভিতরে আছে। এর এ কারণেই সব সময় তাদের ভিতরে নিজের সমস্ত ক্রিয়া-কৌশল খুঁজতে থাকে।
জন্মবধি এ বিশ্বাসকে ধারণ করেই সে বন-বাদাড়-পাহাড়-নদী সবখানে হরহামেশা ঘুরে বেড়ায়। নিঃসঙ্গতা ওর চিরোদিনের সঙ্গী। একজন নিঃসঙ্গ মানুষের অনুভূতি কেমন হতে পারে তা অই বাদুড়টিকে না দেখলে কখনোই সে বুঝতো না। সব বাদুড় যখন সন্ধ্যেবেলায় উড়ে যায় মেঘের নিচে দিয়ে তখন ঐ ডানাভাঙা বাদুড়টি চেয়ে থাকে, মাথা উঁচু করে হা-হুতাশ করে। নিজেও উড়ার চেষ্টা করে, উড়তে পারে না।
যখনই উড়াল দেবার চেষ্টা করে তখনই ডাল থেকে নিচে পড়ে যায়, চিৎকার চেচামেচি করে। এ্যান্থনি এ দৃশ্য দেখে ওকেও হাতের উপর তুলে নিয়ে অনুভব করে চোখের লোনা জল বের করে দেয়। বাদুড়টি ওর চোখের দিকে করুণ চোখে তাকিয়ে থাকে, এ্যান্থনিও কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে। দু’জনই দু’জনকে অনুবাদ করে নেয়। আর সেদিন থেকে ডানাভাঙা বাদুড়টি আর উড়াল দেবার চেষ্টা করে না।
যখন সবাই উড়াল দিয়ে চলে যায় তখন সে এ্যান্থনির জন্য অপেক্ষা করে। অন্য বাদুড়গুলো এ্যান্থনির এই মমত্ববোধকে কুর্ণিশ করে। ওরাও কিছুটা নিশ্চিন্তে থাকে। অন্তত ঐ বাদুড়টির সাথে সঙ্গ দেবার জন্য একজন বন্ধু পেলো।
এভাবে সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে সন্ধ্যে কেটে যায় এ্যান্থনির।
ওরাও খুব মজা করে তার সাথে সময় কাটায়।
কয়েকদিন ধরে এ্যান্থনি অশ্বত্থের নিচে আসেনা। যে যায়গাটিতে এ্যান্থনি পিঁপড়ে দলের সাথে দুষ্টুমি করতো সেখানে পিঁপড়েগুলো জড়ো হয়ে থাকে। ওরা এ্যান্থনিকে খুঁজতে থাকে। প্রত্যেকটি পিঁপড়া একে অপরের মুখোমুখি হয়, নিজেদের ভিতরে কথোপকথোন করতে থাকে।
প্রতিদিনের সারিবদ্ধতা ভেঙে আজ ওরা সবাই জড়ো হয়ে রয়েছে। চামচিকাগুলোও খুব বেশি কিচিরমিচির শুরু করেছে। এ ডাল ও ডাল এ ঘুরে বেড়াচ্ছে। কান্নাকাটি করছে। অশ্বত্থের ডালে ডালে ঝুলে থাকা বাদুড়গুলো নিঃশব্দে ঝুলে আছে।
যেদিন থেকে এ্যান্থনি এখানে আসেনা সেদিন থেকে বাঁদুড়গুলোও উড়াল দিয়ে অন্য কোথাও যায়না। ডানাভাঙা বাদুড়টি গলা উঁচু করে হা-হুতাশ করছে। চিৎকার দিয়ে বাতাস ভারী করছে। যে পথ দিয়ে এ্যান্থনি এখানে আসে সে দিকে একটা মস্ত বড়ো অশ্বত্থের ডাল ঝুলে আছে। প্রতিদিন সব বাদুড়গুলো অই ডালে এসে ঝুলে থাকে।
ঝুলে ঝুলে এ্যান্থনির আসার পথের দিকে চেয়ে থাকে।
এ্যান্থনি অসুস্থতাবস্থায় হাঁটতে হাঁটতে অশ্বত্থের নিচে এগিয়ে আসে। অমনি চামচিকাগুলো তুমুল ওড়াওড়ি শুরু করে দিলো ওকে ঘিরে আর ডানাভাঙা বাদুড়টি এ্যান্থনিকে দেখে চিৎকার দিয়ে ওঠে। অন্যবাদুড়গুলো নেচে ওঠে, এ ডাল থেকে ও ডালে ঝুলে পড়ে। এ্যান্থনি ধীর পায়ে এসে অশ্বত্থের নিচে বসে।
কিছুক্ষণ বসে থাকার পরে চোখে শুধু অন্ধকার ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। একসময় জ্ঞান হারিয়ে অশ্বত্থের নিচে পড়ে থাকে। যেখানে এইমাত্র বাদুর আর চামচিকাদের কোলাহলে মুগ্ধ হয়ে ছিলো অশ্বত্থ গাছ জুড়ে। সেখানে চারিদিকে শুনশান নিরবতা নেমে আসে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।