বাংলাদেশ আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা...
দশমহল । । গল্প । । রেজা ঘটক
বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে এখনো সংখ্যালঘু হিন্দুরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ, কৃষ্ণনগর গ্রাম তার একটি।
কাজেই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, কৃষ্ণনগরে মুসলমানরাই বরং সংখ্যালঘু। বৃহত্তর খুলনা জেলার বাগেরহাট মহকুমার চিতলমারী থানায় এই কৃষ্ণনগর গ্রাম। হিন্দু প্রধান দশমহল নামেই যা বেশি পরিচিত। কৃষ্ণনগরকে বরং দশমহলের একটা মহল বলাই ভালো। বর্তমানে বাগেরহাট জেলা আর চিতলমারী উপজেলা খ্যাতি পেলেও কৃষ্ণনগরের রূপ কিন্তু একটুও পাল্টায়নি।
কোথাও কোথাও গ্রামের পুরনো রাস্তাঘাট ফুটখানেক উঁচু হয়েছে। আর কয়েকটা ভাঙা সেতুর জায়গায় ২৪ বা ৩৬ ফুটের কালভার্ট। তা আবার নগেন মন্ডল মেম্বার হওয়ায় তাঁর বাড়ির সামনের জীর্ণ সেতুটা, বিশ্বাসদের প্রভাব প্রতিপত্তি থাকায় তাঁদের ঘাটের তেলতেলে মসৃণ সাঁকোটা আর ডাকাতিয়া হাইস্কুল পথের খেজুর গাছের ভাংগা সেতুটা কালভার্ট হয়েছে। শশধর পাড়ার লোকদের বেশি যাতায়াত খাসেরহাটের দিকে। ওই পথের ভাঙা সাঁকোটা এখনও আগের মতোই অচল।
তবে অচল পয়সার মতো নয়। ধৈর্য আর সাহস থাকলে এ সাঁকোও নিশ্চিন্তে পার হওয়া যায়।
যেমন এই ভাংগা সাঁকোটা পার হওয়া লক্ষ্মীরাণীর কাছে শিশুর হাসির মতো সহজ কাজ। চাঁদের আলো কোনরকম পক্ষপাতিত্ব ছাড়াই যেমন কৃষ্ণনগরের পথঘাট, মাঠপ্রান্তর, উঠোনবাগান সর্বত্র অবলীলায় ছড়িয়ে যায়, তেমনি সূর্যের আলো যতোক্ষণ থাকে দিনের ততোক্ষণ লক্ষ্মীরাণী কৃষ্ণনগরের এমাথা থেকে ওমাথা বাড়ি বাড়ি ঘুরে অন্ন যোগানের ব্যবস্থায় ভারি ব্যস্ত দিন কাটায়। সে কারণে দিনে কমপক্ষে দু’বার লক্ষ্মীরাণীকে শশধর পাড়ার এই ভাংগা সাঁকোটা পারাতে হয়।
সকালে ঘর থেকে বেরিয়েই একবার, আর সন্ধ্যায় ফিরতি পথে আবার। কৃষ্ণনগরের এমাথা থেকে ওমাথা মোট কত কদম পথ তা লক্ষ্মীরাণীর হিসাবে না থাকলেও কৃষ্ণনগর গ্রামের প্রধান রাস্তার দু’পাশের সকল বাড়িঘরের কার কী নাম, কার কয়টা ছেলেমেয়ে, কার হালে কয়টা বলদ, কার কয়টা দুধের গাভী, কার বউয়ের পেটে বাচ্চা, কার বউয়ের আতুর চলে, কে কেমন রবিশস্য পেল, কার কার পেটের অসুখ, কার অম্বলের বা গ্যাস্ট্রিকের ব্যারাম, কোন ছেলের বিয়ের কথা হচ্ছে, কার মেয়ের ঘরে রাতে জিন নামে, কোন বাড়িতে সোমত্ত মেয়ে দেখতে পাত্রপক্ষ থেকে অতিথি আসছে, কোন কোন বাড়ির গৃহস্থ বউয়ের পরকীয়া প্রেম আছে, এমন সব ধরনের হাঁড়ির খবরই লক্ষ্মীরাণীর কাছে আছে। এক কথায় কেউ যদি কৃষ্ণনগরের কোন খবর জানতে চায়, তার শুধু লক্ষ্মীরাণীর সঙ্গে দেখা মিললেই যথেষ্ট। কৃষ্ণনগর গ্রামের জীবন্ত সংবাদপত্র এই লক্ষ্মীরাণী বসু। কৃষ্ণনগরের অনেক আউবুড়ো মেয়ের বিয়ে হয়েছে লক্ষ্মীরাণীর কাছ থেকে পাত্র পক্ষের পাওয়া নিরপেক্ষ তথ্যের ভিত্তিতে।
আবার অনেক সম্ভ্রান্ত পরিবার কৃষ্ণনগরে মেয়ের বিয়ে দেয়ার আগে লক্ষীরাণীর শরণাপন্ন হয়েছেন, ছেলের পরিবার সম্পর্কে খবর জানতে।
যার চরিত্রে যতটুকু ভালো গুণ তা যেমন লক্ষ্মীরাণী প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না, তেমনি কেউ দুশ্চরিত্রের হলে ঢোল না পিটিয়ে হলেও অকপটে জানাতে লক্ষ্মীরাণীর মোটেও ভয়ডর নেই। সে এডভোকেট কালীদাস বড়াল হত্যাকান্ডের কথাই হোক আর নৌকায় ভোট দেয়াই হোক না কেন। কৃষ্ণনগরে যা কিছু ঘটুক তার খবর লক্ষ্মীরাণী পাবেই। সে কারণে কৃষ্ণনগরের ধনী-গরীব, জোয়ান-বুড়ো, নেতা-মাস্তান সকলেই লক্ষ্মীরাণীকে একটু সমীহ করেই চলে।
কেবল স্কুল পালানো ছেলে ছোকরারা মঝে মধ্যে তার পিছে লেগে প্রাত্যহিক ভিক্ষাবৃত্তির কাজে কিছুটা ব্যাঘাত ঘটিয়ে আনন্দ লুটে নিলেও, লক্ষ্মীরাণীর চরিত্রে আভিজাত্য বলতে তার ওই সত্য ভাষণটুকুই। সত্য বলতে সে পুলিশ, ডাকাত কি মাস্তান কাউকেই ভয় পায় না। তাই আসল শত্র“র চেয়েও ধীরেন বিশ্বাসের ভয়টা ওই লক্ষ্মীরাণীকে নিয়েই বেশি। কারণ গত তিনদিনে বিশ্বাস বাড়িতে একবারও আসেনি লক্ষ্মীরাণী। মাঝেমধ্যে বিরূপ আবহাওয়া থাকলে অথবা কোন ঘটনায় লক্ষীরাণী ভীষণ গোস্যা করে স্বেচ্ছায় অভুক্ত থেকে থেকে নিভৃত কুঁড়েঘরের জীর্ন বিছানায় শীর্ণ শরীরটাকে রহস্যময় এক অভিমানী বেড়িতে জোর করে বন্দি করলেই কেবল এরকমটা হয়ে থাকে।
তাও চার নম্বর সিগন্যাল পর্যন্ত লক্ষ্মীরাণী বসে থাকে না। কৃষ্ণনগর গ্রামের শেষ প্রান্তের ওই ধীরেন বিশ্বাসের বাড়ি পর্যন্ত অন্তত দিনে একবার লক্ষীরাণীর আসা চাই। পেটের দায়েই কৃষ্ণনগরের এমাথা-ওমাথা চক্কর দিতে হয় লক্ষ্মীরাণীকে। তাছাড়া গত পঁচিশ বছরে যতোবার লক্ষ্মীরাণী গ্রামে বের হয়নি, সে হিসাব একেবারে হাতেগোনা। যেমন এডভোকেট কালীদাশ বড়াল যেদিন বাগেরহাটে প্রকাশ্য দিবালোকে সন্ত্রাসীদের গুলিতে খুন হলেন, সেদিনের সেই ভয়ংকর দুঃসংবাদটি শোনার পর, পরবর্তী তিনদিন ছেলে হরানোর শোকের মতো ষাট উর্ধো লক্ষীরাণী কোথাও বের হয়নি।
লক্ষীরাণী জীবনে বিয়ে করেনি কিন্তু এডভোকেট কালীদাশ বড়ালকে তার নিজের সন্তানের মতো জানতো। দেখা হলেই বুকে জড়িয়ে ধরে বলতো Ñ কালারে আমার, সাবধানে চলিস বাপ।
এডভোকেট কালীদাশ বড়ালের অতো সময় কোথায় কৃষ্ণনগরের এক ভিখারি বুড়িমার কথা মেনে সারাক্ষণ সাবধানে চলবেন? একদিকে তাঁর আইন ব্যবসা অন্যদিকে রাজনীতি। গোটা দশমহল, বাগেরহাট, ঢাকা, কলকাতা কতো জায়গায় কতো ধরনের দৌড়ঝাঁপ। কতো কিসিমের লাইনঘাট।
কতো টাইপের মানুষের সঙ্গে ওঠবস। কতো ধরণের খবরে খেয়াল রাখতে হয় তাঁকে। কতো হাজারো কাজে লাখো টাইপের বোঝাপড়া। দম ফেলানোর সময় কোথায় কালীদাশের? এসবের মধ্যেও অসুস্থ সহকর্মীকে দেখতে সময় বের করতে হয় তাঁকে। এডভোকেট মজুমদারের বাসা থেকে ফেরার পথে সাধনার মোড়ে দাঁড়িয়ে পত্রিকায় চোখ বোলাতে বোলোতে গরম চায়ে চুমুক দেয়ামাত্র আগে থেকে সেখানে ওৎ পেতে থাকা সন্ত্রাসীরা খুব কাছ থেকে তাঁকে গুলি করলো।
এক্কেবারে নির্ভুল নিশানা। এই লাইনে পুরোপুরি হাত পাকানো দক্ষ লোকদের টার্গেট কি কখনো মিস হয়? মুহূর্তে সে খবর রাষ্ট্র হয়ে কৃষ্ণনগরের লক্ষীরাণীও পেল। তারপর টানা তিনদিন লক্ষীরাণী কৃষ্ণনগরের কোথাও বের হয়নি। চতুর্থ দিনে নগেন বড়ালের বাড়িতে যখন কালীদাশের লাশ পৌঁছাল সেখানে তখন তিল ধারণের ঠাঁই নেই। ওই ভিড়ের মধ্যে লক্ষীরাণীকে আবার দেখা গেল ফসিলের মতো শুকিয়ে কাঠ হওয়া হাড় সর্বস্ব শরীরটা নিয়ে উথালি পাথালি করতে।
এরপর থেকেই যেন লক্ষীরাণী ধীরে ধীরে বদলে যেতে থাকল। আগের মতো কোন বিষয়ে কথা বলতেও তেমন আর আগ্রহ পায় না। কালীদাশ বড়ালের নিহত হওয়ার ঘটনায় থাতস্থ হতে লক্ষীরাণীর অনেকদিন লাগল। নিজের জীবনের তাগিদেই আবার সে কৃষ্ণনগরের এমাথা ওমাথা চক্কর দিতে লাগল। যেন কৃষ্ণনগরের সবকিছু আবার স্বাভাবিক হয়ে গেছে।
জীবনে কালীদাশের মৃত্যুর মতো অনেক কিছুই মেনে নিতে হয় এমনটাই নিজেকে প্রবোদ দিল লক্ষীরাণী। হিমালয় সমান জটিল জীবনের বোঝাগুলোকে ইঁদুরের মতো ছোট্ট হৃদয়টার মেনে নেয়াই বুঝিবা জীবনের নিয়তি? দশমহলের অভিজাত হিন্দু পরিবারের একমাত্র সন্তান হিসেবে বেড়ে ওঠা বর্তমান সময়ের লক্ষীরাণীর পরিচয় যে শুধুই একজন ভিক্ষুক। অথচ এক সময়ে তার বাবা রমেশ বসু ছিলেন শুধু কৃষ্ণনগর কেন গোটা দশমহল সমাজের মাথা। ধীরেন বিশ্বাসের বাবা নিরোদ বিশ্বাসের সঙ্গে তার বাবার জমিজমার মামলায় হেরে পরিবারসহ দেশত্যাগ করার পর লক্ষীরাণীর জীবন কেমন রাতারাতি পাল্টে গেল। দশমহলের জমিদার কন্যা থেকে একেবারে কৃষ্ণনগরের পথের ভিখারি।
বাবার মৃত্যু, কলকাতায় রেললাইনের বস্তির জীবন, মা-মামাদের ফেলে বারো বছরের মাথায় আবারো কৃষ্ণনগরে তার প্রত্যাবর্তন, আবার সেই নিরোদ বিশ্বাসের ছেলে ধীরেন বিশ্বাসের দয়ায় ভিখারির মতো বাপের ভিটায় কুঁড়েঘরে ঠাঁই। কতো বিচিত্র জীবন যে লক্ষীরাণী বয়ে বেড়াচ্ছে, যা জীবন চক্রের কোন নিয়তির অনিবার্য ফলাফল? এক জীবনের এই ছোট্ট মাথায় কোন ভাবেই লক্ষীরাণী সময় আর জীবনের অমন গোলক ধাধার জবাব পায় না। তাই দুঃখ আর শোক ভুলে রক্ষীরাণীকে আবরো স্বাভাবিক হতে হয়। কৃষ্ণনগরের এমাথা ওমাথা চক্কর দিতে হয় নিরর্থক জীবন রহস্যের আসল অর্থ উদ্ধার করতে।
ওদিকে লক্ষীরাণীর বাবা রমেশ বসুর সঙ্গে দীর্ঘ কুঁড়ি বছরে জমিজমা নিয়ে যার সঙ্গে মামলা চলল, সেই নিরোদ বিশ্বাসের একমাত্র ছেলে ধীরেন বিশ্বাসের তো উত্তরাধিকার সূত্রে মামলায় জেতা জমিজমা নিয়ে পরলোকি বাবা নিরোদ বিশ্বাসের চেয়েও দাপটে থাকার কথা।
তাঁর একমাত্র কন্যা শিখার উচ্চ মাধ্যমিক রেজাল্টের পর, গত তিন দিনে কোথায় গেল তাঁর সেই চণ্ডাল জমিদারি? কৃষ্ণনগরের আরো অনেকের মতো চিতলমারী কলেজের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফলের দিকে ভিখারি লক্ষীরাণীর বা কেন এতো আগ্রহ যা খুব গোপনে সে লালন করছে? ধীরেন বিশ্বাসের মেয়ে শিখার পরীক্ষার রেজাল্টের সাথে লক্ষীরাণীর কীসের সম্পর্ক? শিখার রেজাল্ট যা হবার তাই হল। সারা গ্রামে তখন গুজবের আকারে একটা কথাই শুধু ছড়াল যেÑ পরিমল ছেড়ির মাথাডা খাইছে।
পরীক্ষার আগে পরিমলের সঙ্গে শিখার প্রেমঘটিত সম্পর্ক নিয়ে সারাগ্রামে একবার কানাঘুষা হয়েছিল, যে ধীরেন বিশ্বাসের মেয়ে এবার চমৎকার রেজাল্ট করবে। তা যে এমন জঘন্য চমৎকার হবে তাকি কৃষ্ণনগরের কেউ জানতো? শিখার রেজাল্টে বার সাবজেক্টের মধ্যে মাত্র তিনটাতে পাস। তাও মাত্র ৩৪, ৩৭ আর ৩৯ নম্বর।
হঠাৎ শহরে বিদ্যুৎ চলে গেলে যেমন কারখানার চাকাগুলো মুহূর্তে আটকে যায় তেমনি পুরো কৃষ্ণনগর যেন শিখার অমন জঘন্য রেজাল্টে কিছুটা হলেও ধমকে গেল। অথচ দুবছর ধরে চিতলমারী কলেজে প্রথম বিভাগের জন্য যার নাম সবচেয়ে বেশি আলোচিত হতো, সে নামটা ছিল ধীরেন বিশ্বাসের একমাত্র কন্যা শ্রীমতি শিখা রাণী বিশ্বাসের। আর যাকে নিয়ে ধীরেন বিশ্বাসের চেয়েও বেশি গর্ব করতো ওই রমেশ বসুর মেয়ে লক্ষীরাণী। এমন কি এডভোকেট কালীদাশ বড়ালকে পর্যন্ত আগ মাড়িয়ে সে বলে রেখেছিলÑ ধীরেনের মেয়েটার ঢাকায় পড়াশুনার ব্যবস্থা করবি, মেয়েটার মাথা ভালো। যে মেয়ের ক্লাস ফাইভ ও এইটে ট্যালেন্টপুলে স্কলারশিপ, ম্যাট্রিকে পাঁচ বিষয়ে লেটারসহ আটশর কাছাকাছি নম্বর, তার উচ্চ মাধ্যমিক ফলাফল এতো জঘন্য হবে, তা শিখার নিজেরও কি বিশ্বাসে ছিল? অমন খবর পাওয়ার পরে রহস্যময় নিরাবতায় তাই আবারো লক্ষীরাণী তার জীর্ন কুঁড়েঘরে শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়ে নিল।
মানুষের ওপর বিশ্বাসগুলো কেন এভাবে উল্টোপাল্টা হয়ে যায় লক্ষীরাণী তা কিছুতেই বুঝতে পারে না। মানুষ কেন বিশ্বাসের মর্যাদা রক্ষা করতে পারে না? মানুষের বিশ্বাস থাকে কোথায় আর কেনই বা তারা তা বারবার হারায়ে ফেলে? লক্ষীরাণী নিজের মনকে বুঝাতে পারে না শিখা এমন রেজাল্ট কেমনে করে? যাকে সে পরীক্ষার আগে টানা তিন মাস মনীন্দ্র মাস্টারের বাড়ি থেকে বিশ্বাস বাড়ি পর্যন্ত সারাটা পথ এগিয়ে দিয়েছে, একাকি পথে শিখার যাতে কোন অসুবিধা না হয়। শিখার তখনকার মনের আসল খবর লক্ষীরাণী জানবে কীভাবে? অথবা আসলেই শিখা তখন কি করে বেড়াতো? মনীন্দ্র মাস্টারের বাড়িতে শিখার প্রাইভেট পড়ার খবর লক্ষীরাণী বিশ্বাস করতো। কিন্তু কলেজ থেকে মনীন্দ্র মাস্টারের বাড়ি পর্যন্ত শিখা কার সঙ্গে আসতো শুনি? পরিমল আর শিখা মনীন্দ্র মাস্টারের বাড়িতে পড়ার নামে তখন আসলে কী করে বেড়াতো, যে অমন ভালো ছাত্রীর এতো জঘন্য রেজাল্ট? লক্ষীরাণী কিছুতেই এসব প্রশ্নের জবাব মিলাতে পারে না। যে পরিমলের ব্যাপারে লক্ষীরাণী নিজে থেকেই শিখাকে আগেই সাবধান করে দিয়েছিলÑ ‘ছ্যাড়াডার তিন হাত দূরে থাকবি।
ওর কতা জানি কেমুন!’ শিখা সেই পরিমলের মধ্যে কী অমন গুপ্তধন আবিষ্কার করল, যে পরীক্ষার প্রস্তুতির চেয়েও তার সঙ্গে মাখামাখিটা বেশি জরুরি হয়ে পরল? লক্ষীরাণী শিখার রেজাল্ট শুনে তাই নিজেকেই গুটিয়ে নেয়ার সিদ্ধান্ত তো নিতেই পারে।
এখন কি শিখাও তার নিজের জীবনের কোন হিসাব মিলাতে পারছে? যে পরিমলকে অন্য দশটা ছেলের থেকে আলাদা মর্যাদা দিয়েছে সে। সেই পরিমল তপাদার শিখাকে জড়িয়ে দশ গ্রামে যতো উপকথা, ব্যঙ্গ-রসিকতার কোন প্রতিবাদ তো করলই না, উল্টো সবার কাছে সেই গুজব কথাকে প্রতিষ্ঠা করার সুযোগ দিয়ে রাতের অন্ধকারে অনেকটা ছিঁচকা ছাকা চোরার মতো পালাল। লক্ষীরাণীর কথা মনে রাখলে কী শিখার আজ সারাগ্রামে সবার কাছে এতো উপহাসের পাত্রী হতে হতো? পরিমলকে এখন কী বলতে পারে শিখা? কাপুরুষ? কেবল এই একটা মাত্র শব্দই ব্রেক কশা কোন দ্রুতগামী দশটনি ট্রাকের মতো শিখার গলা বেয়ে ওষ্ঠ পর্যন্ত এসে হঠাৎ আবার আটকে গেল। এতটুকু সাহস নিয়ে কুঁড়িটা বসন্ত পার করে শিখাকে মুগ্ধ করার পেছনে পরিমলের ভেতরে যে ভয়ঙ্কর ভীতু’র হাতছানি ছিল, তা জানলে কী শিখা অমন কুলাঙ্গার ছেলের প্রেমে ধরা দেয়।
প্রেম না ছাই। সামাজে মুখ তুলে কথা বলার স্পর্ধা যার ধমনিতে নেই, সে আবার কেমন প্রেমিক? শিখার মনে পড়ে- ধীরাজ চট্রোপাধ্যায়ের ‘যখন পুলিশ ছিলা’ম বইটার লেনদেন নিয়ে পরিমলের সাথে তার সখ্যের শুরু। পুরুষ জাতির কলঙ্ক মোছার দায়ভার পরিমল নিজের কাঁধে নিয়ে কৃষ্ণনগরের এ যুগের মাথিন শিখাকে ভালোবাসার যে চ্যালেঞ্জ সেদিন শিখার দিকে ছুঁড়ে দিয়েছিল, তার প্রতি যথাযথ সম্মান দেখাতে নিজের অজান্তে শিখার মনে মাথিন হবার যে বাসনা চেপেছিল, যার অনিবার্য ফল পরিমলকে শিখার ভালোবাসা। অথচ পরিমল যে ধীরাজদেরই বংশজাত, পুরুষ জাতির অন্য এক উত্তরাধিকার, তা যেমন সেদিন শিখার টিনেজ বয়সের কুসুমকমল উড়–নচন্ডি হাওয়াই মনে আমলে আসেনি, তেমনি মাথিনের ভাগ্যের চিরায়ত বাস্তবতা যে একদিন নিজেকেও এমন প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করাবে, তা কি শিখা জানত? তাই আজ নিজেকেই সবচেয়ে বেশি অপরাধী মনে হয় শিখার। কাকে কাপুরুষ বলবে শিখা? দোষ তো তারই।
নইলে মাত্র এক বছর চার মাসের লাই পাওয়া সম্পর্কে কেনবা পরিমলের শয্যাসঙ্গী হতে যাবে সে? কেনবা বাবার দশমুখে এমন কলঙ্ক লাগাবে? কেনবা সুন্দর পৃথিবীর সব মায়া ভুলে নিজেকে শেষ করে দেয়ার ইচ্ছা জাগবে শিখার মনে? সমুদ্রের ঢেউয়ের মতো কেন ওই ইচ্ছাটা বারবার তার পারানটারে কুঁড়ে কুঁড়ে খাবে? কোন কিছুই ভালো লাগে না কেন শিখার? শিখা কী এখন নিজের প্রতিই নিজে খুব বিরক্ত? লক্ষীরাণীর কাছেও কি কোন ধরণের পরামর্শ করার মতো এখন আর তার সেই সোনামুখটা নেই? শিখা কী তবে আত্মহননের পথ বেছে নেবে? কী এমন ভয়ংকর ঘটনা ঘটেছে যে শিখা নিজেকে শেষ করে দিতে চায়?
এই সময়ে শিখা যার সাথে এ বিষয়ে নিশ্চিন্তে পরামর্শ করতে পারতো সেই লক্ষীরাণী বা কেন গত তিনদিনে বিশ্বাস বাড়িতে আসে না? নাকী লক্ষী পিসিও শিখার প্রতি ভীষণ অভিমান করেছে? যার ভালো রেজাল্টের প্রত্যাশায় লক্ষী পিসি পরীক্ষার দিনগুলোতে সারাদিন ভগবানের নামে উপোস থাকলো, তাকে শিখা কীভাবে কোন মুখে এখন কাছে ডাকে? শিখা কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে শেষ পর্যন্ত দ্রোহী হয়ে ওঠে। মানুষ কী শেষ আশ্রয়স্থল হারালে শিখার মতো বিদ্রোহ দেখাতে শুরু করে? নাকী পৃথিবীর মায়াজালের বন্ধনে একবার জড়ালে সহজে আর মুক্তির উপায় নেই? হতাশা আর বিদ্রুপ মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়? শিখা আজ কীসের মধ্যে বাঁচার উৎসাহ অনুসন্ধান করছে? বাবা ধীরেন বিশ্বাসকে বা আজ সে কী বলতে উদ্যত? মা তুলসী রানীকে কেন সে রেজাল্টের পর থেকে আর সহ্য করতে পারছে না? বিনিদ্র সারারাত জেগে জেগে শিখা কীসের সন্ধান করেছে? আজ কী সে কোন একটা রহস্যের উন্মোচন বা সমাপ্তি চায়? শিখা নিজে কী ভাবছে এখন?
না। মাথিনের মতো নিজিরি শেষ করতি পারি না আমি। আমার ভিতরি যে বড়ো হোচ্ছে, তার তো কোন দোষ নেই। তাকে হত্যা করার কোন অধিকার তো আমার নেই।
কিসির সমাজ? কিসির এতো কানাকানি? আমারে নিয়ি এতো কতা কিসির? আমি শিখা। আমার প্রবাহ আমার অহংকার। আমার উপস্থিতি না থাকলি কিসির সমাজ? কিসির সংসার? আমারে নিয়িই তো সংসার, সমাজ। না, আমি মরবো না। এ সমাজ মাথা ঠুকি মরলিও আমার কিছু যায় আসে না।
আমি এ সামাজরে আজ দ্যাখফো। এ সামাজের আদালতি আমিও এক অভিন্ন সত্তা। না, আমি মরতি পারি না। বাঁচতি হবে। আমাকে বাঁচতি হবে।
আমার আমিকেও বাঁচাতি হবে। আমি যে নতুন ভগবানের মা। আমি যে স্রষ্টা। আমি কেন মরতি যাবো? এমন অসংখ্য যুক্তি পাল্টা যুক্তির মহড়া শিখার মনের মধ্যে সারা রাত খেলে যায়। অতঃপর সাজ সকালে প্রকাশ্যেই মা-বাবার সামনে শিখা ঘোষণা করল- হ্যা, পরিমলের সন্তান আমার পেটে।
তাতে কী অইছে?
সকাল বেলা এমন দৃঢ়কণ্ঠে শিখার বিদ্রোহী ঘোষণায় বাবা হিসেবে ধীরেন বিশ্বাসের চিন্তিত হবারই কথা। কিন্তু ধীরেন বিশ্বাস মেয়ের অমন উদ্ভট ঘোষণায় যতোটা না চমকিত, তার চেয়ে বেশি বিস্মিত আজ তিনদিনে লক্ষ্মীরাণীকে এ পাড়ার কোথাও না দেখে। তাহলে কী শিখার ঘটনা শোনার পর লক্ষ্মী পণ করেছে আর বিশ্বাস বাড়িতে আসবে না? মধ্যরাতে বাঁশবাড়িয়ার হাট করে মধুমতী ঘাটে কোন নাও না পেলে হতভাগ্য হাটুরে যাত্রীরা যেমন দিশাহারা হয়ে যায়, তেমনি কিংকর্তব্যবিমূঢ় ধীরেন বিশ্বাসের ফ্যাসফেসে কণ্ঠ থেকে এক অস্ফুট শব্দ বের হয় । হায় ভগবান! আমি এ্যাহোন কোতায় যাই?
অথচ দেশ বিভাগের পর যে কয়েক ঘর হিন্দু পরিবার কলকাতা না গিয়ে পূর্ববঙ্গেই থেকে যাবার দৃঢ়তা দেখাল, তার মধ্যে লক্ষ্মীর বাবা রমেশ চন্দ্র বসু ছিলেন অন্যতম। যেমন ছিল তাঁর অঢেল প্রভাব প্রতিপত্তি, তেমনি ছিল তাঁর অনেকটা বৃটিশ রাজপরিবারের মতো আভিজাত্যের বড়াই।
কৃষ্ণভক্ত লোকটা গ্রামের সকল ধর্মের মানুষকেই খুব আপন ভাবতেন। নিজের খরচে বছরে অন্তত একবার হলেও বাড়িতে পদাবলী কীর্তন দিতেন। প্রতিবছরই তাঁর নেতৃত্বে কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণভক্তরা ওরাকান্দি যেতো। ওরাকান্দি থেকে ফেরার পর তাঁর বাড়িতে বসতো টানা তিনদিনের রামায়ণ পালা। ধীরেন বিশ্বাসের স্পষ্ট মনে পড়ে, শেষ যেবার লক্ষ্মীদের বাড়িতি রামায়ণ শুনতি গ্যালাম, কীভাবে পালিয়ে গ্যাছিলাম।
বাবা শুনলি হাত-পা ভেঙে গুড়ো করি দেবে, সে ভয় থাকার পরেও গ্যাছিলাম। চাদর মুড়ি দিয়ে মুখ ঢাকলেও সেদিন রমেশ বাবু ঠিকই ধীরেন বিশ্বাসকে চিনেছিলেন। রমেশ বাবু মেয়ে লক্ষ্মীরে ডেকে বল্লেন- দ্যাখচিস কিছু? ওই যে ওটা নিরোদ বিশ্বাসের পোলা না? লক্ষ্মী আমার দিকি একবার চাইয়ে সোজা রান্ন্াঘরে গেল। লক্ষ্মীর বাবা যতোই ধীরেন বিশ্বাসের কাছাকাছি আসতে লাগল, ধীরেন বিশ্বাস ততোই চাদরে নিজেকে লুকানোর বৃথা চেষ্টা করলেন। পুলিশ যেমন দাগী আসামি নাগালে পেলে রসিকতা করার সুযোগ দেয়না, তেমনি রমেশ বাবু পুরুষালী হাতের ঔদ্ধত্য তাগড়া মুঠিতে খপ করে ধীরেন বিশ্বাসের ডানাটা ধরে ফেলেন।
সাপে ব্যাঙ ধরলে ব্যাঙের যেমন দশা হয় তারচেয়েও ভয়ঙ্কর দশা তখন ধীরেন বিশ্বাসের। কারণ জমিজমার মামলা নিয়ে রমেশ বাবু’র সঙ্গে তার বাবা নিরোদ বিশ্বাসের তখন ছিল প্রকাশ্যে শক্রতা। এক্কেবারে ষাঁড়ে-মহিষি লড়াই। নিরোদ বিশ্বাসের ছেলে ধীরেন বিশ্বাস শুধু এই পরিচয়টুকুই তার মুণ্ডুপাতির জন্যে তখন যথেষ্ট। উপস্থিত রামায়ণ শ্রোতাদের প্রায় সকলেও জানে ধীরেন বিশ্বাসের বাবা আর রমেশ বাবুর সর্ম্পক কেমন সুতায় বাঁধা।
মেঘনাদকে হাতের মুঠোয় পেয়ে স্বয়ং ভগবান রাম যেখানে রাবনপুত্র ইন্দ্রজিৎকে ক্ষমা করেনি, সেখানে নিরোদ বিশ্বাসের ছেলে ধীরেন বিশ্বাসকে কী রমেশ বাবুর ছেড়ে দেবার কথা? অথচ সবাইকে অবাক করে ধীরেন বিশ্বাসকে বিস্ময়ের সাত সমুদ্রে ভাসায়ে লক্ষ্মীর বাবা রমেশ বাবু সেদিন অত্যন্ত করুণ কণ্ঠে বল্লেন- ধীরেন না? আসো, আসো বাবা, দুইটা ডাল-ভাত খাবে। তোমার বাবায় তো আসবে না জানি, তোমার ঠাকুর মায় তো আসতি পারত?
অথচ যার বাবার কাছে মামলায় হেরে মনের কষ্টে কৃষ্ণভক্ত রমেশ বাবু দেশ ছাড়লেন। কলকাতার শিয়ালদাহ রেল স্টেশানে এক প্রকার উদ্বাস্তু জীবন যাপনেও যাঁর কোন পিছুটান থাকল না। এমন কি বছর না ঘুরতে যে লোকটা রেলে একটা পা পর্যন্ত হারালেন। আর পরবর্তীতে কৃষ্ণনগরের নাম শুনলে যাঁর চোখে আগুন বৃষ্টি ঝরত।
সেই লোকটা মাত্র তিন বছরের মধ্যেই কেমন রহস্যজনক ভাবেই পরলোকে চলে গেলেন। কী এমন দুঃখ পেয়েছিলেন রমেশ বাবু যার কারণে তাঁর দেশ ছাড়তে হলো? অভিজাত হিন্দু পরিবারের সকল অহংকার জলাঞ্জলি দিয়ে কলকাতায় কেন তাঁকে বস্তির জীবন বেছে নিতে হলো? নিরোদ বিশ্বাসের সঙ্গে যে জমিজমা নিয়ে তাঁর মামলা তা তো শুধু মামলাতেই সীমাবদ্ধ ছিল। সামাজিক নানান কর্মকান্ডের একই অনুষ্ঠানে তাঁদের দুজনকে তো তবু মাঝেমধ্যে হঠাৎ একত্রে পাওয়া যেতো। সরাসরি হয়তো কথা হতো না। দুজন দুজনকে এড়িয়ে চলতেন।
কিন্তু কখনো কেউ তো কারো সঙ্গে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। অথচ মামলার রায় রমেশ বাবুর বিপক্ষে গেলে হঠাৎ করে কৃষ্ণভক্ত লোকটা কেন এভাবে পাল্টে গেলেন? কী রহস্যময় কারণে রমেশ বাবু এভাবে পাল্টে গেলেন? আর কলকাতা চলে যাবার পর তাঁর সামনে যে অনেক দুঃখ আর সীমাহীন দুর্ভোগের হাতছানি তাতো জেনে শুনেই তিনি গিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর মৃত্যু নিয়ে দশমহলের সবাই যা জেনেছে তা কতোটুকু বিশ্বাসযোগ্য? কী ঘটেছিল রমেশ বাবুর শেষ দিনগুলোতে? তিনি কী তবে পাগল হয়ে গিয়েছিলেন, যা লক্ষীরাণী বা তার কাছের কেউ কখনো স্বীকার করে না? কী ঘটেছিল রমেশ বসুুর মৃত্যুর সময়ে?
রমেশ বসুর মৃত্যু গোটা দশমহলে একটা রহস্য হয়েই থাকল। কেউ ওই বিষয়টা নিয়ে আর যেনো ইচ্ছে করেই আগাতে চাইল না। অনেকটা ইংল্যান্ডের ডা. জন কেলীর মৃত্যু রহস্যের মতো।
ডা. জন কেলী কী সুইসাইট করেছিলেন নাকি তাঁর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল? তা যেমন টনি ব্লেয়ারের বৃটিশ সরকার এবং মার্কিন মদদপুষ্ট বৃটিশ গোয়েন্দা বিভাগ বিশ্ব দরবারে বুশের চক্রান্তে ইচ্ছে করেই রহস্যাবৃত রাখল, তেমনি কলকাতায় রমেশ বসুর মৃত্যু বিষয়টাও আজো পুরো দশমহলে রহস্য হয়েই থাকল। লক্ষীরাণীকেও এখন আর কেউ তার বাবার মৃত্যুর বিষয়ে কোন কথা জিজ্ঞাসা করে না। কারণ ওই বিষয়ে লক্ষীরাণীও খাসেরহাটের বুড়ো তালগাছটার মতো রহস্যময় নিরবতা পালন করে শুধু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে থাকে।
অনেকে অবশ্য রমেশ বসুর স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি বলে নানা কথা বলেন। কেউ বলেনÑ রেলে ঝাঁপ দিয়েই বেচারা আত্মহত্যা করেছেন।
কেউ বলেনÑ লক্ষ্মী পালিয়ে বাংলাদেশে ফেরত আসলে রমেশ বসু পাগল হয়ে যায় এবং শহর বাসের নিচে চাপা পড়ে মরেছেন। কেউ বলেনÑ লক্ষ্মীই তার বাপকে ভাতের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়েছে, যাতে সে কৃষ্ণনগরে এসে ধীরেন বিশ্বাসকে বিয়ে করতে পারে। কারণ রমেশ বসু জীবিত থাকতে নিরোদ বিশ্বাসের মতো চিরশত্র“র ছেলের সঙ্গে মেয়ের বিয়ে যে কোনদিনই হওয়া সম্ভব নয়। হয়তো লক্ষ্মীরাণী ওরকম কিছু একটা করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে পারে। এ বিষয়ে লক্ষ্মীরাণী প্রথম দিকে যা বলত তা কী সত্যি?
Ñ রেলে পা কাঁটার পর থাইকা বাবার মুখের কথা বন্ধ।
যে রাতে আমারা ভারতে যাই, সেই রাত থাইকাই বাবায় অবশ্য কথা কম কইতো। ক্ষণেক্ষণে একা একা শুধু প্রলাপ বকতোÑ ‘নাই, নাই, দ্যাশে বিচার নাই। আবার কহনো কইতোÑ ‘সব অমানুষ। ঠাকুর আমায় লইয়া যাও, গো। ’ সেদিন আছিল শনিবার।
আমি গ্যাছি ধর্মতলায় কম দামের চাল কেনতে। লোম্বা লাইন। ভাদ্দোর মাসের খরায় আড়াই ঘন্টা খারাই থাইকা ট্যাবিলের কাছে যাওয়ার পর, ওপাশ থাইকা ঘোষণা আইলÑ ‘আজকের মত চাল বিক্রি বন্ধ। আপনারা অযথা ভিড় করবেন না। আমাদেরকে হিসাব মিলাইতে দিন।
’ অগত্যা চাল ছাড়াই ধর্মতলা থাইকা পায় হাঁইটা আইসা দ্যাখি, মোগো খুপরি ঘরের সামনে ব্যাবাক জটলা। মায়ের আথালি-পাথালি কাঁন্দন। লোক ঠেইলা ভিতরে ঢুইক্কা দ্যাহি- বাবায় অজ্ঞান হইয়া পাইরা আছে। বাবার গায়ে আছিল হরে-কৃষ্ণ হরে-রাম লেহা গেরুয়া ধুতি। পরে মাইনসে হেইসহ বাবায়রে শ্মশানে নেয়।
রমেশ বসুর পরলোকে যাবার খবর লক্ষীরাণী কৃষ্ণনগরে আসার অনেক আগেই গোটা দশমহলের মানুষ জানল। কিন্তু রমেশ বসুর পরিবার ভারতে যাবার পর নিরোদ বিশ্বাস কি পেরেছেন মামলায় জেতা জমির ষোলো আনা ভোগ করতে? যে জমির মামলায় বিগত কয়েক পুরুষের বসু আর বিশ্বাস গোষ্ঠীর সুগভীর সম্পর্কে মাত্র কুঁড়ি বছরের মধ্যে চিতা জ্বলল, সেই জমির ভোগদখল নিরোদ বিশ্বাস পুরোপুরি পেতে না পেতে সাত বছরের মধ্যে তো তারও চিতায় যাবার খবর আসল। পুত্রবধূর হাতে ইলিশ-পোলাউ খাবার কতো শখ ছিল লোকটার। দশমহলে কম করে হলেও বারোটা মেয়ে যাচাই করেছেন নিরোদ বিশ্বাস। সেই শখ কি তাঁর পূরণ হয়েছিল? মামলায় জিতে রমেশ বসুর অনুকরণে বাড়িতে অনেক খরচ করে কীর্তন দিয়ে কতো জনকে খাওয়াতে পেরেছিলেন নিরোদ বিশ্বাস? আত্মীয়স্বজন ছাড়া দশমহলের কেউ তো গেল না সেই গান শুনতে।
আদালতের রায় বুঝলাম নিরোদ বিশ্বাসের পক্ষে গেছে। তাই বলে কৃষ্ণনগরের মানুষ কি নিরোদ বিশ্বাসকে জমির মালিক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে? নইলে এতো জমিজমা, এতো সম্পত্তি, এতো আধিপত্যের পরেও পুরো দশমহলের একটা মেয়েকে কেন পুত্রবধূ করতে পারলেন না নিরোদ বিশ্বাস? নিরোধ বিশ্বাসের মৃত্যুর পরেই তাই ধীরেন বিশ্বাসকে বিয়ে করতে হলো এই আশায় যে, কখন আবার তার মায়েরও ওপার থেকে ডাক আসে। আর তুলসীর সঙ্গে বিয়ের পর বছর না ঘুরতেই জন্ম হয় শিখার। তুলসীকে এক কন্যা শিখাকে মানুষ করতে কেনবা এতো কাঠখড় পোড়াতে হয়? হাতের কাজটা করার জন্য কেন তাকে এতো মানুষের দুয়ারে দুয়ারে ঘুরতে হয়?
কিন্তু কৃষ্ণনগরের মানুষগুলো যেন পৃথিবীর সবচেয়ে আজব রহস্যময় প্রাণী। কখন যে তাদের মতিগতি কোন দিকে যায় তা হয়তো স্বয়ং ভগবানের পক্ষেও ঠাওর করা কঠিন।
শিখা যতোই বড়ো হতে লাগল, ততোই মা তুলসীর দুঃখ লাফিয়ে লাফিয়ে ঘুচতে লাগল। বাবা ধীরেন বিশ্বাসকেও কৃষ্ণনগরের সবাই নিরোদ বিশ্বাসের মতো সমাজের সকল কাজে ডাকতে শুরু করল। দশমহলের মানুষ বিশ্বাস আর বসুদের মধুবৃক্ষ প্রতারণা বিষের মতো কলহটা ধীরে ধীরে ভুলে গেল। কিন্তু বারো বছরের মাথায় আবার যখন লক্ষীরাণী কৃষ্ণনগরে এসে উঠল, তখন কেন আবার পুরনো হিসাবটা পাল্টে যেতে থাকলো? মানুষ আসলে মানুষের কী কী দেখতে পছন্দ করে? কী কী না দেখলে মানুষের ভালো লাগে না?
অথচ কতো কিছুই তো হতে পারতো। নিরোদ বিশ্বাসের সঙ্গে রমেশ বসুর জমিজমা নিয়ে মামলা না থাকলে, ধীরেন বিশ্বাসের সঙ্গেই হয়তো লক্ষ্মীরাণী বসুর বিয়ে হতে পারতো।
এমনকি পুরো দশমহলে লক্ষ্মীর যোগ্যপাত্র হিসাব করলে যে কাউকেই তো ওই ধীরেন বিশ্বাসের সঙ্গেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হতো। তাছাড়া মেয়ের যাকেই পছন্দ তাকেই যে রমেশ বসু জামাই বানাবেন- তা তো বাবা-মেয়ের সম্পর্ক দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায়। আর যে রাতে ধীরেন বিশ্বাস রামায়ণ শুনতে গিয়ে রমেশ বসুর বাড়িতে অনেকটা জামাই আদরে ভাত খেতে বাধ্য হলেন, তখন ধীরেন বিশ্বাসকে খাবার পরিবেশনের সময় লক্ষ্মীকে অতিমাত্রায় যতœশীল হতে যাঁরা দেখেছেন, সেই দৃশ্যের খোটা কী ধীরেন বিশ্বাস অস্বীকার করতে পারবেন?
সম্ভব হোক আর না হোক, বারো বছরের মাথায় লক্ষ্মীরাণী যখন আবার কৃষ্ণনগরে এসে উঠল, তখন ওই ধীরেন বিশ্বাস ছাড়া তো দশমহলের আর কোন প্রাণী লক্ষ্মীরাণীকে একটু আশ্রয় পর্যন্ত দেওয়ার জন্য এগিয়ে আসলো না। সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া কোন জাহাজের বন্দরের নিশানা পাওয়ার মতো বাপের ভিটায় অন্তত একটা কুঁড়েঘর লক্ষ্মীরাণীর জন্য তখন কম কিসে? যে কিনা শপথ করেই বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করলÑ প্রয়োজনে ভিক্ষা কইরা খামু, তবু বাপের ভিটায় ঠাঁই আমার চাই। তাই একে যারা ধীরেন বিশ্বাসের দয়া বলে মানেন, তেমনি লক্ষ্মীরাণীর মনের জোর যে মোটেও কম নয়, তা বলার জন্য অন্যপক্ষের দাবি কি উড়িয়ে দেবার মতো?
উড়িয়ে দেবার মতো আরও অনেক কথা আছে।
এই যেমন লক্ষ্মীরাণী যদি ধীরেন বিশ্বাসকে বিয়ে করার উদ্দেশ্য নিয়েই মা-মামাদের সঙ্গে বিবাদ করে, বাপটাকে খুন করে ওভাবে একাকী যাযাবরের মতো বাংলাদেশে ফেরত আসে। তখন কি তার জানার কথা যে, গত বারো বছরে বাংলাদেশের কী কী পরিবর্তন হয়েছে? ধীরেন বিশ্বাসের বা এতোদিনে কী হয়েছে? গোটা দশমহলের বা ওই বারো বছরে কি কি পরিবর্তন হয়েছে? একা লক্ষীরাণীর পক্ষে তখন কোন কোন খবর জানার সাধ্য হয়েছিল? লক্ষ্মীরা যখন ভারতে যায়, তখন বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের অংশ, অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান। আইউব খানের সামরিক শাসনে দিকভ্রষ্ট পূর্ববঙ্গের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি তখন ভীষণ হুমকির মুখে। গোটা দশমহলের হিন্দুরা তখন ভয়ংকর আতঙ্কের মধ্যে বিকল্প কোন উপায় না দেখে একাট্টা হয়ে জোট পাকাল। এডভোকেট কালীদাশ বড়ালের বাবা নগেন্দ্র নাথ বড়াল, মনীন্দ্র মাস্টার, রেবতী বসু, রমেশ বিশ্বাস, কালীদাশ বৌদ্ধ, ডা. সুধীর মন্ডল, মহেন্দ্র নাথ মন্ডল, কানাইলাল মন্ডল, ডা. শিবচন্দ্র হীরা, যোগেশ হালদার, চিত্তরঞ্জন বসু, অনন্ত মজুমদার, প্রভাস মজুমদার, মনীন্দ্রনাথ মজুমদার, জওহরলাল হালদার, নিতাই বিশ্বাস, ধীরেন বিশ্বাসের বাবা নিরোদ বিশ্বাস এবং আরো অনেক গন্যমান্য হিন্দু সমাজপতিরা সেদিন দশমহলে অশোকদের বিশাল উঠোনে মিটিং করলেন।
এই বঙ্গে টিকে থাকতে হলে প্রতিরোধের কোন বিকল্প নেই। যদি মুসলমানেরা সা¤প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধাতে হিন্দুদের উপর কোন ধরণের আক্রমন চালায়, তাহলে হিন্দুরাও তাদেরকে জান থাকতে ছেড়ে দেবেন না। তবে হিন্দুরা আগ মাড়িয়ে মুসলমানদের কখনোই আক্রমন করবে না। সবাই ঘরে ঘরে ঢাল সড়কি, ল্যাজা, রামদা নিয়ে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়ে রইল। সেই সময়ে গোটা দশমহলের হিন্দুরা আত্মরক্ষার্থে যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিল, যার খবর মুসলমানেরাও সহসাই পেয়ে যায়।
মুসলমান সমাজপতিরাও একটা মিটিং বসালেন সাত্তার চেয়ারম্যান সাহেবের উঠোনে। চেয়ারম্যান আবদুস সাত্তার, নূর মোহাম্মদ মোল্লা, পাঁচু মিঞা, অধ্যাপক রেজাউল করিম, জয়নাল আবেদীন হাওলাদার, আবদুর রাজ্জাক, দীন মোহাম্মদ, আবুল কাসেম, মুন্সী ঝিল্লুর রহমান, গোলাম সরোয়ার, আলাউদ্দিন মাস্টারসহ অনেকে সেই মিটিংয়ে সেদিন হিন্দু-মুসলমান স¤প্রীতির পক্ষে কথা বললেন। দশমহলের বাইরে বানিয়ারী, দীঘিরজান, হরিপাগলা, বরইবুনিয়া, মাটিভাঙ্গা, ভাইজোড়া, খাসেরহাট, উমাজুরী, কালিগঞ্জ, আমতলীসহ নাজিরপুর আর চিতলমারী থানার ওই অঞ্চলে সেদিন সা¤প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র হিন্দু-মুসলমান সমাজপতিদের স¤প্রীতির উদ্যোগ আর পারস্পরিক দায়বদ্ধতার কারণে। নইলে পিরোজপুর এবং বাগেরহাট মহকুমার অনেক গ্রামে সেদিন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা লেগেছিল। যেমন কুমারখালী, গজালিয়া, রঘুনাথপুর, বাইনকাঠী, কাঁঠালিয়া, বুইচাকাঠী, রুহিতলাবুনিয়া, চালতাবাড়ি, শাঁখারীকাঠী, শ্রীরামকাঠী, ঘোষখালী, দীর্ঘা, সাচিয়া, মালিখালী, দেউলবাড়ি দোবড়া, বাইশারী, বানড়িপাড়া, স্বরূপকাঠী, জলাবাড়িসহ গোটা দক্ষিণবঙ্গে সেদিন স্বার্থান্বেসী মুসলমানেরা অনেক হিন্দুর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে, জোড় করে তাঁদের বাড়িঘর দখল করেছে, ধন সম্পদ লুট করেছে, এমনকি কুমারী হিন্দু মেয়েদের জোর করে উঠিয়ে নিয়েছে, ধর্ষণ করেছে, মুসলিম ধর্ম গ্রহণে বলপূর্বক বাধ্য করেছে।
গোটা দক্ষিণাঞ্চলে সেদিন হিন্দু-মুসলমান যে দাঙ্গা শুরু হয়ে গিয়েছিল, দশমহল আর এর আশেপাশের কয়েকটা গ্রামে তা প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়েছিল কেবলমাত্র ওইসব অকুতোভয় হিন্দু-মুসলিম সমাজপতিদের পারস্পারিক সমঝোতা আর মহানুভবতায়।
পঁয়ষট্টি সালের পাক-ভারত যুদ্ধ গোটা দশমহল ও তার আশেপাশের দশ গ্রামের হাজার হাজার হিন্দু মুসলিম পরিবারকে যেন সবার উপরে মানুষ সত্যের চিরায়ত বাণীকে আবারো প্রতিষ্ঠা করালো। শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ বুঝি মানুষকে মানুষ আথবা পশু হিসেবে চেনার কৌশল শিখিয়ে দেয়? লক্ষীরাণীর বাবা রমেশ বসু তখন দেশে থাকলে তিনিও যে একই বিষয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিতেন। যা গোটা দশমহলের সবাই আজ বিশ্বাস করবেন। তারপর ছয় বছরের মাথায় সারা বাংলায় দীর্ঘ নয় মাসের এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ গেল।
পুরো মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে গোটা ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।