বাসায় ফিরে বান্ধুবী সিমার কথাগুলো খুব মনে হতে লাগলো মহুয়ার। অনেককাল পর দেখা। বেইলী রোডের একটি মার্কেটে। সেখানেই কথাগুলো হচ্ছিলো। এর আগেও বলেছে অনেকবার।
সেই একই কথা, স্বামীর প্রশংসা । সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তার স্বামীর মত ভাল মানুষ এ দুনিয়াতে নেই। কোন নেশা বা বাজে অভ্যাস করেননা মানুষটা। তাকে অনেক টেককেয়ার করে। যখন যা চায়, তাই কিনে দেয়।
সিমার নিজের হাতেও সবসময় থাকে গাদাগাদা টাকা। আছে তিন-চারটা ব্যাংকের ক্রেডিটকার্ড । ইচ্ছে মত নিজের আনন্দে খরচ করে। কখনও যদি তার শরীর খারাপ হয়, তো কথাই নেই, ব্যবসা-বাণিজ্য সব বাদ দিয়ে সারাক্ষণ স্ত্রীর মাথার কাছে বসে থাকে লোকটা। অথচ দুজনা একই কলেজে লেখাপড়া করেছি।
ছিলামও একই ডিপার্টমেন্টে। লেখাপড়ায় আমি সিমার চেয়ে ভালই ছিলাম। চেহারায় সুন্দরীতো বটেই।
আচ্ছা, আমি কি আমার সাধারণ চাকুরিজীবী স্বামীর প্রতি সন্তুষ্ট না? নিজেকে প্রশ্ন করে মহুয়া। কষ্ট করে হলেও তো সংসারটা ঠিকঠাক ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে বিমল।
হয়তো বাসায় ফিরে সে একটু খেচখেচ করে বেশি । আসলে সব পুরুষ মানুষই চায় অফিস থেকে ফিরে একটু শান্তিতে বিশ্রাম নিতে। কিন্তু দুই কামরার ছোট বাসায় পরিবেশটা সেভাবে রাখা যায় না ছেলেপুলের কারনে। ওরাতো তা বোঝেনা। দুটোইতো শিশু।
একজনের বয়স সাড়ে পাচ বছর। ওপরটি সাড়ে তিন। বাবা বাসায় ফিরলে তারাতো উৎফুল্ল হবেই। লাফিয়ে ঘাড়ের ওপর ওঠার চেষ্টা করে। খুশিতে আটখানা হয়ে যায়।
আর তাদের বাবা হাতে করে কিছু এনে থাকলে তো কথাই নেই, তা দেখার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। খাবার কিছু হলে তখনই ঠোঙা ছিড়ে খাওয়া শুরু করে দেয় সৈকত ও শৈবাল। এনিয়ে কখনও কখনও দুই ভাইয়ের মারামারি থেকে শুরু হয় কান্নাকাটি। আর তখনই বিগড়ে যায় বিমলের মেজাজটা। এমনিতেই তো ছয় তলা পর্যন্ত সিড়ি ভেঙে উপরে উঠতে উঠতে ক্লান্ত হয়ে যায় সে।
মেরুল বাড্ডার এশিয়ান হসপিটালের সামনে বাস থেকে নেমে অনেকটা পথ হেটে আসার পর আমাদের বাসা। দশ নম্বর রাস্তার কাদা-মাটি ছেনে একদম শেষ মাথায় আসতে হয়। রাস্তার অবস্থা এতই খারাপ যে কোন রিক্সাওয়ালা ভেতরে ঢুকতে চায়না। আর আসলেও অল্প একটু পথের জন্য ভাড়া চায় বিশ টাকা। কখনও কখনও পনেরো টাকায় আসতে রাজি হলেও খরচটা করতে ইচ্ছে করেনা বিমলের।
তাই হেটে হেটে বাসায় ফিরে সত্যি সে খুবই ক্লান্ত হয়ে পড়ে।
বিমলকে আর্থিক ভাবে একটু সাহায্য করতে পারলে নিজের কাছে খুব ভাল লাগতো মহুয়ার। আর সেক্ষেত্রে তাকে চাকরি করা ছাড়া অন্য কোন উপায় ভেবে পাওয়া যাচ্ছে না। স্কুলে শিক্ষকতা করার ব্যাপারটা হতো সবচেয়ে ভাল। কিন্তু সে সুযোগ মিলছেনা।
একবার মিলেছিল, যখন শৈবাল পেটে। ডাক্তার ডেটও দিয়ে দিয়েছিল। তাই আর চেষ্টা করা যায়নি। এখনও সমস্যাটা ওদেরকে নিয়ে। সৈকত না হয় মা ছাড়া থাকতে পারে দুপুর পর্যন্ত।
ওর স্কুল থেকে ফিরতে ফিরতে বেজে যায় দুইটা। সমস্যা হচ্ছে শৈবালকে নিয়ে। ও মা ছাড়া থাকবে কি করে সারাদিন। অবশ্য গ্রাম থেকে একটা ভাল কাজের মহিলা আনতে পারলে অনেকটা সমাধান হয়ে যায়। একই সাথে মা'কেও কাছে এনে রাখা যায়।
বাবাতো নেই। গ্রামে দুই ভাই ও তাদের বউ বাচ্চা নিয়ে থাকেন মা। সংসারের সব কাজ এখনও মাকে সামলাতে হয়। বড় বৌদি সুযোগ পেলেই চলে যান বাপের বাড়ি। আর ছোটদার বউতো জিপিএ ফাইভ পাওয়া ছাত্রী।
লেখাপড়া নিয়ে কাটে তার সময়। এসব নিয়ে মায়ের মধ্যে একধরণের দু:খবোধ রয়েছে। কিন্তু তিনি তার দুই ছেলের কাছে কোন অভিযোগ করেন না। মা বরং ঢাকায় আমার কাছে চলে আসলে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবেন বেশি। কত মা'তো জামাইয়ের সংসারে থাকেন।
এতে বরং বিমল খুশি হবে। তার নিজেরতো বাব-মা কেউ বেচে নেই।
আচ্ছা, চাকরি করতে চাওয়ার কথাটা সিমাকে বললে কেমন হয়, মনে মনে ভাবলো মহুয়া। ওর স্বামীতো মস্তবড় ব্যবসায়ী। শুনেছি গুলশান, না বারিধারায় ভদ্রলোকের অফিস।
তার নাকি প্রায় যেতে হয় দেশের বাইরে। অনেক জানাশোনা আছে তার। নিশ্চয় তিনি তার ওখানে অফিসিয়্যাল কোন কাজে লাগিয়ে দিতে পারেন আমাকে। হয়তো সিমার বান্ধুবী হিসেবে আলাদা একটু কদরও থাকতে পারে আমার।
মহুয়া চাকরি করার বিষয়ে মনস্থির করলো।
সকালে নাস্তার টেবিলে বিমলকে বললো সেকথা। সে একটু দ্বিমত করলেও শেষ পর্যন্ত মা'কে এনে রাখা যাবে শুনে তার আপত্তির সুরটা নমনীয় হলো। কিন্তু চাকরিতো আর হুট করে পাওয়া যায়না। পাওয়া গেলেও তা কতটুকু ভাল হবে সেটি দেখার বিষয়। বিশেষ করে একজন নারীর জন্য কতটুকু নিরাপদ এবং চাকরিটা করে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করা যাবে কিনা, সেটিও ভাবার বিষয় আছে বটে।
বিমল বললো, তুমি তোমার বান্ধুবী সিমার সাথে আলাপ করতে পারো। তবে একই সাথে পত্রিকায় প্রকাশিত চাকরির এ্যাডগুলো দেখতে পারো। আমিও খোজ খবর রাখতে থাকলাম। ভাল মনে হলে সেসব জায়গায় তুমি সিভি ড্রপ করলে।
বিমল চলে যাওয়ার পর খবরের কাগজটা হাতে নিলো মহুয়া।
চাকরির বিঞ্জাপনগুলোর দিকে চোখ বুলাতে লাগলো। আর তখনই একটি বিঞ্জাপনের দিকে চোখ আটকে গেলো তার। সম্পুর্ণ ইংরাজিতে লেখা বিঞ্জাপনে বলা হয়েছে, অফিস এক্সিকিউটিভ এবং পার্সোনাল সেক্রেটারি হিসাবে দুটি পদে জরুরী ভিত্তিতে লোক নিয়োগ দেয়া হবে। মহুয়া আরও ভাল ভাবে পড়তে থাকলো । সেখানে জব ডেসক্রিপশন এবং আবেদনের নূন্যতম যোগ্যতার কথা লেখা আছে।
স্মার্ট এবং ইংরাজিতে খুব চটপটে মেয়েদের অগ্রাধিকার দেয়ার কথাও বলা হয়েছে। একথাটা ইদানিং সব চাকরির ক্ষেত্রে বলা থাকে। সুন্দর চেহারা এবং চটপটে হলে তার জয় সবক্ষেত্রে। ইদানিংতো দেশের কোন কোন বেসরকারি ব্যাংকে মেয়েদের নিয়মিত ওজন মাপা হয়। চেষ্টা করা হয় ওজন পয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে রাখার।
সেটি যাই হোক না কেনো, দুটি কারনে এই চাকরির বিঞ্জাপনটা ভাল লাগলো মহুয়ার। শুরুতেই বেতন আঠারো হাজার। ছয় মাস পর চাকরি কনফর্ম হলে বেতন হবে ত্রিশ হাজার।
মহুয়া এবার আয়নার সামনে গিয়ে নিজেকে দেখে। না তার চেহারা দেখে কোন ভাবেই মনে হবেনা সে দুই সন্তানের জননী।
বয়স যে প্রায় আঠাশ হয়ে গেছে তাও বুঝার উপায় নেই। চেহারায় সেই বিশ বছর বয়সের আকর্ষণটা ঠিকই আছে । মনে হচ্ছে সদ্য বোধ হয় কোন প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে বের হলো। এখনও যথেষ্ট স্লিম।
আয়নার সামনে থেকে ফিরে মনে মনে ভাবে মহুয়া, চাকরির ইন্টারভিউ দেয়ার আগে কারোর সাথে আলাপ করা যাবেনা।
সবকিছু কনফর্ম হলে তারপর বিমলকে বলা যাবে। তখন ভাল-মন্দ বিচার করে সে একটা সিদ্ধান্ত দেবে। সিমার কাছে চাকরির জন্য আপাতোত কিছু না বললে হচ্ছে। আগে নিজের মত চেষ্টা করে দেখা যাক। চাকরিটা হলে দুজনার বেতন মিলে মাসে আয় হবে আটত্রিশ হাজার।
সাড়ে আট হাজার টাকা বাড়ি ভাড়া এবং অন্যান্য খরচ মিলে দশ হাজারতো খরচ হচ্ছেই। দুইজনার যাতায়াত মিলে আরও না হয় পাচ হাজার খরচ হলো। তারপরও থেকে যাবে আরও তেইশ হাজার। দু-তিনটা ডিপিএস করেও সংসারটা খুব ভাল ভাবে চলে যাবে আমাদের। তারপর চাকরি কনফর্ম হলেতো আর কথাই নেই।
আমার বেতনতো তখন বিমলের চেয়ে অনেক বেশি হয়ে যাবে। আমার একার টাকাই চলে যাবে সংসার। তখন বাচ্চারাও ভাল মন্দ খেতে পারবে। মাঝের মধ্যে ওদেরকে নিয়ে বাইরে ভাল কোন রেস্তুরেন্টে খেতে পারবো। কতদিনতো রাস্তায় যেতে যেতে দূর থেকে দেখেছি হেলভেশিয়া কিংবা কেএফসির ভেতরটা।
এদিকে শিশুপার্ক ও চিড়িয়াখানা ছাড়া আর কোথাও নেয়া হয়নি বাচ্চাদের।
চাকরিটা পেলে ঘরের দরকারি আসবাপত্র কেনা যাবে। কত কিছুতো নেই। একটা রঙিন টেলিভিশন আছে, তাও সবসময় ঝাপসা এবং গোলাপি রঙ ধারন করে থাকে। ছোট্ট একটা ফ্রিজ আছে ।
সেটি আবার কখনও কখনও বিগড়ে যায়। তেলাপোকাও ঢুকে পড়ে ভেতরে। একটা ছোট আলমারী মধ্যে গাদাগাদি করে রাখতে হয় সবার কাপড়। আর বিমলতো কতদিন ধরে নিজের জন্য কিছু কেনেনা। হাতেগোনা চার-পাচটা শার্ট ঘুরেফিরে পড়ে যায় অফিসে।
আচ্ছা আমার ইনকাম মাসে ত্রিশ হাজার হলে আমি কি একটু অহংকারী হয়ে পড়বো? নিশ্চয় তখন ব্যস্ততার কারনে বাড়ির পেছনের বিলটার ধারে ফুটে থাকা কাশফুল ছুয়ে দেখার সুযোগ মিলবেনা।
কাউকে কিছু না বলে আবেদনের বিষয়ে মনে মনে গুছাতে থাকলো মহুয়া। পুরানো সিভিটা একটু ঠিকঠাক করালো মেরুল বাড্ডার একটি কম্পিউটারের দোকান থেকে। তারপর চুপিচুপি কুরিয়ারে পাঠিয়ে দিলো।
এক সপ্তাহর মধ্যে ওই অফিস থেকে মোবাইল এলো মহুয়ার কাছে।
মিষ্টি কন্ঠে একজন নারী বললেন, আপনি মহুয়া চ্যাটার্জি বলছেন।
- জ্বি বলছি।
আপনি ইমিশন ইন্টারন্যাশনালে অফিস এক্সিকিউটিভ পদে আবেদন করেছিলেন।
- হ্যা, হ্যা, করেছিলাম।
আপনি কি আগামীকাল দুপুর তিনটায় ইন্টারভিউ দিতে প্রস্তুত।
- হু, তবুও একটু ভেবে বলি।
না, ভাবাভাবির কিছু নেই। গত তিন দিন ধরে আমরা দশজন করে প্রার্থীর ইন্টারভিউ নিচ্ছি। আগামীকাল শেষ দিন।
- আচ্ছা চলে আসবো।
কিন্তু কোথায় যোগাযোগ করবো।
অফিসে আসলে আপনি বুঝতে পারবেন।
সারারাত খুব উসফিস করে কাটলো মহুয়ার। কোন ভাবেই বিমলকে টের পেতে দিলোনা তা । আগের দিন রাতে নিচের তলার ভাবীর সাথে হাল্কা আলাপ করেছিল সে।
উদ্দেশ্য ছিল শৈবাল ও সৈকতকে তার বাসায় কিছু সময়ের জন্য রেখে যাওয়ার । বাড্ডা থেকে গুলশান পর্যন্ত গিয়ে ফিরে আসতে সব মিলিয়ে না হয় তিন ঘন্টা সময় গেলো। বিমল ফেরার আগেই চলে আসা গেলো।
ঘড়ির কাটা তখন দুপুর দুইটা ছাড়িয়েছে। আর দেরি করা যাচ্ছেনা ।
"দূর্গা" "দূর্গা" বলতে বলতে বাসা থেকে বের হলো মহুয়া।
একটা সিএনজি নিয়ে রওনা হয়েছিল সে। কিন্তু নতুনবাজারের কাছে এসেই ঘটলো বিপত্তি। বায়ে আমেরিকা এ্যাম্বেসির সামনে দিয়ে সিএনজি নিয়ে যাওয়া গেলোনা। আকস্মিক ওই রাস্তায় চলাচল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
বাধ্য হয়ে সেখানে নেমে হাটা শুরু করলো । প্রচন্ড রোদ। ঘামতে শুরু করেছে তার সারা শরীর। চেহারার মেকাপও গোলতে শুরু করেছে। ঘড়িতে তখন বাজে তিনটা দশ।
আরও খানিকটা পথ হেটে যাওয়ার পর ডানে মোড় নিতেই ৬০ নম্বর ফ্ল্যাট। যাক বাবা পাওয়া গেলো শেষ পর্যন্ত । দ্রুততার সাথে ভেতরে ঢুকলো সে। দুজন সিকিউরিটি গার্ড এগিয়ে এলো। মহুয়া দেখলো, একটি বোর্ডে লেখা আছে কয়েকটি অফিসের নাম এবং ফ্লোর নম্বর।
মহুয়া কারোর সাথে কথা না বলে সরাসরি লিফটে উঠে ছয় নম্বর বোতাম চাপ দিলো।
লিফট থেকে বেরিয়ে মহুয়া বুঝতে পারছেনা কোন দিকে যাবে। চারপাশে চোখ বুলালো সে। বড় বড় দুইটা দরজা। কোথাও কোন নেম প্লেট দেয়া নেই।
চুপচাপ থাকলো কিছুক্ষণ। তারপর একটি দরজার দিকে এগিয়ে যেতে ওপাশ থেকে বেরিয়ে এলো এক লোক। তার দিকে তাকিয়ে মহুয়া বললো, ইমিশন ইন্টারন্যাশনালের অফিস কি এটা?
জ্বি আসুন।
ভেতরে ঢুকতে রিসিপসোনিষ্ট বললো, ম্যাডাম, আপনি কি মহুয়া ?
জ্বি, আমি মহুয়া চ্যাটার্জি।
একটু বসুন।
স্যারের সম্ভাবত বের হয়ে যাওয়ার কথা। আপনার ইন্টারভিউ দেয়ার সময় ছিল তিনটায়। এখন বাজে তিনটা পয়ত্রিশ। মহুয়া চুপ করে থাকলো। মেয়েটি টেলিফোন সেট উচু করে রিং লাগালো।
মহুয়া আশেপাশে তাকালো। অফিসটা বেশ বড়। কাচ দিয়ে ঘেরা চারপাশ। চুপচাপ কম্পিউটার নিয়ে কাজ করছে কয়েকজন। বেশির ভাগই মেয়ে।
সবাইকে দেখা যাচ্ছেনা ঠিকমত। এর মধ্যে রিসিপসনিস্ট মেয়েটা সিকিউরিটি গার্ডকে ডাক দিয়ে বললো, ম্যাডামকে স্যারের রুমটা দেখিয়ে দেন।
মহুয়াকে নিয়ে লোকটা লিফটের সামনে এসে বললো ওই দরজা ঠেলা দিয়ে ভেতরে ঢুকে যান। বুঝা গেলো একই ফ্লোরের দুই পাশ নিয়ে অফিসটা । সে দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলো।
সেখানেও একজন সুন্দরী রয়েছেন একটি ডেস্কে। তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন, ওই রুমটা এমডি স্যারের। চলে যান।
মহুয়া ভেতরে ঢুকতেই মধ্য বয়স্ক একজন ব্যক্তি বললেন, কাম হেয়ার লেডি । সে তার দিকে তাকিয়ে সালাম দিলো।
এমডি বললেন, প্লিজ সিট ডাউন।
- থ্যাংক ইউ স্যার।
এমডি স্যার তার চেহারের দিকে তাকালেন কয়েক সেকেন্ড। তারপর ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টি ফেরালেন। মহুয়া চুপ করে থাকলো।
আবার একটু তাকালেন। আবার ল্যাপটপে কাজে ব্যস্ত হলেন। এভাবে কেটে গেলো তিন-চার মিনিট। অচেনা কোন পুরুষ মানুষের সামনে বসে থাকার কোন অভিঞ্জতা অতীতে কখনও ছিলনা তার। মহুয়া বুঝে পাচ্ছেনা, এটা কেমন ধরনের ইন্টারভিউ।
আর কেউ নেই। এমডি একা একা ইন্টারভিউ নেবেন। কিন্তু তার ভাবটাও ইন্টারভিউ নেয়ার মত মনে হচ্ছেনা। থুতনির কাছে হাত রেখে তাকিয়ে আছেন। কখনও আমার দিকে, কখনও বা ল্যাপটপের দিকে।
কি ভাবছেন উনি? ত্রিশ-চল্লিশ মিনিট লেট করে আসাতে কি প্রার্থী সম্পর্কে একধরণের বিরুপ ধারণা তৈরি হয়ে গেছে উনার। তাই হয়তো তিনি নিজেও ভাবছেন কি বলে বিদায় জানাবেন ভদ্রমহিলাকে।
আরও কিছু সময় নীরবতার মধ্যে কাটলো। তারপর এমডি প্রশ্ন করলেন, আপনার বাসা কোথায়?
- স্যার বাড্ডাতে।
খুব বেশি দূরেও নয়।
তাড়াহুড়া করে এসেছেন বুঝি।
মহুয়া চুপ থাকলো।
আপনি বুঝি আমার কথা বুঝতে পারেননি।
- কোনটা স্যার?
এই যে বললাম, তাড়াহুড়া করে এসেছেন কিনা।
- জ্বি স্যার, একটু দেরি হয়ে গেছে ।
আসলে আমেরিকা এ্যাম্বাসির সামনে গাড়ি ছেড়ে বাকিটা পথ হাটতে হয়েছে।
এমডি এবার তার টেবিলেরর পরে থাকা মহুয়ার সিভির দিকে চোখ বুলালো। কিছুক্ষণ পর তিনি বললেন, আপনি কি পারফিউম ব্যবহার করেন?
- স্যার নামটা ঠিক জানিনা। আমার হাসবেন্ডের বন্ধু লন্ডন থেকে পাঠিয়েছিল।
পারফিউমটা ভাল।
আপনার শরীরে মেখে আসা পারফিউম এবং ঘামের গন্ধ মিলে অন্যরকম একটা ঘ্রাণ ভেসে আসছে।
- সরি স্যার।
না, না, দু:খিত হওয়ার কিছু নেই। আমার কাছে ঘ্রাণটা খারাপ লাগছেনা। তাই চুপচাপ আপনার শরীরের ঘ্রাণ নিচ্ছিলাম।
এত চমৎকার গন্ধ আমি কখনও পাইনি।
মহুয়া থান্ডার মেরে গেলো। লাল হতে শুরু হলো তার মুখ । মাথা নিচু করে থাকলো কিছুক্ষণ। এমডি বলতে লাগলেন, আমার কথায় লজ্বিত হওয়ার কিছু নেই।
আমি খুব খোলা মনের মানুষ। অস্বীকার করার কিছু নেই যে, আপনার শরীরের গন্ধটা আমার ভাল লাগেনি। কেমন জানি এক ধরণের ঘোর তৈরি করেছে। ডোন্ট মাইন্ড লেডি।
যার আগমনে সারা ঘরে মিষ্টি একটা গন্ধ ছড়িয়ে যায়, তাকে আমার অফিসে সুযোগ না দেয়াটা অন্যায় হবে।
আর তাই আপনার আর কোন যোগ্যতার বিষয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই। কোম্পানীর নিয়ম অনুযায়ী আপনি বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাবেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে আমার এখানে কর্মরত অধিকাংশ মেয়ে অবিবাহিতা। তবে আপনার মত কেউ কেউ আছেন, যারা অফিস সামলাচ্ছেন, বসকে সামলাচ্ছেন, আবার ঘর সংসারও করছেন। তারা সবকিছু এত চমৎকার ভাবে ম্যানেজ করে চলেন, তা নিয়ে কখনও স্বামীর সাথে অবিশ্বাস সৃষ্টি হওয়ার মত কিছু ঘটেনা।
আপনি নিশ্চয় ইন্টিলিজেন্ট, মিসেস চ্যাটার্জি।
সরি স্যার । আমি এখানে চাকরি করবো না। কথাটা বলেই এমডির রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো মহুয়া। সোজা নিচে নেমে হাটতে শুরু করলো ।
ব্যাগের মধ্যে তখন অনাবরত বাজছে মোবাইল। চেন খুলে বের করতেই দেখে সিমার কল।
- হ্যা সিমা বল।
কতক্ষণ ধরে কল দিচ্ছি, ধরছিস না কেনো।
- এইতো রে, খেয়াল করিনি।
আমিতো বাড্ডা দিয়ে যাচ্ছিলাম। ভাবলাম তোর ওখান দিয়ে ঘুরে যাই। তাই ফোন দিয়েছিলনাম। এখনতো নতুনবাজারের কাছে চলে এসেছি। বাসায় যাচ্ছি।
- আমিওতো নতুনবাজারের কাছে।
ওখানে কেনো।
- এসেছিলাম একটা কাজে।
তুই রাস্তার বা পাশে ব্রিজটার নিচে দাড়া। আমি চলে এসেছি।
কোন কথা শুনলোনা সিমা। একপ্রকার জোর করেই তাকে উঠিয়ে নিলো গাড়িতে। সেও চুপচাপ বসে পড়লো। তার চেহারাটা খুব মলিন হয়ে রয়েছে। মেজাজও বেশ খারাপ।
কত বাজে লোকটা। ভদ্রলোকের মুখোশ পরে রয়েছে। এরা সরাসরি কিছু বলেনা। আকারে বুঝিয়ে দেয়। রাজি থাকলে আসো।
না থাকলে যাও। নিজের কাছে নিজেকে খুব ছোট লাগছে মহুয়ার। কিন্তু সেটি সিমার কাছে খোলসা করতেও ইচ্ছে করছেনা তার। কত ব্যবধান দুই বান্ধুবীর মধ্যে। একজন কোটিপতি ব্যবসায়ীর স্ত্রী।
আর অপরজন সাধারণ এক চাকুরিজীবীর বউ। স্বামীর একার আয়ে সংসার চলছেনা বলেই তাকে চাকরির সন্ধানে নামতে হয়েছে ।
দেখতে দেখতে তারা্ চলে এলো সিমার বাসার সামনে। যমুনা ফিউচার পার্কের পাশ দিয়ে কিছুটা যাওয়ার পর বাসাটা। ভেতরে ঢুকেই সিমা ব্যস্ত হয়ে গেলো মহুয়াকে তার ঘর-বাড়ি দেখাতে।
রান্নাঘর, ডায়নিং স্পেস, বারান্দা, গেস্টরুম দেখিয়ে তাকে নিয়ে এসে বসলো ড্রয়িংরুমে। সিমা বললো, চল আগে নাস্তা পানি কিছু খেয়ে নেই। তারপর বেডরুমে বসে দুজনা গল্প করবো। এর মধ্যে টেবিলে কেক, মিষ্টি, চানাচুর ও ঘরে বানানো পায়েশ রেডি করে তাদেরকে আসতে বললো কাজের বুয়া। খেতে খেতে দুজনার কথা চলতে থাকলো।
সিমা জানতে চায়লো, আচ্ছা মহুয়া, তুই নতুনবাজারের ওদিকে কোথায় গিয়েছিলি। আমার সাহেবের অফিসতো ওদিকেই।
- গিয়েছিলাম একটি কাজে। মহুয়া জবাব দিলো।
কি কাজে?
- সেকথা না হয় পরে শুনিস।
আজ চলিরে।
যাবি কেনো?
- পাশের বাসার ভাবীর কাছে বাচ্চা দুটোকে রেখে এসেছি। মা ছাড়া থাকা ওদের অভ্যাস নেই ।
তুই আমার বরের সাথে দেখা করে যাবিনা ? ইকবাল এখনই চলে আসবে।
মহুয়া চুপ থাকলো।
সেটিও ঠিক, মানুষটার সাথে দেখা হওয়া জরুরি । পরিচয় হয়ে থাকলে পরে একসময় চাকরির কথা বলা যাবে ।
ডায়নিং রুম থেকে ওরা চলে আসলো বেডরুমে। আর তখনই কলিং বেলের টুং টাং শব্দ। সিমা বললো, ওই যে ইকবাল চলে এসেছে।
তুই বোস। আমি দরজা খুলে দিয়ে আসি। বুয়াটা কানে কম শোনেতো।
সিমা চলে গেলো। মহুয়া চোখ বুলাতে লাগলো সারা ঘরে।
অনেক বড় বেডরুম। ওয়ালের সাথে আলমারি। কর্ণারে লম্বা সেলফ। সেখানে অনেক শোপিস রাখা। টাকা থাকলে আসলে সারা ঘরে নানা ধরণের শোপিস সাজিয়ে রাখা যায়।
ফুলদানি। ঝারবাতি। নবাব আমলে ব্যবহৃত পিতলের তরবারিও রয়েছে তাদের বেডরুমের দেয়ালে। এমনই নান কিছু দেখতে দেখতে দেওয়ালে ঝুলে থাকা সিমা ও তার স্বামীর ছবিটার দিকে চোখ গেলো মহুয়ার। এগিয়ে গেলো সেদিকে।
ইনি তাহলে সিমার স্বামী ইকবাল সাহেব । যার কোন বাজে অভ্যাস নেই । যিনি ক্লাবে গিয়ে আড্ডা মারেননা। মদও খাননা।
ততক্ষুণে ঘরে ঢুকেও পড়েছে সিমা।
ওর দিকে তাকিয়ে বললো, তোকে আর ছবি দেখতে হবেনা। পেছনে ফের। চাক্ষুস দেখ আমার স্বামীকে। কথাটা কানে আসতেই যেন ঘেন্নায় গুলিয়ে উঠলো মহুয়ার শরীর। এক মুহুর্তের জন্য তার আর ইচ্ছে করলো থাকতে ।
বেরিয়েও পড়লো চুপচাপ। বাসার কাছকাছি আসতেই দেখলো বিমলও চলে এসেছে। বৃষ্টিতে দুজনা ভিজেও গেছে খানিকটা ।
মহুয়া বললো, চলোনা ছাদে যাই। সুখের বৃষ্টিতে স্নাত হই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।