আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জেলসুপার তিন রুমাল দেখিয়ে পাঁচ খুনির ফাঁসি দিলেন যেভাবে

সত্যের চেয়ে অপ্রিয় আর কিছু নেই

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় দণ্ডপ্রাপ্ত ৫ খুনিকে গত বুধবার দিবাগত রাত ১২টা ৫ মিনিট থেকে ১টা ৫ মিনিটের মধ্যে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এই ফাঁসি কার্যকর করতে ১২ জন জল্লাদ অংশ নেয়। তাদের মধ্যে প্রধান দুই জল্লাদ হাফিজ উদ্দিন ও মো. শাহজাহান ভুঁইয়া ৫ খুনিকে ফাঁসিতে ঝোলানোর মূল দায়িত্ব পালন করে। বাকি ১০ জন আনুষঙ্গিক কাজে সহযোগিতা করে। খুলনার কুখ্যাত সন্ত্রাসী এরশাদ শিকদারের ফাঁসিও কার্যকর করেছিল জল্লাদ শাহজাহান ভুঁইয়া।

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেল সুপার তৌহিদুল ইসলাম ফাঁসি কার্যকর করতে তিনটি রুমাল ব্যবহার করেন। চার দিনের মহড়া ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার চার দিন আগে অর্থাৎ ২৪ জানুয়ারি ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে জেল সুপার তৌহিদুল ইসলামের নেতৃত্বে ট্রায়াল দেয়া হয়। বালির বস্তা দিয়ে চলে এই মহড়ার কাজ। মহড়ায় জল্লাদ শাহজাহান ভুঁইয়াসহ ১২ জল্লাদই অংশ নেয়। ফাঁসির মঞ্চে দুই ঘণ্টা ধরে এই মহড়া চলে।

একদিনের মহড়ায় ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর বিষয়টি সম্পর্কে তাদের সঠিক ধারণা চূড়ান্ত করা হয়। গতকাল বৃহস্পতিবার সিনিয়র জেল সুপারসহ ফাঁসির আদেশ কার্যকর করার সঙ্গে জড়িত অন্যান্যের সঙ্গে আলাপে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বিস্তারিত তথ্য জানান। যেভাবে ফাঁসি কার্যকর করা হয় রাত ৯টা থেকে সাড়ে ৯টায় ৫ খুনি লে. কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব.) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমদ (আর্টিলারি), মেজর (অব.) একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও মেজর (অব.) বজলুল হুদা কনডেমড সেলে স্বাভাবিকভাবে রাতের খাবার খেয়েছেন। এর আগে তাদের আত্মীয়-স্বজন দেখা করে যান। আত্মীয়-স্বজনকে বুঝতে দেয়া হয়নি ঐ রাতেই ৫ বন্দির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হবে।

রাত সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় কারাগারে মসজিদের ইমাম হাফেজ মো. মনির হোসেনকে সঙ্গে নিয়ে জেল সুপার ৫ খুনির কনডেমড সেলে যান। ঐ সময় ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার উপস্থিত ছিলেন। তখনই ৫ খুনি বুঝতে পারেন যে, তাদের ফাঁসি কার্যকর হবে। জেল সুপার তাদেরকে জানিয়ে দেন যে, এটাই আপনাদের শেষ রাত। এই রাতেই আপনাদের ফাঁসি কার্যকর করা হবে।

এখন আপনাদের তওবা পড়তে হবে। ইমাম প্রথমে সৈয়দ ফারুক রহমানকে এবং পরে সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার), বজলুল হুদা ও মহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) তওবা পড়ান। তারা তওবা পড়েন ঠিকমত। এরপর তারা হতবিহ্বল হয়ে পড়েন। সাড়ে ১১টার মধ্যে তওবা পড়ার কাজ শেষ হয়।

জল্লাদ রাত ১১টা ৫৫ মিনিটে সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে পিছনে হাত বেঁধে মুখে কালো টুপি পরায়। ফাঁসির মঞ্চের পাশে অতিথিদের জন্য সামিয়ানা টানিয়ে বসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে আইজি (প্রিজন) ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, অতিরিক্ত আইজি (প্রিজন) কর্নেল সৈয়দ ইফতেখার উদ্দিন, ঢাকার জেলা প্রশাসক জিল্লার রহমান ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক অমিতাভ সরকার, মহানগর পুলিশ কমিশনার একেএম শহীদুল হক, ডিআইজি (প্রিজন) গোলাম হায়দার ও ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন (ঢাকা) ডা. মুশফিকুর রহমান উপস্থিত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুস সোবহান সিকদার কারাগারে জেল সুপারের কক্ষে বসা ছিলেন। তিনি ফাঁসির মঞ্চের কাছে যাননি।

রাত ১২টা ৫ মিনিটে সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানকে ফাঁসির মঞ্চে আনা হয়। তাদের গলায় রশি পরিয়ে দেয়া হয় এবং দুই পা বেঁধে ফেলা হয়। জেল সুপার রুমাল হাতে নিয়ে ফাঁসির মঞ্চের কাছে দাঁড়িয়ে থাকেন। জল্লাদ তার রুমালের দিকে নজর রাখে। জেল সুপার রুমালটি নীচে ফেলে দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে জল্লাদ ফাঁসির মঞ্চের লিভারে টান দেয়।

সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের ফাঁসির মঞ্চের পাটাতন পায়ের নীচ থেকে সরে যায়। তাদের গলায় ফাঁসির রজ্জু চেপে বসে এবং দেহ ঝুলন্ত অবস্থায় ৮ থেকে ১০ ফুট নীচে গর্তে ঝুলে পড়ে। ১৫ মিনিট পর তাদের তোলা হয়। ডাক্তার তাদের মৃত বলে ঘোষণা করেন। এর আগে ডাক্তার (ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন) সৈয়দ ফারুক রহমান ও সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খানের ঘাড়ের চামড়া কেটে দেখেন তাদের গলার হাড় ভেঙ্গে গেছে কিনা।

এই হাড় ভাঙ্গলেই মৃত্যুর ব্যাপারে নিশ্চিত হন ডাক্তার। তারপর তিনি দেহ পরীক্ষা করে মৃত ঘোষণা করেন। ১২টা ৩৫ মিনিটে একইভাবে একেএম মহিউদ্দিন (ল্যান্সার) ও বজলুল হুদাকে ফাঁসির মঞ্চে আনা হয়। একই কায়দায় তাদের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। রাত ১টা ৫ মিনিটে সর্বশেষ মহিউদ্দিন আহমেদকে (আর্টিলারি) ফাঁসির মঞ্চে আনা হয়।

তার ফাঁসিও একইভাবে কার্যকর করা হয়। জেল সুপার এই পাঁচ খুনির ফাঁসি কার্যকর করতে তিনটি রুমাল ব্যবহার করেন। ফাঁসি কার্যকর করার পর ইমামের উপস্থিতিতে জল্লাদরা ৫ জন কাফন পরায় এবং কফিনবন্দি করে লাশ গ্রামের বাড়িতে নেয়ার জন্য প্রস্তুত করে দেয়। জেল সুপার তৌহিদুল আলম এর আগে ২০০৭ সালে কাশিমপুর কারাগারে ২টি ও ২০০৮ সালে একই কারাগারে ২টি ফাঁসি কার্যকর করেন। জাতির জনক ও তার পরিবারের সদস্যদের এসব ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়টি তার জীবনে স্মরণীয় ঘটনা হয়ে থাকবে বলে তিনি প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন।

তওবা পড়ালেন যে ইমাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার জামে মসজিদের ইমাম হাফেজ মোঃ মনির হোসেন গতকাল ইত্তেফাককে বলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনিকে ফাঁসির আগে তওবা পড়িয়েছিলেন। তবে ফাঁসির আসামিদের তওবা পড়ানোর কাজ তার জীবনে এটা দ্বিতীয়। এর আগে তিনি নারায়ণগঞ্জ এলাকার একটি হত্যা মামলায় দণ্ডিত রিপনকে ফাঁসি দেয়ার আগে তওবা পড়ান। তিনি কারাগার মসজিদে ৪ বছর যাবৎ ইমাম হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনির প্রত্যেকে স্বাভাবিকভাবে তওবা পড়েন বলে ইমাম জানান।

শেষ রাতের কথা শুনেও তারা স্বাভাবিক বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনিকে ফাঁসির মঞ্চে নেয়ার আগে তওবাসহ আনুষঙ্গিক কার্যক্রম শেষ করার সময় জেলসুপার তাদের জন্য এটাই শেষ রাত বলে জানিয়ে দেন। উত্তরে মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ছাড়া বাকি ৪ জন স্বাভাবিকভাবে উত্তর দেন- ঠিক আছে। তা আমরা বুঝতে পেরেছি। তাদের আত্মীয়-স্বজনকে রাত সাড়ে ১১টায় কারা কর্তৃপক্ষ তাদের ফাঁসির কথা জানিয়ে দেন এবং লাশ গ্রামের বাড়িতে দাফন করা হবে বলেও জানান। মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার আগে ‘আমি অসুস্থ ও আমাকে মাফ করে দেন’ বলে চিৎকার করে দাবি জানান।

একটি ফাঁসি কার্যকর করলে প্রতি জল্লাদের ২ মাস করে সাজা কমে এই ১২ জল্লাদের মধ্যে ৯ জন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের ও ৩ জন গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে হত্যা মামলার যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত বন্দি। তারা ইতিপূর্বে জল্লাদ হিসেবে প্রত্যেকে কয়েক দফা দায়িত্ব পালন করেছে। গত বুধবার ৯টায় কাশিমপুর কারাগার থেকে সর্বশেষ জল্লাদ শাহজাহান ভুঁইয়াকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে নিয়ে আসা হয়। এর আগে এই কারাগার থেকে জল্লাদ মনির ও বাবুলকে আনা হয়। প্রধান জল্লাদ হাফিজ উদ্দিন ও শাহজাহান ভুঁইয়া গত বুধবারের এই ৫টি ফাঁসি নিয়ে এ পর্যন্ত প্রত্যেকে ২২টি করে ফাঁসি কার্যকর করল।

জল্লাদদের মধ্যে তারাই সর্বোচ্চ সংখ্যক ফাঁসি কার্যকর করেছে। জল্লাদ হাফিজ উদ্দিন হত্যা মামলায় চুয়াল্লিশ বছরের কারাদন্ড প্রাপ্ত বন্দি। অপর জল্লাদ শাহজাহান ভুঁইয়ার ৪২ বছর যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত। অপর ১০ জল্লাদের মধ্যে কালু মিয়া ফাঁসি কার্যকর করেছে ১২টি, মাসুদ ৭টি, এস এম কামরুজ্জামান ফারুক ৫টি, তানভীর হাসান রাজু ৯টি, আবুল ৫টি, মোয়াজ্জেম হোসেন ৫টি, মোঃ জালাল বেপারি ৫টি, মোঃ মনির হোসেন ৭টি, শেখ সানোয়ার ৫টি ও মোঃ বাবুল ৭টি ফাঁসি কার্যকর করেছে। প্রতিটি ফাঁসি কার্যকর করার জন্য দুই মাসের সাজা মওকুফ করা হয় বলে কারা কর্তৃপক্ষ জানান।

জেলকোডে এই নিয়ম উল্লেখ রয়েছে। প্রধান জল্লাদ হাফিজ উদ্দিনের বাড়ি গাজীপুর এবং শাহজাহান ভুঁইয়ার বাড়ি নরসিংদী। জীবনে প্রথম এ ধরনের দায়িত্ব পেলেন ডা. মুশফিক ভারপ্রাপ্ত সিভিল সার্জন (ঢাকা) ডাঃ মুশফিকুর রহমান বলেন, তার ৩০ বছরের চাকরি জীবনে এই প্রথম ফাঁসি কার্যকর করার সময় দায়িত্ব পালন করলেন। গত বুধবার রাত সোয়া ৮টায় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে তাকে বঙ্গবন্ধুর ৫ খুনির ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়টি জানানো হয়। এই সংবাদ পেয়ে তিনি রাত সাড়ে ১০টায় কেন্দ্রীয় কারাগারে যান।

৫ খুনির স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তারা সবাই সুস্থ বলে তিনি কারা কর্তৃপক্ষকে জানান। এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনায় দায়িত্ব পালন করতে পেরে তিনি নিজকে ধন্য মনে করেন। জীবনের প্রথম ফাঁসি দেখতে যেতে প্রথমে খারাপ লেগেছিল। পরে ঠিক হয়ে যায়।

মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি) অসুস্থ বলে দাবি করে এবং তাকে মাফ করে দেয়ার অনুরোধ জানান। তিনি ডায়াবেটিস ও ব্লাড প্রেসারজনিত সমস্যায় ভুগলেও তার শারীরিক অবস্থা স্বাভাবিক এবং রোগ নিয়ন্ত্রণে ছিল বলে ডাঃ মুশফিকুর জানান। সুত্র : ttp://ittefaq.com.bd

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।