বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল সেতু নির্মিত হচ্ছে বাংলাদেশে। এর নাম পদ্মা সেতু। বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ চীনের হাঙজু বে ব্রিজের চেয়েও এর ব্যয় ৬ হাজার ৩শ’ কোটি টাকা বেশি। অথচ বাংলাদেশের এ সেতুর চেয়ে হাঙজু বে ব্রিজ প্রায় ছয়গুণ বড়। মাত্র এক বছর আগে হাঙজু সেতুর কাজ শেষ হয়েছে।
হাংজু বে ব্রিজ ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ। আর পদ্মা সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। কেউ হিসাব মেলাতে পারছেন না কেন এত অস্বাভাবিক ব্যয় ধরা হলো পদ্মা ব্রিজের? এ নিয়ে হৈচৈ পড়ে গেছে দেশজুড়ে।
বাংলাদেশের বৃহত্তম সেতু হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণের সর্বশেষ ব্যয় ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ২৯ ডিসেম্বর তৃতীয় বুড়িগঙ্গা সেতুর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনকালে তিনি জানান, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ২৬০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৮ হাজার ২শ’ কোটি টাকা।
এর মাত্র ১০ দিন আগে ২১ ডিসেম্বর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত পদ্মা সেতুর অর্থায়ন বিষয়ক আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের জানান, এ ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হবে ২৪০ কোটি মার্কিন ডলার বা ১৬ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা। গত অক্টোবরে যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণে ব্যয় হবে ১৯০ কোটি মার্কিন ডলার। ২০০৭ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ১০ হাজার ১৬১ কোটি ৭৫ লাখ টাকা বা ১৪৭ কোটি ২৭ লাখ ডলারে প্রথম প্রকল্পটি অনুমোদন করেছিল। বলা হয়েছিল, ২০১৫ সালের মধ্যে সেতু তৈরি হবে। জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সির (জাইকা) সুপারিশ মেনে ২০০৪ সালে মাওয়া-জাজিরা পয়েন্টে স্থিরকৃত পদ্মা সেতু নির্মাণে সম্ভাব্য ব্যয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ধরা হয়েছিল ১৪০ কোটি ডলার।
অর্থাত্ নির্মাণ ব্যয় বেড়ে গেছে দ্বিগুণ। সর্বশেষ গতকাল পদ্মা সেতু বিশেষজ্ঞ প্যানেলের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী জানান, এ সেতু নির্মাণে ব্যয় আরও বৃদ্ধি পাবে।
মাওয়া থেকে জাজিরা পর্যন্ত চার লেনবিশিষ্ট পদ্মা সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছে ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার এবং প্রস্থ ২৩ দশমিক ৬ মিটার। দ্বিতল এ সেতুর ওপরে সড়ক আর নিচ দিয়ে যাবে রেলপথ।
অথচ আধুনিক স্থাপত্যবিদ্যার অসাধারণ নিদর্শন হিসেবে স্বীকৃত চীনের হাঙজু ব্রিজ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ১৭০ কোটি মার্কিন ডলার।
এ ব্রিজের দৈর্ঘ্য ৩৬ কিলোমিটার। যা পদ্মা সেতুর চেয়ে প্রায় ছয়গুণ বড়। তাছাড়া পদ্মা সেতু তৈরি হচ্ছে নদীর ওপর; আর হাংজু তৈরি করা হয়েছে সাগরের বুক চিরে। চীনের হাংজু উপসাগরের ওপর ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সেতু সাড়ে তিন বছরে শেষ করে গত বছর সেতুটি উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। চীনে আরও একটি সেতু তৈরির কাজ শুরু হয়েছে এবছর।
এ সেতু ৫০ কিলোমিটার লম্বা। হংকং থেকে সেতুটি শুরু হয়ে সমুদ্রের বুক চিরে চলে যাবে চীনের ম্যাকাও ও জুহাই এলাকায়। এর মধ্যে সাড়ে পাঁচ কিলোমিটার সেতু সাগরে ডুবন্ত অবস্থায় থাকবে। অর্থাত্ এটা হবে টানেল। এ সেতুর কাজ শেষ হবে ২০১৫ সালে।
স্থায়িত্ব ধরা হয়েছে ১২০ বছর। পৃথিবীতে এত বড় সেতু আর দ্বিতীয়টি নেই। সেতুটির নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ১ হাজার ৭০ কোটি মার্কিন ডলার।
মালয়েশিয়ার পেনাং সেতুর দৈর্ঘ্য ১৩ দশমিক ৫ কিলোমিটার। এ সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ২৩০ কোটি ডলার বা ৮০ কোটি রিংগিত।
এ সেতুটি তৈরি করেছে হুন্দাই কোম্পানি।
কোরিয়ার ইনচিয়ন সেতুর দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩ কিলোমিটার। এ সেতুটি নির্মাণ করতে ব্যয় হয়েছে ১৪০ কোটি ডলার বা ৯ হাজার ৮শ’ কোটি টাকা।
ভারতে ৫ কিলোমিটারেরও বেশি দীর্ঘ রাজীব গান্ধী সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪০ কোটি ডলার বা ২ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা।
পদ্মা সেতুর ব্যয় নির্ণয় নিয়ে প্রশ্ন ওঠার অন্যতম কারণ হচ্ছে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ যমুনা সেতু নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল ৪ হাজার কোটি টাকা।
১৯৯৫ সালের ১০ এপ্রিল এ সেতুর কাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯৯৮ সালের জুন মাসে। যমুনা সেতুর চেয়ে মাত্র ১ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার বড় পদ্মা সেতুর ব্যয় ধরা হয়েছে ১৮ হাজার ২শ’ কোটি টাকা। অর্থাত্ ১৪ হাজার ২শ’ কোটি টাকা বেশি। যা যমুনা সেতুর চেয়ে সাড়ে চারগুণ বেশি। এছাড়াও লালন শাহ সেতু, খানজাহান আলী সেতু এবং বাংলাদেশ-যুক্তরাজ্য মৈত্রী সেতু নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হয়েছে ৬শ’ কোটি টাকা।
যোগাযোগ মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, পদ্মা সেতু নির্মাণের জন্য বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (আইডিবি) থেকে ঋণ নেয়া হবে। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংক ১ দশমিক ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, এডিবি ৫৫ কোটি মার্কিন ডলার এবং আইডিবি দেবে ১২ কোটি মার্কিন ডলার। এছাড়া জাইকা ৩০ কোটি মার্কিন ডলার এবং আবুধাবি ডেভেলপমেন্ট গ্রুপ ৩ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ধার দেবে। বাকি টাকা বন্ড, মোবাইলে সারচার্জ ও অন্যান্য পন্থায় সংগ্রহ করা হবে।
পরামর্শক প্রতিষ্ঠানকে নিয়েও বিতর্ক দেখা দিয়েছে।
নিউজিল্যান্ডভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মোনসেল-এইকম লিমিটেডকে প্রস্তাবিত পদ্মা সেতুর নকশা প্রণয়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ২০০৯ সালের জানুয়ারি মাসে ১১৪ কোটি টাকায় মোনসেলকে নিয়োগ দেয়া হয়। এখন নকশা প্রণয়নে বাজেট দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮৫ কোটি টাকা। জানা যায়, মোনসেল-এইকম ১৯৯০ সালে প্রতিষ্ঠিত কনসালটেন্সি কোম্পানি। পদ্মা সেতুর মতো রেল ও রোড সুবিধা সংবলিত বড় মাপের ব্রিজ ডিজাইন করার কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা এদের নেই।
তাদের এযাবত্কালের সবচেয়ে বড় ব্রিজ প্রজেক্ট বলতে থাইল্যান্ডের মেকং রিভার থাই-লাও ফ্রেন্ডশিপ সেতু। এ সেতুর দৈর্ঘ্য ১ দশমিক ১৭ কিলোমিটার। তাও এই ব্রিজের শুধু ফিজিবিলিটি স্টাডি করেছিল তারা। পদ্মা ব্রিজের বর্তমান ডিজাইন, ডাবল লেয়ার স্টিল সুপার স্ট্রাকচার অথবা সিঙ্গেল লেয়ার কংক্রিট সুপার স্ট্রাকচারের ব্রিজ ডিজাইন করার কোনো পূর্বঅভিজ্ঞতা মোনসেল-এইকমের নেই।
পদ্মা সেতুর বিশেষজ্ঞ প্যানেল চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী আমার দেশ-এর সঙ্গে আলাপকালে জানান, পদ্মা সেতুতে রেল ও সড়ক উভয় সুবিধা থাকছে।
তাছাড়া ১২০ মিটার গভীরে গিয়ে এ সেতুর কাজ করতে হবে। এজন্য এত বেশি ব্যয় হচ্ছে। তিনি জানান, ২৪০ কোটি ডলারেও পদ্মা সেতু তৈরি সম্ভব হবে না। ব্রিজ তৈরিকালীন ৩ বছরের সুদ হিসাব করলে এ ব্যয় আরও বাড়বে। ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী বলেন, পদ্মা সেতুর ব্যয়ের যে হিসাব দেয়া হয়েছে, তা প্রিলিমিনারি।
বিশেষজ্ঞ প্যানেল সদস্য ড. আইনুন নিশাত জানান, বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ হাঙজু সেতুর চেয়েও পদ্মা সেতুর ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ হচ্ছে পদ্মায় নদীশাসনে ব্যয় হচ্ছে প্রচুর অর্থ। এছাড়াও পদ্মা সেতুতে হেভি লোড বহন করার মতো রেললাইন ও সড়ক থাকছে। উপরন্তু জমি অধিগ্রহণ, পুনর্বাসনে অনেক ব্যয় হচ্ছে। তিনি বলেন, যমুনা সেতু নির্মাণের সময়ও সেতু নির্মাণ ব্যয়ের চেয়ে নদীশাসনে খরচ হয়েছিল বেশি।
যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেনের সঙ্গে বার বার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।
তবে সেতু বিভাগের সচিব জাহিদ হোসেন জানান, নদীশাসনে প্রচুর অর্থ ব্যয় হওয়ার কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণ ব্যয়ও বেড়ে গেছে। তিনি জানান, যমুনা সেতু তৈরি হয়েছে ১০ বছর আগে, তখন জিনিসপত্রের দাম অনেক কম ছিল। তাছাড়া পদ্মা দ্বিতল সেতু। আকারেও বড়। যমুনা সেতুর চেয়ে এ সেতু অনেক মজবুত করে তৈরি করা হচ্ছে।
তাই এর ব্যয়ও বেড়েছে। বিশ্বের সর্ববৃহত্ হাঙজু সেতুর চেয়েও পদ্মা সেতুর ব্যয় বেশি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি জানান, পদ্মার মতো বৈরী পরিবেশ ছিল না হাঙজু উপসাগরে। যমুনা সেতুর চেয়ে চারগুণ বেশি ব্যয় অস্বাভাবিক মনে করেন কিনা—এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এটি একটি প্রিলিমিনারি হিসাব। এটি নিয়োগপ্রাপ্ত কনসালটেন্সি প্রতিষ্ঠান দিয়েছে।
এখানে দেখুন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।