আমি খুবই Innocent...!!!
চাই সচেতনতার বাস্তব প্রয়োগ
আপেল মাহমুদ
বাংলাদেশের সামাজিক সমস্যাগুলোর মধ্যে বাল্যবিবাহ হচ্ছে সবচেয়ে মারাত্মক সমস্যা। বর্তমানে বাল্যবিবাহ এমন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে যে এটি নারী নির্যাতন ও জনসংখ্যা বিস্ফোরণের অন্যতম কারণ হিসাবে আখ্যায়িত হচ্ছে।
দেশে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে নারীরা। যে সময় একজন নারীর স্কুলে যাওয়ার কথা সেই সময় তাকে ধর্ম ও সামাজিক নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। লেখাপড়া ও খেলার সময়ে বিয়ে দিয়ে একজন পুরুষের পুতুল খেলার সামগ্রী হিসাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না এ সম্পর্কে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেন, বাল্যবিবাহ বন্ধ হচ্ছে না এর মূল কারণ হচ্ছে আমাদের সংস্কৃতি বিবাহের সংস্কৃতি তবে বর্তমানে আমরা একটি প্রক্রিয়ার মধ্যে গড়ে উঠছি। তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের ফলে সারাবিশ্ব ঘরের কাছে এসেছে। ফলে মেয়েরা আগের চেয়ে অনেকে বেশি সুযোগ পাচ্ছে। এতে সে স্বাবলম্বী হতে পারছে। ফলে সচেতন পরিবারে বাল্যবিবাহের সুযোগ থাকছে না।
আমাদের দেশে বাল্যবিবাহ গ্রামে বা বিশেষ এলাকায় হচ্ছে। এসব পরিবারের বাবা-মা মনে করে এটি বিয়ের সঠিক সময় মেয়েকে বিয়ে দিতে হবে। ফলে বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
অনেক সময় বয়স্ক লোক যৌতুক ছাড়া কম বয়সী মেয়েদের বিয়ের প্রস্তাব দেয়। এক্ষেত্রে দরিদ্র বাবা-মা তাদের কম বয়সী মেয়েকে বিয়ে দিচ্ছে।
আবার অনেক ক্ষেত্রে বিদেশে কাজের কথা বলে বিয়ের শর্তে নারী পাচার করা হচ্ছে। বাবা-মা মনে করে তাদের মেয়ে কাজের জন্য বিদেশে যাচ্ছে কিন্তু তারা বুঝতে পারেন না কি সর্বনাশ করছেন। কিভাবে আমরা বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে পারি এ প্রশ্নে তিনি বলেন, পিতা-মাতাকে বাল্যবিবাহের ধ্যানধারণা থেকে বের করে নিয়ে আসতে হবে। সন্তানকে অল্প বয়সে বিয়ে দেবে না। এমন শর্তে কাজের উৎস সৃষ্টি করে দিতে হবে।
কাজী যেন বেশি বয়স লিখে বিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে না পারে সে দিক থেকে আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
দেশে বাল্যবিবাহ সম্পর্কে বলতে গিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মালেকা বেগম বলেন, ‘গ্রাম অঞ্চলে বাল্যবিবাহ বেশি হচ্ছে কারণ এখানে নিরক্ষরতা সামাজিক চাপ ও দরিদ্রের সংখ্যা বেশি। কিছু মানুষ সচেতন হলেও ব্যাপক পদক্ষেপ নেই। নারী মনে করে তার নিজস্ব কোনও পরিচয় নেই। পুরুষের পরিচয়ে সে পরিচিত হবে, ফলে সে তার অধিকার কিংবা সচেতনা মূলক কাজ থেকে অনেক দূরে থাকে।
আমাদের দেশের আইনে বলা হচ্ছে ১৮ বছরের পূর্বে একজন নারীর বিয়ে হলে সেটা বাল্যবিবাহ। কিন্তু একবার বাল্যবিবাহ হলে সেটা নিষিদ্ধ করার মতো কোনও আইন নেই অর্থাৎ বিয়ের পরে সেটা বৈধ হয়ে যাচ্ছে। আমাদের আইনটাকে আধা করে রাখা হয়েছে, এটা পূর্ণ করতে হবে। বিয়ের পরে ওই মেয়ে কোনও কারণে স্বামী পরিত্যক্তা বা বিধবা হয়ে বাবা-মা’র সংসার বা ভাইয়ের সংসারে ফিরে এলে কি করবে সেটাও আইনে নেই। দেশে বাল্যবিবাহের বিবাহের বিভিন্ন কারণ রয়েছে।
আমাদের সমাজ একজন মেয়ের জন্মকে সর্বনাশ হিসাবে ধরে নেয়। কম বয়সে কম যৌতুক দিয়ে মেয়ের বিয়ে দিতে পারবে, ফলে নির্দিষ্ট বয়সের আগেই ছোট মেয়েদের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ছেলেদের ক্ষেত্রে পারিবারিক আহাদ ও সম্পদের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। বাবা-মা শখ করে অল্প বয়সে বিয়ে দেয়। আবার অনেকে মনে করে নিজের আত্মীয়ের মধ্যে বিয়ে হলে নিজেদের সম্পদ নিজেদের মধ্য থেকে যাবে।
বর্তমানে বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য বিভিন্ন এনজিও কাজ করে যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে এনজিওর সঙ্গে রাষ্ট্রের ঐক্যবদ্ধতার দরকার। আমাদের সবাইকে বসে সমস্যা চিহ্নিত করতে হবে এবং বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে’।
বিয়ের আগে একজন নারীর দেহ মন বিয়ের উপযুক্ত হতে হবে। যদি এই উপযুক্ত সময়ের আগে বিয়ে দেওয়া হয় তাহলে তার দেহ ও মনে নানা রকম খারাপ প্রভাব পড়ে।
অল্প বয়সে বিয়ের ফলে একজন নারীকে প্রায়ই যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। সন্তান ধারনে স্বাস্থ্যগত সমস্যা থাকলেও তাকে সন্তান ধারণে বাধ্য করা হয়। যেখানে সে নিজেই একজন শিশু, সেখানে জন্ম নেয় আরও একটি শিশু। আর এই সময় মা ও শিশুটি রোগ শোক ও অপুষ্টিহীনতায় ভুগে এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বিআইটিএ এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় প্রায় ৩২.৭৪ শতাংশ মা শারীরিক সমস্যা এবং ৫১.৫১ শতাংশ অপুষ্টিহীনতায় ভুগছে।
সামাজিক কারণে বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। আমাদের কৃষিনির্ভর পুরুষশাসিত সমাজ ব্যবস্থায় কন্যা সন্তান জন্ম হওয়ার পর থেকে বিভিন্ন অবহেলার শিকার হতে থাকে। অশিক্ষা ও অসচেতনতার কারণে অভিভাবকরা কন্যা সন্তানকে বোঝা মনে করে। তারা মনে করে কন্যা সন্তান ভবিষ্যতে তাদে কোনও কাজে তো আসবেই না বরং বিয়ে দিতে গিয়ে বাড়তি খরচ যেমন যৌতুকসহ নানারকম ঝামেলায় পড়তে হবে। ফলে বাবা-মা অল্প বয়সে বিয়ে দেওয়াটাকেই যুক্তির কাজ মনে করে।
বিআইটিএ-এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে দেশের ৬৩.৭২ শতাংশ মানুষ মনে করে বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে অভিভাবক সবচেয়ে বেশি উৎসাহ দেয়। দেশে ৫৩.১০ শতাংশ বাল্যবিয়ে বাবা-মার কারণে ১০.৬২ শতাংশ আত্মীয় স্বজনের কারণে, ১৩.২৭ শতাংশ নিজের আগ্রহে এবং ১.৭৭ শতাংশ অন্যান্য কারণে বাল্যবিবাহ হচ্ছে।
বিয়ের ক্ষেত্রে যে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে সেটিও অনেক সময় মানা হচ্ছে না। শুধু মুখে কলেমা পড়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। আবার অনেক সময় যৌতুকের টাকা দিতে না পারলে রেজিস্ট্রেশন পরে করা হবে এ ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
ফলে পরবর্তী সময়ে মেয়ে স্বামীর ঘর থেকে পরিত্যক্ত কিংবা তার সঠিক অধিকার না পেলেও আইনের সম্মুখীন হতে পারছে না। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৩৩ শতাংশ বিয়ে রেজিস্ট্রেশন ছাড়াই সম্পন্ন করা হচ্ছে। আবার অনেক ক্ষেত্রে ভুয়া রেজিস্ট্রেশনের মাধ্যমে নারী পাচারের ঘটনাও অহরহ ঘটছে। বিয়ে সম্পর্কিত আইন (মেয়েদের জন্য ১৮ ছেলেদের জন্য ২১ বছর থাকলেও দেশের অধিকাংশ জনগণের আইন সম্পর্কে কোনও জ্ঞান নেই। তাদের এই অজ্ঞতা বাল্যবিবাহের সংখ্যা দিন দিন বাড়িয়েই চলছে।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশের প্রায় ৬৬.৩৭ শতাংশ মানুষ আইন সম্পর্কে জানে না এবং ২৬.৫৫ শতাংশ আইনটি সম্পর্কে জানে। যারা জানে না তারা বাল্যবিবাহে আগ্রহের পাশাপাশি যারা জানে তাদের মধ্যেও এই প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।
বাংলাদেশের সব জেলায় বাল্যবিবাহ থাকলেও সবচেয়ে বেশি দেখা যায় রাজশাহী বিভাগের মঙ্গা এলাকায়, চট্টগ্রামের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর, সিলেটের হাওর এলাকায় ও বরিশাল বিভাগের উপকূলীয় এলাকায়। যদি ধর্মের ভিত্তিতে বিভক্ত করা হয় তাহলে দেখা যায় বিহারি মুসলিম, নিম্নবিত্ত মুসলিম পরিবার ও মৎস্যজীবী হিন্দু পরিবারে বাল্যবিবাহের প্রবণতা বেশি। তবে খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দু সুইপারদের মধ্যে এই প্রবণতা অনেকটা কম।
দেশের অধিকাংশ প্রাপ্তবয়স্ক শিক্ষিত নারী মনে করে ১৮ বছরের আগে বিয়ে ও সন্তান ধারা জীবনের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ। বিআইটিএ-এর একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় ৭৫.২২ শতাংশ নারী মনে করে ১৮ বছরের পর মেয়েদের বিয়ে করা উচিত। এতে তারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পূর্ণতাপ্রাপ্ত হতে পারে। কিন্তু আমাদের সমাজ নারীকে সেই সুযোগ দিচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশের অসংখ্য এনজিও বাল্যবিবাহ রোধে কাজ করে যাচ্ছে।
তারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে ও চর, হাওর এলাকায় বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করছে। তবে এক্ষেত্রে শুধু এনজিওগুলোকে একা কাজ করলে হবে না। সবাইকে এ কাজে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে সরকার। সরকার যদি নমনীয় হয় এবং বাল্যবিবাহ বন্ধে আইনের সঠিক প্রয়োগ করে তাহলে বাল্যবিবাহ রোধ সম্ভব।
তবে আমাদের গণমাধ্যমগুলোকেও কার্যকর দায়িত্ব পালন করতে হবে। আগে বাল্যবিবাহ ব্যাপক আকারে হলেও সেটা পত্রিকায় বা গণমাধ্যমে আসত না। ফলে মানুষ এটি সম্পর্ক জানতে পারত না। কিন্তু বর্তমানে গণমাধ্যমগুলোর ইতিবাচক ভূমিকার ফলে অনেক ঘটনা জানতে পাচ্ছি এবং সেই অনুসারে পদক্ষেপ গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে। বর্তমানে গণমাধ্যমকে সামাজিক দায়বদ্ধতার দৃষ্টিা কোণ থেকে আরও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হবে।
পত্র-পত্রিকায় বিভিন্ন কেস স্টাডির মাধ্যমে ও ইলেক্ট্রোনিক মিডিয়ায় বিভিন্ন অনুষ্ঠান যেমন নাটক, চলচ্চিত্র, টকশো ইত্যাদির মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
কেস স্টাডি-১
আঞ্জুয়ারা বেগম (কুড়িগ্রাম)
১৪ বছর বয়সে যখন আমার বিয়ে হয় তখন পরিবার, স্বামী সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। এ সময় আমাকে পরিবারে অনেক কাজ করতে হতো এবং কোনও কাজে ক্রটি হলে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হতো। অবশেষে তাদের নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে বাবার পরিবারে ফিরে আসি। কিন্তু ততদিনে নদী ভাঙনে আমাদের বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।
এরপর আমরা নদীর বাঁধে ছোট্ট ঘরে বসবাস শুরু করি। এই সময় এলাকার ইউপি সদস্যর ছেলে পরিবারে সহযোগিতার হাত বাড়ায়। সে বিভিন্ন খাবার ও কাপড় দিয়ে আমাকে সাহায্য করে। এই সময় আমি আমার স্বামীর বাড়ি থেকে মোহরানার ১০ হাজার টাকা পাই যার পুরোটাই নিরাপত্তার জন্য ইউপি সদস্যর ছেলের হাতে তুলে দিই। তাকে টাকা দেওয়ার পরে যে আমার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে এবং ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখাতে থাকে।
আমাকে বিয়ে করবে এই প্রতিশ্রুতিতে শারীরিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। একদিন সে আমাকে ঢাকায় আমার ভাইয়ের বাসায় নিয়ে আসে এবং এখানে রেখে চলে যায়। প্রায় একমাস এখানে থাকার পর আমি জানতে পারি সে অন্য এক মেয়েকে বিয়ে করেছে। এটি শুনে আমি বাড়ি ফিরে এসে আমার সঙ্গে প্রতারণা করার কারণ জানতে চাই। তখন সে আমার টাকা ফেরত দিয়ে সেখান থেকে তাড়িয়ে দেয়।
এরপর ইউপি চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিলে তিনিও কোন বিচার করেননি। বিচার না পেয়ে কয়েকবার আত্মহত্যা করতে গিয়েও পরিবারের কারণে করতে পারিনি।
কেস স্টাডি-২
অর্চনা রানী সরকার (খুলনা)
আমি সব সময় স্বপ্ন দেখতাম আমার বিয়ে কোনও শিক্ষিত পরিবারে হবে। নিজে লেখাপড়া শেষে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে বিয়ে করব। কিন্তু ১৪ বছর বয়সে বাবা-মা আমাকে বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
আমি আমার বাবা-মাকে এই সময় বিয়ে না দেওয়ার অনুরোধ করি। কিন্তু তারা বিভিন্নভাবে আমার ওপর চাপ সৃষ্টি করে। অবশেষে রাজি হই বিয়েতে। কিন্তু এই পরিবারের অর্থনৈতিক দুরাবস্থার পরেও পরপর দুটি সন্তানের জন্ম দিই, যেটি পরিবারের দারিদ্র্য তাকে আরও স্পষ্ট করে। শত চেষ্টার পরেও স্বামীর পরিবারে আমি সুখী নই।
আমি ও আমার সন্তান বর্তমানে বিভিন্ন রোগসহ পৃষ্টিহীনতার ভুগছি। আমার সন্তানদের জন্য আমি কিছুই করতে পাচ্ছি না। আমি জানি না কিভাবে দুই সন্তানকে মানুষ করব।
উইমেন্স রাইটস অ্যান্ড জেন্ডার ইক্যুলিটি (অ্যাকশন এইড)
নাঈমা ইমাম চৌধুরী
বাংলাদেশে বাল্যবিবাহের অন্যতম প্রধান কারণ অশিক্ষা। অশিক্ষা মানুষকে জানার, বোঝার দিক থেকে বঞ্চিত রেখেছে।
দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য, যারা দরিদ্র তাদের মধ্যে বাল্যবিবাহের প্রভাব সবচেয়ে বেশি। আবার যারা দারিদ্র্য থেকে উঠে এসেছে তারা চেষ্টা করে বাল্যবিয়ে না দিতে। দরিদ্র পরিবারে একজন মেয়েকে বোঝা মনে করা হয় এবং দ্রুত বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। ফলে এই মেয়ে পড়ালেখার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। তৃতীয় কারণ হচ্ছে ধর্মীয় রীতিনীতি।
গ্রামে এমন কথাও বলা হয় যে, মেয়ে ঋতুপ্রাপ্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিয়ে দিয়ে দাও। এর ফলে বাল্যবিবাহের সংখ্যা বাড়ছে। চতুর্থ কারণ হচ্ছে যৌতুক। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি যাদের বয়স কম তাদের ক্ষেত্রে যৌতুক কম এবং যাদের বয়স বেশি তাদের ক্ষেত্রে যৌতুক বেশি ধরা হচ্ছে। কম বয়সের মেয়ের ক্ষেত্রে পরবর্তীতে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন করা হয়।
কারণ সে প্রতিবাদ করতে পারে না। পঞ্চম যে কারণে বাল্যবিবাহ বাড়ছে সেটি হচ্ছে সামাজিক নিরাপত্তার অভাব। যেসব পরিবার সামাজিক নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে তারা বাধ্য হয় মেয়েকে কম বয়সে বিয়ে দিতে। অভিভাবক যখন দেখে মেয়ে স্কুলে যেতে পারছে না, রাস্তায় বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হচ্ছে তখন মেয়ের জন্য বিয়ের আয়োজন করে। তারা মনে করে গোপন একটা বাড়িতে বিয়ে দিয়ে দিলাম, এখানে মেয়ে নিরাপদ।
এ সব কারণ বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে জড়িত। সবচেয়ে বড় কারণ যেটি সেটি হচ্ছে রাষ্ট্রের যে দায়িত্ব সেটি রাষ্ট্র সঠিকভাবে পালন করছে না। রাষ্ট্র সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করলে বাল্যবিবাহ আজ বন্ধ হতো। বিয়ের ক্ষেত্রে ভুয়া জন্ম সার্টিফিকেট দেওয়া হচ্ছে এবং সরকারি কাজী সঠিক বিধিনিষেধ মানছে না। ফলে মেয়েরা ভয়াবহ নির্যাতনের শিকার হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রায় ৬৪ শতাংশ মেয়ে বাল্যবিবাহের শিকার হচ্ছে। অর্থাৎ ১৮ বছরের নিচে ৬৪ শতাংশ মেয়ের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। এসব দুর্বল মেয়ে পরবর্তীতে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মারা যাচ্ছে। দেশে সবচেয়ে বেশি দারিদ্র্য যে জেলায় সেসব এলাকায় এই সংখ্যাটা বেশি। তবে চর বা হাওর এলাকায় এর প্রকোপটা বেশি।
আমাদের শহর অঞ্চলেও বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে তবে এটি কম। দেশে বাল্যবিবাহের যে শাস্তির ব্যবস্থা আছে তার কোনও প্রয়োগ নেই। এই দুর্বল জায়গায় সরকারকে চিন্তা করতে হবে। মেয়েদের জীবন বিভিন্নভাবে বিপন্ন হচ্ছে, বিপর্যয়ের মুখে পড়ছে এসব এসব জায়গায় সরকারকে সচেতন হতে হবে এবং কঠিন হতে হবে, তাহলে বাল্যবিবাহ বন্ধ করা সম্ভব হবে।
ইমতিয়াজ ইসলাম
টিম লিডার (কেয়ার বাংলাদেশ)
বাল্যবিবাহের প্রচলন আছে এমন ২০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
২০০৬ সালের আগে প্রায় ৯০ ভাগ বিয়ে ১৮ বছরের আগে হতো। বর্তমানে এর সংখ্যা কিছুটা কমলেও কিছু কিছু এলাকায় এটি বেড়েই চলেছে। তবে বর্তমানে বাল্যবিবাহের সংখ্যা প্রায় ৭০ শতাংশ। আমরা আমাদের প্রকল্পের মাধ্যমে মেয়েদের বোঝানোর চেষ্টা করছি কারণ তারা সচেতন হলে বাল্যবিবাহ দূর করা সম্ভব। বাল্যবিবাহের ফলে মেে য়রা দ্রুত গর্ভধারণ করে।
কারণ এই সময় তাদের পরিবার পরিকল্পনার জ্ঞান থাকে না। অল্পবয়সে সেক্সের ফলে মেয়েরা যৌন সমস্যায় ভোগে। ফলে এক সময় স্বামী বাধ্য হয় তালাক দিতে অথবা যৌনকর্মীদের কাছে যেতে।
আমাদের সমাজে নারী সংক্রান্ত দৃষ্টিভঙ্গি ভিন্ন। পুরুষ ও নারীকে আলাদা করে দেখা হয়।
নারীদের পুরুষদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। এটি সমাজকে ক্ষতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। পুরুষরা মনে করে যে মেয়েকে কেউ স্পর্শ করেনি এমন মেয়েকে বিয়ে করবÑ এই ধরনের মনমানসিকতা দূর করতে হবে। মেয়েকে বাবা-মা থেকে শুরু করে রাষ্ট্র পর্যন্ত কোথাও বৈষম্যহীনভাবে দেখা হয় না ফলে এটিও বাল্যবিবাহের বড় কারণ।
বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হলে আমরা চাই ছেলে-মেয়ে উভয়ের বয়স ২১ বছর করতে হবে।
বিশ্বের এমন অনেক দেশ আছে যেখানে ২৪ বছর পর্যন্ত বয়সকে শিশু ধরা হয়। তাই আইনে যেটা আছে অর্থাৎ ১৮ বছরের আগে কেউ যেন বিয়ে করতে না পারে সেদিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। বর্তমানে দেখা যাচ্ছে জন্মনিবন্ধনের ক্ষেত্রে বেশি বয়স দেয়া হচ্ছে এবং কাজীকে পয়সা দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা হচ্ছে। এখানে যারা যুক্ত থাকবে তাদের সবার শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যেন এমন শাস্তি পায় যাতে সবাই ভয় পায়।
বাল্যবিবাহকে নারী নির্যাতনের মধ্যে ফেলা হয় না কিন্তু এটিই সবচেয়ে বড় নারী নির্যাতন এবং সব অপরাধ কর্মকা-ের উৎস। আমরা নারী ভিক্ষুকদের ওপর গবেষণা চালিয়ে দেখেছি বেশির ভাগ ভিক্ষুকের অল্প বয়সে বিয়ে হয়েছিল। বিভিন্ন কারণে তালাকপ্রাপ্ত হয়ে ভাইয়ের পরিবার বা সন্তানের পরিবারে জায়গা হয়নি ফলে এক সময় সে বাধ্য হয় ভিক্ষা করতে। প্রেমের কারণেও বাল্যবিবাহ হচ্ছে। এখানে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানকে সুসম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে এবং সঠিক বয়সে বিয়ের ব্যাপা র খোলামেলা আলোচনা করতে হবে।
বাল্যবিবাহ বন্ধ করতে হলে যুবকদের নেতৃত্বে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। মিডিয়াকে এখানে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। বাল্যবিবাহকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে, আমাদের শপথ নিতে হবে আর একটিও বাল্যবিবাহ হতে দেব না। আমাদের শুধু সচেতন হলেই চলবে না, সরাসরি কাজ করতে হবে।
অনেক পরিবার আছে যেখানে পরিবারের সদস্যরা সচেতন হলেও নিজেরাই বাল্যবিবাহে জড়িয়ে পড়ছে।
আমরা চাই সচেতনতার বাস্তব প্রয়োগ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।