আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শাহবাগ গণজাগরণের প্রেক্ষিত, বাস্তবতা, অভীষ্ট লক্ষ্য এবং নীতি-কৌশল নিয়ে দু-চার কথা

যে শিক্ষক বুদ্ধিজীবী কবি ও কেরানী প্রকাশ্য পথে হত্যার প্রতিশোধ চায়না আমি তাদের ঘৃণা করি শাহবাগের গণজাগরণের বয়স আজ ১৬ দিন। বাংলাদেশে অতীতে এতদিন ধরে আর কোনো গণজমায়েত বা গণআন্দোলন এভাবে এক জায়গায় সন্নিবেশিত থাকেনি। উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, একাত্তরের গণজোয়ারের পর মুক্তিযুদ্ধ, নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থান ছিল বহুমাত্রিক। বহুকেন্দ্রে বিভক্ত এবং বহু অঞ্চলব্যাপী। এবারকার এই শাহবাগের গণজাগরণের মত এক সঙ্গে এত মানুষ টানা এতদিন ধরে আর কোনো আন্দোলনে একাট্টা থাকেনি।

সে দিক দিয়ে তো বটেই আরও একটি কারণে এই আন্দোলন অভূতপূর্ব। স্বাধীনতা সংগ্রাম, স্বাধীকারের লড়াই এবং স্বৈরাচার বিরোধী সংগ্রাম ছিল প্রায় সমগ্র জনগণের। এবং সেই আন্দোলনগুলি কোনো না কোনো ভাবে ছিল বিদেশি শাসক বা দেশি শাসকদের বিরুদ্ধে মুক্তির লড়াই, কিন্তু এই আন্দোলনটি একেবারেই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে উদ্ভব। রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে না, অথচ চূড়ান্ত বিচারে রাষ্ট্রেরই বিরুদ্ধে। সরকারের বিরুদ্ধে না, অথচ শেষ পর্যন্ত সরকারের আপোষকামীতার বিরুদ্ধে।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে না, অথচ সেই ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে। শেষ পর্যন্ত স্টাবলিশমেন্টেরই বিরুদ্ধে এই গণজাগরণ। কিন্তু শাসক দলের ‘নেক নজর’ সম্বল করে চেতনে-অবচেতনে তাদের এজেন্ডাগুলো বাস্তবায়নের ‘গুরু দায়িত্ব’ নিয়ে এই আন্দোলনের নেতৃত্ব একে ‘স্টপ ওয়াচ’ আন্দোলনে রূপ দিয়েছে। এখন পর্যন্ত আন্দোলনের অর্জন কতটুকু? এখন পর্যন্ত যেটুকু অর্জন তা হলো সরকার ট্রাইব্যুনালের আইনে সংশোধনী এনেছে। এখন উভয়পক্ষই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবে।

এই লক্ষ্যটুকু অর্জিত হওয়ার পর পরই এসেছে সেই চূড়ান্ত দাবী- ধর্মাশ্রয়ী বা ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল হিসেবে জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার দাবী। যে দাবীটি দীর্ঘ বাইশ বছর ধরে উচ্চারিত হয়ে আসছে। জাহানারা ইমামের গড়ে দেয়া একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, সরকার এবং সাধারণ মানুষ এখন এই দাবীটির সঙ্গে একমত। তারাও চাইছে জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে? সরকারের ভাষ্যমতে সংসদে জামাত নিষিদ্ধ বিল তুলে পাশ করানোর আগে প্রধান বিরোধী দল বিএনপির সমর্থন নিতে হবে।

তাপর ৭২ এর সংবিধানের ৪৭ (৩) ধারা প্রয়োগ করে জামাতকে নিষিদ্ধ করা যাবে। এরই মধ্যে আইন বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন-ওভাবে করলে সমস্যা আছে (আসলে তারা বলতে চাইছেন বিপদ আছে!) এর পর তারা পরামর্শ দিয়েছেন জামাতকে জনগণের গ্রহণযোগ্যতার যায়গা থেকে বিচ্ছিন্ন করলে জামাত এমনিতেই শক্তিহীন অপ্রয়োজনীয় হয়ে পড়বে! আরও একদল মত দিয়েছেন নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন বাতিল করলেই তো ল্যাঠা চুকে যায়! অথচ নির্বাচন কমিশন বলে দিয়েছে ওটা তাদের কাজ নয়! কিন্তু এবংবিধ জটিলতা থাকায় নিষিদ্ধকরণ বিষয়টি নিয়ে সরকার বা সুশীল সমাজ কেউই নির্দিষ্ট করে কোনো সিদ্ধান্ত দিতে পারছেন না। ‘পারছেন না’ না বলে বরং বলা ভালো ‘দিচ্ছেন না’। সরকার কেন সিদ্ধান্তে আসতে পারছে না? এর সাদামাটা উত্তর হচ্ছে সরকার মনে করছে জামাতকে নিষিদ্ধ করলে তারা আণ্ডারগ্রাউণ্ডে যেয়ে আরও নৃশংস হয়ে উঠবে। দেশে খুন-খারাবি, রাহাজানী বেড়ে যাবে, উগ্র ধর্মান্ধতার কারণে তারা ঝাকে ঝাকে আত্মঘাতি গ্রুপ গঠন করবে এবং ইরাক-আফগানিস্তানের মত মানুষবোমা বা গাড়িবোমা বিস্ফোরণ করে দেশকে মৃত্যুপুরী বানিয়ে ছাড়বে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি কি সম্মতি দেবে? না দিলে কি হবে? বিএনপি’র গত কয়েক বছরের কার্যক্রম বিবেচনায় নিলে স্পষ্টতই প্রমাণ পাওয়া যায় যে তারা কোনো ভাবেই জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করার পক্ষে নয়, বরং দিনের পর দিন জামাত-শিবিরের উপর তাদের ‘আস্থা’ বাড়ছে। এই যে এত বড় একটা গণজোয়ার, তার ভাষা কি বিএনপি পড়তে পারছে, না পেরেছে? না পারেনি। তার পরও তাদের কাছে সরকারি দল সমর্থন চাইছে কেন? কারণটি বোঝা খুব কঠিন কিছু নয়। সরকার বোঝাতে চাইবে তাদের পিছুটান যে কেবল তাদের একার তা নয়, বিএনপি তাদের সহায়তা করেনি বলেই তারা কাজটি করতে পারছে না বা করতে পারল না! এক্ষেত্রে নিজেদের ‘অক্ষমতার’ সঙ্গে বিএনপিকে জুড়ে দেয়ায় সরকারের সুবিধে হলো একক দায় থেকে মুক্তি। যদিও আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেছেন-বিএনপির সহায়তা ছাড়াই জামাতকে নিষিদ্ধ করা যাবে।

এই ‘করা যাবে’, ‘করা হবে’-এর মত ভবিষ্যৎ বাচ্যকে নিন্দুকেরা বলছেন সময়ক্ষেপণ বা এ্যাবাউট টার্ণ। জামাতকে নিষিদ্ধ করার জনপ্রিয় দাবীর পেছনের রাজনীতি কী? একাত্তরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর প্রত্যক্ষ মদদদাতা জামাত সন্দেহাতীতভাবে ত্রিশ লক্ষ মানুষের হত্যাকাণ্ড, দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রমহানীর অংশীদার। বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের হত্যাকারী, হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, পাকিস্তানি সৈন্যদের সকল পাপের সমান ভাগিদার। সন্দেহাতীতভাবে স্বাধীনতার বিরুদ্ধচারণ। প্রত্যক্ষ ভাবে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচারণকারী।

সরাসরি বাংলাদেশকে অস্বীকারকারী এবং ৭২-এর সংবিধান লঙ্ঘনকারী। মানবতাবিরোধী অপরাধ ট্রাইব্যুনালে জামাতের এই সকল অপরাধ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত। অথচ এতকিছুর পরও স্বাধীনতার ৩৬ বছর পর্যন্ত এই দলটিকে নিষিদ্ধ করার বদলে তাদেরকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হয়েছে। করেছে এদেশের প্রধান প্রধান সব দল। এমনকি মুক্তিযুদ্ধের আগুনে পোড় খাওয়া বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সমর্থক ত্বত্ত্বাবধায়ক সরকারও এদের লালন-পালন করেছে।

গত ছত্রিশ বছর ধরে এদের সামাজিকভাবে মর্যাদার আসনে বসানো হয়েছে। ঘৃনিত রাজাকারদের মন্ত্রী বানানো হয়েছে। এবং নির্লজ্জের মত এদের সকল পাপ কর্মকে ‘অতীত’ বলে ‘গত হয়ে যাওয়া বিষয়’ বা ‘পেছনের বিষয়’ এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে। জামাতকে নিয়ে এদেশের প্রধান দুটি দল বা জোট যে ন্যাক্কারজনক রাজনীতি করেছে তার উদাহরণ সারা বিশ্বে বিরল। কিন্তু কেন? জামাত কি অপ্রতিরোধ্য দল? জামাতের সংস্রব কি অলঙ্ঘনীয় ছিল? না।

তার পরও রাজনীতির রাজা-উজির, বড়ে-মন্ত্রী খেলায় জামাতকে দুটি প্রধান দল তথা সেই দুটি দলের সমর্থক গোষ্ঠি তুরুপের তাস মনে করে কখনো আঁচলে ঠাঁই দিয়েছে, কখনো দুধ-কলা দিয়ে পুষেছে, কখনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছে। বাংলাদেশে জামাতের ভোট কত? গত চারটি সংসদ নির্বাচনের খতিয়ানে দেখা যায় জামায়াতের ভোট ৪ শতাংশের মত। বিএনপির সাহায্য ছাড়া এককভাবে নির্বাচন করলে একটি আসনও জামায়াত পাবে কি-না সন্দেহ? তার পরও জামাতকে কেন এত শক্তিশালী ভাবা হয়? জামাতের মুল শক্তি বিএনপি-আওয়ামী লিগের রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব। আওয়ামী লিগ-বিএনপির বৈরী সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে শুধু যে রাজনীতির সুবিধে নিয়েছে তাই নয়, নিজেদের শেকড় আরও গ্রথিত করে ব্যবসা-বাণিজ্যের শাখা বিস্তার করে হাজার হাজার কোটি টাকার লগ্নি এবং মুনাফা ঘরে তুলে সেই টাকায় নিজেদের দেশের অন্যতম ক্ষমতাধর দল হিসেবে হাজির করেছে। বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি জঙ্গী ক্যাডার জামাতের হাতে।

বাংলাদেশে গত চল্লিশ বছরে সবচেয়ে বেশি রক্ত ঝরানো দলও জামাত-শিবির। তরুণ প্রজন্মের বর্তমান আন্দোলনে ভীত হয়ে বাচার পথ খুঁজতে আবারও জামাত তার আদি এবং অকৃত্তিম বন্ধু বিএনপির কাধে ভর করেছে। ক্ষমতায় যাওয়ার আশায় বিএনপি সাফ জানিয়ে দিয়েছে , কোন বাধাই বিএনপি- জামায়াত জোট ভাঙতে পারবে না! অর্থাৎ যে কোনো মূল্যে বিএনপি জামাতকে রক্ষা করবে, যা তারা করে আসছে বিএনপি দলটি গঠনের পর থেকেই। কিন্তু আওয়ামী লীগ কি করেছে? ১৯৯৬ নির্বাচনে জয়ী হয়েও জামাতকে নিয়ে একসাথে চলতে কোনো সমস্যা হয়নি আওয়ামী লীগের। '৭৩, '৮৭, '৯৬ এর মতো এবারও ‘আঁতাত’ করেছে জামায়াতের সাথে।

কসাই কাদের মোল্লার ঘৃণিত অপরাধসমূহ যার দায়ে তার অন্তত পাঁচ বার ফাঁসি হওয়ার কথা তাকে যাবজ্জীবন সাজা দিয়ে যে ট্রাইব্যুনাল সেই ট্রাইব্যুনালে দুর্বল প্রসিকিউশনের দায় আওয়ামী লীগেরই। এবার তারা তাদের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে ,কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেনি আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের এই দোদুল্যমানতা, বিএনপির নির্লজ্জ জামাতঘনিষ্টতা, বামদের ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের মোহময় নির্লিপ্ততা দেখে এবং বিশেষ করে কসাই কাদের মোল্লার ফাঁসি না হওয়ায় অকস্মাৎ ফুঁসে উঠেছে তরুণ প্রজন্ম। গর্জে উঠেছে শাহবাগে লাখো তরুণ। অভূতপূর্ব এই গণজোয়ার সৃষ্টির পর শাসক দল এবং বিরোধী দলসহ অপরাপর সকল শ্রেণী-পেশার মানুষ যার যার পক্ষ ঠিক করে নিয়েছে।

যত দিন গড়িয়েছে ততই এই আন্দোলনের সাথে সংহতি প্রকাশ করেছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ। এই আন্দোলনের চেহারা যতই ‘কার্নিভাল’ এর মত দেখাক না কেন এটা যে শাসকশেণীর এতদিনকার ভিত্তিমূল নাড়িয়ে দিয়েছে তা বুঝতে পণ্ডিত হতে হয় না। কিন্তু তার পরও কি শাসকশ্রেণীর নেপথ্যক্রিড়া বন্ধ আছে? মোটেই নয়। শাসকশ্রেণীর সব কয়টি ফ্যাকশনই সেই পুরোনো কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। ‘চোরেরে কও চুরি করো-গৃহস্তরে কও ধরো ধরো’ নীতিতেই তাদের দাবা বোর্ডের গুটি নড়াচড়া করছে।

ক্ষমতাসীন দল বা জোট কোনো ভাবেই আন্দোলনকে বিতর্কীত করতে চাইছে না। বন্ধও করতে চাইছে না, বরং প্রটেকশ দিয়ে আন্দোলনকে একটা প্যাটার্ণে নিয়ে যেতে চাইছে। যে প্যাটার্নে তাদের নিজেদের কোনো ক্ষতি তো নেই-ই বরং লাভের গুড় ষোল আনা। বিএনপি প্রথমে আন্দোলনকে এটা ওটা বলে তিরষ্কার করলেও হালে অবস্থা বেগতিক দেখে সমর্থনের ছলনায় নিজেদের কিছু শর্ত জুড়ে দিয়েছে আহম্মকের মত। এবং অবধারিত ভাবে তরুণ প্রজন্ম তা ছুঁড়ে ফেলতে দ্বিধা করেনি।

কিন্তু সরকার কি শাহবাগের স্লোগানের ভাষা পড়তে পেরেছে? না পারেনি। তবে একেবারে পারেনি তাই বা বলা যায় কি করে? যেমন সরকার এত দিনে এটা স্পষ্টতই বুঝেছে যে এই গণজাগরণের আগুন কোনো ভাবেই তাদের পোড়াবে না, ভাসিয়ে নেবে না। এই গণঅভ্যুত্থান কোনো ভাবেই রাষ্ট্রক্ষমতা ধরে টান দেবে না। এই শাহবাগের উদ্দীপ্ত তরুণরা কোনো ভাবেই রেজিম বদলে দেবেনা। এই অভূতপূর্ব গণসম্মিলন কোনো ভাবেই নিপীড়িত গণমানুষের হয়ে তাদেরকে রাষ্ট্রক্ষমতায় তুলে আনবে না।

সরকার বা স্টাবলিশমেন্ট আরও বুঝেছে যে জামাত-শিবির যত যুদ্ধংদেহি হোক, যত নৃশংসতাই দেখাক না কেন এই তরুণরা তার প্রতিকারের জন্য সহিংস হবে না কারণ তারা যারা যারা এখানে আন্দোলন করছে তাদের চরিত্রে বল প্রয়োগে দাবী আদায়ের নীতি নেই। তারা যুদ্ধংদেহি হবে না। এমনকি তাদের সাথী খুন হওয়ার পরও না। এই ‘স্বস্তিটুকু’ আছে বলেই সরকার এখনো এই আন্দোলন নিয়ে সময়ক্ষেপণের সুযোগ পাচ্ছে এবং সে সুযোগটা পুরোপুরি কাজেও লাগাচ্ছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতী জনতার অংশগ্রহণ ছাড়া শুধু মাত্র ছাত্র-যুবারা আর কতদিন আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারবে? দেখা যাচ্ছে এই আন্দোলনে যতনা বাস্তবতার নিরীখে চলছে তার যেয়ে বেশী চলছে আবেগে।

বাঁধভাঙ্গা আবেগে। আবেগ জিনিসটা পারদের মত ক্ষণে ক্ষণে ওঠা-নামা করে। এক্ষেত্রেও তা-ই ঘটছে। সরকারের বেঁধে দেয়া সময় '৩টা-১০টা' আন্দোলনকারীরা মেনে নেয়, কিন্তু রাত এগারটায় ব্লগার রাজীবের মৃত্যুর খবর ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই বেঁধে দেয়া সময়সীমা থেকে সরে আসে আন্দোলনকারীরা। আবার তারা ঘোষণা করে আন্দোলন চলবে লাগাতার, দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সরকারকে এখন আবার নতুন করে ছক কষতে হবে। কি সেই ছক? হয় আন্দোলনকারীদের দাবী মেনে স্বল্পতম সময়ে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলো নিষিদ্ধ করতে হবে, বিচারধীন যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে অথবা বল প্রয়োগ করে আন্দোলনকারীদের হটিয়ে দিয়ে একটা অনির্দিষ্ট সময়সীমা বেঁধে দিতে হবে। দুটি কাজই সরকারের জন্য বিব্রতকর। তাহলে কী হবে? আন্দোলনকারীদের ৬ দফা দাবী আসলে কী? কার কাছে এই দাবী? দেখা যাচ্ছে যে ৬টি দফা দেয়া হয়েছে তার ৩ নম্বর এবং ৫নম্বর দাবীটিই শুধু ক্ষমতাসীন সরকারের কাছে করা হয়েছে। বাকি চারটি দাবীই আসলে জনগণের কাছে, জনগণের বিবেকের কাছে এবং ভবিষ্যত প্রজন্মের কাছে রাখা হয়েছে।

বাকি দাবীগুলি মোটামুটি এরকম; ‘সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি’, ‘উদাত্ত আহ্বান জানানো হচ্ছে’, ‘সোচ্চার থেকে আন্দোলনকে এগিয়ে নেওয়া হবে’, ‘বয়কট করার শপথ নেওয়া হচ্ছে’। জামাতকে নিষিদ্ধ করার ৩ নম্বর দাবীটি নিয়ে উপরেই আলোচনা করা হয়েছে। জামাতকে নিষিদ্ধ করতে সরকারকে হিমালয় পাহাড় ডিঙ্গোতে হবে না। সরকার ঐকান্তিক হলে সংসদে আইন করেই জামাতকে নিষিদ্ধ করা সম্ভব। সংবিধানের ৪৭ (৩) ধারায় বলা আছে; ‘এই সংবিধানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা স্বত্ত্বেও গণহত্যাজনিত অপরাধ, মানবতাবিরোধী অপরাধ বা যুদ্ধাপরাধ এবং আন্তর্জাতিক আইনের অধীন অন্যান্য অপরাধের জন্য কোন সসস্ত্র বাহিনী বা প্রতিরক্ষা বাহিনী বা সহায়ক বাহিনীর সদস্য কিংবা যুদ্ধবন্দীকে আটক, ফৌজদারীদে সোপর্দ কিংবা দণ্ডদান করিবার বিধান-সংবলিত কোন আইন বা আইনের বিধান এই সংবিধানের কোন বিধানের সহিত অসমঞ্জস বা তাহার পরিপন্থী, এই কারণে বাতিল বা বেআইনী বলিয়া গণ্য হইবে না কিংবা কখনও বাতিল বা বেআইনী হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে না।

এ ছাড়াও ১৫১ এবং ১৫৩ ধারা প্রয়োগ করেও জামাতকে নিষিদ্ধ করা যায়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে জামাতকে নিষিদ্ধ করলেই কি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের শাস্তি হয়েছে বলে মনে প্রতীয়মান হবে? সাম্প্রদায়ীকতা, ধর্মীয় উগ্রবাদ, ধর্মের ভিত্তিতে মানুষকে বিভাজিত করণ, নারী-পুরুষের সমানাধীকার নিশ্চিত হবে? জামাতকে নিষিদ্ধ করলেই কি তাদের অতীতের সকল অপরাধ মুছে যাবে? তারা রাজনীতি করার জন্য যোগ্যতাপ্রাপ্ত হবে? আন্তর্জাতিক আইনে কি ধর্মভিত্তিক দল কি থাকতে পারে না? এই সকল প্রশ্নের মীমাংসা খুব সহজ সরল নয়। এই সব প্রশ্ন সামনে রেখে জামাতের ভাবনা কী? জামাত-শিবির চাইছে দেশে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি হোক। যত বেশী অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হবে তত বেশী দেশে-বিদেশি শক্তির আগমনের পথ সুগম হবে। জামাত-শিবিরসহ অপরাপর মৌলবাদী দলগুলোর সঙ্গে কোনো কালেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের বৈরীতা ছিলনা, এখনো নেই।

ইরাকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে লক্ষ লক্ষ ইরাকী হত্যা করার পরও এই মৌলবাদী দলগুলি কোনো প্রতিবাদ করেনি। আফগানিস্তানে তালেবান নির্মূলের নামে নির্বিচারে গণহত্যা চালালেও এরা কেউ তার প্রতিবাদ করেনি। অর্থাৎ একাত্তরে যেমন পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা এই সব মৌলবাদী ফ্যাসিস্ট দলগুলোর বন্ধু ছিল, এখনো তা-ই আছে। সঙ্গে যোগ হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কিছু সাম্রাজ্যবাদের ধামাধরা ক্লায়েন্ট রাষ্ট্র। তারা ঠারে ঠোরে এটাই জানিয়ে দিতে চাইছে যে এসব বিচার-টিচার বন্ধ না করলে বাংলাদেশেও পাকিস্তানের মত ড্রোন হামলা শুরু হবে।

বাংলাদেশেও আফগানিস্তান-পাকিস্তানের মত গুপ্ত ঘাতকের হাতে অগুনতি মানুষের মৃত্যু হবে। ইরাকের মত প্রতিদিন প্রায় নিয়ম করে গাড়িবোমা হামলা শুরু হবে। লাশের পর লাশ পড়বে। আর তখন বাংলাদেশকে নিয়ে চলবে পশ্চিমাদের কাটাচামচে খুবলে খুবলে খানাপিনা! বাংলাদেশের তেল-গ্যাস-কয়লা আর সমুদ্রবক্ষে অফুরন্ত তেল-গ্যাস ভাণ্ডারে পশ্চিমা একছত্র আধিপত্য। ব্যাপক জনসাধারণের কাছে শাহবাগ গণজাগরণ মঞ্চের গ্রহণযোগ্যতার প্যারামিটার কি? অল্প কিছু ব্লগার এবং অনলাইন এ্যাক্টিভিস্ট নিয়ে যে আন্দোলনের সূচনা তা দ্রুত গণজাগরণে রূপ নেয়ার পর অনভিজ্ঞ নেতৃত্ব ধাপে ধাপে আন্দোলনে এগিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে যে সব পদ্ধতি বা কৌশল প্রয়োগ করেছে তাতে সরকারকে আশ্বস্ত করা গেলেও কার্যকর দর কষাকষির হাতিয়া হয়ে উঠতে পারেনি গণজাগরণ মঞ্চ।

মোমবাতি প্রজ্জলন, গান, স্লোগান, ব্যানার-ফেস্টুন, হেড ব্যান্ড, পতাকা, তিন মিনিট নিরবে দাঁড়িয়ে থাকা, বেলুন ওড়ানোর মত কর্মসূচী এই আন্দোলনকে হয়ত এক ধরণের ‘কার্নিভাল মুডে’ ধরে রাখতে পেরেছে, কিন্তু নির্দিষ্ট সময়সীমা না থাকায় এর ঝাঝ বা তেজ কোনো ভাবে সরকারকে পোড়াচ্ছে না। সর্বস্তরের গণ মানুষের অংশগ্রহণ না থাকায় আন্দোলনটি সত্যিকারের গণআন্দোলন হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধাপরাধের বিচার, অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি আপামর গণমানুষের দাবী হলেও এখানে সেই দাবীটি উচ্চারিত হচ্ছে কৃষক-শ্রমিকের অংশগ্রহণ ছাড়াই। এতদিনকার একটি বিস্ফোরিত আন্দোলন কিছু জেলা শহরে সংগঠিত হওয়া ছাড়া প্রতিটি শহরের পাড়া-মহল্লায় ছড়িয়ে পড়েনি। আন্দোলনের ‘গিয়ার’ বদল করে একে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ধাপে উন্নিত করে চূড়ান্ত লক্ষ্য হাসিলের পথে নিয়ে যাওয়া হয়নি।

একই বৃত্তে ঘুরপাক খেতে খেতে আন্দোলনটি এখন টিভি চ্যানেলের বদৌলতে একটি ‘বিশেষায়ীত প্রচার ইভেন্ট’ হয়ে উঠেছে। শুরু থেকেই 'অরাজনৈতিক' বলে এই আন্দোলনকে এমন এক ঘেরাটোপের মধ্যে ফেলে দেয়া হয়েছে যে সরকারকে কিছু বলা যাবে না, ট্রাইব্যুনালকে প্রশ্ন করা যাবে না। এই আন্দোলন শুধু মাত্র কাদের মোল্লার ফাঁসি চেয়ে! অথচ যে কেউ এটা বুঝবে যে বিক্ষোভটা মূলত রায়ের বিরুদ্ধে এবং সেই রায় দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। সুতরাং ট্রাইব্যুনাল, বিচার প্রক্রিয়া, সরকার এসব প্রশ্নকে পাশ কাটিয়ে এই আন্দোলনের উদ্যোক্তারা ঠিক কিভাবে এর সফলতা দেখতে চাইছে সেটা পরিষ্কার নয়। কাদের মোল্লাকে সর্বোচ্চ শাস্তি না দিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রদান এদেশে সামগ্রিকভাবে যে বিচারহীনতার পরিস্থিতির সাথে সম্পর্কীত।

এদেশে সাংবাদিক দম্পতি খুন হলে সেটার মূল হোতাদের আড়াল করার জন্য সরকারি পর্যায়ে চেষ্টা করা হয়, তাজরিন গার্মেন্টসের মালিককে গ্রেপ্তার করা হয় না, বাচ্চু রাজাকার পালিয়ে যেতে পারে, খুনিরা রাষ্ট্রপতির ক্ষমা পায়। সন্ত্রাসীদের ছেড়ে দেয়া হয়। আবার বিনা বিচারে ‘সন্ত্রাসী’ নাম দিয়ে ‘ক্রসফায়ারে’ খুন করা হয়। এবং বিস্ময়করভাবে র‌্যাব গঠন হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত একজন জামাত-শিবির নেতা-কর্মীর 'ক্রসফায়ারে' মৃত্যু হয়নি! তার মানে এই নয় যে তারা সন্ত্রাস করেনি! অন্য যে কোনো দলের চেয়ে তারা বেশী সন্ত্রাস করেছে। দিনে-দুপুরে মানুষ খুন করেছে।

এইসব প্রশ্ন কোনো অরাজনৈতিক প্রশ্ন হতে পারে না। সুতরাং যুদ্ধাপরাধী বিচারের প্রশ্নকে দেশের সামগ্রিক বিচার প্রক্রিয়ার সাথে, রাজনৈতিক লাভালাভির সাথে সম্পর্কযুক্ত না করে তা একটি নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ রেখে বিচার চাওয়ার আন্দোলনে সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থন আপাতদৃষ্টিতে যতোই নিরীহ মনে হোক, তা প্রকৃতপক্ষে তাদের ‘ক্লিনচিট’ হাসিলের চেষ্টা। আমরা জানিনা আরও কতদিন এই গণজাগরণকে ধরে রাখা যাবে। ইতিমধ্যে শত্রুপক্ষ এই আন্দোলন ব্যর্থ করতে তাদের ন্যাক্কারজনক সকল কৌশল প্রয়োগ করে চলেছে। বাস্তবে এবং ভার্চুয়াল পরিমণ্ডলে তারা সংগবদ্ধভাবে আক্রমণ করে চলেছে।

চরিত্র হনন, কুৎসা, ধর্ম নিয়ে বেসাতি, ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, ধর্মীয় অপব্যাখ্যা, একাত্তরের মত ধর্ম গেল গেল রব তুলে ধর্মপ্রাণ মানুষের সহানুভূতি আদায়ের কৌশল থেকে শুরু করে খুন, রাহাজানী, জ্বালাও পোড়াও, প্রকাশ্যে হত্যার হুমকিসহ ঘৃণিত সকল অপচেষ্টা করে যাচ্ছে। এসবের বিপরীতে আন্দোলনকারীদের দাবী বা কৌশল কি হতে পারত? কোন পথে এগুতে পারে আন্দোলন? আন্দোলনে জনসচেতনতা বৃদ্ধির কৌশল মোটামুটি সোজা। সেটা নেয়াও হয়েছে। এবং জনগণ আগের তুলনায় সচেতনও হয়েছে। কিন্তু যেহেতু সচেতনতাই আন্দোলনের লক্ষ্য নয়, লক্ষ্য দাবী আদায়।

সুতরাং সেই সব দাবীগুলো কনসলিডেটেড করা দরকার। নির্দিষ্ট করা দরকার। তাদের ৬ দফা দাবীর সাথে সাংঘর্ষিক না করেই কয়েকটি দাবী এবং নীতির উল্লেখ করা হচ্ছেঃ ১। কেবলমাত্র ধর্মভিত্তিক দল হিসেবে নয়, একাত্তরে যুদ্ধাপরাধের কারণে এবং বাংলাদেশের সংবিধানের মূলনীতি অস্বীকার করার কারণে জামাতকে নিষিদ্ধ করতে হবে, (ন্যুরেমবার্গে ক্রিশ্চিয়ান ডেমোক্র্যাটিক দলগুলো নিষিদ্ধ হয়নি, কিন্তু যুদ্ধাপরাধের কারণে নাজি দল নিষিদ্ধ হয়েছিল)। ২।

জামাতের পাশাপাশি একাত্তরের সকল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আওতায় আনতে হবে। ৩। রাষ্ট্রধর্ম আইন বাতিল করতে হবে। ৪। পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করে ৭২-এর সংবিধানে কার্যকরভাবে প্রত্যাবর্তন করতে হবে।

সেই সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক সকল দল, গোষ্ঠি, মতবাদের বিলুপ্তি করতে হবে। ৫। একাধীক শিক্ষা ব্যবস্থা বাতিল করে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণী প্রর্যন্ত একমুখি শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করতে হবে। এই আন্দোলনকে কেউই সহিংস হতে বলেনি। কিন্তু সশস্ত্র প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব ধরে টান দেয়ার পর তারা আক্রমণ শুরু করলেও ফুল আর ফুলেল সৌরভ দিয়ে তাদের মোকাবেলা করা বাতুলতা মাত্র।

তাদের রক্তাক্ত আক্রমণের বিপরীতে মোমবাতি, বেলুন, স্লোগান, মৌন মিছিল তাদের প্রতিহত করবে না, নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করবে না। বরং অসহায় আত্মসমর্পণ এই আন্দোলনকে ধ্বংস করে দেবে। জেগে ওঠা তারুণ্যকে পিছিয়ে দেবে অনির্দিষ্ট সময়ের গহ্বরে। তাই যত দ্রুত সম্ভব আন্দোলনকে সারা দেশময় ছড়িয়ে দিতে হবে। দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা নিতে হবে কোন স্তর পার হলে কোন স্তরে যাবে এবং কোন কর্মসূচী নিতে হবে।

গান্ধিবাদী শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের চরম সমর্থকও স্বীকার করবেন যে, উত্তর কোরিয়ার হাতে পারমানবিক বোমা না থাকলে দক্ষিণ কোরিয়া আর তার পশ্চিমা মিত্ররা জাতিসঙ্ঘের ঘাড়ে চড়ে উত্তর কোরিয়াকে নিশ্চিহ্ন করে ফেলত। এখানে এই আন্দোলনকারীদের পারমানবিক বোমা হচ্ছে দেশের আপামর জনসাধারণ, বিশেষ করে গতরখাটা কৃষক-শ্রমিক। তাদেরকে সাথে না নিয়ে তাদের বাঁচা-মরার দাবীর প্রতি সহানুভূতিশীল না হলে এই আন্দোলন তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে পারবে না। অপ্রিয় হলেও এটাই সত্য। ঢাকা।

২১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৩  ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।