চতুর্মাত্রিক.কম (choturmatrik.com)
[ব্লগ লেখা এক মারাত্মক নেশা। ঘাড় থেকে নামিয়ে রেখেছি আশ্বাসে নিশ্চিন্ত হয়ে বসলেই টের পাই কোন ফাঁকে সে আবারও ঘাড়ে চড়ে বসেছে এবং দুই হাঁটু দিয়ে কানের ওপরে চাপ দিচ্ছে! একটা ব্লগ না লেখাতক এই অদৃশ্য ব্যথাটি সরছে না!]
Inglourious Basterds নামটার মধ্যে প্রথমেই যেটা খেয়াল করলাম সেটা হলো নামের বানান ভুল। ভাবলাম টাইপো, তারপরে ভাবলাম টারান্টিনো কি ভুল শিখেছেন নাকি (যদিও চিন্তাটা শিশুতোষ ভীষণ), পরে একটু ঘাঁটতেই জানতে পারলাম এটা টারান্টিনোর সেই বিখ্যাত স্বপ্রণোদিত “গুফ”গুলোর একটা। টারান্টিনো নিজের সব ছবিতেই এরকম দুয়েকটা স্বেচ্ছায় করা ভুল রেখে দেন। এই ছবিতেও আছে।
কিন্তু আমার লেখা সেইসব ভুল নিয়ে নয়। ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস ছবি দেখে কী কী ভাবলাম আর পাইলাম সেগুলো নিয়ে।
দুর্দান্ত কোন সিনেমা দেখলে আমি সবার সাথে সেটা শেয়ার করার চেষ্টা করি, মাঝে মাঝে জোর করে কাউকে কাউকে ছবি দেখাই, পরে গিনিপিগেরা আমাকে ধন্যবাদই দিয়েছে বেশিরভাগ সময়ে। তবে ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস দেখে আমি একটু মুশকিলে পড়েছি। এই ছবিটা নিয়ে মূলত অনেকেই আমার মতো মুশকিলে পড়েছেন।
সেটাও টের পেলাম রটেন টম্যাটোতে রিভিউ পড়তে গিয়ে। কুয়েন্টিন টারান্টিনোর ছবি নিয়ে এমন দোলাচল খুব স্বাভাবিক, কারণ প্রথাগত ছবি তৈরির অভ্যাস এই পরিচালকের একেবারেই নাই। আখেরে লাভ অবশ্য আমার মতো দর্শকদের হয়, যারা একঘেঁয়ে গোলাগুলি আর ‘ব্রেইনলেস অ্যাকশন’ দেখে দেখে বিরক্ত। উদাহরণ হিসেবে এই মুহূর্তে ডাই হার্ড আর ট্রান্সফর্মারস এর কথা মনে আসছে।
বাস্টার্ডস ছবিতে টারান্টিনোর ম্যুভির স্বাক্ষর খুব প্রকটভাবে বিদ্যমান।
যারা টারান্টিনোর সাথে পরিচিত নন, তাদের জন্যে বলতে পারি, দুর্বলচিত্তের অধিকারী হলে সযত্নে টারান্টিনো এড়িয়ে চলুন! প্রচুর রক্তপাত, যৌনতার দৃশ্য ভরা থাকে, রক্তপাতের দৃশ্যগুলো ধারণের মুন্সিয়ানা এতদূর যে যেকোনো মানুষের বিবমিষা তৈরিতে পারদর্শী। এছাড়া ধীরলয়ের সংলাপও থাকে খানিকটা ছবিজুড়ে। আবহ সঙ্গীতের প্রাবল্য থাকবে আর সঙ্গীতের পরপরই হয়তো শুরু হয়ে যাবে কাটাকুটি বা ভয়ানক নৃশংসতা। ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডস এর পটভূমি ফ্রান্সে, সময়কাল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, সুতরাং এই উপাদান ব্যবহারের যথেষ্ট সুযোগ তিনি পেয়েছেন! তবে মজার ব্যাপার হলো, পুরো ছবিতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়ানক ধ্বংসযজ্ঞ নেই। আর প্রকৃত ইতিহাসের চাইতেও বড়ো চমক রয়েছে ছবির শেষে।
এতো বড়ো সুযোগ পাওয়ার পরেও কেন টারান্টিনো মারামারি এড়িয়ে গেলেন সেটা বোঝার জন্যে ছবিটা আরেকবার দেখলাম। অবাক হয়ে খেয়াল করলাম যে এবার দেখার সময়ে আমার কাছে ছবিটা অনেক বেশিই বীভৎস লাগলো। মানুষের বিকৃতি, মনুষ্যত্বহীনতা, বর্ণবাদ, উগ্রস্বজাত্যবোধ, আর লালসার ঘিনঘিনে রূপ যেন ফেটে ফেটে বের হচ্ছে! এই ম্যাজিকাল ব্যাপারটি কীভাবে হলো? কেনো পরের বার দেখার সময়ে এটা টের পেলাম, প্রথমবারে যেটা পাইনি? আর কেনোই বা সেটা নিয়ে কেউ কথা বলছে না?
আচ্ছা, সেটা নিয়ে বলার আগে একটু কাহিনীটা বলে নেই। গল্পের সময়কাল ১৯৪১ থেকে ১৯৪৪, নাৎজি-অধিকৃত ফ্রান্সে। আমেরিকান-ইহুদী আটজন সৈনিককে পাঠানো হয় এই অঞ্চলে গিয়ে নাৎজিনিধনে।
এই আটজনের নাৎজিনিধনের বীভৎস গল্প ছড়িয়ে পড়ে বিপক্ষশিবিরে, এদেরকেই বলা হতো বাস্টার্ডস। যুদ্ধের শেষের দিকে, ১৯৪৪ সালে এক জার্মান সৈনিকের বীরত্বের কাহিনী দিয়ে চলচ্চিত্র বানানো হয়। সেই চলচ্চিত্রের প্রিমিয়ার শো’তে আসবেন হিটলার, এমন খবর গোপনসূত্রে পেয়ে যায় বাস্টার্ডরা। তাদের পরিকল্পনা ছিলো, একই দিনে হিটলার, গোয়েবলস, জেনারেল হারম্যান গোরিংকে মেরে ফেলার সুযোগ পাওয়া গেছে, সেটা কাজে লাগাতেই হবে। মূলত গেরিলা কায়দায় কাজ করা এই দলটি তখন ছদ্মবেশে সিনেমা হলে ঢুকে পড়ার ফন্দি আঁটে।
সৌভাগ্যক্রমে, সিনেমাহলের মালিক এক কমবয়েসি ছদ্মবেশী ইহুদি মেয়ে, যে নিজেও আলাদাভাবে হিটলারকে মারার নকশা করছে। বাকিটুকু না’হয় সিনেমা দেখার জন্যে এখন উহ্য রাখি!
ইনগ্লোরিয়াস ছবি দেখে সবচেয়ে বড়ো প্রাপ্তি হলো অনেকদিন বাদে এক ভয়ানক ভিলেনের চরিত্রের দেখা পেলাম। স্টান্ডারটেনফুয়েরার হান্স লান্ডা। Schutzstaffel সংক্ষেপে SS অর্থাৎ তৎকালীন নাৎজি বাহিনীর সিক্রেট সার্ভিসের এক সেনা কর্মকর্তা। অস্ট্রিয়া থেকে তাকে ফ্রান্সে পাঠানো হয় লুকিয়ে থাকা ইহুদি খুঁজে খুঁজে তাদেরকে বন্দি করা, কনসেন্ট্রশন ক্যাম্পে পাঠানো অথবা মেরে ফেলা।
ইহুদিদের খুঁজে বের করার পারদর্শিতার জন্য তার নাম দেয়া হয় “দ্য জিউ হান্টার”। ছবির শুরুর বিশ মিনিট কর্নেল (পরবর্তীতে জেনারেল) হান্স লান্ডা দখল করে নিয়েছেন, এবং বাকি ছবি জুড়ে তার একটা প্রচ্ছন্ন ছায়া ছড়িয়ে আছে। চতুর, কথাবার্তায় হাস্যমুখি এই জেনারেলকে দেখে বোঝার কোনো উপায়ই নাই, যেকোন মুহূর্তেই সে কতোটা নৃশংস হয়ে উঠতে পারে। দুটি দৃশ্যের কথা বলতে পারি, ছবির শুরুতেই এক ফরাসির বাসায় ইহুদি খুঁজতে যায় হান্স লান্ডা। সেখানে তার কথা, চাহনি আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজ আমাকে বারবার পাকিস্তানি সামরিক খুনিদের কথা মনে করিয়ে দিয়েছে।
আমারও মনে পড়েছে, “ওয়ান্স আপ’ন এ টাইম, ইন পাকি-অকুপাইড বাংলাদেশ”-এ কীভাবে মানুষকে মারা হয়েছে! ফরাসি গ্রামটিতে চারটি ইহুদি পরিবার ছিলো, যাদের মাঝে তিনটা পরিবারকে খুঁজে পাওয়া গেছে। মঁসিয়ে লাপাদিত’-এর বাসায় গিয়ে হান্স তার সাথে কথা বলা শুরু করেন চতুর্থ পরিবারটি নিয়ে, তারা কোথায়, দেশে আছে না স্পেনে পালিয়ে গেছে, সেই পরিবারটিতে কয়জন ছিলো, তাদের বয়স কতো ইত্যাদি ইত্যাদি। এই সময়ে জার্মান তথা হিটলারীয় দৃষ্টিকোণের কিছুটা ঝলক চলে আসে, ইহুদিনিধনের প্রোপাগান্ডা, ইহুদিবিদ্বেষের বিষ কেমন ছিলো! সেইসাথে জার্মান উগ্র জাতীয়তাবোধের একটা নমুনা নিচের সংলাপে দেখুনঃ
"Col. Hans Landa: Now if one were to determine what attribute the German people share with a beast, it would be the cunning and the predatory instinct of a hawk. But if one were to determine what attributes the Jews share with a beast, it would be that of the rat. If a rat were to walk in here right now as I’m talking, would you treat it to a saucer of your delicious milk?
Perrier LaPadite: Probably not.
Col. Hans Landa: I didn’t think so. You don’t like them. You don’t really know why you don’t like them. All you know is you find them repulsive. Consequently, a German soldier conducts a search of a house suspected of hiding Jews. Where does the hawk look? He looks in the barn, he looks in the attic, he looks in the cellar, he looks everywhere “he” would hide, but there’s so many places it would never occur to a hawk to hide. However, the reason the Führer’s brought me off my Alps in Austria and placed me in French cow country today is because it does occur to me. Because I’m aware what tremendous feats human beings are capable of once they abandon dignity. "
ইতোমধ্যে কান ফেস্টিভ্যালে হান্স লান্ডার চরিত্র রূপায়নকারী ক্রিস্টফ ওয়ালটজ্ সেরা অভিনেতার পুরষ্কার জিতে নিয়েছেন। আমার মতে, এই বছরের অস্কারও তার পাওয়া উচিত! অনেকদিন এমন মানবিক (!) নেগেটিভ চরিত্র আমি দেখি না।
ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ডসের মধ্যে পরিচালক টারান্টিনোর আরেকটা কাজ দুর্দান্ত লেগেছে, তা হলো সংলাপ ও দৃশ্যের হিউমার।
যুদ্ধের ছবিতে কৌতুকমুখর দৃশ্য তৈরি করা বেশ কঠিন, আর যেখানে পাশাপাশি নৃশংসতা দেখানো হয় সেখানে মোটামুটি দুষ্কর। এই দুরূহ কাজটি টারান্টিনো এমন স্বাভাবিকভাবেই করেছেন, যে অভাবিত কষ্টের দৃশ্যগুলোও দর্শকের মনে আঁচড় কাটে না সেভাবে। হাসির দ্রুততায় হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া মৃত্যুও স্বাভাবিক মনে হয়। এরকম বেশ কয়েকটি দৃশ্যই মনে পড়ছে, যেগুলো পরেরবার দেখার সময়ে অনেক বেশি প্রকট হয়ে উঠেছিলো। আরো যে জিনিশটা ফুটে উঠলো সেটা হলো যুদ্ধপীড়িত অবস্থায় মানবিকতার অবক্ষয়।
যে কোন অপরাধ বা অন্যায় যা সাধারণ অবস্থায় খুব গর্হিত বলে গণ্য হয়, সেগুলো যুদ্ধের পটভূমি দৈনন্দিন চর্চা হয়ে ওঠে। মানুষের একটা ‘বাই-ডিফল্ট’ অভ্যাস হলো নৈতিক অন্যায়ের ব্যাপারে বিদ্রোহী হয়ে ওঠা (মনে মনে বা সদলবলে)। যুদ্ধাবস্থায় নৈতিকতা আর মনুষ্যত্বের এই স্খলনের সময়ে তাই খুব জরুরি হয়ে পড়ে সৈন্যদের মোটিভেট করা। “উই আর ফাইটিং ফর এ গুড ক’জ”- এই বাক্যটা যে কোন অন্যায় যুদ্ধে অনেক বেশি ব্যবহৃত হয়! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও তার বাইরে নয়। হিটলার তথা জার্মান যুদ্ধনীতির মূল শক্তিই ছিল অপরিসীম ঘৃণা ও ম্যানিপুলেশন।
উগ্র স্বজাত্যবোধের সাথে দু’চামচ ঘৃণা মিশালে যে সুস্বাদু নেশা-জাগানিয়া বর্ণবাদের জন্ম হয়, তার বিষ খুব সহজেই লাখ লাখ মানুষ মারতে পারে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি যে চর্চা শুরু করেছিলো, সেই একই চর্চা দিয়েই তাদের ঘায়েল করা হয়েছে। মিত্রশক্তির মূল প্রেরণাই ছিল জার্মান নাৎজি বাহিনীর বিরুদ্ধে অবিমিশ্র ঘৃণা! বাস্টার্ডসদের পরিচয়পর্বের শুরুতে লেফটেন্যান্ট আলডো র্যাইন-এর চরিত্র রূপায়নকারী ব্র্যাড পিট তাই বলে,
" And once we’re in enemy territory, as a bushwhackin’ guerrilla army, we’re gonna be doin’ one thing and one thing only… killin’ Nazis. Now, I don’t know about y’all, but I sure as hell didn’t come down from the goddamn Smoky Mountains, cross five thousand miles of water, fight my way through half of Sicily and jump out of a fuckin’ air-o-plane to teach the Nazis lessons in humanity. Nazi ain’t got no humanity. They’re the foot soldiers of a Jew-hatin’, mass murderin’ maniac and they need to be dee-stroyed."
এমন ঘৃণা থেকে কি যুদ্ধের শুরু হয়? নাকি যুদ্ধের মধ্যে দিয়েই এই ঘৃণার জন্ম? আমি এই প্রশ্নের দোলাচলে ভাসছি এখনও। টারান্টিনোর পরিচালনার গুণ এটাই যে বৃহদাকার কোন প্লট আর প্লাটফর্ম ছাড়াই এক অল্টারনেটিভ ওয়ার মুভি তিনি বানতে পারেন, যেখানে গোলাগুলির সংঘর্ষের চাইতে ক্রুর পৈশাচিক হাসির ক্ষমতা বেশি, বেয়োনেটে খুঁচিয়ে মারার চেয়ে নিষ্ঠুরতা হলো কপালে স্বস্তিকার চিহ্ন এঁকে দেয়া।
***
পুনশ্চঃ আমি ছবিটা দেখতে দেখতে মন খারাপ করছিলাম যে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কবে এই ধরনের গভীরতা ধারণ করা চলচ্চিত্র তৈরি হবে, আর কবে আমি সেটা নিয়ে এর চেয়েও বড়ো ব্লগ লিখতে পারবো!
***
পুনঃপুনশ্চঃ লিঙ্করাজি (যারা এখনও ডাউনলোড করেন নাই বা কিনে ফেলেন নাই তাদের জন্যে ):
ডিভিডিরিপ ডাইরেক্ট ডাউনলোডঃ http://stagevu.com/video/rpcjgxzlpxfq
ডিভিডিরিপ টরেন্টঃ Click This Link
ব্লুরেরিপ ডাইরেক্ট ডাউনলোডঃ http://stagevu.com/video/cdryqqtvrleg
ব্লুরেরিপ টরেন্টঃ Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।