আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

১/১১ এর পর ডিজিএফআইয়ের নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্রঃ গুয়ান্তানামো কারাগার ফেইল

ফেসবুক আইডি:নাই

সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু আজকের যায়যায়দিনে এক সাক্ষাৎকার দেন ১/১১ এর পরবর্তী রাজনৈতিক-ব্যাবসায়ীদের নির্যাতন সম্পর্কে। শিউরে উঠার মত! আবেগতাড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর তার এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর যে অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিল তা আজো কাটেনি। তার পরিবার ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি মনে করেন, মইন শুধু রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের হয়রানি করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি জাতিকে অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিয়েছেন। জাতির স্বাধীনতার প্রতীক সেনাবাহিনীকে বিতর্কিত করে জাতির যে ক্ষতি করেছেন তার জন্য দেশের আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহী মামলা হওয়া উচিত।

বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি মইনকে কাঠগড়ায় দাঁড় না করান তাহলে দেশের মানুষ মনে করবে ক্ষমতায় এসে হালুয়া-রুটির ভাগ পেয়ে কৃতজ্ঞতাস্বরূপ তিনি তাদের মাফ করে দিয়েছেন। ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু বলেন, যারা ১১ জানুয়ারি ঘটিয়েছেন তারা নিজেদের ওলি-আল্লাহ মনে করেছিলেন। আর রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ীরা যারা সমাজের উন্নয়নের জন্য কাজ করেন তাদের শয়তানের পরে স্থান দিয়েছিলেন। গ্রেপ্তার মুহূর্তের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় তাদের এলিফ্যান্ট রোডের বাসভবন যেভাবে রেইড দেয়া হয়েছিল সে সময়কেও হার মানিয়েছেন মইনের অনুসারী কিছু সেনা কর্মকর্তা। ৩ ফেব্রুয়ারি রাতে তার বাসা যেভাবে রেইড দেয়া হয়েছিল তাতে তার মনে হয়েছে তিনি কোনো এক দুর্ধর্ষ, দাগী খুনি অথবা আন্ডারওয়ার্ল্ডের কোনো ডন।

সব ধরনের সমরাস্ত্র তারা নিয়ে এসেছিল। বাড়ির বাবুর্চি মন্টুকে তারা নির্দয়ভাবে পিটিয়েছে। অনেকদিন সে জীবনের সঙ্গে লড়াই করে বেঁচেছে। প্রাণে বেঁচে যাওয়ার পর সে বিদেশি জাহাজে বাবুর্চির চাকরি নিয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যায়। সে ছিল তাদের দীর্ঘদিনের পারিবারিক বাবুর্চি।

বাড়িতে পাহারারত দারোয়ানকে হাত-পা বেঁধে বাড়ির ভেতর ফেলে রেখেছিল। এছাড়া মেজর সানাউলের নেতৃত্বে যৌথবাহিনীর সদস্যরা ধরে নিয়ে বেধড়ক পেটায়। পরে অঙ্গীকার নেয় যে, তাকে মারধর করা হয়নি। সিরাজগঞ্জের ব্যবসায়ী আবদুল হামিদ ভূঁইয়াকে ধরে নিয়ে তার ২ হাজার কোটি টাকা কোথায় আছে জানতে চায়। তাকে মারধর করার কারণে তার একটি কিডনি নষ্ট হয়ে যায়।

সিরাজগঞ্জ থানা বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান লেবুকে ধরে নিয়ে বেধড়ক পেটানো হয়। এতে নেতৃত্ব দেন মেজর সানাউল, দুদকের উপপরিচালক আখতার হামিদ ভূঁইয়া এবং ডেপুটি কমিশনার নুরুল আমিন। টুকু বলেন, এরপর যৌথবাহিনীর সদস্যরা বাড়ির বেডরুমে প্রবেশ করে ভিডিও করতে থাকে। এ সময় তার স্ত্রী প্রাইভেসির কথা বলে বাধা দিলে চোখ লাল করে তাকে ধমক দেয়। এরপর তাকে দুই হাত পেছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে চোখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যায়।

চোখ খোলার কিছু পরে বুঝতে পারেন তাকে পিলখানার বিডিআর জওয়ানদের মেসে নিয়ে রাখা হয়েছে। সেখানে দুদিন দুরাত রাখা হয়েছিল। দ্বিতীয় রাতে নাসের রহমানকে তার রুম থেকে সরিয়ে নেয়া হয় এবং তার রুমে একটি টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার সেট করা হয়। বাইরে অনেকে জানালার পাশ দিয়ে ঘোরাফেরা করছিল। মনে হচ্ছিল তারা শক্রকে আক্রমণ করার মহড়া দিচ্ছে।

এ সময় মনে মনে আল্লাহকে ডাকছিলেন। তারপর একজন এসে ফাঁসির আসামির মতো কালো কাপড়ে চোখ বেঁধে তাকে চেয়ারে নিয়ে বসায়। বসানোর পর পাঁচ-ছয়জন সেনা অফিসার তার দিকে এমনসব প্রশ্ন ছুড়তে লাগলেন যাতে মনে হয়েছে, অর্থনীতি, সমাজনীতি, বিজ্ঞান ও প্রকৌশলসহ সব বিষয়ে তারা প-িত। চোখ বাঁধা অবস্থায় তাকে চা এবং সিগারেট খেতে বলা হয়। দেশের জনগণের ট্যাক্সের টাকায় চলা সেনাবাহিনীর সদস্যরা এ ধরনের ব্যবহার করতে পারে কি না তার বিচারের ভার জনগণের।

এরপর তাকে জেলখানায় নেয়া হয়। সেখানে এক রুমে মোট ২২ জনকে রাখা হয়। সেখানে একটা মাত্র টয়লেট ছিল। দুটি করে কম্বল দেয়া হয়। এভাবে জেলখানায় প্রথম রাত কাটাতে হয়।

এর তিনদিন পর ডিটেনশনের কাগজ পৌঁছানো হয়। তাতে বলা হয়, তিনি রোডস অ্যান্ড হাইওয়ের একটি টেন্ডার ছিনতাই করেছেন এবং বাইরে একটি রাষ্ট্র সম্পর্কে খারাপ মন্তব্য করেছেন যার কারণে ওই রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের অবনতি হয়েছে। টুকু বলেন, হঠাৎ করে ১২ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় ফরমান জারি করা হলো তাদের আর ঢাকা জেলে রাখা হবে না। তারা বললেন, যতোক্ষণ না গন্তব্যের কথা বলা হয় ততোক্ষণ তারা অনিশ্চয়তার মধ্যে জেল থেকে বের হবেন না। ডিআইজি প্রিজন এসে সাধারণ আসামিদের মতো একে একে তাদের নাম ঘোষণা করেন।

এ সময় তাকে ও আমানউল্লাহ আমানকে চট্টগ্রাম জেলে, আওয়ামী লীগ নেতা নাসিম ও লোটাস কামালকে সিলেট, আলী আজগার লবী ও নাসের রহমানকে কুমিল্লা, মঞ্জুরুল আহসান মুন্সী ও মীর নাসিরকে বগুড়া, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও নাজমুল হুদাকে রংপুর, সালাহউদ্দিন আহমেদ ও মোসাদ্দেক আলী ফালুকে খুলনায় পাঠানো হয়। রাতেই তাদের একটি মাইক্রোবাসে করে চট্টগ্রামে নিয়ে যায়। এ সময় মাইক্রোবাসের সামনে, পেছনে এবং পাশে র‌্যাব ও পুলিশ ছিল। টানা আট ঘণ্টা জার্নিতে প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে চাইলেও তা সম্ভব হয়নি। তখন মনে হয়েছে হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যাবে।

তিনি বলেন, চট্টগ্রামে পৌঁছার পর দেখতে পেলেন সেখানে ময়মনসিংহ থেকে সাবেক জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী এ কে এম মোশাররফ হোসেনকে আনা হয়েছে। পরে সেখানে চট্টগ্রাম পোর্ট ও ওয়াসার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের আনা হয়। তাদের কারো পা ফুলে হাতির পায়ের মতো হয়েছে এবং কারো মুখ ফুলে বেলুনের মতো হয়েছে। তারা মাটিতে পা রাখতে পারছিলেন না। বহুদিন তারা বিছানায় পড়েছিলেন।

এ বর্বর নির্যাতন দেখে প্রতিদিন আতঙ্কিত হতেন কবে না আবার তার ওপর এমন নির্যাতন হয়। আফ্রিকার জঙ্গলে থাকা অধিবাসীদের যেভাবে দমন করা হতো সেভাবে তাদের দমন করার চেষ্টা করা হয়েছে। স্ত্রী, পুত্র, সন্তানদের সঙ্গে দেখা হতো ১৫ দিনে একবার। তাও অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে। যখন তারা আসতো তখন আবার বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা থাকতো।

তাদের কারণে মন খুলে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারতেন না। তিন মাস পর সেখান থেকে ঢাকা জেলে আনা হয়। সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী বলেন, ছয় মাস পর তার নামে মামলা হয়। মামলা দেয়া হয় দুর্নীতি এবং আয়কর সংক্রান্ত। এর সঙ্গে তার মন্ত্রণালয়ের কোনো সম্পর্ক ছিল না।

এরপর দেড় বছর টঙ্গী কাশিমপুরের ১ ও ২ নাম্বার জেলে রাখা হয়। পরে সেখানে আলী আজগার লবী, ওবায়দুল কাদের, মোসাদ্দেক আলী ফালু, সালাহউদ্দিন আহমেদ, নাসের রহমানকে আনা হয়। তাদের রিমান্ডের নামে নির্যাতন করা হয়েছে। রিমান্ড শেষে জেলে ফেরার পর তাদের শরীরের ভয়াবহ ক্ষতচিহ্নের কথা মনে হলে এখনো তিনি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ফালু রিমান্ড শেষে যখন জেলে ফেরেন তখন তার মাথায় ঘা হয়ে গিয়েছিল।

ইলেকট্রিক শকে সারাশরীরে চামড়ার পিগমেন্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। কোমরে মারাত্মক ব্যথা ছিল। মনে হচ্ছিল, এই মাত্র কবর থেকে উঠে এসেছেন। সালাহউদ্দিন আহমেদ এবং নামের রহমানের শরীরে আঘাতের কালো দাগ ফুটে উঠেছিল। রক্ত জমাট বেঁধে ছিল তাদের শরীরে।

সেই ব্ল্যাকহোলে রাত যখন গভীর হতো তখন কিছু অফিসার এসে তাদের ওপর চলা অত্যাচারের লীলা উপভোগ করতেন। অনেকটা নাইট ক্লাবে যেমনভাবে নগ্ননৃত্য দেখে ক্লাবে আসা লোকেরা। এমনভাবে বিকৃত রুচির পরিচয় দিয়েছেন তারা। তার পরিবারের সদস্যরাও এদের নির্যাতন থেকে রেহাই পাননি। তাদের নির্যাতনের কারণে তার শাশুড়ি এবং বড় বোনকে জীবন দিতে হয়েছে।

তারা দুজনই শোকে মারা গেছেন। এভাবে সবার সংসারে যে অমানিশার অন্ধকার নেমে এসেছিল তা আজো কাটেনি। সবাই আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন। সে ঘটনার তিনটি বছর কেটে গেলেও তার বিরুদ্ধে বহুল প্রচলিত খাম্বা বা অন্য কোনো দুর্নীতির মামলা আনতে পারেনি। এখন মনে হচ্ছে এগুলো মুখরোচক গল্প ছাড়া আর কিছু ছিল না।

তিনি আরো বলেন, যৌথবাহিনীর লোকজন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান এবং সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার দুই ছেলে তারেক রহমান এবং আরাফাত রহমান কোকোর ওপর অমানুষিক নির্যাতন করেছে, যার কারণে তারা দুজনই দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসা নেয়ার পরও এখনো সুস্থ হতে পারছেন না। তাদের এমনভাবে নির্যাতন করা হয়েছে যা সাধারণত ঔপনেবিশক শাসকদের পেটোয়া সেনাবাহিনীও করে না। জেলে আরাফাত রহমান কোকোকে দেখে মনে হয় তার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। তার মুখ নীল হয়ে যাচ্ছিল। তিনি বলেন, তার স্ত্রীর কাছে টাকা চেয়েছিল যৌথবাহিনীর লোকজন।

তার স্ত্রী তাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, কষ্টে অর্জিত টাকা দেয়া যাবে না। এজন্য অত্যাচারের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। টুকু বলেন, এসব কারণে মইনকে কোনো ছাড় দেয়া হবে না। তার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। আদালত বলছেন, ঘটনার এক বছরের মধ্যে মামলা করেননি বলে তা টিকবে না।

তিনি বলেছেন, তিনি তো তখন জেলে বন্দি ছিলেন। এছাড়া তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে মামলা করার পরিবেশও ছিল না। কেউ মামলা করতে চাইলেও সম্ভব হতো না। এ অবস্থায় নিম্ন আদালতে কিছু না হলে হাইকোর্টে যাবেন তিনি। হাইকোর্টে না হলে সুপ্রিমকোর্টে যাবেন।

যেভাবেই হোক মইনকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন তিনি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।