আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইউনিকোড কী ও কেন?

"ধর্মীয় কুসংস্কারে যারা আবদ্ধ তারা সব সময়েই দরিদ্র থাকে। " মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন ব্যক্তিগত বা দাপ্তরিক প্রয়োজনে আমরা প্রায়শই কোন-না কোন চিঠি, নথিপত্র কিংবা দলিলাদি কম্পিউটারে বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষায় টাইপকরে (যাকে আমরা কম্পিউটার কম্পোজ বলি) ব্যবহার করি। কখনো-কখনো আবার বিভিন্ন সামাজিক সাইটে স্ট্যাটাস প্রদান বা ই-মেইলও করে থাকি। অপারেটিং সিস্টেম (যেমনঃ উইন্ডোজ এক্সপি/ভিসতা/সেভেন অথবা লিনাক্স) ইন্সটল করা নতুন একটি সক্রিয় কম্পিউটারে বাংলা অথবা ইংরেজি ভাষায় টাইপ করতে হলে বা কম্পিউটারটি টাইপিং –এর উপযোগী করতে হলে ব্যবহারকারীকে কয়েকটি বিষয় বিবেচনায় আনতে হবে। অন্যথায় কম্পিউটারে মার্তৃভাষা কিংবা অন্য কোন ভাষায় টাইপিং কার্যক্রম সম্পাদন করা সম্ভব নয়।

একটি কম্পিউটারকে বাংলা অথবা ইংরেজী লিখার জন্য উপযোগী করতে হলে চারটি বিষয় বিবেচনায় আনা প্রয়োজন। প্রথমত, টেক্সট এডিটর বা ওয়ার্ড প্রসেসিং সফ্টওয়্যার। যে সফ্টওয়্যারটি ব্যবহার করে আমরা স্ক্রিণে টাইপ করি সেটা। দ্বিতীয়ত, কী-বোর্ড লে-আউট অর্থাৎ কী-বোর্ডের কোন্ কী (key) প্রেস করলে কোন্দ ক্যারেক্টার টেক্সট এডিটর সফ্টওয়্যারের স্ক্রীনে দেখা যাবে তা। তৃতীয়ত, ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারফেইস সফ্টওয়্যার এবং চতুর্থ, ফন্ট/অক্ষর হলো কী-বোর্ডের কোন কী (key) প্রেস করলে তার বিপরীতে যে ক্যারেক্টার এডিটর স্ক্রীন এ দেখা যায় তা।

কম্পিউটারে বহুল ব্যবহৃত অপারেটিং সিস্টেম গুলোতে ডিফল্ট ল্যাঙ্গুয়েজ হিসেবে ইউএস-ইন্টারন্যাশনাল ল্যাঙ্গুয়েজ ও তার উপযোগী ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারফেইস সফ্টওয়্যার ও ফন্ট সেটআপ করা থাকে। আর সমগ্র বিশ্বেই ইংরেজি ভাষায় টাইপকরার ক্ষেত্রে ইউএস-ইন্টারন্যাশনাল কী-বোর্ড লে-আউট ব্যবহার করা হয়। ফলে স্থান, কাল, পাত্রভেদে অনায়েসে ইংরেজিতে টাইপ করা ও ইংরেজিতে লিখা যেকোন ডকুমেন্ট পড়া যাচ্ছে। কিন্তু ইংরেজি ছাড়া অন্য কোন্ ভাষার ক্ষেত্রেই যত বিপত্তি। এখন কথা হচ্ছে, আপনার কম্পিউটার যদি বাংলা লিখা ও পড়ার জন্য উপযোগী হয়ে থাকে তবে আপনি অনায়াসে মার্তৃভাষা বাংলায় কাজ করতে পারবেন।

কিন্তু আপনার কম্পিউটারে বাংলায় টাইপ করা কোন ডকুমেন্ট যদি অন্য কোন কম্পিউটারে (পেনড্রাইভ, ল্যান, ই-মেইলে কিংবা অন্য কোন্ মাধ্যম ব্যবহার করে ট্রান্সফার করে) পড়তে, দেখতে, কোন পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে চান তবে তা সম্ভব নাও হতে পারে। কারণ সেটা বিকৃত হয়ে যাবার ভয় থেকেই যায়। আর এই বিপত্তি দুর করতেই যে ভাষায় টাইপ করতে চাই তার উপযোগী ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারফেইস সফ্টওয়্যার ও ইউনিকোডভিত্তিক ফন্ট প্রয়োজন। বাংলা টাইপিং জন্য বর্তমানে জনপ্রিয় ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্টারফেইস সফ্টওয়্যার হলো বিজয় ও অভ্র। বিজয় বাণিজ্যিক হলেও অভ্র সকলের জন্য উন্মুক্ত।

মূলত, কম্পিউটারে শুধু সংখ্যার ব্যবহার হয়। কম্পিউটারে লিপি বা অন্যান্য অক্ষর সংরক্ষিত হয় সেই অক্ষরগুলির প্রতিটির পিছনে একটি করে একক সংখ্যা দিয়ে। ইউনিকোড আবিষ্কার হওয়ার আগে কম্পিউটারে ব্যবহারের জন্য শত শত লিপিসংকেত ছিলো ঐ একক সংখ্যা হিসাবে ব্যবহারের জন্য। একটি লিপিসংকেতের পক্ষে সব অক্ষরের সমর্থন দেয়া সম্ভব ছিলো নাঃ যেমন, ইউরোপিয় ইউনিয়নেরই অনেকরকম লিপিসংকেতের প্রয়োজন হত তাদের সব ভাষাকে সমর্থন দেয়ার জন্য। এমনকি ইংরেজির মতো একটি ভাষার স্বাভাবিক ব্যবহারের ক্ষেত্রেও একটিমাত্র লিপিসংকেত দিয়ে অক্ষর, বিরাম চিহ্ন এবং কারিগরি অক্ষরগুলির সমর্থন দেয়া সম্ভব হতো না।

সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলো যে ঐ লিপিসংকেতগুলি একটি আরেকটির সাথে ঝামেলা করত বা এখনও করে। কারণ দু'টি লিপিসংকেতে দু'টি আলাদা অক্ষরের জন্য একই সংখ্যা ব্যবহার করা হয় অথবা একই অক্ষরের জন্য আলাদা আলাদা সংখ্যা ব্যবহার করা হয়। যার জন্য, যে-কোনো কম্পিউটার (বিশেষ করে সার্ভার) -এ অনেকগুলি লিপিসংকেতের সমর্থনের প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়; তার পরেও বিভিন্ন লিপিসংকেত বা প্লাটফর্মের ডাটা প্রসেস করার সময় সেটা বিকৃত হয়ে যাবার ভয় থেকেই যায়। আর এই অবস্থা হতে উত্তরনের লক্ষ্যে ইউনিকোড এর আগমন। বিশ্বের ছোট বড় সকল ভাষাকে কম্পিউটারে কোডভুক্ত করার জন্য ইউনিকোড ব্যবহৃত হয়।

ইহা মূলতঃ ২ বাইট বা ১৬ বিটের কোড (Unicode Transformation Format-16 or UTF-16)। এই কোডের মাধ্যমে ৬৫,৫৩৬ টি অদ্বিতীয় চিহ্নকে নির্দিষ্ট করা যায়। ফলে যে সমস্ত ভাষাকে কোডভুক্ত করার জন্য ৮ বিট অপর্যাপ্ত ছিল (চাইনিজ, কোরিয়ান, জাপানিজ ইত্যাদি) সে সকল ভাষার সকল চিহ্নকে সহজেই কোডভুক্ত করা সহজতর হয়েছে। ইউনিকোড পৃথিবীর প্রতিটি ভাষার প্রতিটি অক্ষরের জন্য একটি একক সংখ্যা/নম্বর বরাদ্দ/প্রদান করে, সেটা যে প্লাটফর্মের জন্যই হোক, যে প্রোগ্রামের জন্যই হোক, আর যে ভাষার জন্যই হোক। ইউনিকোডের এই বৈশিষ্ট্য প্রযুক্তিশিল্পে নেতৃত্ব দিচ্ছে এরকম কোম্পানিগুলি যেমন, Apple, HP, IBM, JustSystem, Microsoft, Oracle, SAP, Sun, Sybase, Unisys সহ অনেকেই গ্রহণ করেছে।

অনেক অপারেটিং সিস্টেমে, নতুন সব ইন্টারনেট ব্রাউজারে এবং এরকম অনেক এ্যপ্লিকেশনে ইউনিকোডের সমর্থন রয়েছে। ইউনিকোড বৈশিষ্ট্যের উত্থান, একে সমর্থন করে এরকম টুলের উপস্থিতি, বর্তমান বিশ্বের সফটওয়্যার উন্নতির গতির জন্য গুরুত্বপুর্ণ। বিশাল লিপিসংকেতের সমর্থন থাকায় ক্লায়েন্ট সার্ভার বা বহুমুখী এ্যপ্লিকেশন এবং ওয়েবের গঠনে পুরনো লিপিমালার ব্যবহার না করে ইউনিকোডের ব্যবহার অনেক খরচ কমিয়ে আনতে পারে। ইউনিকোড কোনো বাড়তি প্রকৌশল ছাড়াই একটি সফটওয়্যার বা ওয়েবসাইটকে বিভিন্ন প্লাটফর্ম, ভাষা এবং দেশে ব্যবহারযোগ্যতা দেয়। এটা ব্যবহারের ফলে ডাটা বিভিন্ন সিস্টেমের মধ্যে দিয়ে আনাগোনা করতে পারে কোনো রকম বিকৃতি ছাড়াই।

ইউনিকোড সংক্রান্ত এই কাজগুলো করে থাকে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম। ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিবন্ধিত একটি অলাভজনক বেসরকারী সংস্থা যেটা তৈরী হয়েছে ইউনিকোড বৈশিষ্ট্যের উন্নয়ন, ব্যবহার এবং বিস্তার করার জন্য, যেটা আধুনিক সফটওয়্যার এবং বৈশিষ্ট্যর প্রতিনিধিত্ব করে। এই কনসোর্টিয়ামের সদস্যপদ গ্রহণকারীরা কম্পিউটার তথ্য প্রক্রিয়াকারী শিল্পের কর্পোরেশন বা সংগঠনে তথ্য বিস্তৃতি করার জন্য বোর্ড হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। আশার কথা এই যে, বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের ইনস্টিটিউশনাল সদস্য হয়েছে। ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে বাংলাদেশঃ গত ১৮ মার্চ ২০১০ তারিখে এই সদস্যপদের জন্য আবেদন করে সদস্য চাঁদা বাবদ বারো হাজার ডলার পরিশোধ করে গত ৩০ জুন ২০১০ তারিখে এই সদস্যপদ লাভ করে।

‘আমার বর্ণমালা’ নামে ইউনিকোডভিত্তিক নতুন একটি বাংলা ফন্ট তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে বাংলা একাডেমী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাফিক ডিজাইন বিভাগ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রকল্প। কম্পিউটার টাইপিং –এ ব্যবহারের জন্য, এটাই হবে বাংলা একাডেমীর তত্ত্বাবধানে বানানো প্রথম ফন্ট। এ ফন্টে ইউনিকোড সুবিধার সঙ্গে প্রমিত বাংলা, যুক্তাক্ষর ও নতুন সংস্করণের প্রযুক্তির সমন্বয় করা হবে বলে জানানো হয়েছে। আগামী আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে নতুন এ ফন্টটি বিনা মূল্যে ব্যবহারের জন্য অবমুক্ত করা হতে পারে। এ বিষয়ে বাংলা একাডেমীর অংশগ্রহণ দেরিতে হলেও তা প্রসংশার দাবিদার।

কেননা এতে করে কম্পিউটারে বাংলা টাইপিং এর জন্য জাতীয়ভাবে গ্রহণযোগ্য একটি ইউনিকোডভিত্তিক ফন্ট পাওয়া যাবে। [ লেখকঃ মোহাম্মদ মোয়াজ্জেম হোসেন, প্রোগ্রামার, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি), পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, ঢাকা। ই-মেইলঃ ] ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১৪ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।