আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মধ্যপন্থিদের স্বরূপ ও বিভ্রান্তির ঘরদরজা



মধ্যপন্থিদের স্বরূপ ও বিভ্রান্তির ঘরদরজা ফকির ইলিয়াস ====================================== মৌলবাদী ডানপন্থিদের সহজে চেনা যায়। কিন্তু মধ্যপন্থিদের খুব সহজে চেনা যায় না। জানা যায় না তাদের প্রকৃত মতলব। এরা নিজেকে খুব রহস্যময় করে রাখতে চায়। লুকিয়ে থাকে।

কখনও প্রগতিবাদী, আবার কখনও পতিতদের সঙ্গে উঠাবসা করে। সবই করে নিজেদের হীন স্বার্থের জন্য। এই স্বার্থ মৌলবাদের চেয়েও ভয়ঙ্কর। এই দীনতা কলুষিত করতে চায় সমাজকে। প্রজন্মের প্রত্যয়ে আঘাত হানার চেষ্টা করে।

এরা বিভ্রান্ত করতে চায় গোটা ইতিহাসকে। এই বিভ্রান্তবাদীদের প্রচেষ্টা বাংলাদেশে নতুন নয়। এরা বারবার হীন চেষ্টা করেছে। এখনও করে যাচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের মহান মুক্তি সংগ্রামকে নিয়ে তাদের যত গা-জ্বালা।

কারণ তারা একাত্তরে পরাজিত হয়েছিল। বাংলার মানুষ তাদের হারিয়ে দিয়েছিল। সেই বেদনা তারা এখনও ভোলেনি। তাই ডিসেম্বর মাস এলেই তারা নানা মিথ্যার বেসাতি ছড়ায়। নানাভাবে বলতে চায়, পাকিস্তানের অখন্ডতাই ছিল শান্তির আবাসস্থল।

কী সাংঘাতিক কথাবার্তা! এরা ইতিহাস বিকৃত করার জন্য নানা মিথ্যা, উদ্দেশ্যমূলক, বানোয়াট তথ্য ও অনুমান হাজির করে। বাস্তবতাকে অস্বীকার করতে চায়। শহীদদের পবিত্র রক্তের সঙ্গে বেঈমানি করার ধৃষ্টতা দেখায়। খুব কৌশলে নানা কথা বলে। এসব রাজাকারদের সৌভাগ্য, তারা এখনও বাংলার মাটিতে অবস্থান করে মিথ্যা অপপ্রচার করতে পারছে।

যুদ্ধাপরাধের দায়ে এদের বিচার যদি অনেক আগে সম্পন্ন করা যেত তবে তারা এমন কথাবার্তা চলতে পারত না। সেটা আমরা পারিনি। আর পারিনি বলেই তারা মহান বুদ্ধিজীবী দিবসে, মহান বিজয় দিবসে নানা মিথ্যা কথা লিখছে। নানান ধুয়া তোলে আলোচনার নামে প্রকারান্তরে পাকিস্তানি হায়েনাদের পক্ষে সাফাই গাইছে। ঘাতক রাজাকারদের মুখপত্র বলে পরিচিত 'দৈনিক সংগ্রাম' পত্রিকায় গেল ১৪ ডিসেম্বর ২০০৯ সোমবার একটি সম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে।

ওই সম্পাদকীয়তে অত্যন্ত নির্লজ্জ মিথ্যাচার করা হয়েছে আমাদের বুদ্ধিজীবীদের বিষয়ে। লেখাটিতে যা বলা হয়েছে তার স্পষ্ট অর্থ হচ্ছে এই, পাকিস্তানের বশ্যতা স্বীকার করে যেসব বুদ্ধিজীবী বাংলাদেশে থেকে গিয়েছিলেন, তারাই নাকি হত্যার শিকার হন। যারা ভারতে পালিয়ে যাননি, তাদের নাকি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারতীয় 'র' এর এজেন্ট, ভারতীয় কমান্ডো বাহিনী এসে হত্যা করে। কি চরম মিথ্যাচার! কত বড় পাষন্ড হলে শহীদ বুদ্ধিজীবীদের নিয়ে এমন মিথ্যাচার করে সম্পাদকীয় লেখা যায়। আমাদের মহান বিজয়ের ৩৮ বছর পর এসব কিসের আলামত? কারা এই প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার জন্য মাঠে নেমেছে? তাদের এজেন্ডা কি? তারা এমন সাংঘাতিক মিথ্যাচার কেন করছে? সবচেয়ে বেদনার কথা হচ্ছে, এসব রাজাকার হোতাদের মদদ দিচ্ছে এদেশের একটি বিভ্রান্ত মধ্যপন্থি শ্রেণী।

যারা মুখে বললেও, মনেপ্রাণে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বে বিশ্বাস করে না। যারা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাশাপাশি, একাত্তরের একজন সেক্টর কমান্ডার জিয়াউর রহমানকে আসন দেয়ার জন্য পাঁয়তারা করে। সব সত্য ইতিহাসকে মিথ্যা বানাতে চায়। দুই. বাংলাদেশে মধ্যপন্থিদের প্রধান এবং শেষ আশ্রয়স্থল হচ্ছে ডানপন্থি মৌলবাদীরা। কিছু বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা 'মানবতা', 'আধ্যাত্মিকতা' এবং 'বিবর্তন' এর লেবাস পরে মূলত ডানপন্থি মৌলবাদীর পক্ষে কাজ করে যান।

তারা ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মপালন না করলেও আড়ালে-আবডালে ধর্মের ধ্বজা ধরে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসী হন। এসব 'আধুনিক চিন্তার' ঝান্ডাধারীরা প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশে রাজাকার-আল-বদরদের ইচ্ছাকেই বাঁচিয়ে রাখতে নানাভাবে মাঠে কাজ করে যাচ্ছেন। আমরা দীর্ঘদিন থেকে শুনছি, একটি মহল বলে আসছে, বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষ শহীদ হননি। এ নিয়ে তারা নানা খোঁড়াযুক্তি দাঁড় করার প্রয়াসও দেখিয়েছে, এখনও দেখাচ্ছে। আর এদের সমর্থন করছেন বুকে লাল-গোলাপধারী স্যুট-টাই পরা এক ধরনের বুদ্ধিজীবী।

এরা কারা? যারা একাত্তরের রাজাকারদের এজেন্ডা বাস্তবায়নে এখনও তৎপর তারা তো মূলত মহান বিজয়ের বিপক্ষেরই লোক। বাংলার মানুষ এদের বিশ্বাস করবে কীভাবে? করা কী উচিত? একাত্তারের নরঘাতক গোলাম আযম প্রকাশ্যে বলেছে, ওই সময় রাজাকার বাহিনী তৈরি করা না হলে নাকি পূর্ব পাকিস্তানের পাঁচ কোটি মানুষকেই প্রাণ দিতে হতো। যারা একাত্তর দেখেছেন, তারা কি তার এই তত্ত্বটি মানবেন? প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলতে পারি, রাজাকাররা পাকিস্তানি বাহিনীর 'খোশ তোয়াজ' করা ছাড়া আর কোন মহৎ (!) কাজই করেনি। পাকিস্তানি বাহিনীর ছত্রছায়ায় তারা লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণ, ব্যাভিচারের মতো জঘন্য কাজের পাহারা দিয়েছে। তাদের প্রভুদের মনোরঞ্জন করেছে।

এখন তারা বলছে, তারাই নাকি ছিল মাতৃভূমির রক্ষক। ভন্ডামি আর কা'কে বলে ! বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সর্বাত্মক প্রস্তুতি যখন চলছে তখন সেইসব ঘাতক আল-বদররা বলছে, তারা নাকি তা রাজপথেই মোকাবেলা করবে। লাখো শহীদের রক্তে ভেজা বাংলার রাজপথটি যেন তাদের তালুকের সম্পত্তি। অথচ এই রাজপথে এখনও বাংলার অধিকার- কামী মানুষ সহস্রগুণ সোচ্চার রয়েছেন। স্বাধীনতাবিরোধী এই চক্রটি এখন বলে বেড়াচ্ছে, বিজয়ের মূল লক্ষ্য- অর্থনৈতিক মুক্তি সাধিত হয়নি।

যদি এর পেছনে ফিরে তাকানো যায় তবে দেখা যাবে, অর্থনৈতিক মুক্তির প্রধান অন্তরায় হয়েছে বাংলাদেশে সামরিক জান্তাদের শাসন। যা ক্রমশ ঘাতক দালালদের রাজনীতিকে পুনর্বাসিত করেছে। দেশে মৌলবাদের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে। ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য ধর্মের দোহাইয়ের নামে জঙ্গিবাদী তৈরি করেছে। সন্ত্রাসীদের প্রত্যক্ষ মদদ দিয়েছে।

এই অপতৎপরতা বাঁচিয়ে রাখতে এখনও তারা কাজ করে যাচ্ছে নিরন্তর। তাদের স্বপ্ন বাংলাদেশেও 'তালেবানি শাসন' কায়েম হবে। মধ্যপন্থিরা, বাংলাদেশে বিভ্রান্তির ঘর দরজা তৈরি করতে চাইছে খুব কৌশলে। এজন্য তারা স্যুট-টাই পরা কিছু এজেন্টও নিয়োগ করেছে মোটা অঙ্কের মাসোয়ারা দিয়ে। যেসব তাত্ত্বিকরা সময়ে-সুযোগে জাতীয় সঙ্গীত, রাষ্ট্রীয় ভাস্কর্য, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালির জাতিসত্তার চেতনা, বাঙালি সংস্কৃতির শিকড় প্রভৃতির বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার চালাচ্ছে।

নগ্ন মিথ্যাচার করছে। তারা প্রজন্মকে উপদেশবাণী শোনাচ্ছে- 'নিরপেক্ষ' ব্যক্তিদের কাছ থেকে সঠিক ইতিহাস জানার। এই 'নিরপেক্ষ' ব্যক্তিগুলো কারা? একাত্তরে কোন দেশপ্রেমিক বাঙালিই নিরপেক্ষ ছিলেন না। ছিলেন জন্মমাটির পক্ষে। আর বিপক্ষে ছিল আল-বদর,রাজাকার ও আল-শামসরা।

এই নিরপেক্ষতার ধুয়া যারা তুলতে চায় এরাও রাজাকারের উত্তরসূরি, বিষয়টি প্রজন্মকে মনে রাখতে হবে। নিউইয়র্ক, ১৬ ডিসেম্বর ২০০৯ ------------------------------------------------------------------ দৈনিক সংবাদ। ঢাকা। ১৮ ডিসেম্বর ২০০৯ শুক্রবার প্রকাশিত ছবি- সাফিন ওমর

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.