আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সবক'টা জানালা খুলে দাওনা.........

সব কিছুর মধ্যেই সুন্দর খুঁজে পেতে চেষ্টা করি............

সবক'টা জানালা খুলে দাওনা........ গত কাল ছিল আমাদের মহান বিজয় দিবস। কয়েক দিন পুর্বে-টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠানমালার প্রমোশনাল প্রচারিত হচ্ছে। আমার ছোট ছেলে ড্রয়িংরুমে বসে টিভি দেখছে। সাথে আমি, বাসায় বেড়াতে আসা আমার শ্রদ্ধেয় কাজিন, যিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা, নাম আঃ মজিদ(বীর বিক্রম), পেশায় প্রাক্তন সেনা সদস্য এবং স্কুল শিক্ষক-যিনি বরিশাল থেকে এসেছেন ১৬ ই ডিসেম্বর রাস্ট্রীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। আমার বাসায় বেড়াতে এসেছেন, এখানেই থাকবেন অন্যান্য বছরের ন্যায়।

আমরা কথা বলছি আর টিভি দেখছি। মুক্তিযুদ্ধের একটি বিশেষ নাটকের প্রমোশনাল দেখতেই মজিদ সাহেব আমার ছোট ছেলেকে বললেন, বাবা ১৬ তারিখ মনে করিয়ে দিস তো এই নাটকটা দেখব সবাই মিলে। ছেলে বলল, চাচা এটা তো রাত সারে আট'টায়। তখনতো এইচবিওতে ম্যাট্রিক্স / দ্যা টাইম মেশিন দেখাবে। আমরা তো সেটা দেখতে চাচ্ছিলাম।

বীর মুক্তি যোদ্ধা মজিদ সাহেব বললেন, তোরা তো বুঝিস না-ঐ নয় মাসে কী দিনগুলো অতিক্রম করেছিলাম আমরা। কীভাবে এই দেশ স্বাধীন করেছিলাম। তাই তোরা মুক্তিযুদ্ধের নাটক দেখতে চাস না। ছেলে বলল, চাচা, সত্যি বলতে কী, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক কোনোকিছুই আমাকে টানে না। সে নাটক, সিনেমা, বই যাই হোক।

মজিদ সাহেব আমার বড় ছেলেকে প্রশ্ন করল-তার মনোভাব জানার জন্য। সেও একই উত্তর দিল। বড় ছেলে বলল- "চাচা, কোনটা গ্রহণ করব আমরা? কয়েক বছর আগে বইয়ে পড়া মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের সঙ্গে বর্তমান ইতিহাসের অমিল। ইতিহাস কী তাহলে পরিবর্তন বা বানানো যায়। আর যদি তাই হয় তবে বানানো ইতিহাস জানতে আমার কোনো আগ্রহ নেই"।

আমার বড় ভাই বীর মুক্তি যোদ্ধা মজিদ সাহেব নিশ্চুপ। বড়ছেলে আবার বলল, "চাচা, নাটক সিনেমার কথা না হয় বাদ দিলাম। আপনি আর হাফিজ (মেজর(অবঃ) হাফিজউদ্দীন আহমেদ, বীর বিক্রম)আঙ্কেলতো একসাথে যুদ্ধ করেছেন। দুই বন্ধুইতো বীর মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। কিন্তু এখনতো দুজনে দুরকম মুক্তিযুদ্ধের কথা বলেন।

কেউ কাউকে সহ্য করতে পারেননা। বলেন চাচা আমরা কোনটা বিশ্বাস করব"। আমরা কী চাই? স্বাধীনতা আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন। কিন্তু নয় মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে লক্ষ লক্ষ শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার উদ্দেশ্য কী ছিল। অবশ্যই দেশকে, দেশের মানুষকে পরাধীনতার বেড়াজাল থেকে মুক্ত করে জুলুম-অত্যাচার থেকে রেহাই দেয়া।

কিন্তু স্বাধীনতার পর কি বাংলাদেশে শান্তি ফিরে এসেছে। এই প্রজন্মের তরুণ-তরুণীরা যা দেখছে তাতে তারা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে বেশ চিন্তিত। একটি কিশোর বা কিশোরী যখন প্রথমবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প শোনে সেই একবারের জন্য হলেও আগ্রহ নিয়ে জানতে চায় স্বাধীনতা সম্পর্কে। কিন্তু দ্বিতীয়বার যখন ইতিহাস পাল্টে যায় তখন তারা আশাহত হয়। বিশ্বাস হারায়।

কৌতুহল বশত আমি বজিয় দিবস এবং মুক্তি যুদ্ধ নিয়ে আমার নিকট প্রতিবেশী বেশ কয়েকজন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণ-তরুণীর সাথে কথা বলছি। তাদের মতামতের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলোঃ- বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রাজীব আহমেদ বললেন, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাস একটি দিনে বন্দি করে রাখার নয়। শুধু ১৬ ডিসেম্বর মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান দেখালে স্বাধীনতার আসল উদ্দেশ্য ব্যাহত হবে। তরুণ প্রজন্মের মধ্যে স্বাধীনতা বা মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত বিষয়াদির প্রতি অনাগ্রহের মূল কারণ হলো আমরা স্কুলে যা পড়েছিলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে উঠতে উঠতে তা পরিবর্তন হয়ে গেছে। এটাকে পরিবর্তন না বলে বিকৃতি বলা উচিত।

এতেই আমাদের আগ্রহ নষ্ট হচ্ছে। নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটির এম বি এ'র ছাত্র শুভ। তার মতে, মুক্তিযোদ্ধারা দেশের শ্রেষ্ঠ নাগরিক। তাই শ্রেষ্ঠ সম্মানটিও তাদের প্রাপ্য। কিন্তু জাতি হিসেবে আমরা সেই সম্মান দিতে ব্যর্থ হয়েছি।

খুব কষ্ট লাগে যখন দেখি পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধারা ভিক্ষা করে। আরও কষ্ট লাগে যখন শুনি স্বাধীনতার পরে জন্ম নেয়া কিম্বা স্বাধীনতার সময়ে মাত্র ৩/৪ বছর বয়সের অনেকেরই নাকি মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট আছে এবং সেই সার্টিফিকেটের বদৌলতে এখনো চাকুরী পাচ্ছে! আমার আর এক প্রতিবেশী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী জিনিয়ার মতে, অনেকেই বলে বর্তমান তরুণ প্রজন্মের স্বাধীনতার তথা জাতীয় চেতনা নেই। আমি এর ব্যাখ্যা দেব এভাবে- স্বাধীনতা আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। মুক্তিযুদ্ধ শব্দটি শুনলেই শরীরের রক্তে একধরনের উন্মাদনা জাগে। কানে বাজে "মোরা একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি" কিম্বা "সব ক'টা জানালা খুলে দাওনা"।

কল্পনায় ভাসে লাল-সবুজের পতাকা। কিন্তু সেই কল্পনা এক মুহূর্তেই স্তব্ধ হয়ে যায় যখন শুনি কোনো মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা বিরোধীদের সাথে হাতে হাত রেখে কাজ করছে। তাহলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যুদ্ধ করেছিল কেন? আমার আর এক প্রতিবেশী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালেয়র ছাত্রী সুমাইয়ার ভাষায়, "চাচা, এই দেশের প্রতি রাগ হয় কেন জানেন? যখন দেখি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গৌরবের অধিকারী হয়েও শ্রেষ্ঠ দেশ পেলাম না। কীভাবেই বা পাব। দেশের নীতিনির্ধারকরাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না যে কে মুক্তিযোদ্ধা আর কে স্বাধীনতা বিরোধী।

নিজের স্বার্থ চরিতার্থের জন্য দেদারছে একে অপরকে দোষ দিয়ে যাচ্ছি। নিজের হীণস্বার্থে মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকার বানাচ্ছে আবার রাজাকারকে মুক্তিযোদ্ধা বানাচ্ছে! কবে শুধরাবো আমরা"? নটরডেম কলেজের ছাত্র রাফিন বললেন, স্বাধীনতার আটত্রিশ বছর পরও আমরা স্বাধীনতার সংজ্ঞা সম্পর্কে একমত নই। তাই প্রত্যেকেই স্ব স্ব ক্ষমতার সময়ে ইতিহাসের গতিধারা পরিবর্তন করছি স্ব স্ব ইচ্ছানুযায়ী। এই আটত্রিশ-ঊনচল্লিশ বছরেও আমরা নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়তে পারিনি। তরুণ প্রজন্ম এসব দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ছে।

একটি জিজ্ঞাসাঃ স্কুলে কমবেশি সবাই "প্যাট্রিওটিসম" বা "দেশপ্রেম" রচনা পড়েছি। কিন্তু সেই পড়া শুধুমাত্র পরীক্ষায় পাসের জন্য। দেশপ্রেম শেখার জন্য নয়। মুক্তিযুদ্ধের নাটক-সিনেমা কেন তরুণ প্রজন্মের কাছে পৌঁছুতে পারছে না। এটি কি নির্মাতাদের ব্যর্থতা নাকি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিকেই তরুণ-তরুণীরা তাদের চেতনায় স্থান দিতে পারছে না।

ইংরেজি মাধ্যমে পড়ুয়াদের দেখলে আরো অবাক হতে হয়। তাদের কাছে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ সবই যেন অর্থহীন। এই ব্যর্থতার ভার নেবে কে? চোখে স্বপ্ন বুকে আশাঃ এত হতাশার মধ্যেও আমাদের তরুণ-তরুণীরা আশার আলো খোঁজে। নেগেটিভ ঘটনার পজিটিভ দিক খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। সকলের বন্ধ হয়ে যাওয়া চেতনার জানালাগুলো খুলে দিতে হবে।

যাদের মধ্যে এখনও স্বাধীনতা সম্পর্কে বোধোদয় সৃষ্টি হয়নি তাদের বোঝাতে হবে এর অর্থ। তবে অবশ্যই সঠিক ইতিহাসের মাধ্যমে। সত্যকে ন্যায় ভাবে সকলের সামনে উন্মুক্ত করে দিতে হবে। ইতিহাস নির্ধারন করবে-কার অবস্থান কোথায় হবে। একটি সুন্দর সকাল চাইঃ পুরো তরুণ প্রজন্মের পক্ষে আমাদের প্রত্যাশা একটি সুন্দর সকালের।

একটি পবিত্র সূর্যোদয়ের। যেদিন বীর মুক্তি যোদ্ধা মজিদ সাহেব ও হাফিজ সাহেব পাশাপাশি বসে তাদের যুদ্ধকালীন দিনগুলোর কথা বলবেন একই সুরে। সেই গল্প শুনবে সাজিদ, জিনিয়াসহ সবাই। শ্রেষ্ঠত্বের গর্বে বুক ফুলিয়ে হাঁটবে পৃথিবীর বুকে। আমার, আমাদের এই পবিত্র ছোট্ট চাওয়াটা কী খুব বেশি হয়ে গেল?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।