আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জীবনানন্দ দাশ

কবিতা আসো এইখানে হও চরাচর

হাওয়ার রাত গভীর হাওয়ার রাত ছিলো কাল- অসংখ্য নক্ষত্রের রাত; সারারাত বিস্তীর্ণ হাওয়া আমার মশারিতে খেলেছে; মশারিটা ফুলে উঠেছে কখনো মৌসুমী সমুদ্রের পেটের মতো, কখনো বিছানা ছিঁড়ে নক্ষত্রের দিকে উড়ে যেতে চেয়েছে, এক-একবার মনে হচ্ছিল আমার- আধো ঘুমের ভিতর হয়তো- মাথার উপরে মশারি নেই আমার স্বাতী তারার কোল ঘেঁষে নীল হাওয়ার সমুদ্রে শাদা বকের মতো উড়ছে সে! কাল এমন চমৎকার রাত ছিলো। সমস্ত মৃত নক্ষত্রেরা কাল জেগে উঠেছিল-আকাশে একতিল ফাঁক ছিল না; পৃথিবীর সমস্ত ধূসরপ্রিয় মৃতদের মুখও সেই নক্ষত্রের ভিতর দেখেছি আমি; অন্ধকার রাতে অশ্বত্থের চুড়ায় প্রেমিক চিলপুরুষের শিশির - ভেজা চোখের মতো ঝলমল করছিলো সমস্ত নক্ষত্রেরা; জোছনারাতে বেবিলনের রানির ঘাড়ের ওপর চিতার উজ্জ্বল চামড়ার শালের মতো জ্বলজ্বল করছিল বিশাল আকাশ! কাল এমন আশ্চর্য রাত ছিলো। নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার-হাজার বছর আগে ম'রে গিয়েছে তারাও কাল জানালার থিবর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ায়, মিশরে বিদিশায় ম'রে যেতে দেখেছি কাল তারা অতিদূরে আকাশের সীমানায় কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে কাতারে কাতারে দাঁড়িয়ে গেছে যেন- মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য? জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য? প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য? আড়ষ্ট- অভিভূত হয়ে গেছি আমি, কাল রাতের প্রবল নীল অত্যাচার আমাকে ছিঁড়ে ফেলেছে যেনো; আকাশের বিরামহীন বিস্তৃর্ণ ডানার ভিতর পৃথিবী কীটের মতো মুছে গিয়েছে কাল! আর উত্তুঙ্গ বাতাস এসেছে আকাশের বুক থেকে নেমে আমার জানালার ভিতর দিয়ে, শাঁই শাঁই করে, সিংহের হুঙ্কারে উৎক্ষিপ্ত হরিৎ প্রান্তরের অজস্র জেব্রার মতো! হৃদয় ভরে গিয়েছে আমার বিস্তীর্ণ ফেল্টের সবুজ ঘাসের গন্ধে, দিগন্ত-প্লাবিত বলীয়ান রৌদ্রের আঘ্রাণে মিলনোন্মত্ত বাঘিনীর গর্জনের মতো অন্ধকারের চঞ্চল বিরাট সজীব রোমশ উচ্ছ্বাসে, জীবনের দুর্দান্ত নীল মত্ততায়! আমার হৃদয় পৃথিবী ছিঁড়ে উড়ে গেলো, নীল হাওয়ার সমুদ্রে স্ফীত মাতাল বেলুনের মতো গেল উড়ে, একটা দূর নক্ষত্রের মাস্তুলকে তারায়-তারায় উড়িয়ে দিয়ে চলল একটা দুরন্ত শকুনের মতো। -------------------------------------------------------------------------------- অবসরের গান ০১. শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ, তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, দেহের স্বাদের কথা কয় – বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়! চারি দিকে এখন সকাল – রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল! মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ – পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান! চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল! প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর, চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়: চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান, পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ! আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার – শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে! আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স, মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস! মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়িমির আজিকে সময়। গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্‌ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া! তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া; ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা; ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব – মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে – শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।

হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে; ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ; রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয় দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ – আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত। তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে, এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে; তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড় হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির বিছানার পর; মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর! তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল, চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল! ০২. পুরনো পেঁচারা সব কোটারের থেকে এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের পরে সবুজ ধানের নিচে — মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চলে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা; শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা! ফলন্ত মঠের’ পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান, প্রেম আর পিপাসার গান আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন! ফসল — ধানের ফলে যাহাদের মন ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা করে গেছে – পৃথিবীর সব সিংহাসন – আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড় – যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নীচে পৃথিবীর তলে কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে ফুরায় নি তাদের সময়; পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয়! প্রণয়ীর মতো তারা ছেড়ে নি হৃদয় ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে! চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে কাটায় নি — কাটায় কি কাল। অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল কোনো এক সম্রাটের সাথে মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে! যোদ্ধা — জয়ী — বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে – পাশাপাশি – জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি! অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে — তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার, সেই সব গেঁয়ো কবি — পাড়াগাঁর ভাঁড় আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর? তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল; অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইদুরের জানে তাহা — জানে তাহ নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল! সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে তাহাদের নাম ধরে যায় ডেকে ডেকে। মাটির নিচের থেকে তারা মৃতের মাথার স্বপ্নে নড়ে উঠে জানায় কী অদ্ভুত ইশারা! আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে – আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে।

সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে, পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে; শরীরের অবসাদ — হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে। শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধরে আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই মরে দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; অগাধ ধানের রসে আমাদের মন আমরা ভরিতে চাই গেয়ো কবি — পাড়াগার ভাঁড়ের মতন! – জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা নতুন লাঙল তার পড়ে আছে — পুরনো পিপাসা জেগে আছে মাঠের উপরে; সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা অই আমাদের তরে! হেমন্তের ধান ওঠে ফলে – দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে। আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ অবসর আছে তার — অবোধের মতন আহ্লাদ আমাদের শেষ হবে যখন সে চলে যাবে পশ্চিমের পানে – এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে! ০৩. ফুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার; পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই — কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই দূরে মাঠে গিয়ে আর! রোধ — অবরোধ — ক্লেশ — কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময় – জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়! আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রঙ দামামা থামায়ে ফেল — পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ! এখানে নাহিকো কাজ — উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়! সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন – জেগে থেকে ঘুমবার সাধ ভালোবেসে। এখানে চকিত হতে হবে নাকো — ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়; উদ্যমের ব্যথা নাই — এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়! এই খানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে, মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে! এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর – রাখিবে না চোখ আর নয়নের পর; ভালোবাসা আসিবে না – জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর! অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময় পৃথিবীর মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়; সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে! ------------------------------------------------------------------------------- ক্যাম্পে এখানে বনের কাছে ক্যাম্প আমি ফেলিয়াছি; সারারাত দখিনা বাতাসে আকাশের চাঁদের আলোয় এক ঘাইহরিণীর ডাক শুনি – কাহারে সে ডাকে! কোথাও হরিণ আজ হতেছে শিকার; বনের ভিতরে আজ শিকারিরা আসিয়াছে, আমিও তাদের ঘ্রাণ পাই যেনো, এইখানে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুম আর আসে নাকো বসন্তের রাতে।

চারিপাশে বনের বিস্ময়, চৈত্রের বাতাস, জোছনার শরীরের স্বাদ যেনো! ঘাইমৃগী সারারাত ডাকে; কোথাও অনেক বনে — যেইখানে জোছনা আর নাই পুরুষহরিণ সব শুনিতেছে শব্দ তার; তাহারা পেতেছে টের আসিতেছে তার দিকে। আজ এই বিস্ময়ের রাতে তাহাদের প্রেমের সময় আসিয়াছে; তাহাদের হৃদয়ের বোন বনের আড়াল থেকে তাহাদের ডাকিতেছে জোছনায় – পিপাসার সান্ত্বনায় — অঘ্রাণে — আস্বাদে! কোথাও বাঘের পাড়া বনে আজ নাই আর যেনো! মৃগদের বুকে আজ কোনো স্পষ্ট ভয় নাই, সন্দেহের আবছায়া নাই কিছু; কেবল পিপাসা আছে, রোমহর্ষ আছে। মৃগীর মুখের রূপে হয়তো চিতারও বুকে জেগেছে বিস্ময়! লালসা — আকাঙ্ক্ষা — সাধ — প্রেম স্বপ্ন স্ফুট হয়ে উঠিতেছে সব দিকে আজ এই বসন্তের রাতে; এইখানে আমার নক্‌টার্ন – একে একে হরিণেরা আসিতেছে গভীর বনের পথ ছেড়ে, সকল জলের শব্দ পিছে ফেলে অন্য এক আশ্বাসের খোঁজে দাঁতের — নখের কথা ভূলে গিয়ে তাদের বোনের কাছে অই সুন্দরিগাছের নীচে — জোছনায়! মানুষ যেমন করে ঘ্রাণ পেয়ে আসে তার নোনা মেয়েমানুষের কাছে হরিণেরা আসিতেছে। – তাদের পেতেছি আমি টের অনেক পায়ের শব্দ শোনা যায়, ঘাইমৃগী ডাকিতেছে জোছনায়। ঘুমাতে পারি না আর; শুয়ে শুয়ে থেকে বন্দুকের শব্দ শুনি; চাঁদের আলোয় ঘাইহরিণী আবার ডাকে; এইখানে পড়ে থেকে একা একা আমার হৃদয়ে এক অবসাদ জমে ওঠে বন্দুকের শব্দ শুনে শুনে হরিণীর ডাক শুনে শুনে।

কাল মৃগী আসিবে ফিরিয়া; সকালে — আলোয় তারে দেখা যাবে – পাশে তার মৃত সব প্রেমিকেরা পড়ে আছে। মানুষেরা শিখায়ে দিয়েছে তারে এই সব। আমার খাবার ডিশে হরিণের মাংসের ঘ্রাণ আমি পাবো, মাংস খাওয়া হল তবু শেষ? কেনো শেষ হবে? কেন এই মৃগদের কথা ভেবে ব্যথা পেতে হবে তাদের মতন নই আমিও কি? কোনো এক বসন্তের রাতে জীবনের কোনো এক বিস্ময়ের রাতে আমারেও ডাকে নি কি কেউ এসে জোছনায় — দখিনা বাতাসে অই ঘাইহরিণীর মতো? আমার হৃদয় — এক পুরুষহরিণ – পৃথিবীর সব হিংসা ভুলে গিয়ে চিতার চোখের ভয় — চমকের কথা সব পিছে ফেলে রেখে তোমারে কি চায় নাই ধরা দিতে? আমার বুকের প্রেম ঐ মৃত মৃগদের মতো যখন ধূলায় রক্তে মিশে গেছে এই হরিণীর মতো তুমি বেঁচেছিলো নাকি জীবনের বিস্ময়ের রাতে কোনো এক বসন্তের রাতে? তুমিও কাহার কাছে শিখেছিলে! মৃত পশুদের মতো আমাদের মাংস লয়ে আমারও পড়ে থাকি; বিয়োগের — বিয়োগের — মরণের মুখে এসে পড়ে সব ঐ মৃত মৃগদের মতো – প্রেমের সাহস সাধ স্বপ্ন বেঁচে থেকে ব্যথা পাই, ঘৃণা মৃত্যু পাই; পাই না কি? দোনলার শব্দ শুনি। ঘাইমৃগী ডেকে যায়, আমার হৃদয়ে ঘুম আসে নাকো একা একা শুয়ে থেকে; বন্দুকের শব্দ তবু চুপে চুপে ভুলে যেতে হয়। ক্যম্পের বিছানায় রাত তার অন্য এক কথা বলে; যাহাদের দোনলার মুখে আজ হরিণেরা মরে যায় হরিণের মাংস হাড় স্বাদ তৃপ্তি নিয়ে এল যাহাদের ডিশে তাহারাও তোমার মতন – ক্যাম্পের বিছানায় শুয়ে থেকে শুকাতেছে তাদের ও হৃদয় কথা ভেবে — কথা ভেবে — ভেবে।

এই ব্যথা এই প্রেম সব দিকে রয়ে গেছে – কোথাও ফড়িঙে — কীটে, মানুষের বুকের ভিতরে, আমাদের সবের জীবনে। বসন্তের জোছনায় অই মৃত মৃগদের মতো আমরা সবাই। ------------------------------------------------------------------------------- নগ্ন নির্জন হাত আবার আকাশের অন্ধকার ঘন হয়ে উঠেছে : আলোর রহস্যময়ী সহোদরার মতো এই অন্ধকার। যে আমাকে চিরদিন ভালোবেসেছে অথচ যার মুখ আমি কোনোদিন দেখি নি, সেই নারীর মতো ফাল্গুন আকাশে অন্ধকার নিবিড় হয়েছে উঠছে। মনে হয় কোনো বিলুপ্ত নগরীর কথা সেই নগরীর এক ধূসর প্রাসাদের রূপ জাগে হৃদয়ে।

ভারতসমুদ্রের তীরে কিংবা ভূমধ্যসাগরের কিনারে অথবা টায়ার সিন্ধুর পারে আজ নেই, কোনো এক নগরী ছিলো একদিন, কোনো এক প্রাসাদ ছিলো; মূল্যবান আসবাবে ভরা এক প্রাসাদ; পারস্যগালিচা, কাশ্মীরী শাল, বেরিন তরঙ্গের নিটোল মুক্তা প্রবাল, আমার বিলুপ্ত হৃদয়, আমার মৃত চোখ, আমার বিলীন স্বপ্ন আকাঙ্ক্ষা; আর তুমি নারী-- এইসব ছিলো সেই জগতে একদিন। অনেক কমলারঙের রোদ ছিলো, অনেক কাকাতুয়া পায়রা ছিলো, মেহগনির ছায়াঘন পল্লব ছিলো অনেক; অনেক কমলা রঙের রোদ ছিলো; অনেক কমলা রঙের রোদ; আর তুমি ছিলে; তোমার মুখের রূপ কতো শত শতাব্দী আমি দেখি না, খুঁজি না। ফাল্গুনের অন্ধকার নিয়ে আসে সেই সমুদ্রপারের কাহিনি, অপরূপ খিলান ও গম্বুজের বেদনাময় রেখা, লুপ্ত নাশপাতির গন্ধ, অজস্র হরিণ ও সিংহের ছালের ধূসর পাণ্ডুলিপি, রামধনুরঙের কাচের জানালা, ময়ূরের পেখমের মতো রঙিন পর্দায় পর্দায় কক্ষ ও কক্ষান্তর থেকে আরো দূর কক্ষ ও কক্ষান্তরের ক্ষণিক আভাস-- আয়ুহীন স্তব্ধতা ও বিস্ময়। পর্দায়, গালিচায় রক্তাভ রৌদ্রের বিচ্ছুরিত স্বেদ, রক্তিম গেলাসে তরমুজ মদ! তোমার নগ্ন নির্জন হাত; তোমার নগ্ন নির্জন হাত। ------------------------------------------------------------------------------ যদি আমি ঝরে যাই একদিন যদি আমি ঝরে যাই একদিন কার্তিকের নীল কুয়াশায়; যখন ঝরিছে ধান বাংলার ক্ষেতে-ক্ষেতে ম্লান চোখ বুজে, যখন চড়াই পাখি কাঁঠালিচাপাঁর নীড়ে ঠোঁট আছে গুজে, যখন হলুদ পাতা মিশিতেছে খয়েরি পাতায়, যখন পুকুরে হাঁস সোঁদা জলে শিশিরের গন্ধ শুধু পায়, শামুক গুগলিগুলো পড়ে আছে শ্যাওলার মলিন সবুজে- তখন আমারে যদি পাও নাকো লালশাক-ছাওয়া মাঠে খুঁজে, ঠেস্‌ দিয়ে বসে আর থাকি নাকো যদি বুনো চালতার গায়ে, তাহলে জানিও তুমি আসিয়াছে অন্ধকার মৃত্যুর আহ্বান- যার ডাক শুনে রাঙা রৌদ্রেরো চিল আর শালিখের ভিড় একদিন ছেড়ে যাবে আম জাম বনে নীল বাংলার তীর, যার ডাক শুনে আজ ক্ষেতে-ক্ষেতে ঝরিতেছে খই আর মৌরির ধান;- কবে যে আসিবে মৃত্যু; বাসমতী চালে-ভেজা শাদা হাতখান- রাখো বুকে, হে কিশোরী, গোরোচনারূপে আমি করিব যে ম্লান।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।