zahidmedia@gmail.com
শত বছরেরও আধুনিক বাণিজ্যিক শহর হিসেবে গড়ে ওঠেনি চৌমুহনী। কালস্রোতে হারিয়ে যাচ্ছে শতাধিক বছরের পুরনো নোয়াখালীর প্রধান বাণিজ্য কেন্দ্র চৌমুহনী‘র গৌরব গাঁথা ঐতিহ্য। সময়ের ব্যবধানে এবং সর্বত্র পরিবর্তনের হাওয়া চৌমুহনীর বাণিজ্যিক গুরুত্বকে খর্ব করেছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন আর যানজট, চুরি-ডাকাতিসহ প্রতিদিনই অসংখ্য সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এখানকার ব্যবসায়ীরা। চৌমুহনীতে অথনৈতিক কর্মকান্ড বাড়লেও ব্যবসায়ীদের সুযোগ সুবিধা না বাড়ায় ব্যবসায়ীরা হাতাশ।
প্রথম শ্রেণীর চৌমুহনী পৌরসভায় অবস্থিত এ বানিজ্যকেন্দ্রের আধুনিকায়নের দাবী ব্যবসায়ীদের। চৌমুহনী বাজারের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া খাল পুনঃসংস্কারের দাবীটি দীর্ঘ দিনের। খোদ গত ১৫ ফেব্র“য়ারি সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহম্মেদ এনডিসি,পিএসসি বেগমগঞ্জ উপজেলার উন্নয়ন বঞ্চিত শরীফপুর ইউনিয়নে আসলে স্থানীয় এলাকাবাসী আবারও সেই দাবী উত্থাপন করেন এবং দ্রুত এক ফসলী এই এলাকার জন্য খাল পুনঃসংস্কারের দাবী জানান। । তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে আশা প্রকাশ করেন।
শুরুর কথা-
নোয়াখালী খাল, ছতারপাইয়া খাল, ফেনী খাল ও পৌরনবিবি খালের মোহনায় এই বাণিজ্য কেন্দ্রটি গড়ে ওঠায় এর নাম রাখা হয়েছিলো চৌমুহনী। বৃটিশদের শাসনামলে এখানকার ব্যবসায়ীদের বেশিরভাগই ছিলো হিন্দু সম্প্রদায়ের। মাড়ওয়াড়িদের ব্যবসায়ীক কর্মকান্ডও এখানে ব্যাপৃত ছিলো। হাতে গোনা ক‘জন ছিলো মুসলামান ব্যবসায়ী। পাকিস্তান ও ভারত ভাগাভাগি হবার পর প্রভাবশালী হিন্দু ব্যবসায়ীরা ক্রমান্বয়ে ভারতে চলে যেতে থাকে।
এধার বর্তমানেও অব্যাহত আছে। এদের কেউ কেউ রাতের আঁধারে পালিয়ে আবার কেউ কেউ সর্বস্ব বিক্রি করে ভারতে পাড়ি জমায়।
নৌযানই ছিলো এখানকার যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম। নোয়াখালী অঞ্চলে এক সময় প্রচুর পরিমানে পাট উৎপাদন হতো। তাই চৌমুহনীতেও পাটের ব্যবসা ছিলো জমজমাট।
পাট ব্যবসাকে কেন্দ্র করে চৌমুহনীতে গড়ে উঠেছিলো ডেল্টা জুট মিল। আমিন জুট মিল এবং অধুনাবিলুপ্ত এশিয়ার বৃহত্তম পাট কল আদমজী জুট মিলের পাট ক্রয় কেন্দ্র ছিলো চৌমুহনীতে। ব্যক্তি মালিকানায় গড়ে উঠেছিলো পাটের বেল মেশিন। আড়ৎদাররা তাদের পাট বেল করে তা মিলে সরবরাহ করতো। সরিষার তেলের জন্যও চৌমুহনী প্রসিদ্ধ ছিলো।
স্বাধীনতা পূর্ব কালেই এখানে ৩৪টি তেলর কল ছিলো। গোটা পাকিস্তানে কোথাও এত তেলের মিল ছিলো না।
স্বাধীনতা পূর্বকাল থেকে বর্তমান সময়েও প্রকাশনা শিল্পের জন্য চৌমুহনী বিখ্যাত। সদ্য প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহার হাত ধরে পুথিঘর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে এর যাত্রা শুরু হয়েছিলো। পরবর্তীতে বই প্রকাশনী,পপুলার লাইব্রেরী, রেখা প্রকাশনী, মিনার প্রকাশনী, আজিজিয়া লাইব্রেরীসহ অনেক প্রকাশনা সংস্থা পুথিঘরের মাধ্যমে শুরু হওয়া যাত্রাকে সমৃদ্ধ করেছে।
বর্তমান পরিস্থিতি
এক সময়ে যে খালকে ঘিরে চৌমুহনীতে বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে উঠেছিলো সেই খাল এখন নালায় পরিণত হয়েছে। গত এক দশকে চৌমুহনীর ৬টি নৌকাঘাট সম্পূর্ন দখল হয়ে গেছে। ফলে নৌ-যোগাযোগ অনেকটাই বন্ধ। বর্তমান তত্ত্ববধায়ক সরকারের সময়ে খালের ওপর থেকে অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও এখনো অনেক দোকানপাট খালের ওপর রয়ে গেছে ।
পাশাপাশি গ্রামীন অবকাঠামো উন্নয়ন, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বাজারগুলো সম্প্রসারণ এবং সেখানকার ব্যবসায়ীরা ঢাকা ও চট্রগ্রামের সাথে সরাসরি ব্যবসা করা, চৌমুহনীর শ্রমিকদের সাথে স্থানীয় এবং বিভিন্ন স্থান থেকে আগত ব্যবসায়ী ও পণ্য পরিবহনকারীদের মতবিরোধ ব্যবসায়ীক ঐতিহ্যকে ম্লান করে দিচ্ছে।
এছাড়া দেশি এবং আর্ন্তজাতিক বাজারে পাটের চাহিদা হ্রাস, সরিষা তেলের পরিবর্তে সয়াবিন তেলের ব্যবহার, অবৈধভাবে অননুমদোদিত নোট বই ছাপা, নকল পণ্যের জমজমাট ব্যবসা, ভোগ্যপণ্যের উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো এজেন্টের মাধ্যমে এদতাঞ্চলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের নিকট একই মূল্যে পণ্য সরবরাহ প্রভৃতি কারণে ব্যবসায়ীরা পিছিয়ে পড়ছে। মাদকের ব্যবসা কখনও কমে আর বাড়ে কিন্তু বন্ধ হয় না।
চৌমুহনীর ব্যবসায়ীক কর্মকার্ন্ডের ওপর নির্ভর করে ব্যাংকিং ব্যবসা প্রসার ঘটেছে এখানে। গত কয়েক বছরে চৌমুহনীতে এক্সিম ব্যাংক, ওয়ান ব্যাংক, আই্এফআইসি, মার্কেন্টাইল, এনসিসি, সাইথইস্ট ব্যাংেকের নতুন নতুন শাখা খোলার পাশাপাশি ইসলামী ব্যাংকের আরো একটি নতুন শাখাও চালু করা হয়েছে। সরকারি সবগুলো ব্যাংকের শাখা ছাড়া দেশের প্রায় সবকটি ব্যাংকের শাখা অচিরেই এই চৌমুহনীতে আগামী কয়েকবছরের মধ্যে চালু হবে।
অন লাইন ব্যাংকিং কার্যক্রম ছাড়াও বিশেষ বিশেষ সুবিধা দিয়ে চালু হওয়া ব্যাংক গুলো তাদের লেনদেন করে যাচ্ছে।
চৌমুহনীতে প্রকাশ্যে চাঁদাবাজি কিংবা ছিনতাইয়ের মতো ঘটনা না ঘটলেও গোপনে গোপনে অবৈধ পণ্যের ব্যবসার সাথে সংশ্লিষ্টরাসহ কেউ কেউ চাঁদা দিলেও মুখ খোলেনা।
তবে দেশে জরুরী অবস্থার জারির পর চৌমুহনীতে বেশ কিছু অবৈধ ও ভেজাল পন্যে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান ও মজুদকারীর দোকান ও গুদামে যৌথবাহিনীর অভিযান চলে। ব্যবসায়ীদের সাথে সরকারের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি ও যৌথবাহিনীর কর্মকর্তাররা দফায় দফায় বৈঠক করে বাজারের বিভিন্ন সমস্যা ও দ্রব্যমুল্যের উর্ধ্বগতি রোধ কল্পে বিভিন্ন কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহন করে। কিন্তু তারপরেও অসাধু ব্যবসায়ীরা বিভিন্ন চলচাতুরি দেখিয়ে গ্রামের দুর দুরান্ত থেকে আসা মানুষের কাছ থেকে অতিরিক্ত মূল্য আদায় করে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে।
একাধিক ব্যবসায়ী ক্ষুদ্ধ কÚে বলেন, চৌমুহনী একটি ব্যস্ততম ব্যবসা কেন্দ্র। ঐতিহ্যগত ব্যবসায়ীক ধরন বদলে গেলেও এখনও নোয়াখালী অঞ্চলের মধ্যে চৌমুহীনই সবচেয়ে বড় বাণিজ্য কেন্দ্র। সে অনুযায়ী সহায়ক পরিবশে গড়ে ওঠেনি। যতত্রত ট্রাক বাস দাঁড়িয়ে রাস্তায় যানজট সৃষ্টি করে। এমনকি অনেক সময় পাঁেয় হেঁটে চলাচল করাও দুস্কর হয়ে পড়ে।
সব মিলে এক সময়ের জমজমাট চৌমুহনী এখন অনেকটাই ম্লান হয়ে আসছে। আধুনিক বাণিজ্যিক শহর প্রতিষ্ঠার মধ্যদিয়ে এখানকার প্রাণচঞ্চল ব্যবসায়ীক পরিবশে তৈরি করার দাবী তুলছে ব্যবসায়ীরা।
চৌমুহনী সাধারন ব্যবসায়ী সমিতির সহ-সভাপতি আবুল খায়ের জানান, ব্যবসায়ীক ঐতিহ্য এখন অনেকটা ম্লান হয়ে যাচ্ছে । কারণ একসময় নোয়াখালীর উৎপাদিত কৃষজ পণ্যের বিক্রি ছিলো চৌমুহনী কেন্দ্রিক। এছাড়া প্রকাশনা এবং তেল শিল্পের কারণে উৎপাদন কেন্দ্রিক চৌমুহনীর ব্যবসা বানিজ্য চলতো।
এখন প্রত্যন্ত অঞ্চল ও উপজেলা সদরগুলোতে বাজার ব্যবস্থা গড়ে ওঠায় চৌমুহনীর গুরুত্ব খর্ব হয়েছে। অনেকে আবার বার বার ব্যবসায় মার খেয়ে নতুন ব্যবসা চালু করলেও তেমন ভাবে আগাতে পারেনি। তবে এখানে উৎপাদনমুখী ভারী শিল্প না হলেও যদি ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা যায় তাহলে আবার চৌমুহনী জমজমাট হবে। তবে চৌমুহনী ব্যবসায়ী সমিতি সব সময় বাজারের ব্যবসায়ীদের কোন সমস্যা হলে তাৎক্ষনিক তার সমাধানের উদ্যোগ নেয়ার ফলে এখানে একটি ভালো পরিবেশ বিরাজ করছে। তবে যানজট নিরসনে চৌমুহনী বাজারের ওপর দিয়ে যাওয়া প্রধান সড়ক প্রশস্ত ‘ফোর লেন’ নির্মাণ করার যে উদ্যোগ নিয়েছে বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকার তা বাস্তবায়ন হলে দীর্ঘ দিনের যানজট হিসেব চিহ্নিত যে প্রকট সমস্যাটি তা আর থাকবেনা বলে তিনি ধারনা করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।