বিদায় - পথের নয়, পথিকের...
অনন্ত তুই, আমি ও আমরা ও আমার কথোপকথন
শুয়ে আছি অনেকক্ষন। ঘুম থেকে উঠেছি অনেক আগে, কেন যেন বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছে করছে না, কঙ্কটা ডেকে যাচ্ছে এক নাগাড়ে, মুড়ি দেবার সময় অনেক আগেই পাড় হয়ে গেছে, আজ কঙ্কটার বাটিতে মুড়ি দেয়া হয় নি, তাই অভিমানী সুরেই ডেকে যাচ্ছে, অথবা আমাকে উঠানোর জন্য এই ডাকাডাকি। সূর্য্যটাকে বরণ করা হয় নি আজ, ওটা এখন অনেক উপরে উঠে আমার জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে আমার চোখের উপর রোদ ফেলছে, আমার ঘুমকে তাড়িয়ে দেবার জন্য হয়তো, আমি সূর্য্যের চোখে চোখ রেখেই শুয়ে আছি।
কিছুক্ষন ধরে কঙ্ককে দেখছি, কাক টা আমাকে দেখছে একপাশে কাঁত হয়ে, অভিমানী সুরে ডেকে যাচ্ছে কা কা কা কা, মাথার ভেতর সেটা ভোঁতা আওয়াজ তুলছে কা কা কা কা।
অনন্তটার সাথে যোগাযোগ হয় না বেশ কিছু দিন, আজ সব কিছু এলোমেলো লাগছে, সকালে ঘুম ভেঙেছে একটি স্বপ্ন দেখে অনেক সুন্দর একটি স্বপ্ন, এমন স্বপ্ন দেখে মন ভালো হয়ে যাবার কথা, কিন্তু তেমনটি লাগছে না, ঘুম ভাঙার পরই মনে হচ্ছে আমার চারপাশের কিছুই আমার না।
আজ স্বপ্নে অতশীকে দেখেছি, যখন অতশীকে ভূলে যাই, ভূলে যেতে চাই ও হয়তো নিজেকে মনে করিয়ে দেবার জন্যে স্বপ্নে এসে হাজির হয়, হয়তো এ কারনেই আমার সব কিছু এলোমেলো লাগছে।
অতশী নামটা আমার দেয়া, সেটা অতশী নিজেও জানে না। অতশীর সাথে দেখা হয় কোন এক রঙিন কাঁচা বসন্তে, আমি দাড়িয়ে আছি এমন সময় একটি মেয়ে হঠাৎ এসে হাজির হয় আমার সামনে, "তুমি বাদল না?" আমি হঠাৎ চমকে গেলাম একটি মেয়ের এমন প্রশ্নে, আমি তাকিয়ে থাকলাম মেয়েটার দিকে, মেয়েটাকে খুব চেনা চেনা লাগছে কিন্তু ঠিক চিনতে পারছি না, শুধু তাকিয়ে আছি, ইতস্তত করতে লাগলাম বললাম "হ্যা" ও হয়তো বুঝতে পেরেছিল আমি ওকে ঠিক চিনতে পারছি না, ও তখন মনে করিয়ে দিল যে আমরা এর আগেও চেনা-জানা মুখ, আমার ভিতরের তাকে নিয়ে এতক্ষনের অচেনা সুরটি হঠাৎ করে চেনা সুরে রুপ নিলো এই হঠাৎ সুর পরিবর্তনে নাকি এই মেয়েটার সাথে পরিচয়ে জানিনা কোন একটা ছেঁড়া রং খেলা করতে লেগে গেল, এই মনে আপন মনে। অতশী মনের চিলেকোঠায় এমন একটা রঙের আশ্রয় করে নিয়েছিল জানতেও পারেনি , হয়তো নিজেও জানতে পারি নি।
অনন্ত, তুই তো জানিস আমি হারিয়েছি কেবল নিজের মাঝে নিজে, সময়ের স্রোত আমার কাছে স্থির কাব্য, চঞ্চল হাওয়া আমার কাছে থেমে যাওয়া শিহরন, কখনো বা আমি কোন একটি চলচ্চিত্রের স্থির চিত্র, চারপাশে সব কিছুই চলমান আমি কেবল স্থির।
বসন্তকে বড্ড ভালবাসতাম, তখন জানতাম না কেন ভালবাসি আজ হয়তো বুঝতে পারি কেন ভালবাসি, কেন জানিস? বসন্তের সব কটি রঙ আমার নিজের মাঝে খেলা করে, সব কটি রঙ... ঝিরিঝিরি বাতাস, স্বচ্ছ আকাশ, গাছের পাতা-ফুলের উচ্ছলতা সব কিছু আমাকে অবশ করে দিত নীলের মায়ায়। কেন তোকে এত কথা বলছি জানিস? আসলে আমি নিজেও জানি না।
উঠতে হবে, শুয়ে থাকতে আর ভাল লাগছে না, আমি উঠে পড়লাম, উঠেই কফি বানাতে লেগে গেলাম, খালি পেটে কফি খাবার অন্য একটা স্বাদ আছে, গরম ধোঁয়া ওঠা কফির সাথে সাথে শ্রীকান্তের গান "আমি খোলা জানালা তুমি ঐ দক্ষিনা হাওয়া" আপ্লুত সময় বিসর্জন।
আমি এখন রাস্তায় নেমে গেছি, হাতে ঘড়ি নেই, সূর্য্য দেখে যা মনে হচ্ছে এখন সাড়ে বারোটা, সূর্য্য দেখে সময় শেখার এই প্রাকটিস আমার ঘড়ি মেপে করা, তাই বুঝতে পারছি অনুমানে ভূল হবার সম্ভাবনা খুব বেশি না। রাস্তায় নেমেছি আসলে একটা কাজে, আমার হাতের চিঠিটা পোষ্ট করতে হবে, এই চিঠিটা বয়ে বেড়াচ্ছি অনেক দিন কিন্তু পোষ্ট করা হয়ে ওঠে না, পোষ্ট করতে গিয়ে আবার ফিরে আসি, চিঠিটা ঠিকই থেকে যায় আজ ভাবছি এটাকে হয় পোষ্ট করব না হয় ফেলে দিব ডাস্টবিনে, নাহ ডাস্টবিনে ফেলা যাবে না, ডাস্টবিনে ফেলে দিলে সেটা আবার ঠোঙা হবে, ঠোঙায় ঝাল মুড়ি উঠবে অথবা বাদাম!! হয়তো কিছুই উঠবে না পঁচে যাবে পানি-কাদায় এক হয়ে, ধুর! এই চিঠি নিয়ে এত কেন ভাবছি? আমি পাশে খেয়াল করলাম আমার সাথে একটু কোনাকুনি দুরত্ব রেখে "নবাব" হেটে চলেছে, ওর নাম প্রথমে "ন" দিলেও পরে ওর সাথে "বাব" লাগিয়ে "নবাব" নাম দেয়া হয়েছে, হেটে চলার মাঝে একটা বিজ্ঞ বিজ্ঞ ভাব আছে, কৌতুহলী চাহনী যেন আমাকে বোঝার চেষ্টা করছে।
আমার হাতের চিঠিটার দিকেও মনোযোগ দিয়ে দেখছে, আমি ওর সাথে অবশ্য ততোটা ভাব জমাইনি, তাই নিরাপদ দুরত্বে আছে, হাতের চিঠিটা পোষ্ট করছি না কারন যাকে পোষ্ট করব তার ঠিকানাই জানি না! তাই খালি খাম পাঠাতে ইচ্ছা করে না, খামের উপর শুধু লেখা 'অতশী তোমাকে' চিঠিতে কয়েকটা লাইন লেখা, অনেক আগে লিখেছি, চিঠিটি পোষ্ট করা হয়ে ওঠে না ফিরিয়ে নিয়ে আসি, চিঠিটা পড়াও হয়ে ওঠে না, চিঠিটার মধ্যে কি লিখেছি তা ঠিক মনে করতে পারছি না, তবে বেশ আবেগী কিছু লিখেছি, যার কারনে চিঠির কথা ভাবলেই একটা আবেশ কাজ করে।
আমি যেখানে দাড়িয়ে আছি সামনে একটি বাঁশের সাঁকো, কাজটা তেমন কিছু না সাঁকোর ওপারে যাওয়া গিয়ে একটি শিউলী ফুল গাছ আছে ওর নিচে শিউলী ফুল পড়ে আছে ওগুলোকে কুড়িয়ে নিয়ে চিঠির খামের ভিতর পুরে ফেলা, তারপর আবার এ পাশে চলে আসা, এটাও কয়েকবার করেছি, চিঠিটা পোষ্ট করা হয় না এ জন্যে খামের শিউলী ফুলগুলো পরবর্তীতে আমার রুমের মাছের এক্যুরিয়ামে জায়গা করে নেয়, না এক্যুরিয়ামে কোন মাছ নেই, যে মাছটা ছিল একটি পুঁটি মাছ, পুকুর থেকে তুলে আনা পুঁটি, কিছু দিন সাতার কেটে আৎকা মারা গেল, ওটাকে ফেলে দিয়ে একুরিয়াম খালি করে রেখে দিলাম, এখন ওটার মধ্যে শিউলী ফুল জমাই, চিঠির খামে বয়ে এনে। আজ বড্ড দেরী করে ফেলেছি, শিউলী ফুল পাব বলে মনে হয় না তবু এসেছি।
সাঁকো পাড় হতে লেগে গেলাম, কিছুদূর পাড় হয়ে পিছনে ফিরে দেখি নবাব নামের এই কুকুরটা অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে একদম সাঁকোর গোড়ায় গিয়ে, ওর এই অসহায় ভঙ্গিতে কোথাও একটা কৌতুক আছে, ও ওর মতো দাড়িয়ে রইল আমি সাঁকো পেরিয়ে এগিয়ে গেলাম শিউলী ফুলের সন্ধানে, নাহ ফুল আর নেয়া হলো না, তারা অঝোরে ঝড়েছিল ঠিকই সেটা হয়তো শিশিরের মায়ায়, সূর্য্যের আলো তাদের মায়া কাটিয়ে ফেলেছে তাই চুপসে তারা পড়ে আছে, আমি এই শুস্ক উপহার কেমন করে অতশীকে দিই??
আমি আবার ফিরে এসে সাঁকোটার মাঝে বসে পড়লাম, চিঠিটা একটু পড়ে দেখি, চিঠিটা খাম থেকে তুলে ভাঁজ গুলো খুললাম ভাঁজের ভেতর পুরনো শিউলীর দুএকটা ফুল পড়ে ছিল!! আমি যে শুস্ক শিউলীদের আশ্রয় দিতে চাইনি তারাই দেখি আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে!! হাসতে লাগলাম আপন মনে।
চিঠিটার একদম মাঝ বরাবর লেখা "তুমি জোছনা হয়ে এসো, আমি গোধুলী হয়ে আছি" এর বাইরে কিছু লিখি নি! চিঠিটা আবার ভাঁজ করে রেখে দিলাম তার জন্য নির্দিষ্ট খামে।
আমি পা দুলিয়ে বসেছি সাঁকোটাতে ঠিক মাঝ বরাবর, সামনে পানি, নিচে পানি, পিছনেও পানি, অনন্তটা থাকলে জমত বেশ! অনন্ত, অতশীকে খুব বেশি মনে পড়ে আমার, আমি ওকে ভূলে যাওয়ার জন্য কত কি করেছি আর কেউ না হোক তুই তো জানিস! আমি ওকে স্বপ্নে দেখি! অথচ বাস্তবে ওকে আমি তেমন করে কখনোই দেখিনি, তাকিয়ে থেকেছি কেবল। স্বপ্নে এসে চুপচাপ আমার পাশে বসে থাকবে, আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে, ওর কপালে একটি টিপ থাকে! হাতে কাঁচের চুড়ি থাকে, ঝন ঝন শব্দ নাকি রিনিঝনি শব্দ বলবো বুঝতে পারছি না সেগুলো বাজতে থাকে, ওর হাসিটা এত সুন্দর কেন! ওর চোখে এত মায়া কেন! সবই যে আমার কল্পনা! এ জন্যেই তো ওকে দেখতে চাই না। কত কত রাত জেগে থেকেছি চুপচাপ ওকে স্বপ্নে দেখবোনা বলে, কিছু দিন পর আবার ওকে দেখতে পাই ইদানিং অতশী বাস্তবে আসা শুরু করেছে! অনন্ত তুই বিশ্বাস করবি? ও আমার সাথে কথা বলে, আমি যেমন এখন তোর সাথে বলছি এমনটি করে তবে তোর সাথে কথা বলছি একপাক্ষিক অতশীর সাথে কথা হয় দ্বিপাক্ষিক। অনেক কথা এ কথা সে কথা কত কথা, ওকে এখন ডাকবো না, ওকে ডাকলেই বকবক শুরু করবে তোর সাথে আর কথা বলতে পারবো না তাহলে।
অতশী তো আমার সাথে কথাই বলে তো ওকে চিঠি দেবার কি দরকার সেটা আমি বুঝতে পারছি না।
চিঠির কথাগুলো ওর কাছে পৌছানো দরকার, অনেক কথা মুখে বলতে ইচ্ছে করে না, হয়তো লেখার প্রকাশভঙ্গি অনন্য তাই।
আমি উঠে পড়লাম, চিঠির খামের জন্য আমাকে বেলী ফুল খুঁজে বের করতে হবে...
(চলবে.. )
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।