সবাইকে সাথে নিয়ে এগুতে চাই।
হিজরী সনের প্রথম মাস হলো মুহাররম মাস। এটি একটি পবিত্র গুরুত্বপুর্ন ও তাৎপর্যবহ মাস। ধর্মীয় সামাজিক ও ঐতিহ্যগত কারনে এর গুরুত্ব অপরিসীম । মুসলিম উম্মার জন্য বহু ঐতিহাসিক ঘটনা দুর্ঘটনার স্মৃতির সাথে বিজড়িত রয়েছে এ মাসের ১০তারিখ আরবি ও ইসলামী ইতিহাসে এ দিনটিকে ইয়াওমে আশুরা বা আশুরার দিবস বলে নাম করন করা হয়েছে।
অনেকের ধারনা কারবালার শোকাবহ ও মর্মস্পর্শী ঘটনার কারনে এর বিশেষ বৈশিষ্ট। কিন্তু আসলে তা নয়। বরং ১০ই মুহররমে মানব জাতির ইতিহাসে বহু গুরুত্বপুর্ন ঘটনা সংঘটিত হয়েছে। যেমন এই দিনেই অভ্যুদয় ঘটে এই পৃথিবীর, আবার এদিনেই মহাপ্রলয়ের মধ্য দিয়ে পৃথিবী ধংশ হয়ে যাবে। এই দিনই আমাদের আদি পিতা আদম (আঃ) এর তওবা কবুল হয় এবং হযরত নূহ (আঃ) এর কিস্তি মহা প্লাবন থেকে মুক্তি পান।
এবং হযরত আইয়ূব (আঃ) কঠিন রোগ থেকে আরোগ্য লাভ করেন। এ দিনে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) পাপিষ্ঠ নমরুদের অনলকুন্ড থেকে নিস্কিৃতি পান । এবং বনি ইসরাইল ও হযরত মুসা (আঃ) ফিরাউনের হিংস্র ছোবল থেকে নিস্তার পান। এই আশুরা দিবসে আসমানে উত্তিত হন হযরত ঈসা (আঃ) অবশেষে এ দিনটিতেই নবী করীম (সাঃ) এর দৌহিত্র হুসাইন (রাঃ) স্বপরিবারে ইরাকের মরুময় কারবালা প্রান্তরে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম করে নির্মমভাবে শাহাদাত বরন করেন ”ইন্নালিল্লাহে ওয়াইন্না ইলাইহে রাজেউন”। ইসলাম আগমনের পূর্ব থেকেই এ মাসকে অতীব গুরুত্বপুর্ন ও তাৎপর্যময় বিবেচনা করে লোকেরা অন্যায়, অবিচার, যুলুম, অত্যাচার,ঝগড়া-বিবাদ, দাংগা হাংগামা, রাহাজানী, হানাহানী এবং যুদ্ধবিগ্রহ এড়িয়ে চলতো।
শুধু মক্কার কুরাইশরা নয় বরং মদীনার ইয়াহুদীরাও মুহররমের দশম তারিখ কে বিশেষ ভাবে উদযাপন করতো। যথা হাদীসে আছে আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (সাঃ) মদীনায় হিজরত করার পর দেখতে পান যে ইহুদীরা আশুরার দিনে রোযা পালন করছে। রাসূল (সাঃ) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন কি ব্যাপার তোমরা আজকের দিনে রোজা রাখছো কেন? তারা বলল এটি একটি মহান দিবস। এই দিনে আমাদের নবী মূসা (আঃ) এবং তার উম্মতদেরকে আল্লাহতায়ালা মুক্তি দিয়েছিলেন এবং ফেরাউন ও তার সমপ্রদায়কে দরিয়ায় নিমজ্জিত করে ধংস করেছিলেন। সুতরাং তার শুকরিয়া স্বরুপ নবী মূসা (আঃ) রোজা রাখতেন।
আর আমরাও এজন্যই রোজা রাখি। তখন রাসূল (সাঃ) এরশাদ করলেন, ”মূসা (আঃ) এর সাথে আমার সম্পর্ক তোমাদের চেয়ে অনেক বেশী ও নিকটতর”। অতপরঃ রাসূল (সাঃ) সাহাবীদেরকে বললেন তোমরাও আশুরার দিনে রোজা রাখ। কিন্তু এ ব্যাপারে ইয়াহুদিদের বিরোধিতা কর। অর্থাৎ তোমরা ২টি রোজা রাখ একটি আশুরার দিনের আগে অথবা পরে।
(বুখারী)
ইবনে আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রাসূল (সাঃ) এরশাদ করেন আগামী বছর পর্যন্ত যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে ৯ তারিখের রোজাও রাখবো। (মুসলিম)
উপরোক্ত আলোচনা দ্বারা বুঝা যায় যে এই মুহররমের তাৎপর্য কারবালার ঘটনাকে কেন্দ্র করে নয় বরং এই দিনে যে সব ঐতিহাসিক ঘটনাবলী রয়েছে তারই পরিপেক্ষিতে আশুরার মর্যাদা ও গুরুত্ব। হযরত মূসা (আঃ) যুগ থেকে রাসূল (সাঃ) পর্যন্ত এবং তার তিরোধানের পর সুদীর্ঘ বৎসর যাবৎ মুহররমের ১০তারিখ আশুরার দিন হিসাবে পালিত হতে থাকে। অতঃপর ৬১হিজরী সনের মুহররম মাসের ১০তারিখে ইরাকস্থ কুফা নগরী থেকে ৬০কিঃমিঃ দুরে ফোরাত নদীর তীরে কারবালা প্রান্তরে সংঘটিত হয় এক হৃদয় বিদারক ও মর্মান্তিক ঘটনা।
কারবালার সার কথা ঃ হজরত আমীর মুয়াবিয়া (রাঃ) এর ইন্তেকালের পর তার জৈষ্ঠ পুত্র ইয়াযিদ মুসলিম রাষ্ট্রের শাসনভার গ্রহন করেন।
অথচ তার জন্য সবচেয়ে বেশী উপযুক্ত ছিলেন হযরত হুসাইন (রাঃ)। ইয়াযিদ ক্ষমতায় আরোহন করেই হিংস্র হায়েনার মত জুলুমের হাত প্রসারিত করে। ফলে সর্বত্র বিদ্রোহ ও অশান্তির দাবানল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। হুসাইন (রাঃ) ইয়াযিদের এই কু-শাসন বরদাশত করলেন না। ফলে বেধে গেল মিথ্যা ও সত্যের দ্বন্ধ।
ইতিমধ্যে ইয়াযিদ মদীনার গভর্নরকে এই মর্মে আদেশ পাঠালো যে হুসাইন (রাঃ) যেন ইয়াযিদের প্রতি বাইয়াত গ্রহন করে। এই সংবাদ শুনে হুসাইন (রাঃ) মক্কায় হিজরত করেন। এদিকে কুফার একটি বড় জামায়াত ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহন থেকে বিরত থাকল এবং তারা হুসাইন (রাঃ) হাতে বাইয়াত হওয়ার সিদ্ধান্ত নিল তাই তারা হুসাইন (রাঃ) প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন এবং কুফায় আগমনের আহবান জানিয়ে হুসাইন (রাঃ) নিকট দেড় শতাধিক চিঠি প্রেরন করেন। তাদের চিঠি মোতাবেক হুসাইন (রাঃ) ৭২জন নারী পুরুষের এক কাফেলা নিয়ে মক্কা থেকে কুফার দিকে রওনা হন। যাত্রাপথে ভুলপথে তিনি ফোরাত নদীর তীরে কারবালা নামক মরুভুমিতে ইয়াযিদ বাহিনী কর্তৃক ঘেরাও হন।
হুসাইন (রাঃ) ইয়াযিদের সেনাবাহিনীকে অনেক অনুরোধ করলেও তারা ইয়াযিদের হাতে বাইয়াত গ্রহন অথবা যুদ্ধ ছাড়া অন্য কিছু মানতে অস্বীকার করে।
অবশেষে ৬১ হিজরী সনের ১০ই মুহররম তারিখে কারবালা প্রান্তরে ৪হাজার ইয়াযিদ সৈন্যের মোকাবেলায় হুসাইন (রাঃ) এর নিঃস্ব ৭০জনের কাফেলা ইয়াযিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য দাড়িয়ে যান। হুসাইন বাহিনীর সবাই বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে দুশমনের মোকাবেলায় একে একে সবাই শাহাদাত বরন করেন। অতপরঃ হুসাইন (রাঃ) নিজেই ময়দানে অবতীর্ন হন এবং দীর্ঘক্ষন শত্র“র মোকাবেলায় যুদ্ধ করতে করতে অবশেষে শুকনো জমিনকে করেন পবিত্র রক্তে রঞ্জিত । ৬১হিজরী সনের ১০ই মুহররম শুক্রবার ।
৫৬ বছর ৫ মাস বয়সে এই আত্মত্যাগী বীর মুজাহিদ শাহাদাত বরন করেন। নিষ্ঠোর ইয়াযিদের সৈন্যরা হুসাইন (রাঃ) এর শাহাদাতের পরও নির্মম ব্যবহার করতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। সেনান বিন আনাস নাখরী হযরতের দেহ থেকে মাথাকে দ্বিখন্ডিত করে ফেলে। জাহার বিন কাব হযরতের জামা এবং কোমরবন্দ খুলে নেয়। আসওয়াদ আবদী জুতা ও বনী দারাম গোত্রের এক লোক তলোয়ার খুলে নেয়।
আর এই দিন থেকেই রচিত হয় ইতিহাসের নির্মম অধ্যায়।
মুহাররমের হাকীকতঃ প্রথমে এ কথাটি নির্ধারন করতে হবে যে মুহাররম মাসটি কি মর্যাদাশীল না অলুক্ষন ও বরকত শুন্য। শিয়া স¤প্রদায় এ মাসকে মানহুস বা হতভাগ্য মনে করে। কারন শিয়াদের নিকট শাহাদাত অত্যন্ত খারাপ কাজ। যেহেতু হুসাইন (রাঃ) এমাসে শাহাদাত বরন করেন তাই তারা এই মাসকে বরকতহীন মাস মনে করে এবং এমাসে বিবাহ-শাদী ও এধরনের অনুষ্ঠান করে না।
হসাইন (রাঃ) এর শাহাদাত যদিও সীমাহীন হৃদয় বিদারক কিন্তু শিয়া স¤প্রদায় এ ব্যাপারে সীমা লংঘন করেছে। তারা পহেলা মুহররম হতে ১০ই মুহররম পর্যন্ত ১০দিনের কর্মসুচী শরীয়তের গুরুত্বপুর্ন কাজ হিসাবে পালন করে যাচ্ছে। যার মাঝে হাজার বিদাআত এমনকি শিরকী কর্মকান্ড পর্যন্ত রয়েছে। আমাদের দেশে তথাকথিত কিছু নামধারী আলেমগন মুহররম মাসের প্রথম ১০দিনের কর্মসুচী হাতে নিয়ে ময়দানে অবতীর্ন হয়ে থাকে জানি না শিয়া স¤প্রদায়ের সাথে এদের কোন গোপন সংযোগ আছে কি না? শহীদে কারবালা হুসাইন (রাঃ) যেথানে বলে গেছেন আমি শহীদ হলে তোমরা আমার জন্য উহ আহ করো না আছল ছিড়া ছিড়ি করো না বরং ধৈর্য্য ধারন করে থাকবে কিন্তু সেখানে তারা তাকে উপেক্ষা করে হুসাইন প্রেমের দাবীদার হয়ে আশুরার দিনকে মাতম করার দিন হিসাবে বেচে নিয়েছে। একটু চিন্তা করে দেখি যদি হুসাইন (রাঃ) শাহাদাত দিবসকে শোক মাতমের দিন হিসাবে পালন করতে হয় তাহলে ১২ই রবিউল আওয়াল মুসলমানদের জন্য শোক দিবস হওয়াই অধিক যুক্তি যুক্ত ছিল।
কেননা এই দিনটি মুসলমানদের জন্য একটি বেদনাময় দিন। এদিনেই আমাদের প্রিয় নবী (সাঃ) দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন এদিনেই ১ম খলিফা হযরত আবুবকর (রাঃ) ইন্তেকাল করেন।
বস্তুতঃ আশুরা মাতম করার দিন নয়, বরং শোকরিয়া আদায় করার দিন। রোজা নামাজ দান খয়রাতের মাধ্যমে শহীদি আত্মার মাগফেরাত কামনার দিন। আশুরা আদর্শিক বিজয়ের দিন ।
শোককে যুলুমের বিরূদ্ধে শক্তিতে রুপান্তরিত করার দিন, এই আদর্শ কে সমুন্নত করার লক্ষ্যে কারবালার লোহর্ষক ও হদয়বিদারক ঘটনা সংঘঠিত হল। সে আদর্শ সত্য ন্যায় ও ইসলামী মুল্যবোধকে জাগ্রত করার শপথ গ্রহনের দিন আশুরা। কারবালায় আশুরার আত্মত্যাগে মুসলিম জাতিকে সোনালী যুগের সোনালী আসনের সন্ধান দিয়েছে, এ জাতি যে বিশ্বে সত্য ও ন্যায়ের শাসন কায়েম করেছে নেতৃত্ব দিয়েছে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও আদর্শ রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে, তারই উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত কারবালার ইতিহাস কিন্তু আজ একবিংশ শতাব্দীতে এজাতীর অবস্থান কোথায়? কেন এ জাতী আজ অপ শক্তির দাবার গুটি সেজেছে ? কেন ফিলিস্তিনিরা আজ মাতৃভূমিহারা, কেন চেচনিয়া, বসনিয়া,ও ইরাকের মুসলমানদের উপর চলছে মিথ্যার জুলম ? কেন মুসলিম মা বোনেরা হচ্ছে স্বামী সন্তান ও ইজ্জ্বত হারা ? কেন তাদের করুন নিনাদে আকাশ বাতাস হচ্ছে প্রকম্পিত? এসব প্রশ্নের কি কোন উত্তর নেই ? উত্তর একটাই তা হচ্ছে আমরা হারিয়ে ফেলেছি আশুরার রক্তশ্নাত পথ । আশুরাকে রুপান্তরিত করেছি মাতম আর আহাজারীর অনুষ্ঠানে। হারিয়ে ফেলেছি ঈমানী যশবা ও ঈমানী বিক্রম ।
আশুরা বারে বারে আসে মুসলিম জাতির হৃত ঐতিহ্য তথা জ্ঞান-বিজ্ঞান শৌর্য-বীর্য শিক্ষা-সংস্কৃতি পুর্ন জাগরনের অনুপ্রেরনা যোগাতে । আশুরা আসে সমাজ দেহে বিরজিত নিশৃংসতা মুল্যবোধের অবক্ষা রোধের আহবান জানাতে তাইতো আজ হতেই আমাদেরকে আশুরার ক্ষুরধার চেতনায় উদ্ভুদ্ব হতে হবে। ১০ই মহররমের প্রতিবাদী খুন আহবান জানাচ্ছে আর মাতম নয় । আসুন এই পবিত্র চেতনা ধারায় অবগাহন করি। ঈমানী যোশ ঈমানী বিক্রমে আবার উদ্বেলিত হই।
প্রতিবাদের ঝড় তুলে বাতিলের তখতে তাউস করি খান খান । আল্লাহ আমাদের বুকের রক্তকে শহীদী রক্ত হিসাবে কবুল করুন। আমীন। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।