গর্ভকালীন কয়েকটি অসুখ গর্ভবতী মায়ের প্রাণ সংহার করতে পারে। এরকম একটি রোগ হলো একলামসিয়া। অর্থাৎ গর্ভবতী মায়ের রক্তচাপ বৃদ্ধি। বাংলাদেশে প্রসুতি মায়েরা সবচেয়ে বেশি প্রাণ হারান প্রসবকালীন অধিক রক্ত স্রাবের কারণে। আর প্রসুতি মায়েদের প্রাণসংহারের দিক থেকে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে একালামসিয়া ।
এ বিষয়ে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মাহেনাজ আফরোজ রেডিও তেহরানের আপনার স্বাস্থ্য অনুষ্ঠানে যে আলোচনা করেছেন তা এখানে উপস্থাপন করা হলো।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে যে কয়েকটি ঘাতক ব্যাধি গর্ভবতী মায়েদের মর্মান্তিক মৃত্যুর জন্য দায়ী তার অন্যতম হলো একলাম্পসিয়া-এ কথা আবারো আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি। কোনো গর্ভবতী মাতা এই রোগে আক্রান্ত হলে খালি যে তার রক্তচাপ বৃদ্ধি পায় তা নয় বরং সে সাথে তার খিচুনিও হতে পারে। তবে এ ধরণের খিচুনির স্নায়ু বা মস্তিস্কের কোনো রোগ জড়িত নয়। গর্ভাবস্থা ছাড়াও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কারো রক্তচাপ বৃদ্ধি পেতে পারে।
এ ধরণের উচ্চরক্ত চাপকে চিকিৎসকরা হাইপারটেনশন বলে অভিহিত করেন। গর্ভবতী মায়ের যদি উচ্চরক্ত চাপ থাকে তবে গর্ভকালীন সময় তা জটিলতা সৃষ্টি করতে পারে। তবে গর্ভ অবসানের পর এই উচ্চ রক্তচাপ স্বয়ংক্রিয়ভাবে হ্রাস পাবে না। অন্যদিকে একালাম্পসিয়া বা গর্ভকালীন রক্তচাপ সাধারণভাবে গর্ভ অবসানের পর আর থাকে না। এ ধরণের রক্তচাপ গর্ভাবস্থার ২৮ সপ্তা পর থেকে অর্থাৎ ছয় বা সাত মাসের সময় দেখা দিতে পারে।
সতর্ক না হলে গর্ভকালীন এই রক্তচাপ বৃদ্ধি গর্ভবতী মা এবং তার গর্ভস্থ সন্তান উভয়েরই জন্য বিপদের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। একজন মা যদি গর্ভকালীন সময়ে চিকিৎসক বিশেষ করে একজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের কাছে যান বা তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তবে এ ধরণের ঝুঁকির হাত থেকে অধিকাংশ ক্ষেত্রে রক্ষা পেতে পারেন। আলোচনার শুরুতেই এ কথা বলে রাখছি এ ব্যাপারে সবাইকে সতর্ক হওয়ার জন্য। একলাম্পসিয়ার মতো এমন জটিল রোগ একজন গর্ভবতী মাকে কোনো আক্রমণ করে তা সঠিকভাবে আজও নির্ণয় করা যায় নি। তবে গবেষকরা মনে করেন, রক্তবাহী শিরাসমূহের জটিলতা, মস্তিস্ক এবং স্নায়ুতন্ত্রের জটিলতা, খাবার দাবার এবং বংশগতি বা জিন এই রোগের ক্ষেত্রে একটি প্রভাব ফেলে।
তবে এ সংক্রান্ত কোনো তত্ত্বই এখন পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয় নি।
পাশ্চাত্যের হিসাব মোতাবেক প্রতি ২ থেকে ৩ হাজার গর্ভবতী মায়ের মধ্যে একজন একলাম্পসিয়ার আক্রান্ত হয়ে থাকেন। তবে যারা প্রথমবারের মতো মা হতে চলেছেন, যাদের মা বা বোনদের একালামসিয়া ছিলো, কিংবা যারা অতি অল্প বয়সে অর্থাৎ কিশোরী বা টিনএজে মা হয়ে থাকেন বা যারা ৩০ বছরের পর মা হন তাদের এ রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে। অন্যদিকে যে সব মায়ের ডায়বেটিস আছে, উচ্চরক্ত চাপ আছে বা কিডনির সমস্যা আছে তাদের একলাম্পসিয়া হতে পারে। এ ছাড়া যাদের গর্ভে যমজ বা একাধিক সন্তান রয়েছে তারাও একলাম্পসিয়াতে আক্রান্ত হতে পারেন বলে চিকিৎসকরা মনে করেন।
একলাম্পসিয়াতে মৃত্যু হার নিয়ে বাংলাদেশে কোনো পরিসংখ্যন নেই। আমরা আগেও বলেছি, বাংলাদেশ প্রাণঘাতী হিসেবে পরিচিত বহু রোগ-ব্যাধি নিয়েই কোনো পরিসংখ্যান নেই। তবে এশিয়া মহাদেশে এ রোগের প্রাদুর্ভাব বেশি বলে ভিন্ন একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে। আর এর প্রধান কারণ হলো, এ মহাদেশে মায়েরা অল্প বয়সে গর্ভধারণ করেন। দ্বিতীয় গর্ভকালীন সময় বহু মা একবারও চিকিৎসার কাছে যাওয়ার মতো সামান্য সুযোগটিও পান না।
এক হিসেবে দেখা গেছে, মাত্র ১৮ থেকে ২০ শতাংশ সন্তান প্রসবের সময় একজন চিকিৎসকের বা প্রসুতি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ গ্রহণ করেন। সব মিলিয়ে ভারত উপমহাদেশে ২২ থেকে ২৫ শতাংশ গর্ভবতী মা একলাম্পসিয়ায় আক্রান্ত হয়ে থাকেন। এখানে আমাদের একটি কথা বলতে হবে আর তা হলো, গর্ভাবন্থায় মাতৃদেহে নানা রকম জটিলতা দেখা দেয়। এ ধরণের একটি জটিলতা হলো গর্ভবতী মায়ের পা ফুলে যাওয়া। সাধারণভাবে গর্ভধারণের আট মাস পরে এ ধরণের জটিলতা দেখা দিতে পারে।
এটিকে স্বাভাবিক জটিলতা হিসেবেই গণ্য করা হয় এবং গর্ভ অবসানের সাথে সাথে এ ধরণের জটিলতা দূর হয়ে যায়। কিন্তু যদি কোনো মায়ের শরীরে এই সময়ের আগেই পানি নামে অর্থাৎ হাত পা ফুলে যায়। একই সাথে এমন মায়ের রক্তচাপ বেড়ে যায় অর্থাৎ উচ্চরক্ত চাপ দেখা দেয় ও তার পেশাব পরীক্ষা করে আমিষ বা প্রোটিন পাওয়া যায় তবে তাকে সতর্ক হতে হবে। এ ধরণের উপসর্গ অনেক সময়ই একালামসিয়ার উপসর্গ হয়ে উঠতে পারে।
সাধারণভাবে কোনো মা যদি গর্ভবতী হওয়ার পর নিয়মিত কিংবা গর্ভবতী হওয়ার ২৮ সপ্তার পর চিকিৎসকের নজরে থাকেন তবে তার একলামসিয়ার উপসর্গ সূচনাই ধরা পড়বে।
একই সাথে সে সময় সাধারণ চিকিৎসা দিয়েই একলামসিয়াকে নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব। এ জন্য অভিজ্ঞ চিকিৎসকরা প্রয়োজনে সাধারণ কিছু ওষুধ ব্যবহার করেন। এ সব ওষুধ গর্ভাবস্থায় সেবন নিরাপদ বলেই তা গর্ভবতী মায়েদের দেয়া হয়। মায়ের রক্তচাপ বেশী হলে গর্ভের সন্তানের বৃদ্ধি ঘটে না। আর একজন প্রসূতি বিশেষজ্ঞই কেবল বুঝতে পারেন, মায়ের রক্তচাপের অবস্থা কেমন এবং তার সন্তানের বৃদ্ধি ঠিক মতো ঘটছে কিনা।
সঠিকভাবে চিকিৎসার মাধ্যমে মায়ের গর্ভের মেয়াদ শেষ করা যায়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই সঠিক চিকিৎসা সত্ত্বেও মায়ের গর্ভের মেয়াদ পুরা করা যায় না। সে সময় সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে নির্দিষ্ট সময়ের আগেই গর্ভের সন্তানকে বের করে নিয়ে আসা হয়। অর্থাৎ একলামসিয়ার চিকিৎসার সময় রোগীর দিকেই চিকিৎসকরা নজর রাখেন। এখানে আরেকটি কথা মনে রাখতে হবে, তা হলো কোনো কোনো মায়ের প্রসবের পরও একলামসিয়া হতে পারে।
তবে সে ক্ষেত্রে তাদের রক্তচাপ বেশি থাকবে। চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা বলেন, প্রসবের আগে যে একলামসিয়া হয় তার চেয়ে অনেক মারাত্মক হলো প্রসবের পরের একলামসিয়া। এ ব্যাপারে অবহেলার কোনো অবকাশ নেই। তাই যদি কোনো মা'র প্রসবের আগে উচ্চ রক্তচাপ থাকে তবে প্রসবের পর অন্তত পনর দিন তাকে নীবিড় পর্যবেক্ষণে রাখতে হবে। আর তা না হলে মায়ের একলামসিয়াতে আক্রান্ত হওয়ার আশংকা পুরোপুরি থেকেই যাবে।
সবাই গর্ভবতী মায়েদের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ করবেন, সাধ্যমতো তাকে সহায়তা দান করবেন, তাকে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাবেন, তার যত্ন নিবেন এটা একান্তভাবে কামনা করা হচ্ছে। #
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।