১৫ই আগস্টের বিদ্রোহীদের নিরাপত্তা দিয়ে পাস করা ইনডেমনিটি আইন বাংলাদেশের প্রথম নয়। এর আগে আওয়ামীরীগ সরকারের সময়ের সরকারের রক্ষীবাহিনী (বেসরকারী সামরিক বাহিনী) ও গত জোট সরকারের সময়ের অপারেশন ক্লিনহার্ট এর সমস্ত কাজে ইমডেমনিটি প্রদান করা হয়।
এ ব্যাপারে আজকের আমারদেশের প্রতিবেদন নিন্মরূপঃ
১৯৭৪ সালে জাতীয় রক্ষীবাহিনী আইনের সংশোধনী এনে এই ইনডেমনিটি দেয়া হয়। রক্ষীবাহিনীকে অত্যাচার, নির্যাতন, লুটতরাজ ও গোপনে-প্রকাশ্যে হত্যাকান্ডের দায় থেকে মুক্তি দিতে জাতীয় রক্ষীবাহিনী আইনে এ সংশোধনী আনা হয়। এটা ছিল ১৯৭৪ সালের ১১নং আদেশ।
১৯৭৪ সালে রক্ষীবাহিনী আইনের সংশোধনী এনে ইনডেমনিটি দেয়া হলেও কার্যকারিতা দেখানো হয় ১৯৭২ সালের ১ ফেবুÝয়ারি থেকে। অর্থাৎ রক্ষীবাহিনী কার্যক্রমের শুরু থেকে যা কিছু করেছে সবই দায়মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালের সংশোধনীতে। ১৯৭২ সালে আইন তৈরির মাধ্যমে রক্ষীবাহিনী গঠনের পর এটিই ছিল এ আইনের প্রথম সংশোধনী।
১৯৭৪ সালের রক্ষীবাহিনী সংশোধনী আইনের ১৬(ক) অনুচ্ছেদ সংযোজন করে বলা হয়, রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা তাদের যে কোনো কাজ সরল বিশ্বাসে করেছেন বলে গণ্য করা হবে এবং এ নিয়ে তাদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা দায়ের, অভিযোগ পেশ কিংবা আইনগত কোনো পদক্ষেপ নেয়া যাবে না।
সংশোধনীর ৮(ক) অনুচ্ছেদে আরও বলা হয়, রক্ষীবাহিনীর যে কোনো সদস্য বা অফিসার ৮নং অনুচ্ছেদবলে বিনা ওয়ারেন্টে আইনের পরিপন্হী কাজে লিপ্ত সন্দেহবশত যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার করতে পারবে।
এছাড়া যে কোনো ব্যক্তি, স্হান, যানবাহন, নৌযান ইত্যাদি তল্লাশি বা আইনশৃঙ্খলাবিরোধী কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে-এমন যে কোনো সামগ্রী বাজেয়াপ্ত করতে পারবেন। যে কোনো ব্যক্তিকে গ্রেফতার এবং তার সম্পত্তি হস্তগত করার পর একটি রিপোর্টসহ নিকটতম থানা হেফাজতে পাঠিয়ে আইনানুগ ব্যবস্হা গ্রহণ করতে পারবে।
রক্ষীবাহিনী গঠনের জন্য প্রয়োজনী আইন প্রণয়নের আগে থেকেই কাজ শুরু করে এ বাহিনী। ১৯৭২ সালের মার্চ মাসে জাতীয় রক্ষীবাহিনী অর্ডার নামে প্রথম আইন প্রণয়ন করা হয়। এটি ছিল ১৯৭২ সালের ২১নং আইন।
রক্ষীবাহিনী গঠনের পর থেকে তাদের ভয়ে মানুষ জানমালের নিরাপত্তাহীনতায় ভুগত। রক্ষীবাহিনীর হাতে তখন ৩০ হাজারের বেশি আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী নিহত হন। সাংবাদিক আহমেদ মুসার ‘ইতিহাসের কাঠগড়ায় আওয়ামী লীগ’ বইয়ের ৫৩নং পৃষ্ঠায় রক্ষীবাহিনীর নির্যাতনের শিকার শরীয়তপুরের অরুণা সেনের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলা হয়, ‘বামপন্হী নেতা শান্তি সেনের স্ত্রী অরুণা সেনের ওপর রক্ষীবাহিনী যে অত্যাচার করেছে তা পাকিস্তান আমলে ইলামিত্রের ওপর নির্যাতনের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। ’ এতে অরুণা সেনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ‘গত ১৭ আশ্বিন রক্ষীবাহিনীর লোকরা আমাদের গ্রামের ওপর হামলা করে। ওইদিন ছিল হিন্দুদের দুর্গাপুজার দ্বিতীয় দিন।
খুব ভোরেই আমাকে গ্রেফতার করে। গ্রামের অনেক যুবককে ধরে মারপিট করে। লক্ষণ নামে এক কলেজছাত্র এবং আমাকে তারা নাড়িয়া রক্ষীবাহিনীর ক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেখানে আমাকে জিজ্ঞাসা করে স্বামী শান্তি সেন এবং পুত্র চঞ্চল সেন কোথায়? তারা রাষ্ট্রদ্রোহী; তাদের ধরিয়ে দিন! আরও জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যার দিকে আমাকে ছেড়ে দেয়া হয়। লক্ষণ সেনকে রেখে পরের দিন ছাড়ে।
বাড়িতে ফিরে দেখি মারধরের ফলে সে গুরুতর অসুস্হ। চার-পাঁচ দিন পর আবার তারা রাতে গ্রামের ওপর হামলা করে। অনেক বাড়ি তল্লাশি করে। অনেককে মারধর করে। কৃষ্ণ ও ফজলু নামের দু’যুবককে মারতে মারতে নিয়ে যায়।
আজও তারা বাড়ি ফিরে আসেনি। আত্মীয়রা ক্যাম্পে গেলে বলে তারা সেখানে নেই। তাদের মেরে ফেলে বলেই মনে হয়। এরপর থেকে রক্ষীবাহিনী মাঝে মাঝেই গ্রামে এসে যুবকদের খোঁজ করত। ’ এভাবে অরুণা সেন বইটিতে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের আরও লোমহর্ষক বর্ণনা দিয়েছেন।
দেশের প্রতিটি অঞ্চল ও গ্রামের সরকারবিরোধী মানুষকে তখন রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার-নির্যাতনের শিকার হতে হয়। কেউ গুম হয়েছেন আর ফিরে আসেননি। কাউকে প্রকাশ্যে মারা হয়েছে। রক্ষীবাহিনীর সদস্যরা এসব কিছুর আইনগত বৈধতার স্বীকৃতি এবং ইনডেমনিটি পেলেন ১৯৭৪ সালের জাতীয় রক্ষীবাহিনী সংশোধনী আইনের মাধ্যমে। এ আইনের কারণে রক্ষীবাহিনীর অত্যাচারের শিকার কেউ আজও আইনের আশ্রয় নিতে পারেননি।
রক্ষীবাহিনী গঠন আইন অনুযায়ী এ বাহিনী কোনো সুনির্দিষ্ট মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছিল না। আইনটি তৈরির সময় এ বাহিনীকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর নিয়ন্ত্রণে রাখা হয়। পরে ১৯৭৫ সালের জানুয়ারিতে একদলীয় বাকশাল গঠিত হলে এবং রাষ্ট্রপতিশাসিত পদ্ধতি চালু হলে রক্ষীবাহিনীকে প্রধানমন্ত্রীর পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণে ন্যস্ত করা হয়। রক্ষীবাহিনী সবসময় সরকারপ্রধানের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে থেকে কাজ করেছে।
রক্ষীবাহিনীর অত্যাচার ও হত্যার লাইসেস প্রসঙ্গে ১৯৭২ সালে ২ এপ্রিল ইংরেজি সাপ্তাহিক হলিডে পত্রিকার ‘স্যাংশান টু দ্য কিল ডিসেন্টার’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব যখন প্রকাশ্যে জনসভায় নির্দেশ দিলেন, “নক্সালদের দেখামাত্র গুলী কর” তখন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে রাজনৈতিক হত্যাকান্ড চালানোর জন্য অন্য কোনো অনুমোদনের আর দরকার পড়ে না।
’ এ পত্রিকাটির ১৯৭৩ সালের ২০ মে প্রকাশিত ‘ভিসেজ অব কাউন্টার রেভ্যলুশন’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলা হয়, “রক্ষীবাহিনী হচ্ছে প্রতি বিপ্লবের অস্ত্র, যার উপর এমনকি সর্বভুক শাসক শ্রেণীর কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। ভারতীয় শাসক শ্রেণীর অনুগত এক সরকারকে এবং ভারতীয় উপ-সাম্রাজ্যবাদের সম্প্রসারণবাদী স্বার্থকে রক্ষা করার জন্য এটা হচ্ছে সিআরপির সম্প্রসারণ। এর নিঃশ্বাসে রয়েছে মৃত্যু আর ভীতি। আপনি অথবা আমি যে কেউ হতে পারি এর শিকার এবং বাংলাদেশের প্রশাসনের পুস্তকে আমাদের পরিচিতি হবে ‘দুষ্কৃতকারী’ হিসাবে। ”
রক্ষীবাহিনীকে ইনডেমনিটি দেয়া প্রসঙ্গে সাবেক উপরাষ্ট্রপতি ও সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিষ্টার মওদুদ আহমদের লেখা, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল’ বইয়ে উল্লেখ করা হয়-‘যখন রক্ষীবাহিনীর আচরণ এবং ভুমিকা নিয়ে জনগণের অসন্তোষ চরম পর্যায়ে উপনীত হয় এবং দেশের সংবাদপত্রগুলো তাদের ক্ষমতা, কতৃêত্ব ও ভুমিকা নিয়ে অব্যাহতভাবে প্রশ্ন উত্থাপন করতে থাকে তখন ২০ মাস কার্যধারা পরিচালনায় ঢালাও লাইসেস দেয়ার পর সরকার রক্ষী বাহিনীর তৎপরতাকে আইনসিদ্ধ প্রতিপন্ন করার লক্ষ্যেও একটি অধ্যাদেশ জারি করে।
’
এদিকে রক্ষীবাহিনীকে আইন করে ইনডেমনিটি দেয়ার পর দ্বিতীয় ইনডেমনিটি জারি হয় ১৯৭৫ সালের ১১ সেপ্টেম্বর। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ১৫ আগষ্টের ঘটনায় জড়িতদের দায়মুক্তি দেন।
আইনের মাধ্যমে তৃতীয় ইনডেমনিটি দেয়া হয় ২০০৩ সালে চারদলীয় জোট সরকারের আমলে অপারেশন ক্লিনহার্টে জড়িতদের। চারদলীয় জোট সরকারের সময় অপারেশন ক্লিনহার্ট পরিচালনায় সেনাবাহিনী নেতৃত্বে গঠিত যৌথবাহিনীর যাবতীয় তৎপরতাকে আইনগত বৈধতা দিয়ে এ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি হয়। অপরাশেন ক্লিনহার্টে তখন সরকারি হিসাবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ৪৪ নাগরিক প্রাণ হারিয়েছিলেন।
নির্যাতনে পঙ্গু হয়েছেন আরও অনেকে।
২০০৪ সালের মার্চ মাসে র্যাব গঠনের পর ক্রসফায়ারে নিহত হয়েছেন অনেক নাগরিক। সরকারি খাতায় নিহতের সবাই দুষ্কৃতকারী। ক্রসফায়ার, এনকাউন্টার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে নিহতদের বিষয়ে এক প্রকার অঘোষিত ইনডেমনিটি ভোগ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। চারদলীয় জোট সরকারের সময় ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারে নিহতদের বিষয়ে বিচার বিভাগীয় তদন্তের নামে একটি তদন্ত পরিচালনা করা হতো।
এতে একজন ম্যাজিষ্ট্রেট তদন্ত করে সাজানো রিপোর্ট দিতেন। সব রিপোর্টে একই সরকারি বর্ণনা দেয়া হয়। বর্তমানে এ ক্রসফায়ার ও এনকাউন্টার বন্দুকযুদ্ধ নামে পরিচালিত হচ্ছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন এ ক্রসফায়ার বা এনকাউন্টারের পক্ষে বক্তব্য-বিবৃতি দিয়ে যাচ্ছেন, যা দায়মুক্তিরই নামান্তর বলে আইনবিশেষজ্ঞ ও মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন। তিনি সম্প্রতি বলেছেন, আওয়ামী লীগের চলতি শাসনামলে কোনো ক্রসফায়ারের ঘটনা ঘটেনি।
ওদিকে বেসরকারি মানবাধিকার সংস্হা অধিকার-এর রিপোর্ট অনুযায়ী চলতি বছরের ১০ মাসে ৮০ জনের বেশি লোক র্যাবের ক্রসফায়ারে প্রাণ হারিয়েছে।
Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।