হাফ এ লাইফঃ আধখানা আপেল
নোবেলজয়ী সাহিত্যিক ভি এস নাইপলের বিখ্যাত একটা উপন্যাস হাফ এ লাইফ..., জীবনের আধেক, অর্থাৎ আধা জীবনের কাহিনী... যে কারো মনে হতেই পারে, কোন আত্মজীবনীর নাম হিসাবে- এটা একটা আইডিয়াল, মীনিংফুল নাম হতে পারে! কারন আত্মজীবনী মানেই তো হাফ এ লাইফ।
নিজের জীবন কাহিনী যারা লিখতে চান, তারা আসলে নিজের জীবনের খুব বেশি হলে, সর্বোচ্চ-- অর্ধেক অংশের কথা লিখতে পারেন। তাদের জীবন কাহিনী হয়ে ওঠে বড় জোর, তাদের অর্ধেক জীবনের কাহিনী..... জীবনের বাকী অংশের কথা তার অব্যক্তই রয়ে যায়। কারো পক্ষেই সম্ভব হয়ে উঠে না—সমগ্র জীবন কাহিনী ব্যাক্ত করার।
এই বিষয়টা আমি প্রথম খেয়াল করি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নিজের জীবন কাহিনী অর্ধেক জীবন পড়তে গিয়ে।
নাইপলের বইটার প্রসঙ্গও ছিল, সুনীলের লিখা সেই বইএর ভূমিকায়। যারা সুনীল পড়েছেন, তারা সবাই জানেন—সুনীলের প্রথম জীবনের যাবতীয় রচনার সিংহ ভাগই ছিল তার নিজের ও কাছের বন্ধুদের জীবন যাপনের টুকরা টুকরা কাহিনী নিয়ে। এক হিসাবে তার নিজস্ব জীবনের গল্পকেই সুনীল ঘুরিয়ে ফিরিয়ে তার বিভিন্ন লেখায় এনেছেন।
সে ক্ষেত্রে অর্ধেক জীবন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের প্রথম রচনা, যা তার অফিশিয়াল জীবন কাহিনী হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। শৈশব থেকে শুরু করে তার পরিনত বয়সের যাবতীয় কথিত অকথিত কাহিনীর বিন্যাস।
প্রায় সারা জীবন ধরে লিখালিখির সাথে যুক্ত, আর এখন প্রায় সত্তর বছর বয়সের পড়ন্ত বেলায় এসে সুনীল আমাদের জানাচ্ছেন তার জীবন কাহিনী!!
আমি আসলে ভাবছিলাম, জীবনের কত বছর পার হয়ে এলে- মানুষ তার জীবনী লিখার কথা ভাবে...
জীবনী লিখার জন্য কি কোন নির্দিষ্ট বয়স আছে? এ ক্ষেত্রে রুল অফ গেমসটা কি? আর- কোন সে জীবন, যা নিয়ে কাহিনী রচনার যোগ্য, মানুষ হিসাবে কতটা গ্রেট হলে কেউ একজন তার জীবন-কথা লিখার ছাড়পত্র পায়, আর তাদের জীবন কাহিনী পাঠক আগ্রহ নিয়ে পড়ে? আমাদের মতো লিখিয়ে যারা সাহিত্য-জগত তথা সৃজনশীল জগতের সাথে সম্পুর্ণ সম্পর্কবিহীন, অজ্ঞাত কুলশীল- তারা কি জীবনী লিখার অধিকার রাখেন?
সাধারন আর অসাধারনের মাঝে ফারাক ক্রমশঃ ঘুচে যাওয়ার এই কাল পর্বে—ব্যক্তিগত ব্লগে মানুষ আজকাল লিখছে তাদের নিজ নিজ কাহিনী। সামহোয়ার এর মতো ব্লগ সাইটগুলোর পেজের পরে পেজ ভরে থাকে, তাদের ছোটখাট সুখ-দুঃখ, তুচ্ছ-সামান্যের, আনন্দ-বেদনার পালাগানে। প্রশ্ন হলো-নিজ নিজ জীবনী কি তাতে অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে?
আমাদের মতো সাধারন ব্লগারদের জীবন কাহিনী কি ব্লগের বিষয়বস্তু হতে পারে?
আজ থেকে ঠিক ৭বছর কয়েক মাস আগে আমি আমার মধ্য-বয়স, পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে এসেছি। পেছনে ফেলে আমার প্রায় অর্ধ শতাব্দীর যাপিত জীবনের ভাঙ্গাচুড়া সব টুকরা। এর প্রতিটা দিনের প্রতিটা মুহুর্ত আমার কাছে, আমার নিজের অস্তিত্বের এক একটা টুকরার মতো, ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকে।
মাঝে মাঝে এক একটা টুকরা খাপছাড়া ভাবে হাতে তুলে নেই, আলোক ঝলকানোর মত পুরানো স্মৃতি- লাফ দিয়ে এসে সামনে দাড়ায়। ব্যাকুল স্বরে প্রশ্ন করে- মনে আছে? আমায় তোমার মনে আছে?
দিন যাপনের অমোঘ টানে সময় গড়িয়ে চলে, আমাদের কিছুতেই পুরানো হতে না চাওয়া জীবনের হাত ধরে।
সামহোয়ার ব্লগে এসেছি মাত্র কয়েক মাস, অথচ এই ক’দিনে আমার নিজস্ব ব্লগ সাইটটার প্রতি এত মায়া পড়ে গেছে। খুব ইচ্ছা করে ব্লগটাকে সুন্দর সুন্দর পোষ্ট দিয়ে ভরিয়ে রাখি, তরুন ব্লগার বন্ধু, আমার ভালবাসার- শ্রদ্ধার প্রিয় ব্লগার বন্ধুরা- যেন একবার করে আমার ব্লগ ঘুরে যায়। আমার ব্লগ সাইটটা যেন তাদের কাছে আকর্ষনের বিষয় হয়ে দাড়ায়।
কিন্ত আমার ক্ষমতা কতটুকু, যা দিয়ে আমি তাদের বেঁধে রাখতে পারি? তাদের কৌতুহলের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠতে পারি? সবচেয়ে বড় সমস্যা মনে হয়—গড় ব্লগারদের সাথে আমার বয়সের ব্যবধান। কারও কারও সাথে এই ব্যবধান তো প্রজন্মান্তরের। আমার সামহোয়ারের বন্ধুরা যথেষ্ট বন্ধু বৎসল, আমি যে কোন সময় তাদের সাইটে গিয়ে আমার ব্লগ ভিজিট করার দাওয়াত দিয়ে আসতে পারি, আমি নিশ্চিত তারা আমার ব্লগে আসবেন, মন্তব্য করবেন, কিন্ত ইদানিং আমার খুব ইচ্ছা হয়, তাদের মুগ্ধ করতে, তাদের আগ্রহের একটা জায়গা তৈরী করতে। নিজের ব্লগটাকে জনপ্রিয় করে তুলতে।
কিন্ত হায়! আমার সক্ষমতা নিয়ে আমি নিজেই নিশ্চিত হতে পারিনা!!! এর মাঝেই এক ধরনের দ্বিধাগ্রস্ততা আমাকে ঘিরে ফেলে, আমার আত্মবিশ্বাসের পারদটাকে হটাৎ করেই একটানে নিচে নামিয়ে দিয়ে।
ব্লগে লিখি কম, মন্তব্যও করা হয় তুলনায় অনেক কম। কিন্ত ঘুরে ঘুরে পড়ি প্রচুর। পড়তেই বেশি ভাল লাগে নানা ধরনের বিষয়বস্তু, বিচিত্র ধরনের আলোচনা আর বুদ্ধিদীপ্ত মন্তব্যের যুক্তি। প্রথম যৌবনের তারুন্যের সাবলীল সৌন্দর্য্যে ভরা এক একটা ব্লগ- কি বন্ধু বাৎসল্যে আর আন্তরিকতায় সবাইকে কাছে টেনে নেয়, আনন্দ আর খুশি ভাগাভাগি করে মেতে উঠে সবাই একক প্রাণের হুল্লোড়ে। সময় পেলেই আমি ঘুরে আসি ব্লগার শূন্য আরণ্যক, আন্দালিব, রোডায়া, আশরাফ মাহমুদ বা ছন্নছাড়ার ব্লগে।
কাব্যময়তার এক অচিনপুর, বোধের অতীত এক অনুভুতি- মোহাবিষ্ট করে রাখে আমাকে।
মনজুরুল হক, মোহাম্মদ আরজু, পারভেজ, ফারহান দাউদ, বাফড়া বা জ্বিনের বাদশাদের ব্লগ থেকে ভাবনার খোরাক খুঁজি। প্রাঞ্জল ভাষায় তাদের যুক্তির উপস্থাপন নতুন নতুন দেখার দৃষ্টিভঙ্গী জোগায়। তরতাজা যৌবনের কলকাকলি শুনতে পাই আমি একলব্যের পুনর্জন্ম, অক্ষর, রোবোট, তনুজা বা উদাসী স্বপ্নের ব্লগে গিয়ে। একেকটা পোষ্ট আসে আর তাকে ঘিরে জমে ওঠে দুষ্টু দুষ্টু মন্তব্যের খুনশুটি, কখনও সে আসরে যোগ দেয়- চাঙ্কু অথবা জেরী।
আর আফসুস, বেয়াদ্দপ পুলাপানদের শায়েস্তা করতে তাদের উপর নাজেল হন নুশেরা তাজরীন বা কঁাকনরা, পুলাপানের উপর মুরুব্বিয়ানা(!)ফলাতে। ( নুশেরা তাজরীন এর গদ্য পড়ে হিংসায় আমার বুক পুড়ে যায়—এমন সাবলীল গদ্য কিভাবে লেখেন?)
আমি দূর থেকে তাদের এই নির্মল আনন্দে ভাগ বসাই, নিজের অস্তিত্বের জানান না দিয়ে। সংকোচ আমাকে আটকে রাখে—তাদের প্রাণের এই উৎসবে সামিল হতে। সন্দেহ হয়, মনটা হয়তো আগের মতো সবুজ নাই। আমার এই তরুন ব্লগ বন্ধুদের ভদ্রতা বোধ এবং আন্তরিকতা নিয়ে আমি কোন ধরনের সন্দেহে ভুগি না, তাদের অমলিন উদারতা দিয়ে আমাকে তারা কাছে টেনে নেবেই-আমি নিশ্চিত।
কিন্ত তাদের ঝলমলে জমাটি আসরটা পন্ড করে ফেলি কিনা, এই ভাবনা আমাকে বিহবল করে তোলে।
ব্লগে আমার এই সব তরুন বন্ধুদের যে কোন বিষয়েই মতামত বা অবস্থান খুব স্পষ্ট। তাদের সে সব মতামত খোলাখুলি প্রকাশ করতেও তারা কুন্ঠাহীন। ভাবতে অবাক লাগে—এখনকার তরুনরা কত বেশি জানে... কত বেশি খোঁজখবর রাখে। কত ধরনের বিষয়ে যে তাদের দখল এবং কর্তৃত্ব, এসব আমাকে বাকরুদ্ধ করে দেয়।
আমার বয়স আরও কম হলে তাদের এই অসাধারন ক্ষমতা নিশ্চয় আমার বুকে ঈর্ষার আগুন জ্বেলে দিত- তার বদলে মুগ্ধ বিস্ময়ে তাদের লিখা আমি পড়ে যাই। কয়েকজনের কথা এখানে বলাই উচিত- রিফাত হাসান, ইমন জুবায়ের, ম্যাভেরিক, রাগিব। আমি মুগ্ধ হয়ে পড়ি শওকত হোসেন মাসুম, নাফিস ইফতেখার আর কৌশিকের ব্লগ। ভাষার স্টাইল আর শব্দ ব্যবহারের ক্ষমতা চুরি করতে ইচ্ছা করে সুমন রহমান আর আহমেদ মোস্তফা কামালদের ব্লগ থেকে। দ্বান্দ্বিকতার ছোঁয়া পাই অন্যমনস্ক শরৎ, জামাল ভাস্কর আর খারেজির পোষ্ট থেকে।
আর এ সব ভাবনাই আমার দ্বিধাগ্রস্ততাকে বাড়িয়ে তোলে, আমার আত্মবিশ্বাসের পারদটাকে কোন চেষ্টাতেই উপরে তুলে আনতে পারি না। বেশ বুঝতে পারি, আমার এতসব প্রতিভাবান আর সেইসাথে হৃদয়বান তরুন বন্ধুদের আমার ব্লগে নিয়ে আসা আর তাদের নিয়ত মুগ্ধ করে রাখার মতো ক্ষমতা আমার কখনই ছিল না। সচ্ছলতার সংসারে রাশি রাশি শব্দ আর সুঠাম বাক্যজালের ঠাসবুনোটে বোনা মায়াচাদরে ঢেকে থাকা যে জীবন...
সে আমার নয়......। অন্ততঃ এ জনমে নয়!!!
প্রথম পর্ব সমাপ্ত হইল।
এই আত্মজৈবনিক আপাতত চলিতে থাকিবে, অনির্দিষ্ট কাল ধরিয়া।
ধারাবাহিক এই কাহিনী পাঠ করিয়া বিপুল ভাবে আমোদিত হউন...
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।