আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বড় অভিমানে দুঃখি মন নিয়ে হারিয়ে যাওয়া বাংলার এক রহস্যময়ী কিংবদন্তি-

ঘাটের এই পারে বসে আছি ঐ পারে যাওয়ার অপেক্ষা। মুসাফিরের ব্লগ। (এ লিখাটি লিখার কারণঃ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমার এক তুখোড় মেধাবি বান্ধবিকে জিগ্গাসা করেছিলাম এই মহিয়সী নারীকে চিনিস কিনা? বললো উনি কে? এরপর কৌতুহল বশতঃ আমার এক শ্রদ্ধেয় বড়ভাই যিনি সাউথ ক্যারোলিনার ক্যাফলিন বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ,আমার দেখা মেধাবি মানুষদের একজন, উনাকে জিগ্গাস করেছিলাম - বাংলার এই কিংবদন্তী নারীকে চিনেন কিনা। বলেছিলেন - শুনেছিতো প্যারিসে হারিয়ে গেছেন। বুঝলাম- সামনে আমাদের একুশে ফেব্রুয়ারি ।

ফুলে ছেয়ে যাবে আমাদের শহীদ মিনার। অথচ এ রমনী কে জানেনা অনেকেই। নিজের বিবেক যেন কেমন খোঁচাতে লাগলো। আমি চাই এ দেশের প্রতিটি প্রগতিশীল , মুক্তমনা মানুষ এ দেশের এ গুনি নারীকে চিনুক। তার প্রতি হৃদয়ের গভীর থেকে শ্রদ্ধার্ঘ আর ভালোবাসা প্রেরণ করুক।

তাতে যদি আমাদের দায়ভার এতটুকু কমে। ) আপনি কোথায় আছেন, কেমন আছেন কিছুই জানিনা। কেউ বলে আপনি আর এই পৃথিবীতেই নেই। চিরতরে আপনি হারিয়ে গেছেন। আর কোনোদিন ফিরে আসবেননা।

আপনি একজন রহস্যময়ী কিংবদন্তী হয়ে গেলেন। পৃথিবীর শেষ অপরাহ্ণ শেষ করে জানিনা আজ আপনি কোথায় কেমন করে ঘুমিয়ে আছেন? জন্ম যেমন আপনার রহস্য ঘেরা ছিলো-মৃত্যুতেও তেমনি আপনি রহস্য রেখে গেলেন। আমরা জানলামনা কিছুই। আর আপনি ও কোনোদিন জানলেন না- হাসনাত আব্দুল হাইয়ের উপন্যাস পড়ে -প্রথম আপনার সম্পর্কে জেনে একটি কিশোর ছেলে নীরবে বুকের ভিতর আপনার জন্য অঝোরে কেঁদেছিলো। আপনার সম্পর্কে আমি পড়লেই কেন যেন বারবার আমার চোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে যায় , বুঝিনা।

জানতে পারলামনা, আর পারবোও না কোনোদিন কিসের এতো ব্যাথা ভরা অভিমান বুকে নিয়ে আপনি এই দেশ ছেড়ে চলে গেলেন। সামনে একুশে ফেব্রুয়ারী। শহীদ মিনার ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে। কিন্তু যে আপনি শহীদ মিনারের ভীত হৃদয়ের বিশুদ্ধ স্নেহের পরশে গড়েছিলেন-জানিনা আপনার কবরে একটি ফুলের পাঁপড়িও পরবে কিনা। আপনি রয়ে গেলে নীরবে, নিভৃতে, অভিমানে , বড় গোপনে।

জানিনা, আপনার কবর কোথায়। কোথায় হয়েছে আপনার শেষ ঠিকানা। হয়তোবা আপনার তৈরী ভাস্কর্যের মতো আপনার কবরের পলেস্তারাও খসে খসে পড়ছে। বাংলাদেশের একজন সাধারণ মানুষ হিসাবে আমি বড়ই ব্যতিত, লজ্জিত। এক গভীর বেদনা, মমতা আর আহাজারি নিয়ে কবি সাইয়িদ আতীকুল্লাহ আপনার সম্পর্কে লিখেছিলেন- ‘কী অভিমানিনী সে আসে না কোনদিন শহীদ মিনারে- ‘শহীদ মিনার কী করুণ ডাকে সেই নভেরাকে কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার/ কিছুতে পায় না সাড়া, ডাকে বারবার।

আজ আমার এক বান্ধবীর সাথে কথা হচ্ছিল। কথা প্রসংগে জিগ্গাসা করলাম- নভেরাকে চিনিস। বললো- না সে কে? ফোনটা রেখে দিলাম, কথা বলতে পারলামনা। বুকটা ভেংগে গেলো। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি যে তাজা প্রাণ ঝরে গেলো ভাষার দাবীতে।

বাংলা মায়ের সেই বীরসেনানিদের আপনি এদেশের কোটি মানুষের হৃদয়ে প্রোথিত করে গেলেন শহীদ মিনারের মাধ্যমে । সেই শহীদ মিনারের প্রসুতি , ভাস্কর্যের নিপুন কারিগর- নভেরাকে আজ চিনেনা....অনেকেই। বড়ই রহস্যঘেরা আপনার জীবন। কেউ বলে আপনি চট্টগ্রামের মেয়ে, কেউ বলে সুন্দরবনের। জন্ম ১৯৩০,১৯৩৫ নাকি ১৯৩৯ সাল।

তাও সঠিক জানিনা। আন্তর্জালের পাতা চষে চষে সঠিক কোন জীবন বৃত্তান্তই পেলাম না আপনার। সব শুধু কেমন যেন ভাসা ভাসা। কেউ বলে আপনি ১৯৮৯ সালে মারা গেছেন, কেউ বলে ২০০৩ সালেই আপনি চির বিদায় নিয়েছেন। এতো নীরবে আপনার প্রস্থানের খবর কোনো সংবাদ পত্র জানাতে পারলোনা।

কেন, কেন,কেন এতো বড় একজন গুনী শিল্পীর কদর এ দেশে হলোনা??? বাবা, বড় পুলিশ কর্মকর্তা ছিলেন,,,,,১৪ বছর বয়সে বিয়ে দিয়ে চাইলেন-আপনাকে স্বাভাবিক সংসারে চার দেয়ালের ভিতর রেখে দিতে। কিন্তু আপনি যে সারা পৃথিবীর। যার জন্মই হয়েছে মুক্ত বিহগের মতো পৃথিবীর আকাশে ঘুরে বেড়াতে। তাই আপনি আর সংসারি হলেন না। আপনি যেন গাইলেন- মানুষ দেখুক এক ভাস্কর নারীর আলগা খোঁপার ফাঁস, মুখে তার নাই আহা গোধুলির নরম কোনো আভাস।

এক অতিন্দ্রীয় নিপুন শিল্পীর ভাস্করের মায়াবি হাত নিয়ে আপনি ভাস্কর শিল্পের ফেরি করে বেড়ালেন ইংল্যান্ড থেকে ফ্রান্স হয়ে গ্রীস। চষে বেড়ালেন- বার্মা, ভারত, পাকিস্তান, থাইল্যান্ড, লাউস, জাপান, হংকং, নেপাল ,মালেশিয়া ,ইন্দোনেশিয়া। পুরা ভারতীয় উপমহাদেশে ভাস্কর্য শিল্পী হিসাবে প্রথম হয়ে আপনি প্রেসিডেন্ট পদক পেলেন। মুম্বাই থেকে শিখলেন ক্লাসিক ভারতনট্যম নৃত্য। তারপর---চলে গেলেন পরবাসে।

আর পাথরের তৈরী ভাস্করের মতো আপনিও বধির হয়ে গেলেন। কেনো আপনার এতো দুঃখ। কেনো এ দেশের প্রতি এতো অভিমান !!! শুনেছি-- এ দেশ ছাড়লেও বড় বেশী গোপন ভালোবাসা ছিলো এ দেশের মাটির প্রতি। তাইতো জীবনের শেষদিন পর্যন্ত এ দেশের পাসপোর্টটি আকড়ে ধরেছিলেন। ফ্রান্সের নাগরিকত্ব ফিরে দিয়েছেন।

আবার, মহান একুশে পদকও আপনি চিনেবাদামের খোসার মতো তুচ্ছ করে ছুড়ে ফেলেছেন। তখনই সরকারের বুঝা উচিত ছিলো- আপনার অভিমান ভাঙানোর। পুরা ভারতবর্ষে ভাস্কর্য শিল্পের যে বিপ্লব আপনি ঘটিয়ে গেলেন-তাঁর মনে কেনো এতো হাহাকার.....কেন তার এতো অভিমান??? রশীদ আমিনের একটা মন্তব্য তুলে ধরছিঃ Breaking news-এর মতো breaking post !!! আমাদের দেশে যারা প্রকৃত গুণী শিল্পী তারা পর্দার অন্তরালে হারিয়ে যান । প্রকৃত গুণী শিল্পীদের একটা অহংবোধ থাকে, আমাদের মতো সমাজে এই সব শিল্পীর অহংবোধ প্রতিনিয়ত আঘাত প্রাপ্ত হয়। আমরা তো শুধু ভাগ্যক্রমে এক নভেরাকে বিস্মৃতির অতল থেকে খুঁজে পেয়েছি, কে জানে হয়তো আরো অনেক নভেরাই উলটে যাওয়া বইয়ের পাতার মতো হারিয়ে গেছে ইতিহাসের আঁধারে।

তাদের কীর্তির উপর জমে যাওয়া আবর্জনাগুলো যদি কোনো ঝড়ো বাতাসে উড়িয়ে নিয়ে যায়, তবে হয়তো বেরিয়ে আসতে পারে নতুন কোনো নভেরা, আমরা যেন সেই সময়েরই প্রতীক্ষায় থাকি। একসময় নাকি আপনি আর বাংলা ভাষাও বলতেন না। ফ্রান্সের বাংলা দূতাবাসের কর্মকর্তাদের ইংরেজীতে বলেছিলেন- আপনি বাংলা বুঝেন না। কত বড় বেদনা, কত বড় অভিমানে আপনি বলেছিলেন-বাংলা ভাষা বুঝেন না। যে ভাষার শহীদ মিনার সারা পৃথিবীতেই যার কোনো তুলনা নাই সেই মিনারের প্রসুতি আপনি আর আপনি বাংলা ভাষা বুঝবেন না, তাই কি হয়? জীর্ন শীর্ন শরীর নিয়ে দূতাবাসে প্রিয় জন্মভূমির পাসপোর্ট নবায়ন করতে এসেছিলেন।

সেই নাকি এ দেশের কোনো বাংগালির সাথে আপনার শেষ দেখা। তারপর আপনি চিরতরে হারিয়ে গেলেন। বড় ইচ্ছা হয়- একদিন আপনার কবরের পাশে গিয়ে ফুল নিয়ে গিয়ে দাঁড়াই। আর অশ্রু ভেজা কন্ঠে বলি- সালাম , বরকত, রফিক ,শফিক, জব্বারের রক্তে ভিজা মাটির আপনারই বাংলা মায়ের এক ছেলে আমি। আমার ফুল,অশ্রু, ভালোবাসা, শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।

আর আমাদের ক্ষমা করুন। জানিনা, পারবো কিনা। সামনেই ভাষা দিবস আসছে। শহীদ মিনার ফুলে ফুলে ফুললিত হবে। আর আপনার কবরে একটি ফুলের কুঁড়িও পরবেনা।

কান্না আসে , বড় কষ্ট হয় হে শহীদ মিনারের জননী। গুগলে অনেক ঘাটাঘাটি করে ফ্রেন্চ ভাষায় নভেরা আহমেদের খুবই সংক্ষিপ্ত একটি বৃত্তান্ত পাওয়া যায়, তাও আবার ১৯৭২ সাল পর্যন্ত। সেটাকে গুগল ইংরেজি ট্রান্সলেটে গিয়ে যা পাওয়া গেলো তা নিচে দিলাম- জন্ম -২৯ শে মার্চ, ১৯৩৯ সাল। সুন্দরবান, বাংলাদেশ। ১৯৫১ সালঃ লন্ডনে আগমন।

১৯৫২ সালঃ Jacob Epstein এর শিক্ষার্থী হিসাবে ভাস্কর্যে ডিগ্রী লাভ। ১৯৫৫-১৯৫৬ : Florence Academy of Fine Arts শিক্ষাগ্রহণ। ১৯৫৭ : তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে বর্তমান বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন। জাতীয় গ্রন্থাগার কর্তৃক আয়োজিত প্রথম একক ভাস্কর্য প্রদশণী। ১৯৫৭ সালঃ ২য় বারের মতো শহীদ মিনার নির্মাণের কাজ শুরু।

১৯৫৮ সাল: জান্তা আয়ুব খানের কর্তৃক সামরিক শাসন জারি। শহীদ মিনারের কাজ অসমাপ্ত। ১৯৫৯ সাল: বার্মায় গমন ১৯৬০ সালঃ এশিয়া ফাউন্ডেশানের সহযোগিতায়, জাতিসংঘের পৃষ্ঠপোষকতায় ৭৫ টি ভাস্কর্যের সবচেয়ে বড় প্রদর্শনি। ১৯৬১ সালঃ লাহোরে প্রথম প্রেসিডেন্ট পদক জয়লাভ। ১৯৬১ সালঃ মুম্বাই ভারত নট্যম নৃত্য শিক্ষার শুরু এবং সমাপ্তি।

১৯৬২ সালঃ ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ড, হংকং এ প্রদর্শনী। ১৯৬৩ সাল : প্যারিস আগমন। Caesar এবং Giacomett এর সাথে বন্ধুত্ব স্থাপন। ১৯৬৫ থেকে ১৯৭০ সাল ঃ জাপান, কম্বোডিয়া, লাউস, নেপাল, হংকং , মালেশিয়া, থাইল্যান্ডে ভ্রমণ এবং প্রদর্শনী। ১৯৭১ সাল ঃ ফ্রান্স প্রত্যাবর্তন ১৯৭২ সালঃ গ্রীস গমন এরপর আর কোনো খবর নাই।

নেট গেটে নভেরার কিছু ছবিঃ নভেরা সম্পর্কে ইংরেজি লিংকঃ Novera Ahmed নভেরা সম্পর্কে ফ্রেন্চ ভাষার লিংকঃ Nover Ahmed এ পর্যন্ত নভেরা সম্পর্কে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য এবং বিশদ আলোচিত লিংক: নভেরাকে যারা ভালোবাসেন তাদের জন্য চমৎকার এক লিংক। পাঠ করে তৃপ্তি পাবেন। Novera Ahmed নভেরা সম্পর্কিত আরো কিছু ছবিঃ অবহেলায় নভেরার ভাস্কর্য ফ্রান্সে যেখানে নভেরার স্টোর,, কোন নাম নাই নভেরার আরেকটি ভাস্কর্যঃ নভেরার জন্য সরকার, প্রত্নতাত্তিক দপ্তর, ফ্রান্স দূতাবাস যা করতে পারেঃ ১ নভেরার একটা পরিপূর্ণ জীবন লিপি তৈরী করা। ২ উইকিপিডিয়াতে সংযোজন করা- বাংলা এবং ইংরেজীতে ৩ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইয়ে নভেরার সম্পর্কে একটি পাঠ অন্তর্ভূক্ত করা। অনেক হাবিজাবিই তো বইয়ে পড়ানো হয়।

একটা কিছু বাদ দিয়ে অথবা না দিয়ে এটা করলে কোনো সমস্যা হবেনা। বিশ্ববিদ্যালয়ে পাশ করেও কেউ নভেরা সম্পর্কে জানবেনা, তা বড়ই দুঃখজনক। ৪ ফ্রান্সের যে জায়গায় নভেরা চিরনিদ্রায় শুয়ে আছেন- তা চিহ্নিত করে -প্রতি ভাষা দিবসে শ্রদ্ধা নিবেদন করা। দূতাবাসের কর্মকর্তাদের এ কাজটুকু করতে আশাকরি সম্মানের হানি হবেনা। ৫ নভেরার ভাস্কর্য গুলো সংরক্ষণ করা।

৬ জাতীয় যাদুঘরে নভেরার জন্য আলাদা গ্যালারি খুলা। সম্মানিত ব্লগের মডারেটর মহোদয়রা পোস্টটি স্টিকি করতে পারেন যাতে বেশী সংখ্যক পাঠকের নজরে আসে। ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।