দশম অধ্যায় - একের পর এক টেস্ট
শনিবার, এপ্রিল ৮
আমার মনে হয় বেশীরভাগ ক্রিকেটভক্তের কাছে বাংলাদেশ সম্পূর্ণ এক অচেনা দেশ। এই অর্থে যে, তারা হয়ত জানে, এটা টেস্ট পরিবারের নবীন সদস্য, যেখানে কিছু প্রতিভাবান ক্রিকেটার আছে, যারা মাঝেমধ্যে বড় দলগুলোর বিরুদ্ধে সাফল্য পায়, বিশেষতঃ গত জুনে তারা যখন কার্ডিফে আমাদের পরাজিত করেছিল - কিন্তু দেশটা কোথায়, বা কেমন জায়গা এটা - এসব হয়ত তারা অনেকেই জানে না । জোহান্সবার্গ থেকে ঢাকায় আসতে আমাদের দুবাইতে ট্রানজিট নিতে হয়েছিল এবং তারপর আমরা বিমানে করে পাড়ি জমিয়েছিলাম পূর্বদিকে । তারপর ভারত অতিক্রম করে, আমরা গিয়ে পৌছলাম পৃথিবীর অন্যতম ঘনবসতিপূর্ণ দেশটাতে (আমি আসলে উইকিপিডিয়াতে দেখেছিলামঃ বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৪২ মিলিয়ন, যা বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম, আর এতগুলো লোক থাকে ১৪৩,৯৯৮ বর্গকিলোমিটার জায়গায়, প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৯৮৫ জন করে; ভারতেরটা হচ্ছে - ১১০৩ মিলিয়ন লোক, ৩.৩ মিলিয়ন আয়তন, প্রতি বর্গকিমিতে ৩৩৬ জন; অস্ট্রেলিয়া - ২০ মিলিয়ন লোক, ৭.৭ বর্গকিমি আয়তন, ২.৬ জন প্রতি বর্গকিমিতে। সবচেয়ে ঘনবসতি দেশগুলোর লিস্টে বাংলাদেশের অবস্থান ১১তম; ঠিক মোনাকো, ম্যাকাও, হংকং, সিঙ্গাপুর, জিব্রাল্টার, ভ্যাটিকান সিটি, মাল্টা, বার্মুডা, মালদ্বীপ এবং বাহরাইনের পর, যাদের কারোরই আয়তন ১১০০ বর্গকিমির বেশী নয়।
২৩০ টি দেশের এই লিস্টে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার অবস্থান যথাক্রমে ৩১ ও ২২৪ তম)।
আমরা যখন ঢাকায় নামলাম, আমাদের অভ্যর্থনা হয়েছিল কম উম্মাদনাপূর্ণ পরিবেশে। যেমনটা হয়ে থাকে ভারতে, তেমনটা নয়। শত শত লোক আমাদের দেখতে বিমানবন্দরে যায়নি। তেমনিভাবে লোকজন আমাদের চট করে চিনতে পারেনি, তারপর হোটেলে ভিড় জমায়নি, অথবা রাস্তায় দলে দলে দাঁড়িয়ে থাকেনি।
কিন্তু তা সত্বেও শহরের সর্বত্র লোকে লোকারণ্য ছিল। এই সফরে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার উদ্বেগ ছিল। জানুয়ারীর শেষার্ধে সিএ থেকে চারজন প্রতিনিধি এসে ভেন্যু এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা তদন্ত করে ইতিবাচক রিপোর্ট দেয় এবং তারপরই এই সফর গ্রিন সিগনাল পায়। ধারনা করা হয় যে, এই জায়গাটা একটু ঝুঁকিপূর্ণ এবং মনে হয় অবসর সময়টা আমাদের হোটেলে বা এর আশেপাশের জায়গাতে কাটবে। চট্টগ্রামেও তাই, যেখানে আমরা দ্বীতিয় টেস্ট ও প্রথম ওয়ানডে খেলবো।
আমাদের অবস্থানকে যথাসম্ভব আরামদায়ক ও উপভোগ্য করার জন্য স্থানীয় ক্রিকেট প্রশাসন ও হোটেল কর্মীরা করণীয় সবকিছুই করলো। কিন্তু একটা ব্যাপারে তারা কিছুতেই আমাদের সাহায্য করতে পারলো না। প্রচন্ড ক্লান্তি, যা এখানে প্রথম আসার পর আমরা অনুভব করছিলাম; আর চরম পীড়াদায়ক শারীরিক অনুভূতি, বাসে করে ফতুল্লা, যেখানে প্রথম টেস্ট খেলা হবে, সেখানে যেতে আসতে অনুভূত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের নিয়মিত ভেন্যু বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে পুনঃনির্মান কাজ চলছে। তাই আমাদের খেলা নারায়ণগঞ্জের ওসমানি স্টেডিয়ামে স্থানান্তরিত হয়েছে, যেখানে মাত্র ১৬ দিন আগে স্বাগতিক দল কেনিয়াকে পরাজিত করেছিল।
মাঠটা সুন্দর, সুযোগ সুবিধা যথেষ্ট-এর চেয়েও বেশী। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ জায়গাটা হোটেল থেকে কমপক্ষে এক ঘন্টা ড্রাইভের দুরত্বে অবস্থিত। আমাদের যাত্রা নির্বিঘ্ন করতে সবরকম ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল। সারা রাস্তায় পুলিশ আমাদের সঙ্গে ছিল, পথ ক্লিয়ার করতে। কিন্তু প্রাকটিস শেষে এরকম গরম, গুমোট, লোকারণ্য শহরে ধীর, থেমে থেমে যাওয়া ভ্রমন করে আমরা যখন হোটেলে ফিরছি, তখন বিরক্তি আর উৎকণ্ঠার শেষ ছিলো না।
পরে হোটেলের ছাদের পুলে ঝাঁপিয়ে পড়ে শরীরকে রিকভার করার চেষ্টা করেছি।
টেস্ট চলাকালীন সময়ে প্রত্যেকদিন আমরা বাসে যাত্রাপথে সকালের নাশতা করবো। আমার জন্য এটা একেবারেই নতুন। আমাকে নিশ্চিত হতে হবে যে, আমার স্পেশাল ব্রেকফাস্ট বক্স হোটেলকর্মী প্যাকেট করে দিয়েছে এবং সেটা আমার সাথে যাচ্ছে। সকাল ১০টায় খেলা শুরু করার জন্য ৭টায় রওনা হতে হবে, এবং যাওয়ার আগে এসব নিয়েই ব্যস্ত থাকতে হবে।
আমাদের আসল লক্ষ্য ছিল, এই সফরে দক্ষিণ আফ্রিকায় খেলা ১৪ জনের টেস্ট স্কোয়াড অপরিবর্তিত রাখা। কিন্তু জাস্টিন ল্যাঙ্গার, মাইকেল ক্যাসপ্রোইচ আর শন টেইট বাদ পড়ে গেছে। তাদের জায়গায় ফিল জ্যাকস, মিশেল জনসন আর জেসন গিলেস্পি-কে নেয়া হয়েছে। আমার বিবেচনায় ঐ তিনজনের কেউই গুরুতরভাবে আহত নয়। কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ মতে, তারা কোনভাবেই প্রথম টেস্ট খেলার মতো সুস্থ নয়, এমনকি দ্বীতিয় টেস্ট খেলার সম্ভাবনাও কম।
সেই হিসেবে রিপ্লেসমেন্ট আনাটা যুক্তিযুক্ত। আমাদের সবচেয়ে বড় চিন্তা ছিল ল্যাঙ্গ-কে নিয়ে। আশা করা হচ্ছে, আগামী কয়েক সাপ্তাহের মধ্যে সে সুস্থ হয়ে যাবে। আমি পড়েছি যে, পার্থে বাড়িতে গিয়ে সে তার অনুভূতিকে তুলনা করেছে 'চরম শুণ্যতা'-র সাথে। অবশ্য পরে বলেছে, 'ভবিষ্যত নিয়ে কোন চিন্তা নেই, একেবারেই না।
জোহান্সবার্গের দ্বীতিয় ইনিংসের দূর্ঘটনাটা ছিল অপ্রত্যাশিত। শুধু চিন্তা ছিল স্বল্প সময়ের মধ্যে আবার আঘাত পাবো কিনা তা নিয়ে। ’
ল্যাঙ্গ আরও বলেছে যে, জোহান্সবার্গ টেস্টের শেষ দিনটা ছিলো তার টেস্ট ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা দিন। আপনি আশ্চর্য হবেন, মাঠে কোন অবদান না রাখতে পেরে, সে কেমন হতাশ হয়েছিল। সে আসলে একটা দারুন টিমম্যান।
প্রথম টেস্টের জন্য সেরা একাদশ নির্বাচনকালে আমরা আমাদের টিম সেটআপ, যেটা দক্ষিণ আফ্রিকায় দারুনভাবে কাজ করছিল, তা থেকে সরে এসেছিলাম। প্রথমত, আমরা চারজনের পরিবর্তে পাঁচজন বোলারকে খেলানোর সিদ্ধান্ত নেই, এই যুক্তিতে যে, শেন ওয়ার্ন, ব্রেটলি এবং স্টুয়ার্ট ক্লার্ক গত তিন সাপ্তাহে অত্যন্ত কঠোর পরিশ্রম করেছে। সুতরাং তারা অবশ্যই ভালো সাপোর্ট দিবে। উইকেট একটু শুষ্ক আর সমান হওয়ামাত্র স্টুয়ার্ট ম্যাকগিলকে আক্রমনে আনা হবে। সেইসাথে গিলেস্পিকে পঞ্চম বোলার হিসেবে ব্যবহার করা হবে, দুইটি কারণে, এক. তার অভিজ্ঞতা, দুই. তার বর্তমান ভালো ফর্মের জন্য।
২০০৫-০৬ 'পুরা কাপ'-এ ২১.২৮ গড়ে ৪০ উইকেট পাওয়া তার ভালো ফর্মকে নির্দেশ করে
তারপর নির্বাচকরা মাইকেল ক্লার্ককে মিডেল অর্ডারে ফিরিয়ে আনেন। সেই সাথে ফিল জ্যাকসকে অযথা ওপেনিংয়ে না রেখে মাইক হাসিকে দিয়ে ওপেনিংয়ের সিদ্ধান্ত নেন। দক্ষিণ আফ্রিকায় পাপ-এর (মাইকেল ক্লার্কের ডাকনাম - অনুবাদক) কাজ দেখে আমরা ইম্প্রেস্ড হয়েছি। সবচেয়ে দুর্ভাগা হলো সাইমো। কিন্তু যেখানে দলে পাঁচজন বোলার রয়েছে, সেখানে সে হয়তো বেশী একটা ওভার পাবে না।
সেইসাথে পাপকে সুযোগ দেয়া হয়েছে নিজিকে প্রলুব্ধকর হিসেবে প্রমাণ করতে।
টেস্টের পর যে তিনটি ওয়ানডে খেলা হবে, তার স্কোয়াড আমরা দক্ষিণ আফ্রিকাতে থাকতেই ঘোষণা করা হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে খেলা স্কোয়াড অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে, শুধু একটি পরিবর্তন ছাড়া, দক্ষিণ অস্ট্রেলিয়ার অফ স্পিনার ড্যান কালেন-কে নেয়া হয়েছে মাইক লুইসের পরিবর্তে। মাইকের জন্য এটা চিন্তার কিছু নয়। দুইটি কারণে আমরা তা করেছি, এক. এখানকার পরিবেশ সিমারের বদলে স্পিনারের জন্য বেশী উপযোগী, দুই. ড্যানের প্রতিভা আমরা পরখ করে দেখতে চাই।
সেই সাথে টেস্টে মিশেল জনসনকেও। মনে হচ্ছে এটা ভালো সুযোগ তা করে দেখার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।