বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু, বাংলার ফল, পুন্য হউক, পুন্য হউক, পুন্য হউক, হে ভগবান। বাংলার ঘর, বাংলার হাট, বাংলার বন, বাংলার মাঠ, পুর্ন হউক, পূর্ন হউক, পূর্ন হ্উক, হে ভগবান। রবীন্দ্রনাথ
আপনি কয়টি ভাষা জানেন?
দশম শতকের মুসলিম দার্শনিক আল ফারাবি সত্তরটি ভাষা জানতেন! যে কারণে আরবরা আল ফারাবি কে বলত: ‘হাকিম সিনা। ’ অর্থাৎ দ্বিতীয় আচার্য। প্রথম আচার্য কে? অ্যারিস্টটল।
ঐশীজ্ঞানের পরিবর্তে মানবীয় বুদ্ধিবিবেচনাকে অগ্রাধিকার দিয়েছিলেন বলেই মুসলিম রক্ষণশীলেরা আল ফারাবিকে বলত কাফের, যদিও আল ফারাবি ছিলেন মধ্যযুগের জ্ঞানের সুবিশাল বটবৃক্ষ সরূপ। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এমন প্রতিভাবান জ্ঞানী পরবর্তী যুগের ইসলামী পন্ডিতদের খ্যাতির আলোয় ম্লান হয়ে আছেন। ফারাবির লেখায় গ্রিক দর্শনের প্রভাব থাকলেও চিন্তার দিক থেকে অত্যন্ত মৌলিক।
আল ফারাবি । (৮৭৩-৯৫০ ) দার্শনিক, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও সংগীতজ্ঞ।
আল ফারাবির আসল নাম-আবু নসর আল ফারাবি। পরিবার প্রদত্ত নাম অবশ্যি মুহাম্মদ ইবনে মুহাম্মদ ইবনে তারখান ইবনে উজালাঘ আল ফারাবি। ইউরোপ অবশ্যি আল ফারাবি কে চেনে ‘আলফারাবিয়াস’ নামে। মোল্লাদের দেখানো পথে না হেঁটে ফারাবি স্বর্গলাভের বিকল্প পথ অনুসন্ধান করেছিলেন বলেই আল ফারাবির দর্শনের সঙ্গে আবহমান বাংলার ভাবের প্রচ্ছন্ন হলেও সম্পর্ক রয়েছে।
৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে ট্রান্সঅক্সিআনার ফারাব প্রদেশে একটি তুর্কি পরিবারে ফারাবির জন্ম ।
ফারাব প্রদেশটি ছিল এখনকার উজবেকস্তান। আল ফারাবির বাবা মুহাম্মদ ছিলেন ফারাব প্রদেশের ছোটখাট একটি কেল্লার সেনাপতি। তরুণ বয়েসে ইরানের খোরাসানে পড়াশোনা করেন ফারাবি; এরপর বাগদাদ যান।
ট্রান্সঅক্সিআনা
বাগদাদ ছিল সে আমলের অন্যতম জ্ঞানতীর্থ। বাগদাদে ফারাবির শিক্ষকরা ছিলেন গ্রিক দর্শনে পন্ডিত, তাদের সান্নিধ্যে ফারাবি খ্রিস্টীয় ভক্তিবাদ ও যুক্তিবাদী গ্রিকদর্শন সম্বন্ধে গভীর জ্ঞান অর্জন করেন।
ফারাবির এক শিক্ষক যোহন্না ইবনে হৈলান ছিলেন সিরিয় খ্রিস্টান । এ সব কারণে সংকীর্ণতা কাটিয়ে উঠতে পেরেছিলেন। তাছাড়া ফারাবির জন্মস্থান ট্রান্সঅক্সিআনা ইসলাম প্রচারের পূর্বে ছিল বৌদ্ধঅধ্যুষিত, বৌদ্ধ মঠগুলি তখনও টিকে ছিল; ফারাবির পরিবার ছিল সদ্য ধর্মান্তরিত মুসলিম। বিভিন্ন ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক ছিল ফারাবির। যে কারণে পরবর্তীকালে ফারাবির লেখায় সার্বজনীন এক ধর্মের কথা পাই।
তিনি বিশ্বাস করতেন বিশ্বের ধর্মসমূহ সেই সার্বজনীন ধর্মেরই রুপকার্থ প্রকাশ। এই রকম উদারতা দার্শনিক বলেই সম্ভবপর হয়েছে।
দশম শতকে প্রারম্ভে বাগদাদের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন হচ্ছিল। বাগদাদ থেকে সিরিয়ার আলেপ্পো যাওয়ার কথা ভাবলেন ফারাবি। আলেপ্পোর সামন্তপ্রভূ সাইফ আল দৌলা দর্শনের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন; তিনি ফারাবির পৃষ্ঠপোষক হতে সম্মত হন।
পড়াশোনা ও লেখালেখি চলছিল। ফারাবির অন্যতম কৃতিত্ব হল, গ্রিক দর্শনের সঙ্গে আরব বিশ্বের পরিচয় করিয়ে দেওয়া। অ্যারিস্টটল-এর রচনার টীকাভাষ্য লিখেছিলেন। অবশ্য সেই বইটা সহ ফারাবির আরও প্রায় ১০০ টি বইয়ের সন্ধান পাওয়া যায়নি। তবে সৌভাগ্যক্রমে কিছু গ্রন্থ মধ্যযুগে লাতিন অনুবাদে সংরক্ষিত আছে।
বিজ্ঞানের ক্যাটাগরি করেছিলেন ফারাবি। তিনিই প্রথম মুসলিম হিসেবে সমগ্র মানবীয় জ্ঞানের ইতিহাস রচনা করার উদ্যেগ নিয়েছিলেন।
‘কিতাব আল মুসিকা’ নামে সংগীত বিষয়ক গ্রন্থও লিখেছেন ফারাবি। বইটি যদিও পারস্যসংগীতের বিচারবিশ্লেষন- ‘কিতাব আল মুসিকা’ ইউরোপে আরব সংগীতের আলোচনা বলে পরিচিত। তাছাড়া আজ আমরা যে ‘মিউজিক থেরাপির’ কথা শুনি - ফারাবি সে বিষয়েও ভেবেছিলেন।
ইউরোপীয় নবজাগরণের পিছনে যে কটি মুসলিম মন সক্রিয় ছিল-ফারাবি ছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম।
ফারাবি বিশ্বাস করতেন যে, ঐশি প্রত্যাদেশের (Revelation) চেয়ে মানবীয় যৌক্তিকতাই শ্রেয়। আর এখানেই তিনি দার্শনিক এবং কাফের! ফারাবির মতে, বিশ্বজগতের সৃষ্টিকর্তা একজন প্রধানতম সত্তা বা সুপ্রিম বিয়িং-আর সৃষ্টি হচ্ছে এই সুপ্রিম বিয়িংয়ের বৌদ্ধিক কার্যক্রম, মানে বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রধানতম সত্তা সৃষ্টিকার্য পরিচালনা করেন। (আমাদের মধ্যে যারা যারা লালনদর্শন নিয়ে আগ্রহী তারা লক্ষ করুন) ফারাবি বলছেন, মানুষের অর্ন্তজগতেও এই বৌদ্ধিক দিকটি (আয়নামহল?) রয়েছে, যা অমর ও অবিনশ্বর। এই অর্ন্তলোকের উন্নতি সাধনই মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ।
দেখুন ফারাবির দর্শনে সুফিবাদের মূলতত্ত্ব কী ভাবে প্রতিফলিত হয়ে উঠছে । ইসলামের ইতিহাসের প্রথম শতকেই অর্থাৎ সপ্তম শতকেই সুফিবাদের উত্থানকাল হিসেবে অনেকে চিহ্নিত করে থাকেন। সোফি শব্দটি গ্রিক । সোফি বলতে গ্রিসের পরিব্রাজক দার্শনিকদের বোঝায়। অস্টম শতকে আরবি ভাষায় গ্রিক দর্শনের অনুবাদের সময় সোফি শব্দটি আরবি ভাষায় অর্ন্তভূক্ত হয় ।
তবে সুফি শব্দটি নবম শতকে প্রথম আরব বিশ্বে শোনা যায়। অমসৃণ উলের পোশাক কে আরবিতে বলে সুফু। যে মরমীবাদীরা সাদাসিদে উলের পোশাক পড়ে তারাই সুফি। সুফি বলতে আরবিতে বোঝায়- উলের মানুষ। তবে সুফি বলতে মূলত বোঝায়, যারা অর্ন্তজগতের উন্নতির জন্য নিরন্তর সাধনা করেন।
ফারাবি যেমন বলছেন, মানুষের অর্ন্তজগতেও এই বৌদ্ধিক দিকটি (আয়নামহল?) রয়েছে, যা অমর ও অবিনশ্বর। এই অর্ন্তলোকের উন্নতি সাধনই মানবজীবনের একমাত্র লক্ষ এবং ফারাবির দর্শন বহু বছর পরে ধ্বনিত হয়েছে বাংলার একটি মুর্শিদি গানে-
দয়াল বাবা কেবলাকাবা আয়নার কারিগর
আয়না বসায়ে দে মোর কলবের ভিতর।
লালনের মনের মানুষের সন্ধান আসলে ফারাবি-কথিত সেই অর্ন্তলোকেরই সন্ধান।
কি সন্ধানে যাই সেখানে আমি
মনের মানুষ যেখানে,
আঁধার ঘরে জ্বলছে বাতি
দিবারাত্রি নাই সেখানে ...(লালন)
আর এখানেই বাংলার বাউলধর্ম ও নব্যপ্লেটোবাদ (Neoplatonism) লীন হয়ে গেছে। আরেকবার স্মরণ করি।
ফারাবি সংগীতপ্রিয় ছিলেন ... যা হোক। কিন্তু, নব্যপ্লেটোবাদ কি? নব্যপ্লেটোবাদ হচ্ছে খিষ্টিয় তৃতীয় শতকের একটি দার্শনিক মতবাদ। যে মতবাদটির প্রবক্তা রোমান দার্শনিক প্লটিনাস (২০৫-৭০)। প্রাচ্যের মরমীবাদ ও প্লোটোর ভাববাদের মিশ্রনেই
গড়ে উঠেছিল নব্যপ্লেটোবাদ- যে দর্শনটির মূলতত্ত্ব হল: এক থেকে বহু প্রবাহিত। এই এক হল প্রধানতম সত্তা, আল্লাহ বা সাঁই।
বহু গঠিত আত্মা দ্বারা। স্বর্গীয় তাড়নায় আত্মা সেই এক-এর সঙ্গে পূর্নমিলিত হতে চায়।
মিলন হবে কত দিনে
আমার মনের মানুষেরও সনে? (লালন)
ফারাবি যাকে অবহিত করেছেন প্রধানতম সত্তা বা সুপ্রিম বিয়িং-বাংলার বাউলের কাছে তিনিই সাঁই নামে পরিচিত। নৌকা বাইতে বাইতে বাংলার মাঝির কন্ঠে ভাটিয়ালি গানে আজও ধ্বনিত হয় সেই সাঁইয়ের নাম -
দুঃখ-সুখের দুইটি ধারায় বইছে নদীর জল
সুখে বাইব তোমার ডিঙা করিয়া কোন্ ছল?
তাই তো বলি ওরে ও মন, এ যে কঠিন ঠাঁই
কোন খানে পাঠাইয়া দিল মওলা মালিক সাঁই রে ...
ফারাবির নির্বিকার নিরাসক্ত প্রধানতম সত্তা বা সুপ্রিম বিয়িং বাংলায় প্রেমময় রুপ নিয়েছেন। সম্প্রতি চন্দনা মজুমদারের গাওয়া একটি গানে পাই-
আমার বন্ধু দয়াময়,
তোমারে দেখিবার মনে লয় ...
(গানটির গীতিকার ও সুরকারের নাম এখনও জানতে পারিনি বলে আমি আন্তরিক দুঃখিত।
)
বাংলায় শ্রীচৈতন্যদেব প্রচারিত গৌড়িয় বৈষ্ণবধর্মটিতে নব্যপ্লেটোবাদী বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। সনাতন বৈদিক ধর্মের প্রধানতম দেবতা বিষ্ণু । দেবতার বিষ্ণুর ভজনাই বৈষ্ণবধর্ম। উত্তর ভারতের মথুরাবৃন্দাবনের একজন পরম পূজনীয় পুরুষ হলেন কৃষ্ণ বা শ্রীকৃষ্ণ। তিনি দীর্ঘকাল ধরেই দেবতা বিষ্ণুর অবতার বলে বৈদিক সমাজে শ্রদ্ধাভরে স্বীকৃত।
দীর্ঘকাল পর বাংলার ভক্তেরা নদীয়ার শ্রীচৈতন্যদেবকে কৃষ্ণর অবতার বলে সাব্যস্ত করে । শ্রীচৈতন্যদেবের চিন্তাভাবনা ও দর্শনই গৌড়িয় বৈষ্ণব ধর্ম নামে পরিচিত। একাদশ ও দ্বাদশ শতকে সেনদের শাসনামলেল দুশো বছর বাংলায় বৈষ্ণবধর্মটি ছিল স্টেট রিলিজিয়ন বা রাষ্ট্রীয় ধর্ম। রাষ্ট্রীয় ধর্ম হলে যা হয়-দুশো বছর ধরে বৌদ্ধদের ও অন্যান্য প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে পীড়ন করা হয়েছে।
শ্রীচৈতন্যদেব।
(১৪৮৬-১৫৩৩) প্রেমের শক্তিতে বৈষ্ণব ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম থেকে অন্তরের ধর্মতে রুপান্তরিত করেছেন। শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাবান একজন সংগীতজ্ঞ ও প্রখর প্রজ্ঞাসম্পন্ন কবি । উল্লেখ্য, শ্রীচৈতন্যদেব-এর পিতা জগন্নাথ মিশ্রর জন্মভূমি বাংলাদেশের সিলেট বলেই সিলেটকে পুণ্যভূমি বলা হয়ে থাকে; বিশিষ্ট সুফিসাধক হযরত শাহ জালালের পবিত্র স্মৃতির কারণেও সিলেট পূন্যভূমি হয়ে উঠেছে।
শ্রীচৈতন্যদেব ছিলেন ষোড়শ শতকের মানুষ। তিনি জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনের ধারনাটি লাভ করেছিলেন বাংলার সুফি-সাধকদের কাছ থেকে।
দীর্ঘকাল ধরে সুফি-সাধকগন বাংলায় ‘ইশক’ এর মাধ্যমে বান্দার আল্লায় লীন হয়ে যাওয়ার ধারনাটি প্রচার করছিলেন । সুফি-সাধকরা বলতেন,‘ হক্ এর সঙ্গে জীবের মিলনের একটিই পথ, তা হল প্রেম বা ইশক,’ (দ্র: রাহুল সাংকৃত্যায়ন, দর্শন দিক্দর্শন; পৃষ্ঠা ৫৫) ।
ফারাবির সঙ্গে সুফিবাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্কের ইঙ্গিত আগেই দিয়েছি। শ্রীচৈতন্যদেব জীবাত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলনতত্ত্বকে এক অভাবনীয় উচ্চ স্তরে নিয়ে গিয়ে উচ্চারণ করলেন, ‘আমার অন্তরে রাধা, বহিরঙ্গে কৃষ্ণ। ’
রাধা।
রাধা কল্পনাটি বাংলার। দ্বাদশ শতকের বাঙালি কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’ কাব্যে রাধা নামটি প্রথম উল্লেখিত হয়। এর পরপরই রাধার কনসেপশনটি ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়ে। কেননা, কবি হিসেবে জয়দেবের ছিলেন ভারতবর্ষজুড়ে অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় । এখনও দক্ষিণ ভারতের মানুষ বাংলা বলতে জয়দেবকেই বোঝে!
নদীয়ার শ্রীচৈতন্যদেবই সনাতন বৈষ্ণবধর্মের নব্যব্যাখ্যাকার।
যে ধর্মে রাধা হলেন জীবাত্মার প্রতীক এবং কৃষ্ণ হলেন সাঁই বা ফারাবির প্রধানতম সত্তা বা সুপ্রিম বিয়িং। শ্রীচৈতন্যদেব বাঙালি বলেই নব্যপ্লেটোবাদী নিরাসক্ত দর্শনটিকে আবেগময় রাধাকৃষ্ণের লীলায় ও গানে ভরিয়ে দিলেন। এখানেই বাংলার আত্মিক স্বাতন্ত্র। যে অপূর্ব অপার্থিব স্বর্গীয় প্রেম প্রকাশিত হল কীর্তন গানে। কীর্তন থেকেই বাংলা গানের যাত্রা শুরু।
যে গানের মর্মবাণীকে পরবর্তীকালে লালন ও রবীন্দ্রনাথ অনেক গভীরে নিয়ে গেছেন। রবীন্দ্রনাথ গেয়েছেন,
আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে
তাই হেরি তাই সকলখানে ...
লালন গেয়েছেন,
কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম-ভর মেলে না।
ভারতীয় উপমহাদের এইসব বিস্ময়কর ঘটনাবলীর সঙ্গে নব্যপ্লেটোবাদ সম্পর্ক ঐতিহাসিক ও ঘনিষ্ট। এবং ফারাবির দর্শন মূলত নব্যপ্লেটোবাদী দর্শন। এবং এই মহাত্মা লিখেছেন, অ-দার্শনিকদের কাছে ধর্ম রূপকের মাধ্যমে সত্যকে তুলে ধরে; ধর্মের শুদ্ধ সরূপটি অবোধগম্যই থেকে যায়; কেবল দার্শনিকগনই প্রধানতম সত্তার প্রকৃত সরুপটি উপলব্দি করতে পারে।
প্রধানতম সত্তা যেমন বৌদ্ধিক শক্তির সাহায্যে মহাবিশ্ব শাসন করেন, রাষ্ট্রও অনুরুপ দার্শনিকগনের দ্বারা শাসিত হওয়া উচিত এবং সেকারণেই রাষ্ট্রের নিরন্তর সংস্কারের ভিতর দিয়ে যেতে হয়। সে সংস্কার নিয়ে ফারাবি লিখেছেন: “আল মাদিনা আর ফাদিলা” (পূন্য নগর বা বিশুদ্ধ নগর ) । অবশ্যই সে লেখায় প্লেটোর প্রভাব লক্ষণীয় এবং সেটিই স্বাভাবিক। ফারাবি আক্ষেপ করে লিখেছেন, দার্শনিকরা রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন না। এ কারণেই কি অভিমানবশত বাগদাদ পরিত্যাগ করে নির্জন আলেপ্পোয় চলে গিয়েছিলেন?
নির্জনতাপ্রিয় ফারাবি বৌদ্ধভিক্ষুদের মতন অত্যন্ত সাদাসিদে জীবনযাপন করতেন।
পরিধান করতেন সুফি পোশাক । (আমরা রবীন্দ্রনাথের বাউল পোশাকটির কথা ভাবতে পারি) সহজেই অনুমান করা যায়, পার্থিব ধনসম্পদ না-থাকলেও ফারাবির আন্তরিক ঐশ্বর্য কোনও সম্রাটের চেয়ে কম ছিল না; প্লেটো-অ্যারিস্টটল পাঠ করে গভীর তৃপ্তি পেতেন, অবসর কাটাতেন উদ্যানে ফুলেদের শোভা দেখে ও পাখিদের কাকলী শুনে।
কে কথা কয় রে দেখা দেয় না
নড়েচড়ে হাতের কাছে খুঁজলে জনম-ভর মেলে না।
৯৫০ খ্রিস্টাব্দ। ফারবির বয়েস প্রায় ৮০ ।
কী কাজে সিরিয়ার রাজধানী দামাস্কাস পৌঁছলেন আল ফারবি। সে নগরেই দেহত্যাগ করেন। শোনা যায়, আলেপ্পোর সামন্ত সাইফ আল দৌলা তাঁর কবর সুফি পোশাকেই আচ্ছাদিত করে দিয়েছিলেন।
তারপর?
গ্রিক দার্শনিক প্লেটো ইসলামি বিশ্বে অত্যন্ত সমাদৃত ও শ্রদ্ধেয়। ইসলামি বিশ্বে প্লেটো ‘আফলাতুন’ নামে পরিচিত।
তা সত্ত্বেও মুসলিম দর্শনে গ্রিক প্রভাব মুসলিম রক্ষণশীলদের মর্মপীড়ার কারণ হয়ে উঠেছিল। যে কারণে একাদশ শতকে ইমাম আল গাজ্জালি দর্শনের ধ্বংস কামনা করে লিখলেন, ‘তাহাফাতুল ফালাসিফা। ’ এই শব্দ দুটির মানে দর্শনের ধ্বংস। সমকালীন দর্শন বিচারবিশ্লেষ করে গাজ্জালি বললেন, জ্ঞানের ভিত্তি ঐশি প্রত্যাদেশ । গ্রিক দর্শনের হাত থেকে ইসলাম বাঁচাতে গাজ্জালি আরও লিখলেন, সৌভাগ্যের পরশমনি বা ‘কিমিয়ায়ে সাদাত।
’ সে মহামূল্যবান বইয়ে বিশুদ্ধ করে ওজু করার ১৯ প্রকার নিয়ম পাবেন! অথচ, আল ফারাবির মতো স্বাধীন চিন্তার মুসলিম দার্শনিকদের লেখনিই সূত্রপাত করেছিল ইউরোপীয় নবজাগরনের । তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য আর ইউরোপ ষোড়শ শতাব্দী অবধি আর্থ-সামাজিক দিক দিয়ে সমমানের ছিল; এরপর ইউরোপীয় নবজাগরনের সূত্রপাত হল অথচ অটোমান সাম্রাজ্য তথা ইসলামি বিশ্বে বিরাজ করল মধ্যযুগীয় তমসা, চিন্তাচেতনার যে ঘোর অন্ধকার একুশ শতকেও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
বর্তমানের ইসলামি রক্ষণশীলদের কার্যকলাপে মনে হচ্ছে তাদের ফারাবি প্রদর্শিত স্বর্গলাভের বিকল্প সাংগীতিক পথে আস্থা নেই! যে কারণে রমনা বটমূলে বোমা হামলার কারণটি বোঝা যায়। প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে মঞ্চের ওপর লালন ও রবীন্দ্রনাথের পাশে বসে থাকেন মহাত্মা আল ফারাবি। তাঁকে হত্যা করাও তো জরুরি ...
(উৎসর্গ: শয়তান।
)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।